এল_এ_ডেইস পর্ব ১৮

0
292

#এল_এ_ডেইস
পর্ব ১৮
লেখনীঃ মাহীরা ফারহীন

চকচকে রুপালী লকারগুলো খোলা বন্ধ করার ঠাস ঠাস শব্দ হচ্ছে। স্কুলের লকারের সামনে যারপরনাই ভির। ক্লাস এখনো শুরু হতে বেশ কিছু সময় রয়েছে। ছেলে মেয়েরা হইচই করতে করতে লকার থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বের করছে বা রাখছে। ক্যারোল নিজের লকার থেকে একটা মাঝারি আকারের খাঁচা বের করছে। বা বলা যায় ছোট মতো একটা ঘর। সাবধানে সেটা বের করে এনে মেঝেতে রেখে লকারটা বন্ধ করতে ব্যস্ত হলো। রাবিত করিডোর ধরে লাফাতে লাফাতে যাচ্ছিল। ক্যারোলকে দেখে থেমে গেল। এবং ফট করে ওর খাঁচাটা হাতে তুলে নিল। ক্যারোল চমকে উঠে বলল,

‘এ্যই! ডোন্ট ইউ ডেয়ার টু মেস আপ উইথ মি!’

র‌্যবিট কিছুটা দূরে সরে গিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল, ‘কাম ডাউন, ফিল এ্যট ইজ। আমি তোমার খাঁচা নিয়ে উধাউ হয়ে যাচ্ছি না। শুধু দেখছিলাম।’

‘এখোনি রাখো বলছি।’ তীব্র স্বরে বলল ক্যারোল।

‘ওয়াও ব্রিটিশ সর্ট হেয়ার! কিন্তু নিজের বিড়াল কে এত ভালোবাসো যে স্কুলের সময়টুকুও আলাদা থাকতে পারলা না। ওরে ওরে।’ খাঁচার ভেতর উঁকি মেরে বলল
র‌্যবিট।

ক্যারোল বলল, ‘ওফ ওটা আমার বিড়াল নয়। আমি অন্য কাজে এনেছি ওকে।’

র‌্যবিট বলল,’স্কুলে আবার বিড়ালের কি কাজ? দেখো সাবধানে কিন্তু নাহলে তোমার বিড়ালকেও কেউ মাহীনের হ্যামস্টারের মতো উড়িয়ে দিবে।’ কথাটা বলেই র‌্যবিট ভ্রু উঁচু করে ক্যারোলের দিকে চাইল। উদ্ভাসিতমুখে বললো, ‘আরেহ ক্যারোট। তুমিই তো মাহীনের হ্যামস্টার খুনি। তাহলে তো তোমার থেকে সবার সাবধান থাকা উচিৎ। আমি কি পাগলের মতো তোমাকেই তোমার থেকেই সাবধান করছি।’ বলে মুখ টিপে হাসল র‌্যবিট।

ক্যারোলের ফ্র্যাকল ভরা গাল দুটোয় লালাভাব ফুটে উঠেছে। হয়তোবা পুনরায় মাহীনের হ্যামস্টারের মৃত্যুর কথা মনে পরায় অনুতপ্ত বোধ থেকেই এমনটা হলো। ক্যারোল র‌্যবিটের হাত থেকে খাঁচাটা সাবধানে ছিনিয়ে নিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল, ‘তোমাকে কেউ কখনো বলেনি যে, তুমি অতিরিক্ত ফালতু কথা বলো?’ বলে ছাত্র-ছাত্রীদের পাশ কাটিয়ে হাঁটতে শুরু করল।

র‌্যবিটও ওর সাথে সাথে হাঁটতে হাঁটতে বিচলিত হেসে বলল, ‘কেউ কেনো? সবাই বলে। এবং প্রতিদিনই বলে। তবুও আই এম হাউ আই এম ক্যারোট।’

ক্যারোল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ক্যারোল। দয়া করে ক্যারোট ক্যারোট করো না। ক্যারোট কোন ধরনের নাম? আজব! বলে চোখের মনি ঘোরাল ও।

র‌্যবিট টিপ্পনী কেটে বলল, ‘ইশ আমার নাম যদি র‌্যবিট হতে পারে তাহলে তেমার নাম ক্যারোট হতে পারে না?’

ক্যারোল হাঁটতে হাঁটতে থেমে গেল। অবাক দৃষ্টিতে চাইল র‌্যবিটের দিকে এবং বলল, ‘ওহ তো তুমিই র‌্যবিট! তাই তো আমাকে এসে কখন থেকে বিরক্ত করছ। আর আমাকে কি ক্যারোট নামটাই দেওয়া লাগত? এটা শুনেই কেমন যেনো র‌্যবিটের সঙ্গে কানেক্টেড মনে হয়।’
র‌্যবিট বিড়বিড় করে বলল, ‘এইজন্যেই তো এই নামটা তোমাকে দিয়েছি।’

ক্যারোল আবার হাঁটতে শুরু করে ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘কি বললা?’

র‌্যবিট বলল, ‘না বলছিলাম যে ক্যারোলের সাথে মিলিয়ে ক্যারোট নামটাই মাথায় আসে। এবং কোইন্সিডেন্টালি খরগোশ এবং গাজরের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।’

ওরা দুজনই সিঁড়ি বেয়ে মাত্র দুই তলায় এসে পৌঁছেছে। সিঁড়ি মুখোমুখি একটা কক্ষ থেকে মিসেস রে একজন হতভাগা ছাত্রীর ওপর ধমকের কামান চালাতে চালাতে নিয়ে যাচ্ছে। অনেকজনই উদ্বিগ্ন দৃষ্টি তাকিয়ে আছে সেদিকে। ক্যারোল সেসব দিকে নজর না দিয়ে দূরে করিডোরের অপর প্রান্তে চোখ রেখে উৎকন্ঠিত গলায় বলল,

‘আরেহ ওইতো ও। আমি আসছি বাই বাই।’

বলেই প্রায় ঝড়েরবেগে হাঁটতে লাগল ক্যারোল। র‌্যবিট তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো, খোলা করিডোরের অপর প্রান্তে মাহীন লিম জু ও জেনেটের সঙ্গে দাড়িয়ে আছে। র‌্যবিট ভাবল, আরেহ তো এই মতলব ক্যারোটের। ওখানে তো একটা ড্রামা হবে মনে হচ্ছে।
দ্রুত গতিতে হাঁটতে হাঁটতে উচ্চস্বরে বলল,

‘এই ক্যারোট বাই কাকে দিচ্ছো? আমি এখনো বিদায় নেইনি।’

ক্যারোল ছেলে মেয়েদের কে দ্রুত গতিতে পাশ কাটাচ্ছে। অনেকে এতবড় খাঁচা নিয়ে ছুটে যাওয়ার কারণে বেজায় বিরক্ত হচ্ছে। মাহীন দাড়িয়ে কথা বলছিল ফলে এখনো ও খেয়াল করেনি ক্যারোলের আগমন। লিম জু সামনের দিকে ইশারা করে বলল,

‘মাহীন দেখো তোমার ফেভারিট মানুষ ধেয়ে আসছে তোমার দিকে।’

মাহীন এবং জেনেট দুজনই ওর কথা মতো সামনের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। ক্যারোল তখন ওদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মুখে মিষ্টি একটা হাসি।

লিম জু ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘এবং সাথে আরেক আপদও আসছে দেখি।’

তখনই র‌্যবিটও ক্যারোলের পাশে এসে দাঁড়াল। ক্যারোল কিছু বলতে যাচ্ছিল তার পূর্বেই র‌্যবিট লিম জুকে উদ্দেশ্য করে উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,

‘আরেহ লিম জু! আর তুমি দেখি ব্র্যান্ড নিউ এক্সিডেন্ট করেছো! কবে কোথায় কিভাবে হলো?’ লিম জুর হাতের ছিলে যাওয়া স্থানটার দিকে দৃষ্টি রেখে বলল ও।

লিম জু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘আচ্ছা আমার এক্সিডেন্ট হতেই পারে। সেটা নিয়ে তুমি এত অবসেসড কেন?’

র‌্যবিট নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল, ‘ওয়েল দেখো…’

ক্যারোল ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘ওফ দয়া করে থামো। আমাকে আমার কাজ আগে করতে দাও তারপর তোমরা তোমাদের আর্গিউমেন্ট কান্টিনিউ করো।’

বলেই ওর হাতে থাকা খাঁচাটা মাহীনের সামনে তুলে ধরল। মাহীনের ভ্রু কুঁচকে গেল। মুখে আতঙ্ক ও বিস্ময় ছড়িয়ে। জিজ্ঞেস করল,

‘এটা আবার কোন নতুন আপদ?’

‘আহা এটা কোনো আপদ নয়। আমি জানি আমার জন্য যা হয়েছে আমি তার ক্ষতি পূরণ তো দিতে পারব না। কিন্তু তার বদলে তোমাকে একটা উপহার দিতে পারি। প্লিজ দয়া করে আমাকে ফিরিয়ে দিও না।’

মাহীন বলল,’সেইদিনই না তোমাকে মাফ করে দিলাম। আবার কি ঝামেলা শুরু করসো এগুলো?’

জেনেট পাশ থেকে বলল,’আরেহ মাহীন। একবার দেখি না ও কি আনসে আসলে।’

বলেই খাঁচার ছোট গেটটা খুললো। তারপর ভেতরে হাত দিতেই তীক্ষ্ণ “মিয়াউ” শব্দ হলো। এবং জেনেট লাফ দিয়ে উঠে হাত বাইরে বের করে নিলো। ওর ফরসা হাতে স্পষ্ট তিনটা খামচির দাগ বসেছে। জায়গাটা ক্রমেই লাল হয়ে উঠল। ক্ষীণ রক্তও বেরিয়ে এলো। ক্যারোল নড়ে উঠল। মাহীন তীব্র ভাবে বলল,

‘এইসব কি?’

ক্যারোল বলল, ‘আহা কিছু মনে করো না। আমার তোমার জন্য একটা ব্রিটিশ সর্ট হেয়ার ক্যাট এনেছি। যদিও আমি জানি না তোমার আদৌ বিড়াল পছন্দ কিনা।’

জেনেট কাঁদো কাঁদো মুখেও হাসি ফুটিয়ে বলল,
‘ওয়াও দ্যাটস গ্রেইট! মাহীন তোমার কিন্তু ওকে ফিরিয়ে দেওয়া উচিৎ না।’

সামনের করিডোর ধরে মিসেস হকিংস যাচ্ছেন ফলে সকল শিক্ষার্থীরা রাস্তা ছেড়ে দাঁড়াচ্ছে। কখন কাকে কিসের দায় শাস্তি দিয়ে বসেন তাঁর কোনো ঠিক নেই বলে কথা। মাহীন বিরক্ত কন্ঠে বলল,

‘এইসব কোন ধরনের পাগলামি! আমি তো সেইদিন তোমাকে মাফ করেই দিলাম। তোমার কোনো অমঙ্গল টমঙ্গল হবে না। আর তুমি কাকে জিজ্ঞেস করে আমার জন্য বিড়াল আনস? আমি বিড়াল চাইসি?’

র‌্যবিট বলল, ‘আরেহ ক্যারোট এত যত্ন করে তোমার জন্য বিড়াল আনল আর তুমি কি বিরক্তটাই না হচ্ছ। তুমি যদি সত্যিই ওকে মাফ করে থাকো তাহলে বিড়ালটা নিয়ে নাও।’

মাহীন কঠোরভাবে বলল, ‘ওফ র‌্যবিট চুপ থাকো। তুমি আরোও ওকে আস্কারা দিচ্ছ।’

ক্যারোল উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, ‘আরেহ র‌্যবিট সুপার বুদ্ধি দিয়েছো। হ্যা মাহীন প্লিজ তুমি আমাকে মাফ করে থাকলে তোমার এটা নিতেই হবে।’
মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল, ওফ কি ঝামেলায় পরলাম! এখন এই বিড়াল নিয়ে বাসায় গেলে মা বিড়াল শুদ্ধ আমাকে বাসা থেকে বের করে দিবে। আর ভাইয়া তো এমনিতেও বিড়াল দেখতে পারে না। ওফ কি বিপদ!’

লিম জু নরম কন্ঠে বলল,’নিয়ে নাও না মাহীন। এত রাগ করে আর কি হবে?’

মাহীন বলল, ‘আরেহ না আমি এখন ওর ওপর রাগ করে আছি তেমনটা নয়। কিন্তু আমার মা বিড়াল পালতে দেবেন না। এটাই সমস্যা।’

ক্যারোল বলল, ‘ওহ আচ্ছা এই সমস্যা। তাহলে তো আমার আর অমঙ্গলের ভয় নেই। তবে আমরা যদি বিড়ালটাকে তোমার মায়ের সামনেই তোমাকে উপহার দেই তাহলেই তো হয়েই গেল। আমি তাহলে বিড়ালটাকে নিয়ে কাল ছুটির পর তোমার বাসায় যাব।’

জেনেট বলল, ‘ওহ তাহলে তখন আমিও সাথে আসব। এইসব মিস করতে চাই না।’

লিম জু মিনমিন করে বলল, ‘ক্যারোট আমিও তোমার সাথে আসব।’

র‌্যবিট কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই মাহীন বলল, ‘হ্যা হ্যা র‌্যবিট তুমি আর বাদ যাবা কেন। ড্রামা দেখতে তোমাকেও আমন্ত্রণ রইল।’

র‌্যবিটের মুখে হসি ফুটে উঠলো। তবে বিড়বিড় করে বলল, ‘সবই তো বুঝলাম কিন্তু অমঙ্গলের ব্যাপারটা বুঝলাম না।’

মাহীনের মধ্যে মস্ত চিন্তা এবং অস্থিরতা জেঁকে বসেছে। হঠাৎ করেই কোন ঝামেলায় ফেঁসে গেল। মনে মনে ভাবল, ‘ইয়া আল্লাহ এখানে সবাই এত কনফিডেন্ট কেন? যেখানে বাংলাদেশে বন্ধুত্বের আট নয় বছর পার হয়ে যাওয়ার পর একে অপরের বাসায় যাওয়ার কথা মাথায় আসে যদিও সবার ক্ষেত্রে নয়। আর এখানে কিসের চেনাজানা আর কিসের পরিচয় সেগুলোর ধার দিয়ে যাওয়ার আগেই বাসায় আসার কথা চলে আসে।’
ক্যারোট উচ্ছ্বসিত চিত্তে খাঁচাটা নিয়েই অন্য দিকে চলে গেল। ওর সাথে সাথেই যেমন র‌্যবিট এসেছিল তেমনি ওর সাথে সাথে র‌্যবিটও চলে গেল।
.
.
.
.
কাঠের ফ্রেমের বড় জানালা দিয়ে কড়া রোদ ঠিকরে পরছে। কাঠের মেঝেতে রোদের রুপালী প্রতিফলন চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। মাথার ওপর একটা মাঝামাঝি আকারের ফ্যান দ্রুত গতিতে ঘুরছে। ছেলেমেয়েদের হইচইয়ের শব্দ এই পর্যন্ত কদাচিৎ পাওয়া যায়। মোটামুটি নিরিবিলিই থাকে জায়গাটা। শুধু লেখার খসখস শব্দ হচ্ছে। মিসেস রেয়ের ওক কাঠের ডেক্সে হেলান দিয়ে নির্বিকার চিত্তে দাড়িয়ে আছে রায়েদ। এক কানে ওয়ারলেস হেডফোন গুঁজে গান শুনছে এবং নখ খুটরাচ্ছে। এখানে ও মিডটার্ম পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন করতে এসেছিল। কয়েকদিন পূর্বেই মিডটার্ম পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। মিসেস রে ওর রেজিস্ট্রেশন ফর্মটা নিয়ে তার সামনে রাখা কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে চেয়ে মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা করছেন। ‘বানা এলেরিনি ভার’ গানটা শেষ হয়ে প্লে-লিস্টের আরেকটা গান ওয়াইল্ড ফ্লাওয়ার শুরু হলো। কারোও পদশব্দে রায়েদ বামদিকে দৃষ্টি ফেরাল। হয়তো কোনো ছাত্র ছাত্রী এদিকেই আসছে। কিছুক্ষণ পর মাহীন করিডোরের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসল। মাহীন খুব মনোযোগ দিয়ে নিজের ব্যাগের মধ্যে কিছু একটা খুঁজতে ব্যস্ত ছিল। তাই সামনে রায়েদের উপস্থিতি খেয়ালই করেনি। রায়েদ ওকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল। চোয়াল শক্ত হলো। নিজের ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে আনতেই মাহীনের মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। এবার সামনে চাইতেই দেখল রায়েদ ওর দিক থেকে পেছনে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথম দৃষ্টিতে ওকে দেখে থমকে দাঁড়াল। মুখের উজ্জীবিত ভাবটা দমকা হাওয়ার ঝাপটার মতো মিলিয়ে গেলো। আবার সেই নাম না জানা অদ্ভুত অনুভূতিটা মনে হানা দিয়ে বসল। অস্বস্তি ঘিরে ধরল ওকে। হৃদয়ও কোনো অজানা কারণে ধুকপুক শুরু করেছে। ওর মানস্পটে বিচলনের হাওয়া ঝাপটা দিচ্ছে। তবে স্বাভাবিক ভাবেই সামনে এগিয়ে গিয়ে ডেক্সের সামনে দাঁড়াল। মিসেস রে মাহীনকে দেখে বললেন,

‘তোমার প্যারেন্টসদের দিয়ে সিগনেচার করিয়েছো?’
মাহীন হাতে থাকা কাগজটা কাউন্টারে রেখে বলল,

‘জ্বি মিসেস রে। আপনি একবার দেখে নিন। আশা করি আমার রেজিস্ট্রেশন নিয়ে আর কোনো ঝামেলা নেই।’

মিসেস রে বললেন, ‘একটু অপেক্ষা করো।’

মাহীন এক দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। রায়েদের দিকে তাকাচ্ছে না। এবং মনে মনে আনন্দ বোধ করছে যে মুখের একপাশটা চুল দিয়ে ঢেকে থাকার কারণে হয়তোবা রায়েদের দিক থেকে ওকে দেখাই যাচ্ছে না। একই সাথে মাহীন চরম অস্বস্তির বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। সঙ্গে মনের ভেতর তিক্তরস বইছে। এতদিনে পাশে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে কখনো বিরক্ত হয়নি। আজ বিরক্তিবোধের সঙ্গে চাপা রাগও মিশে আছে। ভাবছে, আমার প্রস্তাব নাকচ করল ও। আমাকে অপমানও করল ও। অথচ একবার সরিটাও বলতে পারে না। আসলেই ওর একটু বেশিই অহংকার! আমার সাথে কী ওর কোনো সম্পর্কই নেই? এই কয়েকদিনে যে দেখা হলো। একসাথে কাজ করলাম সেসব কী ভুলে গিয়েছে ও। কোনো মানুষ এতটা অকৃতজ্ঞ কিভাবে হতে পারে?’ ভাবনা গুলো পরিষ্কার নীল আকাশে যেমন ধূয়া ধূয়া মেঘ ভেসে আসে তেমনি ওর ঝকঝকে মনের আঙ্গিনায় তীব্র চিনচিনে ব্যথার আবির্ভাব ঘটাচ্ছে। এ কেমন অস্থিরতা!’

রায়েদ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ওয়াইল্ড ফ্লাওয়ার গানটায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। গান যেন কানের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। এতে বিরক্তি বাড়ছে। এই মুহূর্তে পৃথিবীতে মাহীনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে বেশি বিরক্তিকর আর কিছু হতে পারে না। এটাই চলছে ও মাথায়। ভাবছে, ওফ সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। চারটা গান শেষ হয়ে গেল মিসেস রেয়ের এখনো কচ্ছপের গতিতে কাজ চলছে। আর আমার ভাগ্যটাই এত খারাপ নাকি আজকের দিনটাই খারাপ এই সময়ই মাহীনের আসা লাগতো? অবশ্য এখানে আমার কিছু করার নেই। আমার তো ওর সাথে কথা বলার কথাও না। কিন্তু ওই বা একদম নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে কেন? ওর কি আমার ওপর রাগ করে থাকার কথা? কিন্তু কি নিয়ে? ওর প্রস্তাবটা নাকচ করে দিয়েছি তাই? ওকি জানতো না আমার তেমনটাই করার কথা? ও আশাই বা করেছিল কি? নাহলে তো সেদিন ওদের না পাঠিয়ে নিজেই আসতে পারত। ও কী এতটাই অবুঝ! আমি শুধু ওর সাথে কথা বলি সেটাও সে বুঝতে না পেরে অন্যদের পাঠিয়ে আমাকে অপমান করল। ওর ফ্রেন্ডরা কী আমার ফ্রেন্ড!’ বড্ড রাগও হচ্ছে, মাহীন কী করেছে তা নিয়ে নয়। বরং একমাত্র মাহীনের সঙ্গে ও কিছুটা ফ্রি ছিল। স্বাভাবিক আচরণ করত। তারপরও সেটার দাম রাখতে পারল না মাহীন সেটা নিয়ে। এখন নিজে থেকে কথাও বলছে না। ফিরেও তাকাচ্ছে না। কিন্তু এখানে তো ওর রাগ করার কোনো কারণই থাকতে পারে না।
এ এক আচ্ছা জ্বালা। রাগ, হৃদয়ে চিনচিনে ব্যথা, অস্থিরতা সবকিছু মিলিয়ে সে এক বেসামাল অবস্থা।
রায়েদ মিসেস রেয়ের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘আপনার আর কতক্ষণ লাগবে মিসেস রে? সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি।’

মিসেস রে প্রতুত্তরে শুধু উপরে নিচে মাথা ঝাকালেন।
মাহীন চুলের আড়াল থেকে আড় চোখে চাইল এদিকে। রায়েদে হাতের থাকা মোবাইলে একটা ম্যাসেজ আসায় স্ক্রিনটা জ্বলে উঠল। সেখানে ‘অল আবাউট আস’ গানটা চলছে। আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল ও। তখনই বামদিকের করিডোর হতে পদশব্দ শোনা গেল। কাঠের মেঝেতে এবার কিছুটা জোড়ালো ভাবে শব্দটা হচ্ছে। ঠকঠক করে দেখা গেলো করিডোরের ওপাশ থেকে র‌্যবিট বেরিয়ে আসল। ও প্রায় লাফাতে লাফাতে আসছিল বলেই জোড়ে শব্দ হচ্ছিল। মাহীন ও রায়েদ উভয়কেই এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লাফানো বাদ দিয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসল। উৎফুল্ল কন্ঠে বললো, ‘আরেহ অবশেষে তোমাদের দুজনকেই এক জায়গায় পেলাম।’ র‌্যবিট এসে রায়েদের পাশে দাঁড়িয়ে ওর কাধে হাত রাখল। মাহীন শুধু একবার র‌্যবিটের দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। তারপর আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। রায়েদ জিজ্ঞেস করল,

‘তুই এখানে কেন?’

র‌্যবিট বলল, ‘আমি তো তোমাকেই খুজছিলাম। লাইব্রেরিতে পেলাম না তো একজন বলল, সে তোমাকে এখানে আসতে দেখেছে। এভাবেই এখানে আসা।’ বলেই মাহীনের দিকে দৃষ্টি ফেরাল বলল, ‘আর মাহীন তুমি এখানে যে?’

মাহীন ভাবলেশহীন মুখে ওর দিকে চেয়ে বলল,
‘পিকনিকের জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে এসেছি।’

র‌্যবিট সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। তারপর আবার বলল,
‘আচ্ছা মাহীন তোমার বাড়ির ঠিকানা কি?’

মাহীনের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। র‌্যবিটের দিকে চেয়ে বলল,
‘আমার বাড়ির ঠিকানা দিয়ে কি করবা?’

‘ওই যে আজকের ছুটির পর তো আসার কথা।’

‘তোমার না ক্যারোটের সাথে আসার কথা?’

‘ওইটাই তো। ক্যারোটের কাছেও বা ঠিকানা কোথা থেকে আসবে? তাই এখোনি বলে দাও।’

রায়েদ এক রাশ বিরক্তি নিয়ে এক দৃষ্টিতে মিসেস রেয়ের কাউন্টারের দিকে তাকিয়ে আছে। মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘টুইন্টি ফোর নম্বর স্ট্রিট, হাউজ নম্বর সেভেন, মন্টানা এভেনিউ।’

র‌্যবিট ঈষৎ হেসে বললো, ‘অলরাইট।’

মাহীন জিজ্ঞেস করল, ‘মনে থাকবে তো?’

র‌্যবিট নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল, ‘মনে থাকবে মানে? আমি চারটা ভাষা বলতে পারি এবং পাঁচ নাম্বারটা শিখছি। ভাইও এতগুলো ভাষা পারে না।’

হঠাৎ কথার মাঝে রায়েদের নাম টেনে আনায় রায়েদ আরোও কিছুটা বিরক্ত হলো।

মাহীন চোখ সরু করে বলল, ‘দে ভেরদাদ?’

‘সি’।

তখনই মিসেস রে ওনার কম্পিউটার থেকে মুখ সরিয়ে বললেন, ‘রায়েদ তোমার মিডটার্মের রেজিস্ট্রেশন হয়ে গিয়েছে।’ বলে একটা কার্ড এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই নাও তোমার আইডি কার্ড।’

তারপর মাহীনের দিকে ফিরে বললেন, ‘এবং তোমার রেজিষ্ট্রেশনও কমপ্লিট। সবকিছু ঠিকঠাকই আছে।’

মাহীন এটা শোনা মাত্র চলে যাওয়ার জন্য এক কদম বাড়াতে যাচ্ছিল তখন র‌্যবিট বলল,

‘একমিনিট কি ব্যাপার তোমরা কেউ কারো সাথে কথাই বললা না? আরেহ প্রথম বার তোমাদের একই জায়গায় পেলাম অথচ কেউ কোনো কথাই বলছো না। আর ভাই তোমার কি হয়েছে? কয়দিন আগে তো ঠিকই ছিলা।হঠা…’

রায়েদ কঠিন স্বরে বলল, ‘রাবিত! কারো সাথে কথা বলা মানে বৃথা সময় নষ্ট। আমার অত সময় নেই।’ বলে দ্রুত গতিতে বাম দিকের করিডোর ধরে চলে গেল।

মাহীন মনে মনে ভাবল, ‘ধুর আমার আগে যাওয়ার কথা ছিল। এই র‌্যবিটের কল্যাণে রায়েদ আগে চলে গেল। আর ও কথাটা কাকে উদ্দেশ্য করে বলল আমাকে? আশ্চর্য আমি আবার কি করলাম? রাগ তো আমার ওর ওপর করে থাকার কথা। ও আমার ওপর কীসের রাগ দেখাচ্ছে? আমার সাথে কথা বলা মানে সময় নষ্ট ছিলো তাই না? তাহলে সেদিন ছাদে আমাকে শান্তনা দিতে এসেছিল কেন? ওইটাও তো সময় নষ্টই ছিল।’ ভাবতে ভাবতে গটগট করে চলে গেল।

র‌্যবিট অসহায় মুখভঙ্গি করে ভাবল,’এইসব কি হলো? এর মধ্যে আমার কি দোষ ছিলো? আমাকে ধমক দিয়ে গেল কেন?’ ভেবে মিসেস রেয়ের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল, ‘মিসেস রে, ওদের কি হয়েছে টা কি? এতক্ষণে কি ওরা একবারও কথা বলেনি?’

মিসেস রে কম্পিউটারের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই বললেন, ‘না একবারও তো কেউ কারো সাথে কথা বললো না। কোনো ঝামেলা হয়েছে বোধহয়।’

র‌্যবিট ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘ভাই যা বাঁকা মানুষ। নিশ্চয়ই ওই কোনো ঝামেলা করেছে।’

মিসেস রে বললেন, ‘এবং যাই হয়েছে সেটা মনে হয় না কেউ ঠিক করতে পারবে। রায়েদ তো মুখ খোলার মতো মানুষই না। আর ওই মাহীন সেদিন যেভাবে বলে গেল যে ও আর নিজে থেকে কিছু করতে রাজি না। বুঝাই যায় ও যথেষ্ট জেদি।’

র‌্যবিট সায় জানিয়ে মাথা নেড়ে ভাবল, ‘ওফ আমাকেই এখন ব্যাপারটা দেখতে হবে। কারণ আমিই একমাত্র ভাইয়ের কাছের মানুষ। সমস্যা ঠিক করার জন্য ভাইকে বুঝে এমন মানুষ প্রয়োজন।’ ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো রাবিত। মন ভার নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেল।

ইনশাআল্লাহ চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here