কমরেড_শায়লা (১ম পর্ব)
জাহান_সুলতানা
আজ, বিবাহের পূর্বদিন, পার্লারে গিয়ে মাথা ন্যাড়া করে এসেছি। আম্মা দরজা খুলে আমাকে দেখে “হায় আল্লাহ” বলে সাময়িক জ্ঞান হারালেন। ভাবি দৌড়ে এসে জাপটে ধরলেন আম্মাকে।
আমি শার্টের কলারের কাছাকাছি জমে থাকা কুচো চুল ঝাড় দিতে দিতে ভাবলেশহীন কন্ঠে বললাম,আম্মাকে সোজা করে শুইয়ে ঠ্যাংয়ের নিচে একটা বালিশ দাও।
ভাবী কাঁদো কাদো হয়ে আমাকে বলল,শায়লা! তুমি এইটা কী করলা?
ভাবী বিলাপ শুরু করার আগেই আমি আমার শয়নকক্ষের দিকে হাঁটা দিলাম। নারী অধিকার, দেশ ও দশের চিন্তাভাবনা, পুরুষের কেন পৃথিবীতে থাকা উচিত না,মাথা ন্যাড়া করা কি শুধুই পুরুষের একান্ত ব্যক্তিগত অধিকার ইত্যাদি বিষয়াদি নিয়ে আজকে একটা গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট করতে হবে ফেসবুকে। পার্লারের মেয়েগুলো মাথা ন্যাড়া করতে চাইছিলনা। মাথা ন্যাড়ার উপকারিতা নিয়ে লেকচার দিতে হয়েছে এক ঘন্টা,মাথা ন্যাড়া করতে খরচ হয়েছে পনের মিনিট। নারীর জীবন ফেলনা নয়। প্রতিটা মিনিট অনেক গুরুত্বপূর্ণ । এদেরকে কে বোঝাবে? আমি ছাড়া?
আমি বোঝাব। হ্যা,আমি,ব্ল্যাকবেল্ট কমরেড শায়লা ইয়াসমিন। ফেসবুকের পুরুষ হটাও গ্রুপের এডমিন। আমাদের লক্ষ্য পৃথিবীতে পুরুষজাতির অস্তিত্ব বিনাশ করা। এই অস্তিত্ব বিনাশ শিল্পক্ষেত্রে,কৃষিক্ষেত্র,চিকিৎসা,গবেষনা সব জায়গায়। পুরুষ একটা বিশ্রি শব্দ। পৃথিবীতে পুরুষদের কাজ হলো শুধু নারীকে নির্যাতন করা । অথচ নারীরা দয়া করে পুরুষদেরকে এই পৃথিবীতে থাকতে দিয়েছে। কিন্তু আর নয়। সবকিছুর একটা শেষ আছে। আমাদের গ্রুপটায় এখন পাঁচ হাজার সদস্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গ্রুপের শাখা প্রশাখা বিস্তারের কাজ চলছে। সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন পৃথিবীতে থাকবে শুধু নারী আর নারী। ভাবতে ভাবতে আমার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।
আর সেই আমার কিনা একটা পুরুষের সাথে আগামীকাল বিবাহ! হাউ কাম? ভাবতে ভাবতে কান্না পেয়ে গেল আমার।
আব্বা বলেছে,হয় তুই এই ছেলেকে বিয়ে করবি নাহয় আমি সুইসাইড করব।
বলতে ভুলে গেছি একমাত্র আমার আব্বা ছাড়া পৃথিবীর সব পুরুষ খারাপ,এরা এক একটা মিশা সওদাগর। আমার ভাই? সেতো একটা বদের হাড্ডি। ছেলেবেলায় আমার গায়ে তেলাপোকা ছেড়ে দিত।
প্রথম প্রথম ভয় পেতাম। একদিন চোখমুখ শক্ত করে ওর ছেড়ে দেওয়া তেলাপোকা ধরে ফেলে ওর সামনেই টিপে মেরে ফেললাম। ভাইয়া তেলাপোকার নাড়িভুঁড়ি দেখে আমারই গায়ের উপর বমি করে ফেলল। কী এক বীভৎস অবস্থা। সে যাক!
কথা হলো আগামীকাল আমার বিবাহ। আব্বার ছেলেবেলার বন্ধুর ছেলের সাথে। বাংলা সিনেমা মনে হচ্ছেনা?
আমার হতচ্ছাড়া ভাইটা ছোটবেলায় মেলায় হারিয়ে গেলে রীতিমত একটা বাংলা সিনেমা হিসেবে চালিয়ে দেয়া যেত। কবে থেকে আশায় আছি কোন একদিন আব্বা ওকে ডেকে বলবে, তুই আমার আপন ছেলে না। ছোটবেলায় তোকে ডাস্টবিন হতে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম! আহা সেদিন কী আর আসবে?
স্বীয় শয়নকক্ষের কাছাকাছি পৌঁছুতেই আমার ভাইয়ের সাথে দেখা। ফ্যাক ফ্যাক করে হেসে বলল,”তোকে জনি সিন্সের মত লাগছে। ”
নাহ আমি রাগিনি। খাম্বার সাথে কখনো রাগ করতে হয়না।
ভাইয়া আমাকে মেজাজ খারাপ করা কিছু বললেই ইদানীং আমি চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করি,সামনে দন্ডায়মান ব্যক্তিটি আসলে আমার ভাই না। সে একটা খাম্বা!
ওকে পাত্তা না দিয়ে ওর মুখের উপর ধড়াম করে দরজা লাগালাম। তারপর ল্যাপটপ কোলে নিয়ে আমি চিন্তামগ্ন হলাম।
বিয়েতে আমি বাধ্য হয়ে রাজি হয়েছি দুটো কারনে,এক.আব্বাকে আমি অনেক ভালবাসি,দুই. যে ছেমড়ার সাথে আমার বিবাহ ঠিক হয়েছে সে ঘোরতর নারী বিদ্বেষী। এর মাঝে গোপন ব্যাপার ক্লাস এইটে এই ছেলের সাথে আমি ক্রিকেট খেলেছিলাম। ক্রিকেট খেলতে যেয়ে কোন এক আশ্বিনের বিকেলে মেরে আমি ছেমড়ার নাক ফাটিয়ে দিয়েছিলাম। শুনেছি তারপর হতেই এই ছেলে জগতের কোন নারীকেই সহ্য করতে পারেনা। ছেলে পেশায় ডাক্তার। আমি আবার সাংবাদিক। এই নারী বিদ্বেষী ছেলেকে আমি বিবাহের পর কঠিন সাইজ করব। সাইজ করার ভিডিও আমার গ্রুপে আপলোড হবে। এই নারীবিদ্বেষী ছেলেরাই যুগে যুগে নারীদের নির্যাতন করে এসেছে। আমি ব্ল্যাকবেল্ট কমরেড শায়লা এদের সাইজ করার জন্য পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছি! জগতের বাকী নারীরা আমার কাছ হতে অনুপ্রেরণা পাবে। ভবিষ্যত নারী জাতির মুক্তি চিন্তায় আমার এই ক্ষুদ্র স্বামী বলিদান যুগ যুগ ব্যাপী স্মরিত হবে।
আজকের রাতে আমার আরেকটা মিশন আছে। মিশন বিয়ের জন্য কেনা পনের হাজার টাকা দামের শাড়িটা কাঁচি দিয়ে কুচিকুচি করে কাটা।
কাঁচি একটা জোগাড় হয়েছে। এই মুহূর্তে গ্রুপে বিপ্লব চলছে মেয়েরা কেন জিন্স টিশার্ট পরে বিবাহ করবেনা। কেন শাড়ি,গাউন পরতে হবে,অলংকার পড়ে, খোপায় ফুল দিয়ে জবড়জং পুতুল সাজতে হবে? বিপ্লবের অংশ হিসেবে মাথা ন্যাড়া করে এসেছি। এখন শাড়িটা কাটব। আমি আব্বার বিবাহের পাঞ্জাবীটা পড়ে বিবাহ করার প্ল্যান করছিলাম। আব্বা তাঁর বিয়ের পাঞ্জাবী পরিহিত ন্যাড়া মাথার আমাকে দেখলে স্ট্রোক করতে পারেন সেই টেনশনে আপাতত প্ল্যান বাদ দিয়েছি। টপস আর জিন্সই ভরসা এখন।
দেখা যাক কী হয় আগামীকাল।