দি সুইসাইড ব্যুথ,পর্ব : ৪

0
249

দি সুইসাইড ব্যুথ,পর্ব : ৪
তামান্না জেনিফার

মর্জিনা বুয়া রিমশার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে ৷ ভয়ার্ত গলায় মর্জিনা রিমশাকে বললো

—আপা , লন ঘরে যাই

—তুই কিভাবে বুঝিস আমার সবকিছু বলতো ?

—আপা , ঘরে গিয়া কতা কমু চলেন

—ভয় পাচ্ছিস কেন ? আরে আমি লাফ দিবো না

—আপা , লন ঘরে যাই …

—ঠিক আছে বাবা , চল ..

রিমশা মর্জিনার সাথে ঘরে চলে যায় ৷ রিমশা বিছানায় হেলান দিয়ে শুলো ৷ চোখটা বন্ধ করে রিমশা ৷ ওর আজ খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে ৷ মর্জিনার সাথে কথা বলা খানিকটা দেয়ালের সাথে বলার মতো ৷ চুপচাপ শুনবে , কিন্তু কোন উত্তর দিবে না ৷ কোন উত্তরই দিবে না ! সে শুধু একটা কাজই ভালোমতো পারে ছায়ার মতো রিমশাকে ফলো করতে ৷ রিমশা চোখ মেলে তাকালো , মর্জিনা সেখানে নেই ৷ সে মর্জিনা বলে ডাক দিতেই মর্জিনা চলে এলো সাথে সাথেই ৷ হাতে এক কাপ কড়া লিকারের চা….

রিমশা চা হাতে নিলো ৷ হাতে নিয়ে বললো

—মর্জিনা , বাবা তোকে বলেছে সারাক্ষন আমাকে ফলো করতে ?

মর্জিনা চুপ করে রইলো ৷ রিমশার বাবা তাকে এই দায়িত্ব দেয়নি ৷ কিছুই বলেনি ৷ কিন্তু গতবারের ঘটনার পর মর্জিনা নিজেই এ দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছে ৷ সেবার মর্জিনা যদি একটু সচেতন হতো তাহলে বোধহয় এমনটা হতো না !

—কি রে মর্জিনা , চুপ করে আছিস কেন ? বল ! বাবা বলেছে তোকে আমাকে ফলো করতে ?

—জে না আপা

—সত্যি করে বল ! বাবা যদি এমনটা বলে আমার কিন্তু ভালোই লাগবে , মনে হবে মানুষটা অন্তত আমার কথা ভাবছে ..

—বাপের কাছে মাইয়্যার লাহান আপন কেউ হয় না আপা..ছারে আপনারে অনেক ভালোবাসে , তয় দেহায় না..

—হা হা হা ! মর্জিনা , তোকে যে বিক্রি করে দিয়েছিলো বারো বছর বয়সে সে তোর বাবাই ছিলো তাই না .. বাবা হলেই ভালো হবে , মেয়েকে ভালোবাসবে এ ধরনের চিন্তা করাটা হচ্ছে বুলশিট বুচ্ছিস ! মানে বাজে কথা…

—অভাবের জন্যি এমুন করছিলো ৷ আমার আরো ভাই বোন আছিলো , নদী ভাইঙা সব গেছিলো গাঙের জলে … এতগুলা মানুষের বাঁচনের আশায় আমারে বেঁইচা দিছিলো..

—তার উপর তোর রাগ নাই ? এভাবে বলছিস অভাবের জন্য বিক্রি করেছে .. সত্যিই কি রাগ নাই ?

—না আপা … আমি তো ভালাই আছি ৷ খাওনের কষ্ট নাই , পেন্দনের কাপড়ের কষ্ট নাই … রাগ রাইখা কি হইবো , নিজেরটা খালি বুঝলে হইবো ! তাগো কষ্টও বোঝন লাগে আপা …

—তুই ভালো আছিস , কারন তোকে যে কিনেছিলো সে তোকে ব্রোথেলে না বিক্রি করে আমার বাবার কাছে বিক্রি করেছে ! ব্রোথেল বুঝিস ? নষ্ট মেয়েদের আখরা .. তোর কপাল ভালো বুচ্ছিস ! আর কিছু না ..

—কপাল যদি ভালোই তাইলে আর রাগ রাইখা লাভ কি কন !

—যাক , তোর সাথে এসব কথা বলা অর্থহীন.. তারপরও বুঝলি মর্জিনা , তোর বাবা আমার বাবার চেয়ে ভালো ৷ তোর বাবা তোকে বিক্রি করে দিয়েছে টাকার কাছে , আর আমার বাবা আমাকে বিক্রি দিয়েছে সময়ের কাছে …

মা মারা যাবার পর আমার কথা বলার মানুষটাও আর থাকলো না ৷ কখনো কোন বন্ধু বানাতে পারিনি , সবসময় নিজেকে সংকীর্ন লাগতো ! আমি তো শুধু বাবার কাছে সময়ই চেয়েছি , বাবা কি এটুকুও আমাকে কখনো দিয়েছে !

তুই আর আমি তো একসাথেই বেড়ে উঠলাম এই বাড়িতে ! কখনো দেখেছিস বাবাকে আমার মাথায় একটু হাত রাখতে ! আমার যখন জ্বর হতো , আমি জ্বরের ঘোরে কাঁপতাম ৷ সুনিতা আন্টিকে জড়িয়ে ধরে আমি বাবাকে খুঁজতাম .. বাবা হয় বিদেশে থাকতো না হয় অফিসে ! আমার পাশে ছিলো না কখনো .. সুনিতা আন্টি আমাকে মায়ের মতো ভালোবাসতো জানিস , তোকেও অনেক ভালোবাসতো তোর মনে নেই ? সেই আন্টিও একদিন আসা বন্ধ করে দিলো , দিনের দিনের দিন আমি আন্টির জন্য অপেক্ষা করেছি .. অনেকদিন পর জানলাম আমাদের বাড়ির চাকরিটা আন্টি ছেড়ে দিয়েছে ৷ কেন ছেড়ে দিলো চাকরিটা বলতে পারিস ?

আজ আমি বাবার কাছে গিয়ে বসলাম ৷ বাবা যদি শুধু একবার জিজ্ঞেস করতো , রিমশা মা ভালো আছো ! আমি কতটা খুশি হতাম তোকে বোঝাতে পারবো না … কিন্তু বাবা একবারও বললো নারে মর্জিনা ৷ আমার বাবা একটাবারও বললো না..

—আপা , মাইয়্যা মানুষের ধৈয্য ধরন লাগে অনেক.. ছারে মানুষ খারাপ না ৷ তয় কামের চাপ বেশি জন্যি আপনার লগে গফসফ করতে পারে না ৷ এইগুলান মনে নিয়া মন ভারি কইরা রাখলে চলবো ! এরচে বিরাট বিরাট কষ্ট নিয়া মানুষে হাসি মুখে বাঁইচ্যা থাকে গো আপা.. ধৈয্যের গুণ বড় গুণ

—ধৈর্য্য ! হা হা হা ! হুম ভালো বলছিস … হা হা হা !

********

একটা কেস সল্ভ করার আগে আমি অন্য কেস নিতে চাই না ৷ মনোযোগ ডাইভার্ট হয়ে যায় ৷ কিন্তু মারিয়া আফরোজ আমার সাথে আর যোগাযোগ করছে না ! হয়তো টাকাটা এখনো জোগার করতে পারেনি ৷ তাকে অনলাইনে দেখি , কিন্তু সে আমাকে নক দেয় না … চিন্তা হচ্ছিলো , ভাবলাম সব ঠিক আছে তো ! নিজে থেকেই তাই হ্যালো বললাম ৷ আমার হ্যালোর জবাবে তিনি লিখলেন , আর কটা দিন সময় লাগবে .. আমি আর কথা বাড়ালাম না , উনিও আর কোন কিছু বললেন না ৷ যাক , আমি নিশ্চিন্ত হলাম কিছুটা ৷ উনি ভালো আছে এটুকুই যথেষ্ট , টাকা জোগারের চেষ্টায় আছে ৷ থাকুক !

আজ আমি পেন্ডিং ম্যাসেজগুলো চেক করতে বসলাম ৷ তিনটে নতুন ম্যাসেজ ! এত মানুষ মরতে চায় ! কেন ! মৃত্যুই কি তবে জগতের সব সমস্যার সমাধান ? এই যে আমার সুমা এই মৃত্যুকে সমাধান ভেবে যে চলে গেলো , ও কি জানে ওর চলে যাবার পর আমরা কেমন আছি ! আমার মা সুমা চলে যাবার পর থেকে একবারও হাসেনি ৷ মায়ের কথা ভাবলে অবাক হই ৷ আট বছর বয়সী দুটো জমজ মেয়ে রেখে বাবা মারা গেলেন ৷ এরপর মা ঐ স্কুলে চাকরি করেই আমাদের বোনদুটোকে বড় করলেন ৷ বাবা যখন মারা যায় তখন মায়ের আর কতই বা বয়স ছিলো ! কিন্তু তারপরও উনি একটাবারও নিজের কথা ভাবেনি ৷ দ্বিতীয়বার সংসার করেননি ৷ শুধু আমাদের জন্য নিজের জীবনটা উৎসর্গ করে দিয়ে গেলো ৷ অথচ বিনিময়ে তার একটা মেয়ে তার মুখ থেকে হাসি কেড়ে নিয়ে চলে গেলো সারাজীবনের জন্য ৷ মানুষটা বেঁচে আছে ঠিকই , কিন্তু এই বেঁচে থাকাকে ঠিক বেঁচে থাকা বলে কি না আমি জানি না .. বাবার মৃত্যুও মা কে এতটা ভেঙে চুরে দেয়নি যতটা দিয়েছে সুমার মৃত্যু ৷ বাবার মৃত্যুটা ছিলো সহজ স্বাভাবিক ৷ অসুস্থ হয়েছিলেন , দীর্ঘদিন রোগে ভুগেছেন , তারপর মারা গেছেন ৷ সুমার মৃত্যুটা অস্বাভাবিক ৷ সুমার বয়স ছিলো একুশ … রোগ ছিলো না , জরা ছিলো না .. শুধু ছিলো হয়তো বুক ভর্তি গোপন অভিমান ৷ আমি জানি না সে অভিমানের কারন , জানে না মা ও ..

বসার ঘরে ছবিটা এখনো আগের মতোই টাঙানো আছে ৷ মা ঐ ছবি খুলতে দেয় না ৷ ছবিতে আমার বেনী ধরে টানছে সুমা .. আমি চিৎকার করছি আর সুমা খিলখিল করে হাসছে .. আমাদের দুজনেরই বয় তখন পনেরো ..

আমাদের দুই বোনের সম্পর্ক ছিলো বন্ধুর মতো ৷ আমরা কত রাত গল্প করে পার করেছি , অথচ এত গল্পেও আঁচ করতে পারিনি কি চলছে আমার সুমার বুকের গহীনে ..

মানুষ কষ্ট লুকানোর অভিনয় সবচেয়ে ভালো পারে ৷ একজন মানুষ সহজ স্বাভাবিক ভাবে আপনার সামনে হেঁটে বেড়াবে , আপনি বুঝতেও পারবেন না সেই মানুষটার হৃদয়ে কোন ঝড় তুফান চলছে … অভিনয় ! সবই অভিনয় ! এই অভিনয় না জানলে যে সমাজে মান থাকে না , পরিবারে মুখ থাকে না ৷ যে যত ভালো অভিনয় করতে পারবে মানুষ তাকে তত বেশি সুখী ভাববে ৷ আচ্ছা , কেউ যদি কষ্টে থাকে তাহলে তা প্রকাশ করতে দোষ কি ! কেন করতে হবে এই লোক দেখানো মিথ্যা অভিনয় ! অন্য কারো কাছে না হোক আপন মানুষগুলোকে তো বলাই যায় ! আমি কি সুমার আপন ছিলাম না ? কেন সুমা আমাকে তার কষ্টের কথা বলেনি ? ভালোবাসা আর বন্ধনের চেয়েও কি তবে দ্বিধার শক্তি বেশি ?

প্রথম ম্যাসেজটা ওপেন করলাম ৷ আইডির নাম স্বপ্নতারা .. ফেক আইডি বোঝাই যাচ্ছে ৷ ফেক আইডি থেকে আসা কেস এর আগেও সল্ভ করেছি ৷ এটা আমার জন্য ব্যাপার না ৷ আইডির নাম যাই হোক , হোক সে পুরুষ বা নারী , আমার কাছে সবারই একটাই পরিচয় ..তারা সবাই সুমা .. আমার সুমা..

স্বপ্নতারা লিখেছে ” সুইসাইড ব্যুথ কেনার হয়তো আমার হয়ে উঠবে না আঁধার ৷ তবে আপনাকে আমার গল্পটা শোনাতে ইচ্ছে হলো ৷ আপনি শুনে শুধু বলবেন আমি যদি আত্মহত্যা করি কারনটা কি যৌক্তিক হবে নাকি অযৌক্তিক ! এর কি কোন সমাধান সম্ভব নাকি সম্ভব নয় ! … ব্যুথ না কিনে যদি আমি গল্পটা বলতে চাই আপনি কি শুনবেন ? ”

আমি লিখলাম “অবশ্যই শুনবো , আপনি বলুন ”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here