এল_এ_ডেইস পর্ব ১৭

0
225

#এল_এ_ডেইস
পর্ব ১৭
লেখনী-মাহীরা ফারহী

সাই সাই করে তীব্র বাতাসের বিপরীতে ছুটে চলেছে নীল ক্যাডিলাক। হাইওয়ের দুইপাশে সারি সারি পাইন গাছ গুলো দ্রুত গতিতে পেছনে সরে যাচ্ছে। ইওসেমিতে পৌছতে আর অল্প কিছু সময় বাকি। মাহীন চুপচাপ ব্যাকসিটে বসে ওয়ারলেস হেডফোন কানে গুজে জন ডেনভারের কান্ট্রি রোড গানটা শুনছে। পাশে নাইম নিজের মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে গভীর মনোযোগে চেয়ে আছে। মিস্টার মোর্শেদ ড্রাইভ করছেন এবং মিসেস নাসরিন পাশের সিটে বসে আছেন। বাইরে থেকে কি যেন একটা উড়ে এসে হঠাৎ নাইমের নাকের ওপর পরল। নাইম চমকে উঠে মৃদু চিৎকার দিতেই পাশে থাকা মাহীনও ভড়কে গেল। সামনে থাকা মি.মোর্শেদ জিজ্ঞেস করলেন,

‘কি হলো নাইম কোনো সমস্যা?’

নাইম উত্তেজিত কন্ঠে বলল, ‘ইয়া আল্লাহ আমার মুখে পোকা বসেছিল। ওটা আশেপাশেই কোথাও রয়েছে।’

মিসেস নাসরিন বললেন,’কিসের পোকা। ওখানে কিছুই নোই।’
মাহীন বিরক্ত দৃষ্টিতে ভাইয়ের পানে চাইল। খেয়াল করল নাইমের টি-শার্টের কলারে একটা শুকনো পাতা আটকে আছে। মাহীন হাত বাড়িয়ে পাতা খুলে নিতেই নাইম পুনরায় উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

‘খাইছে! তুই পোকাটাকে হাতে ধরলি!’

মাহীন মড়া পাতাটা সামনে ধরে বলল,’গাধা এটা একটা শুকনো পাতা। পোকা না। আগে দেখবি তো কি হইসে তারপর প্যা প্যা করবি।’

নাইম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। বলল, ‘আমি কিভাবে জানবো ওটা মড়া পাতা।’

মি.মোর্শেদ মুচকি হাসলেন। কিছুক্ষণ পর ওদের গাড়ি রাস্তার পাশে সারি সারি স্থির দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল। একটা সময় সাউথ এনট্রেন্সে এসে থামল ওরা। ইউসেমিতে পার্কে প্রবেশ করার মোট ৫ টি গেট রয়েছে। বিগ ওক ফ্ল্যাট ও এরচ রক গেট দুটোয় বেশ জাম থাকে। তবে সাউথ এনট্রেন্সে তুলনামূলক কম ভিড় থাকে। তারপরেও প্রায় সাত আট মিনিট খরচ হয়েছে শুধু রাস্তার পাশে সারি সারি রাখা গাড়িগুলোকে পাশ কাটাতে। এল এ থেকে আসলে সাউথ এনট্রেন্সকেই বেছে নেয় মানুষ। গাড়ি থামতেই নাইম ও মাহীন এবং মিসেস নাসরিন নেমে গেলেন গাড়ি থেকে। মি.মোর্শেদ গাড়িটা পার্ক করে তারপর আসলেন। ওরা যেখানে থেমেছে সেখান থেকে রাস্তা সামনে লম্বা লম্বা গাছগুলোর মাঝ দিয়ে চলে গিয়েছে। সামনে ওয়াওনা হোটেলের বড় গেটটা হা করে খোলা। গাড়ি পার্ক করার স্থান বাইরে। হোটেলের সামনে রাস্তার মাঝে টেলিফোন বুথের সমান দুটো কাঠের বুথে রোড পুলিশ রয়েছে যারা প্রতিটা গাড়ি চেক করছে। হোটেলের গেটে বড় মাপের আমেরিকার লাল,সাদা ও নীল রঙের পতাকা পৎ পৎ করে উড়ছে।ওরা গেট পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। সামনে একটা বড় ফোয়ারা। তার থেকে বারো তেরো গজ দূরে দুই তলা সাদা খোলা বারান্দা বিশিষ্ট কাঠের তৈরি হোটেল। নীলচে ধূসর রঙের ডাচ ছাদ। হোটেলটা উনিশ শতকের নকশায় তৈরি। এখনো সবকিছুই সেরকমই থেকে গিয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে নাইম মাহীনকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘আরেহ জানিস এই হোটেলটায় অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা আছে।’

মাহীন আগ্রহ ভরা কন্ঠে বলল, ‘ভৌতিক ঘটনা?’

নাইম ঠোঁট বাকিয়ে বলল,’আমি ঐতিহাসিক বলেছি।’

‘কি হয়েছিল?’

‘প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট জন মুইরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ১৯০৩ সালে এই হোটেল থেকে তিন দিনের জন্য ঘুরে গিয়েছেন।

‘ওয়াও হোয়াট আ হিস্টোরিক্যাল প্লেস! বাই দ্যা ওয়ে তুই এতকিছু কখন গবেষণা করলি?’

‘কখন আবার? যখন তুই যেখানে সেখানে টো টো করে বেড়াস তখন আমি এসব করি। তুই জানবি কি করে? তোর তো সময়ই নাই আমি কি করি না করি দেখার।’ কিছুটা অভিমানী কন্ঠে বলল নাইম।

‘কোই কালকেই না কত কী খুলে বললাম তোকে।’ প্রতিবাদ করল মাহীন।

‘আমি অন্য সময়ের কথা বলছি।’

ওরা হোটেলের সামনের খোলা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। খোলা বারান্দায় পাশাপাশি এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত চেয়ার টেবিল, সোফা সবই আছে। মাঝের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে সামনে কাউন্টার। সেখানেই আবার দুইপাশে বড় বড় সোফা রাখা। মি.মোর্শেদ কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। সাথে সাথে নাইমও এগিয়ে গেল। রিসেপশনিষ্টের সঙ্গে কথা বলছে ওরা। এদিকে মিসেস নাসরিন ও মাহীন সোফার নিকট দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষণকাল পর মি.মোর্শেদ দুটো চাবি হাতে ফিরে এলেন। ওদের রুম প্রায় চৌদ্দ পনেরো দিন আগে থেকে বুক করা হয়েছিল। দুই তলায় যেতে হবে। সেখানকার কেয়ারটেকার রা ওদের ব্যাগ কামরায় পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিলেন। সকলে ওপরে উঠে গেল। আশপাশটা মোটামুটি অতিথিদের উপস্থিতিতে কলরব মুখর। মিসেস নাসরিন ও মি.মোর্শেদের আলাদা কামরা এবং তার পাশের কামরাটাই দুই ভাই বোনের জন্য। মাহীন কামরায় প্রবেশ করে দুটো সিঙ্গেল বেডের একটিতে ধপ করে বসে পরল। কামরায় সবকিছুই উনিশ শতকের পুরনো আসবাবপত্র। এখানে সেই পুরোনো আমলের কনক্রিটের ম্যানুয়েল ফারায়প্লেস রয়েছে। বাদামি সোফার রঙ মলিন হয়ে এসেছে। নাইম নিজের এবং মাহীনের স্যুটকেস দুটো সেন্টার টেবিলের পাশে রাখল। তারপর এ্যটাচ বাথরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে। সোফার পেছনে দুটো জানালা পাতলা সাদা পর্দায় মোড়া। মাহীন উঠে দাঁড়িয়ে কামরার ভিতরটা পরক্ষ করতে লাগল। এখানে একমাত্র কাঠের ক্লজেটটার পাশে একটা অনেক পুরনো রাস্ট রঙের রুম হিটার দেখা গেল। যদিও সেটা অকেজো, শুধু মাত্র ঐতিহাসিক আবহ বজায় রাখতে এসব জিনিস এখনো যত্নের সঙ্গে সাজিয়ে রাখা আছে। বিছানা দুটোর পেছনের লোহার রেলিঙগুলো সরু সরু। কিছুক্ষণ পর নাইম বেরিয়ে আসে বাথরুম থেকে। তারপর ব্যাগ থেকে কিছু একটা খুঁজে বের করতে ব্যস্ত হয়ে পরল। মাহীন নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল,

‘ভাইয়া জানিস তো, এখানকার সেই বিখ্যাত ঘটনা গুলো?’

নাইম ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করল, ‘আবার কোন ঘটনা? আমি তো বললামই ঐতিহাসিক ঘটনা গুলো।’

মাহীন নিগূঢ় গলায় বলল,’সেইসব ঘটনা যেগুলো মানুষ যুগযুগ ধরে চাপা দিয়ে এসেছে।’

নাইম এবার বিরক্ত ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ওফ এত প্যাচাল না পেরে সোজাসুজি বল কি বলছিস।’

‘সেই উনিশশো বিশ সালের ঘটনা। একজন পাইলট এখানে মৃত্যু বরণ করেছিল। মুরস কটেজে। এবং তারপর থে.. ‘

নাইম শব্দ করে হেসে উঠল। বলল, ‘এহ! আসছে আমাকে ভয় দেখানোর ফন্দি এটে। এতই ভূতুড়ে ঘটনা থাকলে আমি যখন রিসার্চ করলাম তখন পেতাম না।’

মাহীন শ্রাগ করে বলল, ‘তোর ইচ্ছা। বিশ্বাস করলে কর না করলে না কর।’ তারপর বাথরুমে চলে গেল ও।

শান্ত স্থির পর্দাগুলো হঠাৎ বাতাসের ঝাপটায় উড়তে লাগল। নাইম চমকে তাকায় সেদিকে। শুকনো ঢোঁক গিলে আয়াতুল কুরছি পড়া শুরু করল।
.
.
.
মস্ত দানবাকৃতির স্যকোয়েয়া গাছগুলো গম্ভীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে যেন। প্রতিটা গাছই একশ হতে দেড়শো ফিটের বেশি লম্বা। চওড়ায়ও চার পাঁচ গজের মতো হবে। দর্শনার্থীরা কেউ কেউ হেঁটে চলে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। কদাচিৎ গাছের আড়াল থেকে অচেনা পাখিরা ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে।
এক ডাল হতে আরেক ডালে লাফিয়ে চলে যাচ্ছে আদুরে কাঠবিড়ালিরা। কোনো গাছের গোড়ায় ফাঁক সৃষ্টি হয়ে মস্ত গুহায় পরিণত হয়েছে। মাহীন ও নাইম একটা গাছের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ পর আবার মিসেস নাসরিন ও মি.মোর্শেদের ছবি তুললো ওরা। তারপর এগিয়ে যেতে লাগল। জায়গাটার নাম ‘ম্যারিপোসা গ্রোভ’। এই জঙ্গলটা ইয়োসেমিতে ন্যাশনাল পার্কের অন্তর্গত। এখানে সবচাইতে উঁচু গাছের নাম ‘গ্রিজলি জায়েন্ট’। যা একইসাথে পৃথিবীর সবচাইতে উঁচু গাছগুলোর মধ্যে পঞ্চম। সেটাই ম্যারিপোসার মূল আকর্ষণ। সমতল ভূমি তাই চলতে অসুবিধে হয় না। মাহীনরা হোটেল থেকে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছে। এখন বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে রোদের তেজ। যদিও এই জঙ্গলে দানবাকৃতির গাছগুলোর ছায়ায় তেমন একটা রোদ গায়ে লাগে না। গাছগুলোর ফাঁকে ফাঁকে রোদের কিরণ ঝিলিক দিয়ে উঠছে। হাঁটতে হাঁটতে মি.মোর্শেদ মাহীনকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা শোন, তোদের স্কুল পিকনিক স্পটটা সদূর আরকানসাসে ফেললো কেন? এখানে করলেও তো পারতো। জায়গাটা তো বিশাল এবং ক্যাম্প করার জন্যেও ভালো।’

মাহীন একটা নুরি পাথর লাথি মেরে বলল,’আসলে গত দুই বছর নাকি টানা এখানেই পিকনিক ফেলেছিল। তাই এবার একটু দূরে দূরে স্পটগুলো ঠিক করেছে।’

মিসেস নাসরিন উদ্বিগ্ন গলায় বললেন,’কলোরাডোও বেছে নিতে পারতি। সেটা তূলনামূলক ভাবে ক্যালি থেকে কাছাকাছি আছে। কিন্তু তোরা নিয়েছিস সেই আরকানসাস। দেশের মাঝখানে।’

সামনে থেকে একটা মধ্য বয়স্ক লোক দুটো বড়সড় জার্মান শেফার্ড নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই দেখে ওরা মুহূর্তের জন্য থামল। লোকটা পার হয়ে যেতেই আবার হাটতে হাটতে মাহীন জবাবে বলল,

‘জানি মা। কিন্তু কলোরাডো বলো, আরকানসাস বলো আর ফিলাডেলফিয়াই বলো না কেন। সবই ক্যালিফোর্নিয়া থেকে দূরেই। শুধু পার্থক্যটা কম এবং বেশি দূরত্বের।’

মি.মোর্শেদ বললেন, ‘তবুও চিন্তা তো হয়। তুই ছোট মানুষ একা একা সেই আরেক শহরে যাবি। কোথায় কি বিপদে পরবি।’

‘আর তোকে জিজ্ঞেস করছে যে, তুই আরকানসাস কেন বেছে নিলি? দূরত্বের পরিমাপ কেউ জিজ্ঞেস করেনি।’ এতক্ষণে নাইম কিছু বলল।

মাহীন চোখের মণি ঘুরিয়ে বলল, ‘উম..কারণ পিনাকেল মাউন্টেইন অনেক সুন্দর! এবং ওইখানে মাছ ধরার ব্যাবস্থা আছে। এবং সবচাইতে আকর্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে ওখানে কাছেই একটা বড় পরিত্যক্ত দূর্গ আছে। আমার এসব অনেক ভালো লাগে। এবং সবচাইতে বড় কথা আমার বন্ধুরা সবাই ওখানেই যাচ্ছে। তাহলে অন্য জায়গায় গিয়ে কী আমার একা একা ভালো লাগবে?’

নাইম টিপ্পনী কেটে বলল, ‘হ্যা তা ঠিক আছে। তাই বলে আবার মাছ ধরতে গিয়ে পানিতে ডুবে যাইস না। পাহাড়ে উঠতে গিয়ে পরে যাইস না। আর সবচাইতে বড় কথা দূর্গ এক্সপ্লোর করতে গিয়ে আবার হারিয়ে যাইস না যেন। ‘

ওরা একটা কাঠের ব্রিজ পার হচ্ছে। এর নিচ দিয়ে চলে গেছে এক নজর কারা ক্রিক। ইচ্ছে করে সারাদিন ক্রিকের পাশে গাছে হেলান দিয়ে বসে পানি বয়ে যাওয়ার কলকল ধ্বনি শুনতে। এখানে ক্রিকের আশেপাশে আবার ভালো ভাবেই রোদের আলোর হাতছানি। ক্রিকের স্বচ্ছ পানি রোদের কিরণে রুপোর মতো চিকচিক করে উঠে। মিসেস নাসরিন বললেন বললেন,
‘নাইম! সবসময় এমন নেগেটিভ কথাবার্তা বলিস কেন?’
নাইম আর কিছু বলল না কিন্তু মুখ বাঁকা করে রইল।
কিছুক্ষণ পর ওরা সকলে গ্রিজলি জায়েন্টের সামনে আসল। এই গাছটা লম্বায় ২০৯ ফিট লম্বা। ফলে এর গোড়ায় দাঁড়িয়ে এর অগ্রভাগ দৃষ্টিগোচর হয় না। গোড়াটা বিশাল গুহার মত। ওপরের দিকে দৃষ্টিপাত করে পুরো ঘার বাঁকালেও গাছের আগাটা আর চোখে ধরা দেয় না। মাহীনরা এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াল। ছবি তুললো। এক কৃষ্ণকায় বাচ্চা গাছের গোড়ার গুহার মধ্যে দিয়ে দৌড়ে আসতে গিয়ে বারি খেয়ে পরে গেল। তাঁর মা বাবা ছুটে গেলেন সেদিকে। সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করার পর ঠিক হল আরেকটু সামনে গিয়ে বিরতি নিবে। মিসেস নাসরিন ও মি.মোর্শেদ নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পরেছে বলে ওরা ধীরে ধীরে হাঁটছে।

ওরা বন পেরিয়ে খোলা মাঠে এসে পরেছে কিছুক্ষণ পূর্বে। খোলা মাঠেরই ছাউনিতে টেবিল চেয়ার রাখা আছে বিশ্রামের জন্য। মি.মোর্শেদ ও মিসেস নাসরিন একটা কাঠের টেবিলে ছাউনির নিচে বসে আছেন। আর মাহীন ও নাইম কিছুটা দূরে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছে। মাথার ওপর নীল আকাশের বুকে এসে ভিরেছে বড় বড় পেলব সাদা মেঘের ভেলা। সমতল মাঠ পেরিয়ে সামনের বনে কোনো স্যকোয়া গাছ নেই। রয়েছে বড় বড় সিডার এবং ওক গাছ। আবার রয়েছে বিভিন্নরকম মস্ত ফুলের গাছ। এর মধ্যে ক্যাবঅ্যাপল এবং চেরিব্লসোমের গাছগুলো চিনতে পারলো মাহীন। বাকিগুলো অচেনা ঠেকল।
.
.
.
বাতাসের ঝাপটায় সাদা পর্দাগুলো ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘের মতো উড়ছে। নিয়ন আলো ভরা কামরা। চারিপাশের পিনপতন নীরবতার মাঝে বাইরে তীব্র ঝিঁঝি পোকাদের সোরগোল। মাঝে মাঝে কাঠের মেঝেতে খুটখাট শব্দ হয়। হঠাৎ পুরনো ফায়ারপ্লেসের ওপর রাখা একটা প্লাস্টিকের প্রায় খালি হয়ে আসা বোতল তীক্ষ্ণ শব্দ করে কাঠের মেঝেতে পরল। এবং সাথে সাথে নাইমের নিদ্রা ভঙ্গ হল। সে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। কিছুটা ঘেমে উঠেছে শরীর যদিও তাপমাত্রা পনেরোর কোঠায়। জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে এদিক ওদিক চাইল। অন্ধকারে চোখ সয়ে আসতেই দেখলো মেঝেতে একটা প্লাস্টিকের বোতল পরে আছে। নাইম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে ভাবল, ‘এই বোতল নিচে কিভাবে পরল? বাতাসে? কিন্তু এটা তো জানালার কাছ থেকে অনেক দূরে ছিল। মাহীন কিছু করেছে?’ ভাবতে ভাবতে পার্শ্বের বিছানায় নিদ্রারত মাহীনের দিকে চাইল। আবার ভাবতে লাগল,’নাহ মাহীন তো ঘুমিয়ে আছে। মনে হয় না ও কিছু করেছে। আর মরার কপাল এই সময় আবার মাহীনের শোনানো সেই ভূতের থিওরিটা কেন মাথায় আসছে? লা হাওলা ওলাকুওয়াতা ইল্লাবিল্লাহিল আলিউল আজিম।’ পরে নিচু গলায় মাহীনকে ডাক দিলো। কিন্তু মাহীনের কোনো সাড়াশব্দ নেই। নাইম মাঝের বেড টেবিলে রাখা মাহীনের ছোট একটা কাঁকড়া ব্যান্ড নিয়ে ওর দিকে ছুড়ে মারল। ওটা গায়ে লাগতেই মাহীন লাফ দিয়ে উঠল। এবং উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

“আ আ আ! তেলাপোকা! ভাইয়া তেলাপোকা!’

নাইম বলল, ‘চুপ! ওটা তোর মাথার ক্লিপ ছিলো। কোনো তেলাপোকা না।’

মাহীন সেটা হাতে নিয়ে দেখল আসলেই ওর চুলের কাঁকড়া ব্যান্ড। এতক্ষণে শান্ত হয়ে অলস ভঙ্গিতে বসে চোখ ডলছে সে। বিরক্ত কন্ঠে বলল,

‘তোর সমস্যা কি? কাল সকাল সকাল উঠতে হবে জানিস না? এই রাত দুপুরে ফাজলামো শুরু করেছিস কেন?’

নাইম বলল,’আমি কোনো ফাজলামো করছি না। আগে তুই বল তুই পানির বোতলের সাথে কি করেছিস? ওটা পরল কেন?’

মাহীন কিছুক্ষণ এমন ভাবে নাইমের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল যেন এর চাইতে আশ্চর্যজনক কথা ও এর আগে কখনো শোনেনি। তারপর বলল,

‘আজ তুই ছাগল বলে তোর এতটুকু আক্কেল নাই যে ওটা বাতাসে পরে যেতে পারে?’

নাইম ধমক দিয়ে বলল, ‘বাজে কথা বলবি না। ফায়ারপ্লেস কোথায় আর জানালা কোথায় দেখতো। ওই পর্যন্ত বাতাস গিয়ে হাফ পানি থাকা বোতলটা ফেলে দিলো? তুই তো কচু পাতার মতো কথা বলছিস।’

মাহীন ঠোঁট বাঁকা করে বলল, ‘তাহলে তুই এখন রাত তিনটার সময় বোতল পরে যাওয়ার কারণ বের করতে বায়ুচাপ নিয়ে গবেষণা কর। আমি গেলাম ঘুমোতে।’

বলেই মাহীন বালিশে মাথা এলিয়ে দিতে যাচ্ছিল নাইম তড়িঘড়ি বলল, ‘এই ইয়ে না মানে তুই ঘুমোতে পারবি না। আমি পাক্কা সিওর বোতলের পেছনে তোর কোনো হাত আছে।’

মাহীন পুনরায় উঠে বসে চোখ সরু করে বলল,
‘আসলেই সত্যি করে বলতো তোর ভয় লাগছে তাই না? মানে সিরিয়াসলি ভাইয়া তুই আমার বড় ভাই আর আমি তোর ছোট বোন নাকি আমি তোর বড় বোন এবং তুই আমার ছোট ভাই এটা আগে ঠিক কর।’

নাইম বলল, ‘আরে ধুর ভয় কে পায়। আমি মোটেও তা বলছিনা। শুধু তোর বোতলের জন্য আমার আর ঘুম আসছে না। তো তুই এখন আমাকে গান শোনা। এমনিতেও তোর গানের গলা শুনে মনে হয় যেন এজমায় আক্রান্ত গাধা গান গাইছে।’

মাহীন বলল, এজমায় আক্রান্ত গাধা কাকে বলছিস তুই হ্যা! আর এই রাত তিনটায় তোর গান শোনার শখ উঠছে! তাহলে শোন। বলে লম্বা এক শ্বাস ফেলে গান ধরল,
”One day, the only butterflies left will be in your chest.
As you march towards your death. Breathing your last breathe. I hate you say ‘i told you so’, but look how the bruises show…”

নাইম ওকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই থাম থাম, তুই আবার এই অদ্ভুত গানটা গাচ্ছিস! তোকে কতবার বলেছি না যে এটা শুনলে আমার সাফোকেশন হয়।’

মাহীন বলল,’ঢং করতে পারিস বাবা। গান শুনে নাকি মানুষের সাফোকেশন হয়। ঠিক আছে তাহলে এটা শোন,

‘বাদনাম হ্যায় কোই, গুমনাম হ্যায় কোই।
কিশকো খাবার কন হ্যা ওও
আনজান হ্যায় কোই….’

নাইম আবারও মাহীন কে মাঝপথে থামিয়ে বলল, ‘হইসে বাবা আমার গান শোনার শখ শেষ। তুই এইসব অদ্ভুত আর ভুতূরে গান গাওয়া বন্ধ কর। আমি এমনিই ভালো ছিলাম।’

মাহীন দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল, ‘না,না সমস্যা কি আমার তো আরো গান গাইতে ইচ্ছে করছে। গাই না।’

নাইম বলল, ‘না না, দরকার নাই। পরে দেখিস সবাই ভাববে আমরা উইচক্র্যাফট করছি। রাতদুপুরে গান করে শয়তানের উপাসনা করছি।’

মাহীন হাই তুলে বলল, ‘সেটাই তো আমি আগে বলতে চাইছিলাম। বোকা। আমি গেলাম ঘুমোতে। এবার ডিস্টার্ব করলে ওই বোতলের পানি তোর মাথায় ঢালবো কিন্তু।’

বলে পেছনে ঘুরে বালিশে মাথা রাখল। নাইম এদিক ওদিক একবার ভিত দৃষ্টিতে পরখ করল। তারপর আবার শুয়ে পরল। কিছুক্ষণ পরই মাহীন ঘুমের দেশে তলিয়ে গেল। কিন্তু নাইমের চোখে ঘুম নেই। হঠাৎ সেই বোতলটা গড়িয়ে এসে নাইমের বিছানার পায়ের সঙ্গে বারি খেল। নাইম যেন এবার পাথর হয়ে গেল। ওর শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে গেল। চোখের পাতা ফেলতেও যেন ভয় পাচ্ছে। ভাবছে, ওফ আজকের রাতটা যেন কোনো ভাবে পার হয়ে যায়। কালকের সকালে তো চলেই যাব। তারপর এখানে আসলেও এই হোটেলে ওঠার আমার শিক্ষা হয়ে গেছে। আর কখনো এখানকার ধার দিয়ে যাচ্ছি না আমি।’

চলবে ইনশাআল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here