এল_এ_ডেইস পর্ব ৩০

0
208

#এল_এ_ডেইস
পর্ব ৩০
লেখনী মাহীরা ফারহীন

সোনালি রোদের পরশে হলদেটে দেখাচ্ছে নরম সবুজ ঘাসগুলো। সম্পূর্ণ নদীর পাড়টুকুই ঘাসের চাদরে মোড়া। বাতাস বয়ে যাচ্ছে শনশন শব্দে। কার্ডিনাল পাখির সুরেলা গান থেমে গিয়েছে। এখন শুধু শোনা যায় ভিরি ও নাইটিংগেলের কিচিরমিচিরের শব্দ। এই বনে প্রচুর নাইটিংগেল পাখির বসবাস বোধহয়। প্রায়ই শোনা যায় তাদের কলরব। একটা গাছে হেলান দিয়ে হাতদুটো আড়াআড়ি ভাবে বুকে বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে রায়েদ। গম্ভীর মুখভঙ্গি। সেখান থেকে নদীর পাশ হতে সামনে বেশ কিছুদূর শুধু ঘাসে ঢাকা পাড় এবং এবং গাছপালা দেখা যায়। মাঝে অনেকেই ঘাসের ওপর বসে আছে। একটা গাছের নিচে হলদে রঙের কুর্তি পরা একটা মেয়ে বসে আছে। কাঁধ থেকে একটু লম্বা,ছাড়া চুলগুলোয় মুখটা প্রায় ঢেকেই আছে। ওদিকে দৃষ্টি পরতেই ভ্রু কুঁচকে গেল রায়েদের। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মাহীনের পানে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। ক্ষণেই এক রাশ অস্থিরতা জেঁকে বসল বুকে। ভাবছে, কি ব্যাপার আধাঘন্টাও তো হলো না মাহীনকে নৌকায় দেখলাম। এরই মাঝে কখন ফিরে আসল? আর ও এখন মুখ গোমড়া করে গাছের নিচে বসে আছে কেন? দেখে তো মনে হচ্ছে কি দুর্ঘটনাটাই না ঘটেছে ওর সাথে।’ ভাবতে ভাবতেই সন্তর্পণে এগিয়ে গেল সেদিকে। তবে কাছাকাছি পৌঁছতেই থেমে গেল। সামনে যাবে কি না তা নিয়ে বিভ্রান্তিতে পরে গেল। ও যে এখানে এগিয়ে আসতে গেল কেন তাও ঠিক ঠাহর হলো না। সামনে বসে থাকা মেয়েটার ওপর এক চাপা অভিমানের সৃষ্টি হয়েছে। তবে রায়েদের ভাবনার বিষয় হচ্ছে আদৌও কী মাহীনের ওপর অভিমান করার অধিকার ওর আছে?
হঠাৎ মাহীন মুখ তুলে সরাসরি ওর দিকেই চাইল। ও নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল যেন একটুও অবাক হয়নি রায়েদকে সামনেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। তবে মাহীন কিছুই বললো না। ওর দৃষ্টি একদম শান্ত স্রোত হীন পানির মতো। রায়েদও কিছুই না বলে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ওকে দেখছে। একটু একটু করে মাহীনের মুখে ব্যাথাতুর ভাব ফুটে উঠল। হঠাৎ ওকে দেখে এত কষ্ট পাওয়ার মতো কী হলো তা ঠিক বুঝতে পারলো না রায়েদ। ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকিয়ে থাকল। অবশেষে যেখানে ছিলো সেখান থেকে মুখ খুললো,’কী ব্যাপার তুমি এমন বিষন্ন ভাবে এখানে বসে আছো কেন?’

মাহীন নির্বিকার চিত্তে বলল,’বসো।’

রায়েদ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,’কী?’

‘বসো। এমন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলবা?’ বলল মাহীন। এবার রায়েদ এগিয়ে গিয়ে ওখানেই ওর পাশে বসল। মাহীন হঠাৎ করে প্রফুল্লিত হয়ে উঠল। ওর মনের আলো এমন ভাবে জ্বলে উঠল যেন খরায় কাঠ শুকনো জমিনে হঠাৎই ঝুপ করে বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে তার শীতল পরশে প্রাণ ফিরে পেলো জমিন। আগ্রহী কন্ঠে বলল, ‘এখনো হাতে সময় আছে। তুমি আমার সাথে বোটিং করতে যাবা?’
হঠাৎ এমন প্রস্তাবে রায়েদ অবাক হলো। একই সঙ্গে হতবাক। ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকিয়ে থেকে ভাবল, একটু আগেই না ও বিলের সঙ্গে বোটিং করতে গেল। তাহলে হলোটা কী? ও এত তাড়াতাড়ি ফিরেই বা আসলো কিভাবে? আর এখন আমার সাথেই বা যেতে চাচ্ছে কেন?’ ভাবতেই বলল,
‘কিন্তু তুমি তো কিছুক্ষণ পূর্বেই বিলের সঙ্গে গিয়েছিলা বোটিং এ।’
এই কথায় মাহীন কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো। বলল,
‘হ্যা গিয়েছিলাম। কিন্তু…রায়েদ মাঝখান দিয়ে বলল,
‘তাহলে এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসলা কেন?’
মাহীন ইতস্তত করে বলল, ‘উম কারণ আমার ঠিক ভালো লাগছিল না তখন। সে যাই হোক এই জন্যে আমার বোটিং ঠিকঠাক হয়ইনি। এবং আমি আবার যাবো।’
‘এবং আমার সাথেই কেন? তোমার ফ্রেন্ডরাও তো ছিলো?’
মাহীন শান্ত কন্ঠে বললো, ‘কারণ আমি তোমার সাথেই যেতে চাই। সকালে তুমি আমাকে সূর্যদয় দেখাতে পর্বত চূড়ায় নিয়ে গিয়েছো তাহলে আমি কী আমার সাথে নৌকায় ওঠার প্রস্তাব দিতে পারি না?’ বলে জুলজুল চোখে তাকাল। ওর চোখের দিকে সরাসরি তাকানোরও অনুমতি দিচ্ছে না হৃদয়। হৃদয় দ্রিমদ্রিম শব্দ করে দ্রুত গতিতে লাফাচ্ছে। হঠাৎ হৃয়ের অদ্ভুত হইচইয়ে বিচলিত হলো রায়েদ। বাধ্য হয়ে মাহীনের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বলল, ‘ওহ আচ্ছা এই তাহলে কারণ। কিন্তু তুমি আমাকে আগেই বলতে পারতে। দেরি হয়ে গেলো না এখন?’
মাহীন পানসে গলায় বলল, ‘ওফ আমি আগেই বলতাম। যদি না মাঝখান দিয়ে ঝামেলা হতো। তোমাকে তো ধারে কাছেই পাইনি। এনি ওয়েজ। বলো না যাবে না?’
রায়েদের মনে জমে থাকা চাপা অভিমানটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। মনেই হলো না সেটা কখনোও ছিলো। প্রসন্ন কন্ঠে বলল, ‘ঠিক আছে যাবো।’
মাহীন হঠাৎ আনন্দে এমন ভাবে লাফিয়ে উঠল, রায়েদ এক মুহূর্তের জন্য ভাবল ওকে বুঝি জড়িয়ে ধরল। তবে মাহীন এমন কিছুই না করে উঠে দাঁড়াল। রায়েদও উঠে দাঁড়াল। মাহীন বলল, ‘আচ্ছা তো একটা কথা বলার ছিলো। আমরা যেখানে যাবো সেটা হচ্ছে দক্ষিণ মাউমেল নদী ও উত্তর মাউমেল নদীর মিলন স্থল।’
রায়েদ চোখ বড় বড় করে তাকাল। অবাক কন্ঠে বলল,
‘ওখানে যে স্রোতের প্রবাহ বেশি সেটা আদৌ তুমি জানো?’
মাহীন বলল,’জানি। তবে আমরা ওই জায়গাটায় ঠিক যাবো না। তার পূর্বে দুইপাশে জঙ্গল ঘেরা যে সরু নালী মতো আছে সেখানে যাবো। ওখান থেকে তো নৌকা স্রোতের টানেও বেরিয়ে আসতে পারবে না।’
ওরা নৌকা বাঁধা স্থানটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রায়েদ জিজ্ঞেস করল,’তুমি রাস্তা জানো তো?’

মাহীন চোখ টিপে বলল,’নো টেনশন।’
নৌকাগুলোর কাছে পৌঁছে একটা নৌকা খুঁটি থেকে খুলে নিতে নিতে রায়েদ বলল, ‘আমি জানি না বাবা। আদৌ তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো। খুন করবা না তো?’
মাহীন হেসে বললো, ‘আহ আমার ডায়লগ নকল করা। আগেই শুনে রাখো আমি কিন্তু নৌকা বাইতে পারি না। তোমাকে খুন করলে আমি কিভাবে ফিরে আসব?’
রায়েদ আমুদে কন্ঠে বলল,’হুম যুক্তিসংগত কথা। তাহলে আমি নিরাপদ।’ এবার মাহীন প্রথমে নৌকায় উঠলো। ঢেউয়ের প্রবাহে নৌকা দুলছে বলে মাহীন টলতে লাগল। রায়েদ ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বসতে সাহায্য করল। এরপর নিজে নৌকায় উঠে বসলো এবং বৈঠা হাতে নিলো। বৈঠা পানিতে নামিয়ে ঢাক্কা দিলো। প্রবল বেগে বাতাস হচ্ছে। ওরা বাম দিকে ঢেউয়ের বিপরীতে এগিয়ে চলেছে। মাথার ওপরের গাছের সবুজ ছাউনির সঙ্গে নদীর সেদ্ধ জলপাই রঙা পানি মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। রায়েদ বৈঠা চালাতে চালাতে বলল,
‘তুমি যেখানে যেতে চাচ্ছো সেই জায়গা এবং ওখানকার গতিপথ সম্পর্কে কিভাবে জানলে?’
মাহীন প্রসন্ন মনে নদীর পানিতে এক হাত ডুবিয়ে রেখেছে। শীতল পানি তিরতির করে হাত ছুঁয়ে গিয়ে শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। পানির দিক থেকে দৃষ্টি না ফিরিয়েই বলল,’মি.ববোফিট বলেছেন।’

‘আর যদি তুমি ভুলে যাও?’

‘আমার এখন পর্যন্ত মনে আছে। আর যদিও আমি ভুলে যাই তাহলেও আমার প্ল্যান চেরনোবিল রেডি আছে।’

‘আর প্ল্যান চেরনোবিল টা কী?’
মাহীন এবার মুখ তুলে চাইল। হেসে বলল,’আমি ওনার কথাগুলোই রেকর্ড করে এনেছি।’

রায়েদ অবাক হয়ে হেসে বলল, ‘অবিশ্বাস্য।’ তারপর মাহীন আবারও পানিতে হাত ভেজাতে মনোযোগ দিল। বাতাসে ওর চুল উড়ে বার বার মুখের ওপর এসে পরছে। রায়েদ জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা তোমার মধ্যে কী এমন কোনো ব্যাপার আছে যেটা তুমি নিজেই পছন্দ করো না?’ মাহীন মুখ তুলে চাইল। ওর কপালে চিন্তার ছাপ করল। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল,’হুম আছে। আমার ট্রাস্ট ইস্যু আছে। এটাই আমি পছন্দ করি না।’
‘যেমন?’

মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
‘যেমন সবার সাথে সহজে বন্ধুত্ব হয় তো ঠিকই কিন্তু তাদের খুব কমজনকেই আমি আসলে বিশ্বাস করতে পারি। এইজন্যেই তো সহজে কোনো বিষয়ে কারো কাছে মুখ খুলি না।’
রায়েদ সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। এবং বলল,’আর আমি?’

‘তুমি কী?’

‘বলছি আমাকেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়?’
মাহীন স্মিথ হাসল। বলল, ‘আমি যে নৌকা চালাতে পারি না সেটা তোমাকে জানিয়ে দিয়ে এই খরস্রোতা নদীতে আমার জীবনের পুরো নিরাপত্তার দায়িত্ব তোমাকে দিয়ে এসেছি। আর কিছু বলার আছে?’
রায়েদ মুচকি হেসে না সূচক মাথা নাড়ল। মাহীনের মনে রায়েদের জায়গাটা কতটা বিশেষ সে সম্পর্কে আরোও পাকাপোক্ত ধারণা হলো ওর। মনে হলো এর চাইতে ভালো কিছু বোধহয় অনেক কাল ধরে শোনা হয় না।
মাহীন পথ বাতলে দিচ্ছে এবং রায়েদ সে অনুযায়ী নৌকা বাইছে। আকাশের ক্যানভাসের রঙ পাল্টেছে। সারা আকাশ জুড়ে কমলা, গোলাপি বা বেগুনির মাখামাখি। সূর্য ডোবার প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়েছে। সবুজাভ জলের ভেতরও অনেক গাছের গোড়া ডুবে রয়েছে। মাথার ওপর খোলা আকাশ নয় বরং ডালপালায় ছাওয়া ছাউনি চোখে পরে। নদীর পানি থেকে আরম্ভ করে সবকিছুই সবুজ তার ওপর সোনালী রোদ পরে হিরের মতো চিকচিক করে উঠছে। মাহীন পানিতে হাত ডুবিয়েই রেখেছে। হঠাৎ পানি থেকে হাত উঠিয়ে রায়েদের দিকে পানি ছিটা দিলো। রায়েদ মুখ কুঁচকে ফেললো। হাসতে হাসতে তীব্রভাবে বলল, ‘মাহীন!’
মাহীন হাসতে হাসতে আবার পানি ছিটা দিলো। রায়েদ হাত দিয়ে মুখ ঢাকল। তারপর হাসতে হাসতে বলল,
‘মাহীন এসব কী? দেখো আমি কিন্তু তোমার ওপর পানি ছিটাচ্ছি না।’
মাহীন ফিচেল হাসি মুখে বললো, ‘তো ছিটাও।’

রায়েদ বলল,’আমার হাতে বৈঠা আছে না। একটা বৈঠা ধরো তারপর দেখো তোমাকে পুরোই ভিজিয়ে দিচ্ছি।’

মাহীন বলল,’না, না থাক। ঠিক আছে আর পানি ছিটাবো না।’

আরো দশ মিনিট পর ওদের নৌকা একটা সরু নালির সামনে এসে থামল। বা ভেসে রইল। সামনে দুপাশের বনের মাঝ দিয়ে সরু নালিটা চলে গিয়েছে। নৌকা তার মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করে নিরদ্বিধায় চলতে পারবে। সেখানেই ওদের নৌকা প্রবেশ করল। বিনা বৈঠার সাহায্যেও স্রোতের টানে নৌকা সামনে এগিয়ে চলেছে। তবে ঠিক নালির শেষ মাথায় এসে আটকে গেল। এখান থেকে সামনে অনেক দূর পর্যন্ত শুধুই পানি এবং পানি চোখে পরে। কোথাও কোনো জঙ্গলের চিহ্ন মাত্র নেই। নদীটি দুই দিক থেকে এখানে এসে মিলিত হওয়ায় প্রবল স্রোত পানিতে। নালির বাইরে নৌকা বের হবে না বলে রক্ষা। যদি এই স্রোতের মধ্যে নৌকা সেখানে পৌঁছে যায় তাহলে তা স্রোতের টানে যে কোথায় পৌঁছে যাবে তার কোনো ঠিক নেই। দূর দিগন্তে নদীর বুকে লাল টকটকে সূর্য ডুবে যাবে বলে নিচে নেমে এসেছে। আকাশের একাংশ রক্তিম আভাময়। সূর্যদয়ের সময় সূর্য সোনার মতো সোনালি কীরণ বিচ্ছুরণ করে যেমন উদিত হয় তেমনি একদম রক্ত বর্ণ ধারণ করে লালচে মরা আলো ছড়িয়ে দিতে দিতে কোথাও হারিয়ে যায়। সূর্যের কমলাটে আলো ওদের নৌকায় এসে পরেছে। গায়ে সোনাবরণ রোদের আলো মেখে মাহীনের কালো চোখের মণিকে হালকা বাদামি এবং কালো চুলগুলোকে বাদামি মনে হচ্ছে। শ্যামবর্ণের মিষ্টি চেহারার মেয়েটাকেও কী অদ্ভুত স্বর্গীয় সুন্দর লাগছে। রায়েদ আবিষ্ট নয়নে তাকিয়ে আছে মাহীনের পানে।
বলল, ‘তো আমাকে সূর্যদয় দেখানোটাই তোমার আসল পরিকল্পনা ছিলো তাই না?’
মাহীন হাসল। বলল,’ঠিক তাই।’
দুইজনের মুখেই মিটিমিটি হাসি।
রায়েদ বলল,’সূর্যাস্ত বা সূর্যদয় দুটোরই আলাদা আলাদা অপার্থিব সৌন্দর্য রয়েছে।’
মাহীন প্রসন্ন হেসে বলল,’কি মজার ব্যাপার না আজকের সূর্যের উদয় হওয়াটাও আমরা দুজন একসাথে দেখেছি এবং সূর্যের ডুবে যাওয়টাও একসাথেই দেখছি।’
‘সত্যিই দুর্লভ ঘটনা।’ মুচকি হেসে বলল রায়েদ।
রায়েদ দৃষ্টি ফিরিয়ে দূরের দিগন্তের দিকে তাকাল।
হিরা আকৃতির গঠনের রায়েদের ফরসা মুখখানা স্নিগ্ধতায় ভরে আছে। এই সুন্দর মুখের দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আছে মাহীন। ভাবছে,
‘আহা এই সুন্দর মূহুর্তটা আসলে আমাদের ভাগ্যেই ছিলো। মাঝে যতই ঝামেলা হোক না কেন। তবে আজ বুঝলাম তুমি দেখি আমার জন্যে জেলাস ফিলও করো। যাক আজ এই ঘটনা না ঘটলে জানা হতো না।’
.
.
.
.
বড় বড় পাহাড় সমান ধূসর মেঘ জমেছে আকাশে। সকাল থেকে সূর্যের মুখদর্শন হয়নি একবারও।কিছুক্ষণ পর পর বিকট শব্দে আকাশ চীরে বিদ্যুৎ চমকে উঠছে। সকলেই উদ্বিগ্ন বৃষ্টি আসা নিয়ে। সকলের মাঝেই ছোটাছুটির হিড়িক পরেছে। যে যার যার মতো তাবুগুলো খুলে গুটিয়ে ফেলছে এবং এক জায়গায় একত্র করছে। বড় বড় টেবিলগুলোও মোড়াতে ব্যস্ত টিচার এবং ছাত্র-ছাত্রীরা। সকলেই একটি বিষয় নিয়ে অবাক তা হলো আজই সকলে প্রস্থান করছে এবং এই সময়েই বৃষ্টি আসছে। যেকোনো সময় কালো মেঘগুলো ভার বহন না করতে পেরে একজোড়ে বর্ষণ আরম্ভ করবে। পোর্টেবল চুলাগুলো পূর্বেই বাসে নিয়ে তুলে ফেলা হয়েছে। কিছুক্ষণ পরপর আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে সাথে সাথে সকলকেই চমকে দিচ্ছে। সকলে এটা ওটা ব্যস্ত হয়ে গোছাচ্ছে এবং বারংবার আকাশের পানে চাইছে। মাহীনদের তাঁবুগুলো গোছানো হয়ে গিয়েছে। ওরা সকলে অন্যান্য কাজে সাহায্য করছে। র‌াবিত নিজের সাউন্ড বক্সটা আবার চালাতে চেয়েছিল। তবে সেটা আনপ্যাক করে সেটাপ করার আর সময় পায়নি ও। সবই ঠিক ভাবেই চলছে তবে ওদের মনে হচ্ছে এখনো কিছু একটা বাঁকা ভাবে চলছে। আর তা হলো এসিসিয়া এখনো ওদের সাথে সাথেই লেগে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাঁবু গুটানো থেকে আরম্ভ করে সবকিছুতেই সাহায্য করছে। সাইলোহ ভিন্ন বাকি সকলের সঙ্গে মোটামুটি ওর ভালোই সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। রায়েদকে বেশ কয়েকবার নায়েলের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেল। মাহীন নিশ্চিত অন্তত নায়েলের সঙ্গে রায়েদের বন্ধুত্বটা পাকাপাকি ভাবে হয়েছে। যদিও নায়েল নিজেই এই নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। এখন প্রায় বিকেল সাড়ে চারটা বাজে। সকাল থেকে আকাশের মেঘলা মুখ হলেও বৃষ্টি হওয়ার আয়োজন হতে হতে বেলা বেড়েছে। আরো কিছুক্ষণের মধ্যেই সকলে সারি বেঁধে বড় বড় জিনিসপত্রগুলো নিয়ে সেই বড় গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল। জায়গাটা ত্যাগ করার পূর্বে মাহীন বেশ কিছুক্ষণ মাঠের চারিদিকে চক্কর কাটলো। মাত্র তিনদিনেই জায়গা খুব আপন হয়ে উঠেছিল। এই জায়গায় হয়তো আরোও ছেলেমেয়েরা আসবে, আরোও পর্যটকরা আসবে তবে ওদের স্মৃতিগুলো ওদের কাছেই রয়ে যাবে। গত তিনদিনের চব্বিশটা ঘন্টায় এখানেই গল্প করেছে, হইচই করেছে, রান্নাবান্না করে, ঘুমিয়েছে, হেঁটে বেরিয়েছে আরো কত কী। আসার সময় যতটা উদ্যমতা ছিলো সকলের মাঝে যাওয়ার সময় ততটাই বিষন্নতা। অবশেষে সকলেই একসময় বেরিয়ে গেল বাইরে। মস্ত বড় মাঠ ফাঁকা হয়ে গেল। জমে থাকা মেঘের ছায়ায় অন্ধকার পরিবেশে জায়গাটা আরোও নিরব, নির্জন, ও নিষ্প্রাণ হয়ে গেল যেন। বেশ কিছুক্ষণ পূর্বেও যেখানটা গমগম করছিল এখন সেখানে গিয়ে কেউ দাঁড়ালে গায়ে কাটা দিয়ে উঠবে। শন শন শব্দে প্রবল বেগে বাতাস গাছপালা দুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। বাস পর্যন্ত পৌছুতে লম্বা রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতেই ঝমঝম করে শুরু হলো বৃষ্টি। সকলেই তাড়াহুড়ো করে দৌড়াতে শুরু করলো। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কোনো রকমে সকলেই ছুটতে ছুটতে বাস অব্দি এসে পৌছলো। এবার বাসে উঠতে চরম ঠেলাঠেলি বাঁধল। টিচারদের ধমক খাওয়া পর অবশেষে সকলে বাসে উঠতে সক্ষম হলো। বাসে উঠার পরও টিচাররা সকল ছাত্রছাত্রীই বাসে উঠেছে কিনা সেটা নিশ্চিত করলেন। গতবারের মতোই মাহীন সহ বাকিরা পেছনের দিকেই গিয়ে বসেছে। বাসের জানালাগুলো সব বন্ধ। বন্ধ জানালায় বৃষ্টির ছটা এসে পরছে এবং কাঁচ ঝাপসা করে দিচ্ছে। বাসের মধ্যে লাইটগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাবিত অনেক ছলেবলে কৌশলে ক্যারোটের পাশের সিটটা দখল করেছে। রায়েদের পাশের সিটটা খালি ছিলো বলে সেখানে নায়েল গিয়ে বসেছে। মাহীন সাইলোর সঙ্গে। জেনেট ও লিও একসাথে বসেছে। এবং সকলকে আরেকদফা চমক দিয়ে এসিসিয়া নিজের বান্ধবীদের ছেড়ে এখানেও লিম জুর পাশে পেছনেই বসেছে। যেখানে বিল সহ ওর বাকি বন্ধুরা সামনের দিকে রয়েছে। সকলের সন্দেহ হতে শুরু করেছে স্কুলের পৌঁছনোর পরও আদৌও কী এসিসিয়া ওদের পিছু ছাড়বে?

ইনশাআল্লাহ চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here