চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস,উনিশের বর্ধিতাংশ

0
413

#চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস,উনিশের বর্ধিতাংশ
#মম_সাহা

এয়ারপোর্টের বিচ্ছিরি শোরগোল। একটু পর পর ফ্লাইট ছাড়ার ঘোষণা। অবনী বেগমের চোখে টলমল অশ্রু। আমজাদ সওদাগর ক্ষণে ক্ষণে উৎকণ্ঠিত হচ্ছে। অধৈর্য কণ্ঠে বললো,
“কিন্তু কী বলবে তো? আর ঐ পুলিশ অফিসার কী মেজো ভাইসাহেব ছিলেন?”

তুমুল কান্নার বেগের মাঝেই হাসি এসে পরলো অবনী বেগমের। আহারে, তার আর্তনাদ ছুঁতে পারলো না কাউকে। বরং সন্দেহ পরিষ্কারের জন্য উন্মুখ মানুষ। বেশ বড়সড় এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে অবনী বেগম চোখ বন্ধ করলেন। অতঃপর বলা শুরু করলেন,
“তখন সময়টা বর্ষাকাল। হুট করে গ্রামে কেমন যেন একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলো। ছেলেমেয়ে নে*শায় আসক্ত হয়ে যাচ্ছিলো। চু*রি,মারামারি,হা*নাহা*নি তে গ্রাম উত্ত্যক্ত। আমার সাথেরই কত বন্ধু এই নে*শায় আসক্ত হয়ে যাচ্ছিলো। এক অরাজকতার সৃষ্টি হলো। এই নে*শা কে বা কারা প্রাচার করছে তা সন্ধান পাচ্ছিলো না কেউ। নতুন আরও পুলিশ অফিসারের আগমন ঘটলো।

আমিও ততক্ষণে বাড়ন্ত শরীরে বেশ বড়সড় হয়ে গেলাম। কোনো বিয়ের সম্বন্ধ আসতো না, কারণ সবাই জানতো আমার সাথে পুলিশ বাবুরই সম্পর্ক। হয়তো বেশ গভীর, শারীরিক আরকি। কিন্তু তেমন কিছুই ছিলো না। সে আমার হাত ধরে ছিলো দু একবার, এর বেশি কিছুই না। কিন্তু মানুষ তো বরাবরই বেশি ভাবতে পছন্দ করে।

বাবা তখন উনাকে বার বার চাপ দিতো। বিয়ে করার প্রস্তাব দিতো। উনি বলতো উনার শহরে গিয়ে পরিবারের সাথে কথা বলে প্রস্তাব নিয়ে আসবে। আমারও হুড়মুড় করে শরীর বাড়লো। কিশোরী থেকে নারীতে পরিবর্তন হচ্ছি। গ্রামের অবস্থা বেহাল থেকে বেহাল হওয়া শুরু করলো। রাস্তায় বের হওয়া বিপদ হয়ে গেলো। ঘরে সারাদিন পরে থাকতাম। দিন গুনতাম, সে বোধহয় আসবে। কিন্তু আশার আলো কেবল হতাশায় পরিণত হলো।

বর্ষার এক মাঝামাঝি সময়ে হুট করে সে একবারে উধাও হয়ে গেলো। তার বন্ধুর কাছে ছুটে গেলাম, খোঁজ দিতে পারলো না সে। আমি কেঁদে কেটে একাকার। গ্রামের মানুষ ততদিনে আমাকে কলঙ্কের কালি লেপে দিয়েছে। আমাকে নাকি নষ্ট করে সে মানুষ চলে গিয়েছে। বাবার অবস্থাও করুণ হতে লাগলো। আমার হাসিখুশী বাবাটা নিরব হয়ে গেলো, আমি কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে দেখতাম সে নিরবতা। কাকে জানাবো সেই কষ্টের কথা, তখন আমার কেউ ছিলো না। অতঃপর তার বন্ধু আমাদের ভরসা দেয় খুঁজে নিয়ে আসবে জানায়।

কত গুলো দিন পেরিয়ে গেলো হতাশায়, অতঃপর তার বন্ধু অনেক খোঁজখবর করে জানতে পারলো তার পরিবারের সবাইকে নাকি মে*রে ফেলা হয়েছে। পুলিশবাবু এরপর থেকেই নিরুদ্দেশ। আমার তখন হাউমাউ করে কান্না, লোকটা গেলো কোথায়। আল্লাহর দরজায় তিনবার করে মাথা ঠুকতাম যেন সে ফিরে আসে। অতঃপর বর্ষার শেষের দিকের এক দিনের কথা। আমি ভরদুপুরে ঘুমিয়ে ছিলাম। বাহিরে ঝরঝরে রোদ। গ্রামের এক ছেলে এসে খবর দিলো তার দেখা নাকি পাওয়া গেছে। আমার পুলিশ বাবু নাকি ফিরে আসছে। আমি সেই ভরদুপুরে এলোমেলো শরীর নিয়ে ছুটে গেলাম।

গ্রামের মাঠে তখন তুমুল ভীড়। থানার সবচেয়ে বড় অফিসারও নাকি এসেছে। কত বড় বড় মানুষ। কত অফিসার! আমি আমার পুলিশ বাবুর দিকে তাকাতেই থমকে গেলাম। শরীরে কালো পোশাক, চেহারা একবারে ভেঙে গেছে। চোখ গুলো কেমন ভেতরে চলে গেছে, মুখ ভর্তি চাপদাড়ি। মানুষটাকে মাঠের মাঝখানে একটা গাছে বেঁধে রেখেছে। পরে জানতে পারলাম মানুষটা নাকি দেশ*দ্রোহী, পরিবার মারা যাওয়ার শোকে সে এই কালো দুনিয়ায় চলে গিয়েছে। সৎ থেকে তো পরিবার হারাতে হয়েছিলো, অসৎ হয়েছে তাই। গ্রামের নে*শার প্রবেশও সে করিয়েছে। আমি মানতে পারি নি মানুষটার বিধ্বস্ততা। ছুটে যেতে চেয়েছিলাম তার কাছে কিন্তু আমাকে যেতে দেওয়া হয় নি। মৃত্যুর আগে নাকি সকলের শেষ ইচ্ছে পূরণ করা হয়, কিন্তু মানুষটা আমাকে একবার ছুুঁতে চেয়েছিলো, সে ইচ্ছেটাও ওরা পূরণ করতে দেই নি। আমি কত কাঁদলাম, হাউমাউ করে কাঁদলাম, আমার কান্না ওদের হৃদয় অব্দি পৌঁছায় নি। আমি ভিক্ষে চেয়েছিলাম মানুষটার প্রাণ। বলেছিলাম আমরা অনেক দূর চলে যাবো, এ পাপে আর ডুবতে দিবো না মানুষটাকে। ওরা শুনে নি। আমার এত যত্নের ভালোবাসা, আহা কি নিদারুণ তার বিধ্বস্ততা! মানুষটাও আমাকে একবার ধরতে চেয়েছিলো কিন্তু তার আগেই তার শরীরে পর পর ছয়টা গু*লি মেরে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। র*ক্তে লাল হয় আমার প্রিয় সোজনবাদীর মাঠ। যে মাঠে মানুষটার হাত ধরে ছুটে বেরিয়ে ছিলাম, সে মাঠে পরে থাকে নির্লিপ্ত ভাবে আমার পুলিশবাবু। যার সুুনামে একদিন গ্রাম মুখরিত ছিলো, তার লা*শ সেদিন দেশ*দ্রোহীর লা*শ হিসেবে গন্য হয়েছিলো। আর তাকে গু*লি করেছিলো কে জানো? তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু, তোমার ভাই নুরুল সওদাগর।

আমায় চোখ ভরে দেখতে দেই নি আমার পুলিশবাবুকে। ওরা পাষণ্ড! আমি হাউমাউ করে কেঁদেছি। কি ব্যাথা নিয়ে চিৎকার করেছি। মৃত্যুর পরও মানুষটা চোখ মেলে যেন অপলক চেয়ে ছিলো আমার দিকে। আমি শেষবার ছুঁতেও পারলাম। দেয় নি ছুঁতে আমায়। তোমার ভাই সেদিন বন্ধুত্ব ভুলে হয়তো কর্তব্য পালন করেছিলো কিন্তু আমি আজও ভুলি নি সেই ভয়াবহতা। আমার মানুষটার এ দশা আমি আজও ভুলি নি।

প্রকৃতি আমার এসবটা নিয়েও ক্ষান্ত হয় নি। যখন আমি গুটিয়ে গেলাম শূণ্যতায়, আমার বাবা আমার বিধ্বস্ত অবস্থা সহ্য করতে না পেরে বি*ষ খেয়ে সেই মাঠেই আত্মহত্যা করে মানুষটা মারা যাওয়ার তিনদিনের মাথায়। সেদিন সন্ধ্যায় তুমুল ঝড়, আব্বা আমার ঘরে নাহি ফিরে। চিন্তায় চিন্তায় আমি মরিয়া। আব্বা টা ছাড়া যে আমার কেউ ছিলো এই দুনিয়ায়। অবশেষে পরের দিন সকালে মানুষ খোঁজ দিলো আব্বা আমার স্বার্থপর হয়েছে। আমায় এই গোটা দুনিয়ায় একা রেখে চলে গেছে। আমার আব্বা বেইমানি করেছে, আব্বা আমার বিশ্বাসঘাতক। ওরা কেউ কথা রাখলো না। কেউ আমার রইলো না। ওরা শেষ করে দিয়েছিলো আমায়।

এই সবটা হারানো যন্ত্রণার রাগ গিয়ে পরেছিলো তোমার ভাইয়ের উপর। সেও তখন ট্রান্সফার হয়ে শহরে চলে এসেছিল। অতঃপর প্রতিহিংসার আগুনে দাউদাউ করে জ্বলে আমিও পা রাখলাম সওদাগর বাড়ি। এরপর আগুন আজ কেবল মায়া হয়ে রইলো।”

অবনী বেগমের চোখ অশ্রুর ঢেউ। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে সে কান্নার দাপটে। আমজাদ সওদাগরের চোখেও দেখা গেলো অশ্রু দের ভীড়। এতটা দুঃখ পুষে রেখে একজন মানুষ তার সাথে এত বছর ঘর করে গেলো, অথচ সে টেরই পেলো না! বরং মিছে ভ্রম নিয়ে করে ফেলেছে জীবনের চরম ভুল। এ ভুলের মাশুল আদৌও দেওয়া যাবে!

তন্মধ্যেই অবনী বেগমের প্লেন ছাড়ার সময় হলো৷ চোখের জল মুছে অবনী বেগম ব্যাগটা কাঁধে চরিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আমজাদ সওদাগর আমতাআমতা করে কেবল ডাক দিলো, “অবনী…”। পথিমধ্যে থামিয়ে দিলো অবনী বেগম। মুচকি হেসে বললো,
“তুমি হয়তো আজ যা বলতে চাও তা আমাকে দ্বিতীয় বারের মতন ভেঙে দিবে। প্রথম বার ভেঙে গিয়ে অনেক কষ্টে জোরা লেগেছি। দ্বিতীয় বার হয়তো আর পারবো না। তোমার আমাকে নিয়ে ভুল ধারণা ছিলো, আমিও ভাঙাতে চাই নি, ভেবেছিলাম একটা কলঙ্ক লাগুক তোমার ভাইয়ের গায়ে। আমি অভাগিনী তো চির কলঙ্কিনী ছিলামই। তাছাড়া তুমি যেভাবে ধোয়াশা আমিটাকে আঁকড়ে নিয়ে ভালোবেসে ছিলে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম ভালোবাসাও যে রঙ বদলাতে পারে। আজ তাই আফসোস করলাম। তুমিও নাহয় একটু আফসোস করো, আমাকে সব খুলে বলতে না পারার আফসোস। আমাকে অনেক ভালোবেসেও কিছুটা কম ভালোবেসেছো সেই আফসোস। কিছু আফসোস থেকে যাক, অবসাদ জাগবে। আমায় এতদিনে ভুলে গিয়ে খুশি ছিলে আজ থেকে নাহয় প্রতিক্ষণ মনে রাখলে। আমি আজ একটু স্বার্থপর হলাম। কি সুন্দর তোমার মনে আফসোস জাগালাম! ভালো থেকো কেমন?”

আমজাদ সওদাগর কেবল তাকিয়ে রইলো অবনী বেগমের যাওয়ার পানে। সত্যিই হয়তো সে অনেক ভালোবেসেও কোথাও একটা ভালোবাসতে পারি নি। সত্যি বলতে এক জীবনে হয়তো অনেকটা ভালোবাসা কাউকেই দেওয়া যায় না।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here