এল_এ_ডেইস পর্ব – ২৬

0
184

#এল_এ_ডেইস
পর্ব – ২৬
লেখনী- মাহীরা ফারহীন

বেলা বাড়ছে। সূর্য মাথায় চড়ে বসেছে। তবে মোটেও কারো গরম অনুভূত হচ্ছে না। তাপমাত্রা যে খুব একটা বেশি নয় এ অঞ্চলে। তারওপর বনজঙ্গলে ঘেরা এ জায়গার পরিবেশ বেশ শীতল থাকে। মাউমেলের পানি থেকে স্বাদমতো মাছ ধরার পর্ব শেষ। সকলে মাত্র মাঠে এসে পৌঁছচ্ছে। পেছনে আরোও অনেকে এখনো আসছে বনের মধ্যে দিয়ে। অন্যান্যরা ইতোমধ্যেই রান্নাবান্নার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে দিয়েছে। অনেকেই আবার ক্লান্ত হয়ে নিজ নিজ তাঁবুর ছায়ায় গিয়ে বসেছে। মাহীনের পায়ের ব্যথার কারণে ও বেশিক্ষণ হেঁটে বেড়ায় না। কিছুক্ষণ পরপর বিশ্রাম না নিলে অন্যরা ওকে চাপাচাপি করতে শুরু করে। মাহীন তাঁবুর কাছে এসে পৌছুতেই ওকে জেনেট এবং সাইলোহ বসিয়ে দিয়েছে। এরপর ওরা মাছ নিয়ে বড় টেবিলগুলোর কাছে চলে গিয়েছে। মাহীনের মনে এক অভিভূত প্রফুল্লতা ও প্রশান্তি। রোদের কিরণে ঝলমল করতে থাকা চেনা অচেনা গাছগুলোকে এক দৃষ্টিতে দেখছে সে। ঠিক আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকানো দায়। রোদের তেজে চোখ বুঝে আসে। হঠাৎ এসিসিয়া এসে মাহীনের পাশে বসলো। মাহীন চমকে উঠে সেদিকে তাকায়। বলল,

‘হেই সিয়া। তোমার মাছ ধরা কেমন হলো?’

সিয়া হালকা হেসে বলল, ‘আমি যে মাছ ধরতে পেরেছি তাতেই আমি অসম্ভব খুশি। এট লিস্ট আমার বোনদের গিয়ে বলতে পারব যে আমিও নিজের হাতে মাছ ধরতে পেরেছি।’

‘ওহ তোমরা কয় ভাই বোন?’

‘আমরা তিন বোন। আমি মেজো।’

‘ওহ ভালোই তো। বাই দ্যা ওয়ে তুমি সাইলোর কথায় সত্যি সত্যি তোমার নখ কেটেই ফেললা?’

সিয়া শ্রাগ করে হালকা হেসে বলল, ‘ইউ নো ওয়াট সবসময় ওভাবে থাকতে ভালোও লাগে না। টু বি অনেস্ট সাইলোহ খুব রুডলি কথাগুলো বললেও আমার মনে হয়েছে, যখন এখানে এসেছি তাহলে এনজয় করি। আফটার অল বাবা তো এখানে নেই।’

মাহীন কপাল কুঁচকে বলল, ‘বাবা এখানে নেই মানে? উনি থাকলে কি হতো?’

সিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘না কিছু না। বাবা এখানে থাকলে দুনিয়ার রুলস এন্ড রেগুলেশন মেনে চলতে হতো। সেটাই বলছি যে আমি স্বাধীন ভাবে এনজয় করতে পারবো।’

‘ওহ আচ্ছা। এমনিতে সাইলোর কথায় মাইন্ড করো না। ও সবার সাথেই একটু খিটখিটে আচরনই করে। বাট ও আমাদের সবারই খুব ভালো ফ্রেন্ড।’

‘হুম এমনিতে তোমরা সকলেই আমার কাছে নতুন। আগে তো কখনো তোমাদের সাথে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ হয়নি।’

‘তো হঠাৎ করে? মানে এবার যে তুমি তোমার ফ্রেন্ডদের সাথে ক্যাম্প শেয়ার করলা না তার কি কোনো বিশেষ কারণ আছে?’
ফট করে কথাটা বলে ফেললো মাহীন। তবে তা ঠিক হলো কী হলো না সেটা ভাবার পূর্বেই সিয়ার ভ্রু কুঞ্চিত হলো। জিজ্ঞেস করল,

‘আমার এখানে থাকাতে কী কোনো সমস্যা হচ্ছে?’

মাহীন ততক্ষণাৎ বলল,’না, না আমি সেটা বলতে চাইনি। মানে এইযে বললা তুমি আমাদের তেমন ভাবে চেনোই না। তেমনি আমিও তোমাকে চিন্তামই না। এবং তোমার আলাদা ফ্রেন্ড সার্কেল আছে। তাই ভাবলাম ওদের সাথে কোনো ঝামেলা হয়েছে কিনা।’

সিয়া ম্লান হেসে বলল, ‘না, না ঝামেলা হবে কেন। ওই যে বললাম না বাবা আশেপাশে থাকলে অনেক রুলস এন্ড রেগুলেশন মেনে চলতে হয়। সকলেই আমার বাবার বন্ধু অর বিজনেস পার্টনারের মেয়ে বা এমন কিছু। তাই বাবার কথায় ওদের সাথেই মেলামেশা করি। নিজে থেকে যে একটা ফ্রেন্ডশিপ হয় সেটা আমার শুধু বিল এবং ম্যাটের সঙ্গে হয়েছে। এখন এখানে এসে চেয়েছিলাম একদম আমার ইচ্ছে মতে চলবো। এবং বিল ও ম্যাট দুইজনই তো ছেলে ওদের সাথে তো আর ক্যাম্প শেয়ার করতে পারি না। তাই এখানে এসে ভিড়েছি।’
মাহীনের ওর কথাগুলো শুনতে খারাপ লাগলো। তাই নরম কন্ঠে বলল, ‘আমাদের দলটা খুব অদ্ভুত জানো। প্রথমে আমরা শুধু পাঁচজন ছিলাম। একজন করে আসে এবং আমাদের সাথে ভিড়ে যায়। এবং আমরা সকলকেই সাদরে গ্রহণ করি। আরোও দুইদিন আমাদের সাথে থাকলেই হয়তো তুমিও সকলের বন্ধু হয়ে যাবা।’

সিয়া হেসে বলল, ‘থ্যাঙ্কস।’

তারপর বেশ কিছুক্ষণ ওরা দুজনই নিশ্চুপ বসে রইল। অবশেষে সিয়া বলল, ‘আচ্ছা মাহীন।’

‘হুম?’

‘তোমার কারো ওপর ক্রাস আছে?’

মাহীন চমকায়িত হলো। জিজ্ঞেস করল, ‘কি? ক্রাস? মানে হঠাৎ এমন প্রশ্ন?’

‘না এমনিই জিজ্ঞেস করছি। সকলেরই তো কেউ না কেউ থাকে। তোমাকে খুব অন্য রকম লাগে তো। তাই তোমার ক্রাস কে হতে পারে জানতে ইচ্ছে করছিল।’

মাহীন ইতস্তত করে বলল, ‘রবার্ট পেটিনসন।’

সিয়া হেসে বলল, ‘আমি নর্মাল ক্রাসের কথা বলছি।’

‘আমি জানি তো। কিন্তু আমার কোনো নর্মাল ক্রাস নাই। তাই কি বলবো?’

‘মানে কেউই না? লাইক একদম লিটল ক্রাসও নাই কারোর ওপর?’

মাহীনের মনের গভীরে চলছে অন্যরকম কথা। ভাবছে
‘কাকে পছন্দ আমার? একটু হলেও? ভালো লাগে বলা যায় রায়েদকে। না, না ওইটা জাস্ট ও রহস্যময় হওয়ার কারণে ওর প্রতি বেশি কিউরিওসিটি কাজ করে। কিন্তু রায়েদের মুখটাই সবার আগে চোখে কেন ভেসে উঠল? সুন্দর মানুষদের প্রতি সবারই এট্রাকশন থাকেই। এটাই স্বাভাবিক।’

‘মাহীন?’ সিয়ার ডাকে ভাবনার গভীর জালটা ছিড়ে গেল। বাস্তব দুনিয়ায় ফিরে এসে মাহীন বলল, ‘না আমার মনে হয় না। আমি না যাকেই দেখি তখনই ভেবে নিই, ও জাস্ট ফ্রেন্ড, ও জাস্ট ফ্রেন্ড, ও জাস্ট ফ্রেন্ড!’

‘ওহ মাই গড। আমি তো ভাবলাম রায়েদ তোমার ক্রাস।’

মাহীন অপ্রস্তুত হলো। যেই ভাবনাগুলো কয়েক মুহূর্ত আগেই ভেবে আসল সেটাই সিয়া ধরে ফেললো। সকলেরই কেন মনে হয় রায়েদকে ও পছন্দ করে? এমন বিশেষ কিছু কি ও করে ফেলেছে নাকি? নিজের ভাবনাগুলোও হঠাৎ তালগোল পাকিয়ে গেল। আসলেই রায়েদকে পছন্দ হয়ে থাকতে পারে ভাবনাটা মাথায় খুঁটি গেঁড়ে বসতেই হালকা গোলাপি রঙ ছড়িয়ে গেল গাল ভরে। এসিসিয়া সেটা খেয়াল করল না। সামনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ ওর। মাহীনের দিকে নয়। অবশেষে মাহীন কিছুটা অপ্রতিভ কন্ঠে বলল,

‘ধ্যাৎ এমন কিছু না। আর দয়া করে এখন তুমিও শুরু করো না।’

সিয়া ফিচেল হাসি দিয়ে বলল, ‘ওহ তো তাহলে অলরেডি অন্যদেরও এমনই মনে হয়েছে। ঠিক আছে। আচ্ছা এট লিস্ট স্কুলের কতগুলো পার্ফেক্ট বয় থাকে না। অনেকেরই তাদের ওপর ক্রাস থাকে। মানে তারা ক্রাসের সেন্টার পয়েন্ট থাকে। তেমন কাউকেও না?’

মাহীন বিরস কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘সেটা আবার কে? তুমি কার কথা বলছো? কে আমাদের স্কুলের পার্ফেক্ট বয়?’

‘ওফ না। ছাড়ো তো। জাস্ট ফরগেট ইট।’

মাহীন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। এসিসিয়া মনে মনে ভাবলো, হুম আমি যেমনটা ধারণা করেছিলাম ঘটনা তো এখানে অন্যরকম। ইট উইল বি আ ইন্টারেস্টিং গেইম টু প্লে।
.
.
চারিদিকে মাছ ভাজার মোহনীয় সুবাস ছড়িয়ে গিয়েছে। সদ্য ধরে আনা তাজা মাছগুলো এতক্ষণ ধরে সকলে যে যার যার মতো ম্যারিনেট করেছে। ঘন্টাখানেক আগেও যেই মাছরা শান্তিতে একেবেঁকে শীতল পানির নীচে সাঁতার কেটে চলেছিল তারা এখন চুলার আগুনে তেল মশলা মেখে পুরছে। মাহীনও এবার চুলার সামনে দাঁড়িয়ে মাছ ভাজার কাজে হাত লাগিয়েছে। রাবিত নিজের মাছ নিজে নিজে ভাজতে গিয়ে একপাশটা পুরিয়ে ফেলেছে। একজন ফ্রেশম্যান ছাত্রীর তো প্যানের ওপরই আগুন ধরে গেল। কে যেন বেশ কিছু মাছ ম্যারিনেট করার সময় দিয়েছে একগাদা মরিচ গুঁড়ো ঢেলে। এখন টিচাররা সেগুলো আবার ধুয়ে নিয়ে নতুন করে মসলা মাখিয়ে সেটা সামলানোর চেষ্টা করছেন। হঠাৎ কোথাও কেউ চিৎকার দিয়ে উঠছে। কেউ এর মাঝে গলা ছেড়ে গানও ধরেছে। টিচারদের কথা যেন কারোও কানেই ঢুকছে না। এতগুলো ছাত্র ছাত্রীকে পাঁচজন টিচার মিলেও সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। গজঘন্টা বাজালে বুঝি এরা থামবে। জেনেট যখন ভাজাভাজিতে হাত লাগিয়েছে, হাত ধুয়ে আসার কারণে হাত থেকে পানি পরেছে এবং তেল ছিটকে উঠেছে। বেচারির হাতে গরম তেল এসে পরায় এখন ও নিজের তাঁবুতে এসে বসে আছে। এর মাঝে এসিসিয়া আবার খুব দক্ষতার সঙ্গে শুধু নিজের মাছ নয় বরং অনেকজনেরই মাছ ভেজে তুললো। ওর ভাষ্য মতে, ওর বাসায় সকলকে পার্ফেক্ট হিসেবে গোড়ে তোলার জন্য তিন বোনকেই সব ধরনের রান্না করা শেখানো হয়েছে। বলাই বাহুল্য ব্যাপারটা সাইলোর হজম হচ্ছিলো না। অবশেষে আড়াইটার সময় সকলের ভাজাভাজি এবং বাকি রান্নাবান্না শেষ হলো। এবং সকলেই তৃপ্তি সহকরে খাওয়া দাওয়া শেষ করল। এরপর বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সকলকেই এদিক ওদিক যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো। এতক্ষণ কেউ বনে যেতে পারবে না এমন একটা নিষেধাজ্ঞা ছিল। যদিও বলা হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে তবুও অনেকেই তখনই এদিক ওদিক কেটে পরল। তবে বেশি দূর যাওয়া যাবে না। মাহীনদের ক্যাম্পে কেউই কোথাও গেল না। বরং ওরা সকলেই একসাথে গোল হয়ে বসলো গল্প করতে। গল্পের মূল বিষয় হচ্ছে নিকটস্থ পরিত্যক্ত দূর্গটা। বনের মাঝেই রয়েছে সেটা। রাবিত কিছুটা ভিত স্বরে বলল, ‘আমি বলছি ওখানে ভূত থাকতে পারে।’

‘ওয়াট দ্যা হেল এই ভুত টুত আবার কি ঝামেলা? ওখানে কোনো ভূত নেই।’ বলল ক্যারোট।

র‌াবিত চোখ গোল গোল করে বলল, ‘সিরিয়াসলি! তুমি এতকিছু বিশ্বাস করো আর ভূতে বিশ্বাস করো না?’

ক্যারোট ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, ‘মানে? এসবের সাথে আবার ভূতের কি সম্পর্ক? আমি কোনো ভুতটুতে বিশ্বাস করি না।’

মাহীন র‌াবিতের পাশেই বসেছিল। র‌াবিতের হাতে গুঁতা দিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘এ্যই ভুতটুত কি হ্যা? ভুত বলতে কিছু হয় নাকি?’

‘আরেহ না না আমি ওইটা বলতে চাইনি। বলছিলাম যে ভুত না হলেও তো জ্বীন হয়। ওরা তো জ্বীনে বিশ্বাস করে না। সেই যাই হোক ওই পরিত্যক্ত দূর্গে তো জ্বীনও থাকতে পারে।’

মাহীন বলল, ‘ওহ আচ্ছা সেটা বলো।’

সাইলোহ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘র‌্যবিট এত ভয় পাওয়ার কি আছে? আমরা কি ওখানে যাচ্ছি নাকি? আমরা জাস্ট কথা বলতেসি।’

লিও বলল, ‘ওই বৃদ্ধর কথা শুনেছো না যাকে প্রায় সময় লিটল রকে ভবঘুরের মতো ঘুরে ফিরে বেড়াতে দেখা যায়।’

নায়েল বলল, ‘কারোর মাথা খারাপ নাকি যে সে ওই দূর্গে এমনি এমনি যাবে। ওই লোক আবার ঢাকঢোল পিটিয়ে সকলকে সাবধান করে দূর্গ থেকে দূরে থাকতে।’

সাইলোহ চোখের মণি ঘুরিয়ে বলল, ‘জাস্ট পাবলিসিটির জন্য করে।’

লিম জু বলল, ‘নিঃসন্দেহে বুড়োর মাথায় ভুতের বেড়াম আছে।’ ওরা সকলে হেসে উঠল। লিম জু আবার বলল,
‘তবে ওটা সেই আঠারোশো সালের শেষের দিকে তৈরি। ওফ ওখানে নাকি আসবাবপত্রগুলো এখনো ওভাবেই আছে।’

এসিসিয়া বলল, ‘দামি কোনো কিছুই নেই। শুধু অকাজের আসবাবপত্রই আছে যেগুলো এতদিনে সব ঘুনে ধরে শেষ যদি না সেগুলো অন্য কোনো ধাতুর হয়।’

মাহীন বলল, ‘তা ঠিক। কিন্তু ওটা এভাবে পরিত্যক্ত হয়েছিল কিভাবে?’

জেনেট বলল, ‘হয়েছে কি এই ব্যাপারে অনেক বিতর্ক আছে। যদিও সবচেয়ে বেশি বিশ্বাসযোগ্য ঘটনা হলো…ওকে মাঝখান দিয়ে থামিয়ে দিয়ে র‌্যবিট বলল,

‘আমি বলবো! আমি বলবো!’

সাইলোহ মুখ বাঁকা করে বলল, ‘তুমি আদৌও জানো?’

রাবিত বলল,’ডোনচিউ ডেয়ার টু আন্ডারেস্টিমেট মি! পিপরাও কিন্তু হাতিকে উল্টায় দিতে পারে। আর তুমি কি জিনিস।’

লিও বলল, ‘আচ্ছা আচ্ছা এখন এটা তো বলো যে তুমি কি জানো?’

রাবিত নাটকীয় ভঙ্গিতে বলতে শুরু করল, ‘হ্যা তো ওটা একটা স্প্যানিশ দূর্গ।’

ক্যারোট মাঝখান দিয়ে বলল, ‘হ্যা ওটা আমরা সবাই জানি।’

র‌াবিত বিরক্ত গলায় বলল, ‘ওফ আল্লাহ! আমাকে বলতে তো দিবা। তো আঠারোশো পঁচাত্তর সালে একটি স্প্যানিশ সম্ভ্রান্ত লি-কুয়ের্তো পরিবার এখানে আসে এবং জায়গাটা তাদের খুবই পছন্দ হয়। কারণ প্রথমত অদূরেই ক্যালিফোর্নিয়া ও নিইউ মেক্সিকোতে দামি ধাতুর খনি ছিলো। এবং এখানে নদীর তীরবর্তী স্থান হওয়ায় আরোও সুবিধা ছিলো। তো তারা এখানে এই বাড়িটা করার পর যখন ওঠে তার কিছুদিন পর এই অঞ্চলে মহামারী দেখা দেয়। এবং একই সাথে তাদের পরিবারের তিনজন সদস্য মৃত্যুবরণ করে। এরপর শুধু মি.লি কুয়ের্তো, তার বোন এবং ছোট মেয়েটা বেঁচে ছিলো। তার বোন কিছুদিন পর চিলেকোঠার ঘরে আত্নহত্যা করেন। ছোট মেয়েটা তারও দুই বছর পর সেই চিলেকোঠার ঘরেই আত্নহত্যা করে। এবং লি-কুয়ের্তো একদম একা এই বনের মাঝে নির্জন একটা দূর্গে পরে থাকেন। পরে ব্রিটিশরা সে সময় দূর্গটা দখল করতে চায়। তবে মি.লি-কুয়ের্তো কোনো ভাবেই এর দখল ছাড়েন না। শেষে একাকিত্বে এবং এসব মানসিক চাপের কারণে তিনিও একই ভাবে চিলেকোঠার ঘরেই আত্নহত্যা করেন। এরপর ব্রিটিশরা বাঙলোটা দখল করেও লাভ হয়নি। কেউই এখানে টিকতে পারতো না। পরে সেটা পরিত্যক্ত হয়ে যায়।’

ক্যারোট চোখ কপালে তুলে টিটকারির সুরে বলল, ‘ওহ মাই গড আমি তো ভাবসিলাম তুমি পড়াশোনাই করো না এন্ড এসব ইতিহাসের ‘ই’ ও জানো না। এটা সত্যিই অপ্রত্যাশিত ছিল।’

র‌্যবিট ঝাঁজ ভরা কন্ঠে বলল, ‘তোমরা আমাকে ভাবোটা কি বলো তো? আমি জাস্ট অলওয়েজ ফান করতে থাকি বলে আমার দুনিয়ার কোনো খবর নাই? আমি কিছুই পারি না?’

উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ধুর ট্রু ট্যালেন্ট এর কোনো দামই নাই আজকাল।’

নায়েল বলল, ‘আরে তুমি যাচ্ছো কোথায়?’

জেনেট বলল, ‘র‌্যবিট বসো না।’

র‌্যবিট বলল, ‘নাহ থাক আমি এখানে আর বসবো না।’ বলে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগল।

লিম জু নরম গলায় বলল, ‘আহারে ওকে এত আন্ডারেস্টিমেট করা ঠিক হয়নি।’

সাইলোহ বলল, ‘কো জানতো ও এত রিসার্চ করে বেড়ায়।’

মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘ক্যারোট তোমার কথায় ও কষ্ট পেয়েছে। তুমি গিয়ে ওকে ফিরায় আনো।’
ক্যারোট ম্লান কন্ঠে বলল,
‘আমি তো আর ওকে হার্ট করতে কথাটা বলিনি। সার্কাস্টিক ওয়েতে কথাটা বলসি। আর এমন ভানে রিএক্টও তো করে না সাধারণত।’

লিও বলল, ‘সে যাই হোক। তুমি এখন ওকে ফিরায় আনো।’ ক্যারোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল।

র‌্যবিট হাঁটতে হাঁটতে নিজের ক্যাম্পের কাছে পৌঁছে গেল। রায়েদ ঘাসের ওপর বসে সিডনি শেলডনের ব্লাডলাইন উপন্যাসটি খুলে বসে ছিলো। র‌াবিত ওর পাশে ধপ করে বসে পরল। রায়েদের কাঁধে মাথা রেখে দিয়ে বিষন্ন মুখে বসে রইল। রায়েদ ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘মাইন্ড নামক বেলুনটায় বেশি হাওয়া দেওয়ার কারণে তা ফুটে গিয়েছে দেখি।’

রাবিত বিরক্ত কন্ঠে বলল, ‘ওহ মজা করো না তো।’

‘কিন্তু কি হয়েছে তোর?’

‘কি আর? আমি পাঁচটা ভাষা বলতে পারি। এত রিসার্চ করি। এন্ড হোয়াট আই গেট ইন রিটার্ন? নাথিং বাট নেগলিয়েন্স। সকলে আমাকে অলওয়েজ আন্ডারেস্টিমেট করে।’

রায়েদ চাপা হেসে বলল, ‘তুই এত জ্ঞান অর্জন তো করিস কিন্তু কোথাও ব্যবহার তো করিস না। এবং সবসময় জোকারের মতো আচরণ করলে কিভাবে হবে? সবসময় ফাজলামো না করে মাঝে মাঝে সিরিয়াস হওয়ার চেষ্টা করবি।’

‘ওত সিরিয়াসনেস ভাল্লাগে না আমার।’

তখনই ক্যারোট হাঁটতে হাঁটতে ওদের তাঁবুর দিকে আসছিল। রায়েদ ওকে দেখে বলল, ‘ওই দেখ তোর ফ্রেন্ড ক্যারোল আসছে।’

রাবিত ওইদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল, ‘ওর নাম ক্যারোট।’

ক্যারোল ওদের তাবুর কাছাকাছি তো এসে পৌঁছেছে, কিন্তু কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। তাও আবার রায়েদ সামনে আছে। ক্যারোল ভাবতে লাগল, ওফ র‌্যবিটকে তো কখনো রাগ করতেই দেখিনা। ওর রাগ কি করে ভাঙ্গায় আমি কি করে জানবো? আর কারোও কথায় জীবনে রাগ করে না সেখানে আমার কথায়ই রাগ করে আমাকেই ঝামেলায় ফেলা লাগতো। মহা মুশকিল তো! আচ্ছা এমন পরিস্থিতিতে মাহীন কি করতো? ও নিশ্চয়ই অন্যরকম কিছু করতো যেটা র‌্যবিট ভাবতেও পারে না।’ ভাবতে ভাবতেই এগিয়ে গিয়ে ওদের সামনে দাঁড়াল। তারপর মূহুর্তের জন্য দ্বিধাবোধ করে ধপ করে ওদের সামনে বসে পরল। এবং রায়েদের দিকে তাকিয়ে সাহস করে অভিযোগের স্বরে বলল,

‘দেখো রায়েদ তোমার ছোট ভাইকে বুঝাও যে, আমি যেই কথাটা বলেছি ওটা আসলে ওকে আন্ডারেস্টিমেট করে নয় বরং ওকে ইন্ডাইরেক্টলি প্রশংসা করে বলেছি।’ হঠাৎ করে ক্যারোটের এভাবে কথা বলায় রায়েদ হকচকিয়ে গেল। সকলে টুকটাক ওর সাথে কথা বললেও মাহীন যেভাবে ওর সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে যায় সেভাবে আর কেউ বলে না। তবে ক্যারোল হঠাৎ করে একদম নির্দ্বিধায় কথাগুলো বলে যাওয়াতে রায়েদ এবং রাবিত দুইজনই অবাকই হলো বটে।

ক্যারোল বলে গেল, ‘দেখো অন্যান্য সময় সকলে ওকে কি না কি যে বলে। অনেক সময় সবাই তো সার্কাস্টিক ওয়েতেও অনেক কথা বলে না। সেখানে কখনো কোনো মাইন্ড করলো না। আর আমি কি একটা কথা বললাম একদম মুখ ফুলিয়ে উঠে চলে আসল। এটা কোনো কথা হলো?’

রায়েদ ওর কথাগুলো শুনে নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে যেন হাসি না আসে। তবুও উত্তর দেওয়ার সময় হাসি হাসি মুখেই বলল, ‘ওহ তাই নাকি। র‌্যবিটের সঙ্গে ক্যারোটের নাকি অনেক প্রাচীন সম্পর্ক। তাই হয়তো অভিমান করেছে।’ বলে রাবিতের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তুই এত অভিমান করতে পারিস জানতাম না তো।’

রাবিত ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে ঘাসের দিকে তাকিয়ে আছে।
রায়েদ ক্যারোলের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল, ‘তুমি একজ্যক্টলি ওকে কী বলেছিলা?’

ক্যারোল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ও আমাদের নিকটস্থ যেই পরিত্যক্ত বাঙ্গলোটা আছে সেটার ডিটেইলস ইতিহাস শোনানোর পর আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, ওহ গড আমি তো ভাবসিলাম তুমি পড়াশোনাই করো না এন্ড এসব ইতিহাসের ‘ই’ ও জানো না। এটা সত্যিই অপ্রত্যাশিত ছিল।’
তারপর একটু বিরতি দিয়ে বলল, ‘এখন আমি সোজা ভাবে বলেছি আমি ভাবতাম ও পড়াশোনা করে না। কিন্তু এখন জানতে পারলাম ও অনেক কিছুই পারে যেটা হয়তো ওকে দেখে বোঝা যায় না।’

রায়েদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাবিতের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘রাবিত রাগ করলে জায়গা মতো তো করবি। আমি হলফ করে বলতে পারি ওযে কি বলসে সেটা তুই বুঝিসই নি।’

রাবিত বলল, ‘আহ ভাই। আমি বুঝেছি। তবে ও সোজা ভাবেও তো বলতে পারতো। প্রশংসা কেউ অত ঘুরায় প্যাচায় করে?’ বলে ক্যারোটের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটলো।

রায়েদ বলল, ‘প্রথমত প্রশংসা ও নিজে থেকে করেছে। তাই সেটা বুঝে নেওয়া তোর কাজ। এখন বেশি কথা না বাড়িয়ে রাগ ঝেড়ে তোরা কোথায় বসে কি গল্প করছিলি সেখানে যা।’

বলে ওকে ঠেলা দিলো। রাবিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। তারপর ক্যারোলের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘এরপর থেকে প্রশংসা করলে ক্লিয়ারলি করবা। লাইক ‘র‌্যবিট ইউ আর goat!’

ক্যারোল হেসে উঠে বলল, ‘নিজেকে ছাগল বলছো?’
রায়েদ নিজের বইটা হাতে নিয়ে চাপা হাসল। র‌্যবিট বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আরে নারে বাবা। এই goat সেই goat না। এই goat এর মানে ‘Greatest of all time’। এটা একটা আমেরিকান কাম ক্যালিফোর্নিয়ান স্ল্যাঙ্গ। তুমি আমেরিকান হয়েও এটা কখনো শোনোনি?’
ওরা হাঁটতে শুরু করেছে। ক্যারোল এখনো হাসতে হাসতে বলল,

‘র‌্যবিট এখন আর খরগোশ নেই ছাগল হয়ে গিয়েছে বাহ। দাঁড়াও ওদের এটা বলা লাগবে।’ বলেই দ্রুত গতিতে হাঁটতে লাগলো। র‌্যবিট প্রায় ক্যারোটের পেছনে ছুটে যেতে উচ্চস্বরে বলল,

‘এ্যই এক মিনিট এসব কি? আমি না বললাম এটার মানে কি!’

ইনশাআল্লাহ চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here