এল_এ_ডেইস পর্ব ২৮

0
278

#এল_এ_ডেইস
পর্ব ২৮
লেখনী মাহীরা ফারহীন

Cause there we are again in that little town street.
You almost ran the red cause you were looking over at me
Wind in my hair, i was there… টেইলর সুইফটের গান বেজে চলেছে কোথাও চাপা শব্দে। তবে চারিদিকের পিনপতন নীরবতা ভেঙ্গে দিয়ে শব্দটা অতি উচ্চ শোনাচ্ছে। এই শব্দ তীরের মতো ঘুমন্ত মানুষগুলোর কানে গিয়ে বিঁধছে। কারোও কারো ঘুম পাতলা সুতোর মতো ছিঁড়ে যায় অল্প শব্দেই। ঠিক যেমনটা জেনেটর সঙ্গে হলো। জেনেট ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল, ‘আরেহ আমি কখন টেইলরের কনসার্টে এলাম?’
মাহীন নিজের ফোনের রিংটোন চিনতে পেরে সজাগ হয়ে উঠলো। কোনো রকমে ঘুম জড়ানো চোখের পাতা টেনে খুললো। তারপর এদিক ওদিক হাতরে সেলফোনটা খুঁজতে লাগল। বলল,’জেন আমরা কোনো কনসার্টে যাইনি। এটা আমার ফোনের রিংটোন।’
জেনেট বিরক্তমাখা কন্ঠে বলল,’তাহলে ফোন ধরো না।’

‘খুঁজে পাচ্ছি না তো।’ বলতে বলতে ক্যারোলের ছড়িয়ে থাকা লাল চুলের নিচে পেলো ফোনটা। ক্যারোল মাঝে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। ও একটু উশখুশ করে উঠল। মাহীন ফোনটা হাতে নিয়েই রিসিভ করে তারপর নামটা দেখলো। লেখা আছে ‘দ্যা স্ট্রেঞ্জ বয়’। ঘুমের ঘোর লাগা চোখে নামটা দেখেও মস্তিষ্কে কোনো সাড়া জাগলো না।
মাহীন ফোনটা কানে ধরতেই ওপাশ থেকে গাঢ় কন্ঠস্বর কানে এলো, ‘মাহীন আমি রায়েদ।’ কথাটা শুনতেই মাহীন ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। তারপর ওর মনে পরলো রায়েদের নম্বর আসলে এই নামেই সেভ করেছে ও। যদিও রায়েদ ওকে একবার বলেছিল ওর নম্বর সেভ না করতে। তবে কে শোনে কার কথা? তাড়াতাড়ি তাবুর চেইন খুলে বাইরে বেরিয়ে আসল। তীব্র কন্ঠে বলল, ‘তুমি এখান থেকেই এখানে ফোন দিচ্ছো কেন? এখানে এসেই তো আমাকে ডাকতে পারতে।’
ওপাশ থেকে বলল, ‘এই সময় তোমাকে ডাকতে আসলে সকলেই উঠে যেত। সেটা বোধহয় খুব একটা ভালো হতো না।’ মাহীন ওর কথাটা শুনে চারিদিকে একবার চোখ বুলালো। পূর্ব আকাশে সূর্যের আগমন এখনো ঘটেনি। । চারিদিক আবছা অন্ধকারের চাদরে ঢাকা। তবে অন্ধকার আকাশের চেহারা ফ্যাকাসে হতে শুরু করেছে। আকাশের এই ম্যারম্যারে রুপটাও মনে প্রশান্তি এনে দেয়। কত অচেনা গাছের ঝাঁকড়া ডাল পালার ফাঁকে ফাঁকে পাখিরাও ঘুমের পর্বে সমাপ্তি টেনে নতুন দিনের সূচনা করছে। কনকনে শীতল বাতাস শা শা শব্দে বয়ে চলেছে। ঠান্ডায় মাহীনের গায় কাটা দিয়ে উঠল। ফোনের অপর সংযোগ দাতার নিকট প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, ‘কিন্তু তোমার এই সময় কী এমন জরুরিকথা বলতে হবে আমায়?’

‘তুমি আমার ক্যাম্পের কাছাকাছি আসো তারপর বলছি। এখান থেকে এখানে ফোনে বলবো নাকি?’

মাহীন ভাবলো, এক মিনিট গতকাল যে ডেয়ারটা দিয়েছিল ওটা ব্যবহার করে যে আমাকে কি করতে বলবে আল্লাহই জানে। কি করতে যে ওর কাছে ডেয়ার নিয়েছিলাম।! এখনই ওটা খরচ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি।’ মুখে বলল, ‘হুম আমি তো নাও আসতে পারি। তবে মনে আছে গতকাল তোমার ডেয়ারটা। আমি না আসলেও সেটা ব্যবহার করতে পারো।’
ফোনের ওপাশে রায়েদ নিঃশব্দে হাসল। বলল,
‘ওইটা এত সহজে তো খরচ করবো না। তুমি এখন এমনিই এখানে আসছো। সি ইউ।’ বলে মাহীনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লাইন কেটে দিল। মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে রায়েদের ক্যাম্প যেদিকে সেদিকে দৃষ্টি ফেরাল। কিন্তু কাউকেই দেখা গেল না। মাহীন নিজের তাঁবুতে আবার প্রবেশ করল।
.
.
.
রায়েদ গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে নিজের ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিল। তবে এখন সেদিকে তাকিয়ে থেকেও কিছুই দেখছে না। বরং ও গভীর ভাবনায় ডুবে আছে। ঠান্ডা বাতাস ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে ওকে। ভাবছে, কী একটা কাজ করলাম আমি?
মাহীনকে এই সাতসকালে ফোন দিয়ে ঘুম থেকে তুললাম। কেন? সূর্যদয় দেখার জন্য। ব্যাপারটা একটু বেশিই অপ্রতুল হয়ে গেল না? ওফ আমিও কী আমার কমনসেন্স বাসায় ফেলে রেখে এসেছি নাকি? ও আসলে ওকে বলবোটা কী? কেন ওকেই ডাকলাম? এভাবেই বলে দেওয়া যায় নাকি? আমি তো নিজেও ঠিক বলতে পারবো না কেন সর্বপ্রথম ওর কথাই মনে পরলো? মেয়েটা আসলেই পাগল করে দিচ্ছে আমাকে। আজকাল দেখি কিছু কিছু ঘটনা এমন ঘটে যার কোনো ব্যাখ্যাই খুঁজে পাই না।’
রায়েদের সামনে তুড়ি বাজাতেই ও চমকে উঠল। ভাবনার সুতোয় টান পরল। দেখলো মাহীন ওর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। সাধারণত ওর চুল খোলা থাকে বা ব্যান্ড দিয়ে ঢিলা করে বাঁধা থাকে। এখন ও চুল উঁচু করে পোনিটেইল করে এসেছে। চুখে মুখে এক স্নিগ্ধতার ছোঁয়া। রায়েদ পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখছে ওকে।
মাহীন গাঢ় কন্ঠে বলল, ‘হুম আমি জানতাম তুমি একটু বেশিই ওভারথিংক করো। তবে আজকাল তোমার আশেপাশে থাকতে থাকতে সেটা করতে দেখার সৌভাগ্যও হচ্ছে।’ তারপর থেমে আবার বলল,’আচ্ছা তো বলো এই ঠান্ডার মধ্যে জমতে ডাকসো কেন?’

‘তোমাকে জমতে ডাকিনি। একটা জায়গায় যাবো। এখান থেকে কাছাকাছি। তুমি চাইলে যেতে পারো আমার সাথে।’

‘ওহ তাই। কি ধরনের জায়গা?’ আগ্রহী কন্ঠে বলল মাহীন।

রায়েদ আমুদে গলায় বলল, ‘যেখান থেকে খুব সুন্দর সূর্যদয় দেখা যায়।’

মাহীন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আর তুমি সেই জায়গাটা কিভাবে চেনো?’

‘আমাদের বাস ড্রাইভার ওরফে গাইড এর আগেও এখানে অনেকবার এসেছেন। এবং তিনিই সেই জায়গাটার কথা আমাকে বলেছেন এবং কোন দিক দিয়ে যেতে হয় সেটাও।’

মাহীন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল, ‘গ্রেট! বাট এক্ষেত্রে আমার কথাই তোমার কেন মনে পরলো?’
রায়েদ জ্বিব কামড়াল। মনে মনে ভাবলো, এই যাহ। আমি জানতাম এই প্রশ্ন ও করবে। এখন কি বলবো? ভাবতে ভাবতেই আবার একটা কারণ দাঁড়িয়েও গেল। বলল, ‘কারণ একমাত্র তুমিই কি আমার সবচেয়ে ভালো ফ্রেন্ড না?’
কথাটা মাহীনের মনের মধ্যে এক অদ্ভুত ভালো লাগার অনুভূতির সঞ্চার করল। মুখ টিপে হেসে সায় জানিয়ে মাথা ঝাকাল। বলল, ‘হুম যুক্তিসঙ্গত কথা।’ তারপর একটু থেমে বলল, কিন্তু যদি আমরা হারিয়ে যাই।’
কিছুটা উদ্বিগ্নতা মিশে আছে কন্ঠে। রায়েদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমি বিভিন্ন ক্যাম্পে গাইড হিসেবে কাজ করেছি। এখন হারিয়ে গেলে কিভাবে ফিরে আসতে হবে সেই অভিজ্ঞতা আমার আছে। তবুও আস্বস্ত থাকতে পারো আমরা হারাব না।’
মাহীন গাঢ় কন্ঠে বলল, ‘আচ্ছা তবুও একটু ভাবতে দাও।’
রায়েদ তীব্রভাবে বললো, ‘থাক আমি একাই যাচ্ছি।’

মাহীন তখনই তাড়াহুড়ো করে বলল, ‘এই এই না, না! একটু থামো। আমাকে ছাড়া তুমি যাবে না।’ রায়েদ ভ্রু উঁচু করে ভাবলো, ও যখন আমার সাথে যাওয়ার জন্যে এক পায় খাঁড়া তাহলে এত ভাবছে কী?’
মাহীনের মনে চলছে কিছু উদ্ভট চিন্তা ভাবনা, আচ্ছা ভাইয়ের সেখানো রুলস হচ্ছে কেউ কোথাও যাওয়ার প্রস্তাব দিলে যাওয়ার আগে এর চারটা কারণ বের করতে হবে। একটা কারণ হতে পারে,
রায়েদ আমার ফ্রেন্ড, দ্বিতীয়ত ও প্রস্তাবটা দিচ্ছে, তৃতীয়ত সূর্যদয় খুব সুন্দর হয়, এবং এবং আর কী? আর কী কারণ থাকতে পারে? ওফ!…আ, ওহ হ্যা! এবং আমি যেতে চাই। শেষ! চারটা কারণ দাঁড় করিয়েছি।’ মুখে উচ্ছাস ভরে উঠল এবার। প্রফুল্ল চিত্তে বলল,’হ্যা হ্যা ঠিক আছে আমি রাজি।’

রায়েদ মুচকি হেসে বলল, ‘এতক্ষণ যে কী ভাবলা আল্লাহই জানে। যাই হোক আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। সূর্যদয় হওয়ার আগেই আমাদের যেতে হবে।’
তারপর তাঁবুগুলো পার করে বাম দিকে হেঁটে যেতে লাগল। মাহীন জিজ্ঞেস করল,’আচ্ছা তুমি আমাকে খুন করবা নাতো?’

রায়েদ হেসে উঠল। বলল, ‘নাহ খুনটুন আমি করতে পারি না বাবা।’

‘আর যদি আমাকে ফেলে রেখে আসো?’

রায়েদ হেসে বলল,’এখন তুমি ওভারথিংক করছো কিন্তু। আমি তোমাকে খুনও করবো না, ফেলেও রেখে আসবো না। তুমি ঠিকঠাক ভাবেই যাবা। ঠিকঠাক ভাবেই আসবা।’

মাহীন হাসল। হঠাৎ করে এমন সব অর্থহীন কথা বলতেই ভালো লাগছে। কেন জানে না। শীতে কবলিত ভোরে আরামের ঘুম ভেঙে যাওয়ায় মাথা ঠিকঠাক কাজ করছে না? নাকি প্রিয় মানুষটির সঙ্গে একান্তই সময় কাটানোর স্বর্গীয় আনন্দে? হ্যা হয়তো বলাই যায় প্রিয় মানুষ। মনে পরে না তো ওর, এর আগে কাউকে এই ছেলেটার মতো ভালো লেগেছিল কিনা। কাছাকাছি পর্যায়েরও হবে না।

ওরা দুজনই তাঁবুগুলো পার করে বাম দিকের বনের মধ্যে প্রবেশ করল। বনে প্রবেশ করার পূর্বে বড় টেবিল থেকে একটা ফ্ল্যাশলাইট নিয়ে নিল। রায়েদ হাঁটছে এবং মাহীন ওকে অনুসরণ করছে। এখানে কোনো মেঠোপথ নেই। কাজেই গাছের গোড়া, ঝোপঝাড় এড়িয়ে হেঁটে যেতে হচ্ছে। তাছাড়া এখনো অন্ধকার। ফ্ল্যাশলাইটের সাহায্যেই কাজ চালাতে হচ্ছে ওদের। কাছেপিঠে তীব্র ঝিঁঝি পোকাদের ডাক শোনা যায়। কখনো কখনো সামনে গাছের ডালপালা বেশি হেলে থাকতে দেখা যায়। কয়েকবার শিকড়বাকর মাহীনের পায়ে বাঁধল। ওর পায়ে এখনো বেশি দ্রুত হাঁটলে ব্যথা অনুভব হয় বিধায় ওরা সাধারণ গতিতে হাঁটছে। গাছের ফাঁকে ফাঁকে কোথায় যেন একটু পরপর কোন পাখি টিউ টিউ করে ডেকে উঠছে। অন্ধকারেও ফ্ল্যাসলাইটের আলোয় ঝোপঝাড়ের মাঝে ছোট ছোট বনফুল পাওয়া গেল। একটা ফুল দেখল মাহীন। হালকা হালকা নীল রঙের ছোট ছোট ফুলের মাঝে হলুদ বোটা। ভিষণ ভালো লাগল ফুলটা ওর। কয়েকটা হাতে তুলেও নিল।আরো বেশ কিছুক্ষণ পার হলো। হয়তোবা বিশ মিনিট পার হয়েছে। মাহীন এটাই ভেবে অবাক হচ্ছে যে এখনো সূর্যদয় হয়ে যায়নি কিভাবে। রায়েদকে জিজ্ঞেস করল,
‘আচ্ছা এখন কয়টা বাজে?’
রায়েদ নিজের হাতঘড়িতে আলো ফেলে বলল,’সাড়ে পাঁচটা। কেন?’
‘না এমনি ভাবছিলাম কখন না সূর্যদয় হয়ে যায়।’
‘চিন্তা করো না আমরা সূর্যদয় মিস করবো না।’
ওরা এগিয়ে গেল। আরো বেশ কিছুক্ষণ পর থেকে পথ খাঁড়া হতে লাগল। এখন মাহীনের হাঁটতে বেগ পেতে হচ্ছে। যেহেতু সামনের দিকে পথ খাঁড়া হয়ে এগিয়ে গিয়েছে। রায়েদ থেমে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার হাঁটতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?’
‘নাহ ঠিক আছি।’
‘ঠিক আছে। তবে ব্যাথ্যা হলে বলিও।’
মাহীন হালকা হেসে সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। তবে আবছা অন্ধকারে সেটা রায়েদের চোখে পরল না।
আরো কিছুক্ষণ পর সামনে গাছের ফাঁকফোঁকর থেকে খোলা আকাশ দেখা যাচ্ছে। বিবর্ণ সেই আকাশ। আর গাছপালা দেখা যাচ্ছে না। সেই পর্যন্ত পৌঁছতেই দেখা যায় সামনে আর পথ নেই। এটাকেই পর্বত চূড়া মনে হচ্ছে। যদিও আসলে পিনাকেল মাউন্টেইন এখান থেকে বেশ স্পষ্ট ভাবেই আরেকটু দূরে দেখা যাচ্ছে। এই পাহাড়ের তলদেশ দিয়ে দ্রুত বেগে মাউমেল নদী বয়ে চলেছে। নদীর ওপাশ থেকে আবারও ঘন বন। এই চূড়া থেকে নিচের নদী অন্তত ত্রিশ ফুট নিচু হবে। দূরের পিনাকেল পাহাড়ের পেছন থেকেই একটা হলদে-সোনালি আভার ডালপালা গজিয়ে উঠছে। ওরা যেখানে দাড়িয়ে আছে সেখানে পাহাড়ের পাড়টা মোটামুটি এতটা চওড়া যে ঘাসের ওপর বসা যায়। মাহীন প্রসন্ন কন্ঠে বলল,’আহ! এখন যা দেখছি তাই তো বিশ্বাস করতে পারছি না। এমন দৃশ্য কখনো ছবি ভিন্ন বাস্তবে দেখবো সেটা কল্পনাও করিনি।’
রায়েদ মুখ টিপে হেসে বলল,’সূর্যদয় তো এখনো হলোই না তার আগেই যা খুশি তুমি, দেখো আবার লাফালাফি করতে গিয়ে পাহাড় থেকে পরে যেও না।’
মাহীন হাসি মুখে বলল,’পরবো না। আচ্ছা আমরা কী এইখানে একটু বসতে পারবো? এতক্ষণ হাঁটার পর আমার পায়ের ‘ব্যাটারি এবাউট টু ডায়।’
রায়েদ হেসে বলল, ‘অফ কর্স উই ক্যান সিট।’ মাহীন মুচকি হেসে ঘাসের ওপর গোল হয়ে বসে পরল। রায়েদ হঠাৎ অন্যদিকে দুটো গাছের মাঝে একটা ফুলের ঝাড় দেখে বসল না। সেদিকে একটু সরে গেল। এক গুচ্ছ হালকা বেগুনি ফুলগুলো তুললো। এসে মাহীনের পাশে ঘাসের ওপর বসল। মাহীন সেদিকে খেয়াল করে বলল,
‘ওউ কী অসাধারণ সুন্দর ফুলগুলো!’ কী ফুল এগুলো?’
রায়েদ মাহীনের ডান হাতটা ধরে ফুলগুলো ওর হাতের তালুতে রেখে বলল, ‘এগুলো ভারবেনা ফুল। স্যান্টা মনিকায় খুব একটা পাওয়া যায় না। গেলেও এই রঙটা পাওয়া যায় না।’
মাহীন ফুলগুলো হাতে নিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দিল। রায়েদ ওর দিকে মুগ্ধ মোহময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। প্রমত্ত কন্ঠে বলল, ‘গর্জিয়াস!’
মাহীন হাসল। জিজ্ঞেস করল,’তোমার প্রিয় ফুল কী?’

‘নির্দিষ্ট কোনো প্রিয় ফুল নেই। সব ফুলই ভালো লাগে। এই ফুলটা কীসের সিম্বল জানতে চাও?’

‘সিম্বল? তাই? কিসের সিম্বল এটা?’

‘এটা পবিত্রতা এবং হিলিংয়ের সিম্বল। ঠিক তোমার মতো। ঠিক যেমন তুমি সকলের দুঃখগুলো অদ্ভুত ভাবে ঘুচিয়ে দিতে জানো। এই ফুলটা বোধহয় তোমার প্রতীক।’
মাহীন লাজুক হাসল। অপ্রতিভ ভাবে জিজ্ঞেস করল,
‘তুমি তো দেখি ফ্লোরিওগ্রাফি পড়েছো।’
‘তা তো পড়েছিই। ভালো লাগে। যদিও এই ফুলের অর্থগুলো মানবসৃষ্ট।’
মাহীন বলল,’আমি ফ্লোরিওগ্রাফি পড়িনি ঠিকই। তাও বলতে পারবো ভালোবাসার সিম্বল নিশ্চয়ই লাল গোলাপ।’
‘ঠিক বলেছো। তবে গোলাপ খুব একটা বিশেষ মনে হয় না আমার। আসলে এটা এতোটাই কমন ফুল যে খুবই সহজলভ্য হয়ে গিয়েছে।’
‘তা ঠিক। দুর্লভ জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেশি। আচ্ছা যেহেতু তোমার গোলাপ খুব একটা ভালো লাগে না। তাহলে ভালোবাসার প্রতীক তোমার কাছে কোনটা?’
‘উম এখন পর্যন্ত ঠিক নেই। ঠিক হয়ে গেলে তোমাকেই সবার আগে বলবো।’ পেছনের গাছে হেলান দিয়ে বসে আছে ওরা। পেছনের গাছটায় চোখ পরল মাহীনের সেটা কোন গাছ বোঝার চেষ্টা করল, এটা কী গাছ হতে পারে। তবে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল,’আচ্ছা এটা কী গাছ?’
‘ওহ, এটা ওয়েস্টার্ন রেড সিডার।’ পেছনে তাকিয়ে বলল রায়েদ।
মাহীন হঠাৎ করেই গতকাল রাতে রায়েদের বলা সেই ছাব্বিশ আগস্টের কথা ভাবল। ছাব্বিশ আগস্টের কথাটা জানতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু নিশ্চয়ই সেটা সেরকম কোনো দিন হবে যেটা এই মুহূর্তটাকেই নষ্ট করে দিতে পারে। তাই এখন কেন ওকে কখনোই এটা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা যাবে না।’
মাহীন ভাবনায় ব্যস্ত এবং রায়েদ ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো নিশ্চুপ ভাবে। আবিষ্টমনে। মাহীন হঠাৎ ওর দিকে দৃষ্টি ফেরাতেই ব্যপারটা খেয়াল করল। বলল,
‘সামনের দৃশ্যটা আমার থেকেও বেশি সুন্দর ওটা দেখো।’
রায়েদ মুচকি হেসে প্রমত্ত কন্ঠে বলল,’আচ্ছা তুমি সাধারণত পনিটেইল করো না কেন?’
মাহীনের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ‘পনিটেইল? উম কারণ আমার চুল এত সিল্কি, পনিটেইল করলে আধাঘন্টার মধ্যে ঢিলা হয়ে বাঁধন নিচে নেমে আসে। এবং পনিটেইল দুধ পানি হয়ে যায়।’
তারপর একটু থেমে আবার বলল,’কিন্তু কেন?’
রায়েদ ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি ঝুলিয়ে বলল,’কারণ তোমাকে পনিটেইল করলে কিন্তু আরেক রকম সুন্দর লাগে।’
মাহীন লাজুক হাসল। ওর গালে লালাভাব ফুটে উঠেছে। ততক্ষণাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,
‘আরেহ আমাকে বাদ দাও। আগে দেখো সূর্যদয় হচ্ছে।’ রায়েদ সামনের দিকে দৃষ্টি ফেরাল। আসলেই পিনাকেল পাহাড়কে ঠেলে তার পেছন থেকে সোনালি আলোর গোলকটা বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। তার তীব্র আলোর কীরণে ধীরে ধীরে পিনাকেল পাহাড় ও সামনের জঙ্গল মেখে যাচ্ছে। সূর্যের প্রথম কীরণ ঠিক ধীর গতির ঢেউয়ের মতো এগিয়ে আসছে। এ কিরণ ঠিক তরল সোনাল মতো সোনালি। এ যেন এক স্বর্গীয় দৃশ্য। মাহীন মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলল,’এমন দৃশ্য দেখাটাও সৌভাগ্যের ব্যাপার।’
রায়েদ বলল, ‘তোমাকে স্পেশালি এখানে আনার আরেকটা কারণ আছে।’
মাহীন সামনের দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি আসলেই আমাকে খুন করতে চাও?’
রায়েদ হেসে বলল,’আরেহ না। কারণটা হলো আজকে যখন অন্যরা পিনাকেল পাহাড়ে উঠবে তুমি তো তখন যেতে পারবে না। পাহাড়ে এসে যদি পাহাড়েই ঘুরতে না পারো তাহলে তোমার যাত্রাটাই তো সফল হলো না। আমি হলফ করে বলতে পারি পাহাড়ে উঠে যেই দৃশ্য সকলে দেখতে পাবে তার চাইতেও সুন্দর দৃশ্য এটা।’
মাহীন প্রসন্ন হেসে বলল,’ইউ আর দ্যা গ্রেটেস্ট এভার! আমি এটা ভেবেই মন খারাপ করছিলাম যে আমি পাহাড়ে উঠতে পারবো না। কিন্তু আমার সব আফসোস দূর করে দিলা।’
রায়েদ বলল,’মাই প্লেজার।’
তরল সোনার ন্যায় সোনালি কিরণ ক্ষণকালের মধ্যে মাহীন ও রায়েদকে ছুঁয়ে গেল। সোনারঙা আলোয় স্নান করে সুমিষ্ট পবিত্র অনুভূতিতে ভাসতে লাগলো অন্তর।
মনে হলো অন্ধকার ভুবনটাই যেন আলোয় ভরে গেল। ভোরের পাখিরা আপন নিবাস ছেড়ে বেরিয়ে পরেছে। ওরা সমতল ভূমি হতে বেশ উপরে বসে আছে বলে, মনে হচ্ছে পাখিরা যেন ওদের পাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে।
পেলব সাদা মেঘভেলা গুলো ওদের ঢাক্কা দিয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে।

ইনশাআল্লাহ চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here