দি সুইসাইড ব্যুথ,পর্ব : ৫
তামান্না জেনিফার
“আমার আইডি নাম দেখে আপনি হয়তো ভাবছেন আমি হয়তো একটা মেয়ে ৷ আসলে এটা আমার ছোটবোনের আইডি ৷ ওর নাম স্বপ্নতারা ৷ ওর আবার ফেসবুকের নেশা নেই ৷ আমিই মাঝে মাঝে ওর আইডিতে ঢুকি ৷ সমস্যাটা শুরু হয় এই আইডি নিয়েই ৷ আসলে সমস্যা শুরু হয় ব্যাপারটা তা নয় , সমস্যাটা আমি নিজে নিজেই তৈরি করেছি ৷
আমার নাম ফয়সাল ৷ অনার্স শেষ করে মাস্টার্সে ভর্তির অপেক্ষা করছি ৷ যাই হোক , আপনার বেশি সময় নিবো না ৷ প্রসঙ্গে আসি ৷ আমার বোন নিজের ছবি প্রফাইলে দিতে পছন্দ করে না ৷ ইন্টারনেট থেকেই ডাউনলোড করে একজন নায়িকার ছবি দিয়েছিলো প্রফাইলে ৷ মালায়ালাম মুভির নায়িকা ৷ ও যেহেতু ফেসবুকে ঢোকে না , আর আমিই মেইনলি ওর আইডি চালাই খেলাচ্ছ্বলেই সমস্যার শুরুটা আমি করে ফেললাম ৷
মেয়েদের আইডিতে বিভিন্ন ছেলেরা নানান সময়ে নানা রকম নোংরা ম্যাসেজ দেয় ৷ আদার ম্যাসেজবক্স ওপেন করলে বোঝা যায় মানুষের মনের নোংরামির কোন সীমা পরিসীমা নাই ৷ আমার বোনের আইডিতেও এমন ছেলেদের ম্যাসেজ আসতো ৷ নিজেদের বিশেষ অংগের ছবি পাঠাতো ইনবক্সে ৷ আমি কড়াভাষায় রিপ্লাই দিয়ে সেই আইডিগুলোকে ব্লক করে দিতাম ৷ এসবেও কোন সমস্যা ছিলো না ৷
একদিন একটা ম্যাসেজ আসলো তপন কুমার নামের একটা আইডি থেকে ৷ খুব সুন্দর করে ভদ্রভাষার ম্যাসেজ ৷ আমি নোংরা ম্যাসেজ দেখে দেখে এতটাই বিরক্ত ছিলাম , আমার উনার ম্যাসেজ খুব ভালো লাগলো ৷ আমি খুব স্বাভাবিকভাবে রিপ্লাই দিলাম ৷ তবে ফোনের ওপারের মানুষটা জানলো না আমি একজন ছেলে ….
তপন প্রতিদিন ম্যাসেজ দিতো ৷ দারুণ সব কবিতা লিখে পাঠাতো ৷ ওর কবিতা আমার ভালো লাগতো ৷ আমি নিয়মিত কথা বলে যেতে লাগলাম ৷ একসময় অবাক হয়ে দেখলাম আমি তপনের সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছি.. আমি ভীষণ ভালো লাগা নিয়ে অপেক্ষা করছি …
আস্তে আস্তে আমাদের কথা বলা বাড়লো ৷ সারা রাত আমরা কথা বলতাম ৷ আমার পরীক্ষা থাকলে ও আমার সাথে জাগতো ৷ আমি অসুস্থ হলে ও আমাকে ওষুধ খাবার কথা মনে করিয়ে দিতো ৷ আমি দিনে দিনে ওর উপর নির্ভর হয়ে পড়তে লাগলাম ৷
আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন আঁধার ? অবশ্য বিরক্ত হবার মতোই কথা বলছি আমি ৷ আর বেশিক্ষন নিব না আপনার …
তারপর যা হবার সেটাই হলো ৷ তপন আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলো ৷ ও যেহেতু হিন্দু আর আমি মুসলিম ও নিজ থেকেই বললো ও ধর্ম পরিবর্তন করবে ৷ প্রেম না , সরাসরি বিয়েই করতে চায় আমাকে …
আমি দ্বিধায় পরে গেলাম ! আমি তপনকে কি বলবো ! হিন্দু মুসলিম সমস্যা না , সমস্যা তো অন্যখানে ৷ আমি একজন পুরুষ … ঠিক একই ভাবে তপনও একজন পুরুষ ৷ তপনের কাছে আমি নারী হলেও আমি তো নারী নই !
প্রচন্ড দ্বিধা নিয়ে দিন কাটাতে লাগলাম ৷ আমি তপনের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলাম… ও আমাকে পাগলের মতো নক দিতো ৷ আমার সাথে কথা বলার জন্য ও পাগল হয়ে ছিলো ৷ আমার অসহায় লাগতো ৷
নিজের সাথে যুদ্ধ করে আর পারলাম না ৷ সত্যিটা বলে দিলাম অবশেষে ৷ বললাম , তপন আমি একজন ছেলে …ও বিশ্বাস করতে চাইলো না ৷ ও ভাবলো আমি ওকে বিয়ে করবো না জন্য মিথ্যা কথা বলছি …
আমি অবশেষে ওর সাথে দেখা করতে চাইলাম ৷ ওর কান্না আমার সহ্য হচ্ছিলো না ৷ আমিও কাঁদছিলাম , কেন কাঁদছিলাম জানি না..আমিও বোধহয় ভালোবেসে ফেলেছিলাম তপনকে ! বোধহয় না , আমি সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিলাম তপনকে ৷ একটা ছেলে হয়েও আমি আরেকটা ছেলেকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম … হয়তো এখনও বাসি ..
আমি তপনের সাথে দেখা করলাম ৷ ও অবাক হয়ে দেখলো আমাকে .. ঘৃনাভরে দেখলো আমাকে …কোন কথাই বললো না ! শুধু যাবার আগে একদলা থুথু দিয়ে গেলো আমার গায়ে ..
এ ঘটণার ছয়মাস হয়ে গেছে ৷ এই ছয়মাসে আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি পুরো ঘটণাটা ভুলে যেতে , পারিনি ৷ আমি এখনও ফেক আইডি দিয়ে তপনের আইডি ফলো করি ৷ ওকে দেখি ৷
আমি চেষ্টা করেছিলাম কোন মেয়ের সাথে যেন সম্পর্কে জড়াতে পারি ৷ সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক … আমি পারিনি … কোন মেয়ের প্রতি আমার সেই অনুভূতিটা জন্মে না ..
তপন কিন্তু আমাকে মনে রাখেনি ৷ ও বিয়ে করেছে গত তিনদিন আগে ৷ একদম হিন্দুরীতিতে খুব ধুমধাম করে এক রূপসী কন্যাকে বিয়ে করেছে .. বিয়ের ছবিতে তপনের হাসিমুখ আমার বুকে শূলের মতো বিঁধেছে আঁধার ..
আমি জানি ভুলটা আমার ৷ আমিই প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাবার চেষ্টা করেছি , মিথ্যা বলেছি .. আমি শাস্তি পাবো এটাই স্বাভাবিক ! কিন্তু শাস্তির এই বোঝাটা আমি আর টানতে পারছি না ৷ তপনের বিয়ের আগ পর্যন্ত কষ্টটা ভিন্ন ছিল , কিন্তু এখনকার কষ্টটা ভিন্ন ৷ আমি চোখ বন্ধ করতে পারি না , চোখ বন্ধ করলেই দেখি তপন ওর বউয়ের সাথে …….
আমি আর পারছি না আঁধার ! মৃত্যু মনে হয় সবচেয়ে সহজ সমাধান … আমাকে ঘৃনা করবেন না আমাকে আঁধার , খুব সাহস সঞ্চয় করে প্রথমবার এই কথাগুলো আমি কাউকে বললাম ….”
ফয়সালের ম্যাসেজ পরে আমি খানিকক্ষন চুপ করে থাকলাম ৷ কি বলা উচিত আসলে বুঝতে পারছি না .. একটা ছেলে আরেকটা ছেলেকে কিভাবে ভালোবাসে আমার মাথায় ঢুকছে না ৷ আমি রিপ্লাই দেবার প্রস্তুতি নিলাম ৷ আমি লিখলাম “আপনি যে সমস্যায় পড়েছেন সে সমস্যার সাথে আমি পরিচিত নই ৷ তবে এটুকু বলতে পারি , আমার মনে হয় আপনার কোন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো দরকার ৷ এটাও এক ধরনের মানসিক সমস্যা মনে হচ্ছে ৷ আমার পরিচিত একজন
সাইকিয়াট্রিস্ট আছেন ৷ আপনি চাইলে আমি তার সাথে কথা বলে আপনার জন্য এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে দিবো ৷ একটাবার চেষ্টা করে দেখুন ৷ ভুল তো মানুষই করে , তবে ভুল শোধরাবার চেষ্টা তো করা লাগবে , তাই না বলেন ? ”
ফয়সাল চুপ করে থেকে উত্তর দিলো “আমি পরিবারের একমাত্র ছেলে ৷ একটা শেষ চেষ্টা আমি করতে চাই … আপনি এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে দেন …”
আমি আচ্ছা বলে কথা শেষ করলাম ৷ কথা শেষ করতেই দেখি মারিয়া আফরোজ ম্যাসেজ দিয়েছে ৷ তার টাকার জোগার হয়ে গেছে ৷ আমি তাকে কাল দেখা করার সময় দিলাম ৷ অন্য কেস আর মারিয়া আফরোজের কেস এক রকম নয় ৷ আমার আরো কিছু কাজ আছে , কাজগুলো শেষ করতে হবে অতি দ্রুত …
ইনবক্সে থাকা দ্বিতীয় ম্যাসেজটা ওপেন করলাম ৷ ভদ্রমহিলা তার পুরো গল্পটা বলেই রেখেছেন ৷
“আমার নাম আতিয়া ৷ বয়স পয়তাল্লিশ ৷ তিন সন্তানের জননী ৷ বড় মেয়ের বিয়েও দিয়েছি ৷ ছোট মেয়েটা ইন্টার দিলো এবার ৷ আর সবচেয়ে ছোট ছেলে ক্লাস নাইনে পড়ে ৷ আমার স্বামীর বয়স পঞ্চান্ন , দশ বছরের বড় আমার থেকে..
বছর দুয়েক আগে আমার জরায়ুতে টিউমার ধরা পড়ে ৷ টিউমারটার জন্য অপারেশন করে আমার পুরো জরায়ু ফেলে দিতে হয় ৷ এরপর থেকে নানান ধরনের সমস্যা হচ্ছে আমার ৷ তার মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা , বয়সের কারনেই হোক আর অপারেশনের কারনেই হোক , স্বামী স্ত্রীর নিজস্ব সম্পর্কে আমি আর কোন আগ্রহ পাচ্ছি না ৷
এটা নিয়ে অনেক অশান্তি ৷ আমি স্বামী ভদ্রলোক এ বিষয়টি বুঝতে চাচ্ছেন না ৷ আর বিষয়টি এতটাই লজ্জার আমি আমার সন্তানদের সাথেও শেয়ার করতে পারছি না .. এটা কি ওদের বলার মতো কথা ! বাবা মা মারা গেছেন আমার ৷ শ্বশুর মারা গেছেন ৷ আছেন এক শ্বাশুড়ি , বৃদ্ধা … জাগতিক বোধশূন্য ! আমি আমার এ যাতনা কাকে বলবো ! আমি ডাক্তার দেখিয়েছি , এ সমস্যার সমাধান আসলে নেই ৷
আমার স্বামী গত দুমাস আগে বিয়ে করেছে আমার অনুমতি ছাড়া ৷ ইচ্ছে করলে আমি কেস করতে পারি ৷ কিন্তু আমার নিজেকে এতটাই ক্লান্ত লাগে আমার আর কোন ঝামেলা করতে ইচ্ছে হয় না ৷ আমার ছেলে মেয়েরা এখনও জানে না তাদের বাবার এ কথা ৷ টাকা রেডি আছে আঁধার , আমি কি সুইসাইড ব্যুথটি পেতে পারি ? এত কষ্ট করেছি , মৃত্যুটা অন্তত আমার সহজ হোক…”
আমি পড়লাম ৷ পড়তে পড়তে আমার দুচোখ দিয়ে পানি চলে আসছিলো ৷ আমি আজকাল দ্রুতই ভেঙে পড়ছি ৷ এভাবে আমার ভেঙে পড়লে তো চলবে না ..
আমি নিজেকে শক্ত করলাম ৷ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে রিপ্লাই দিলাম ..
” একটা বয়সের পর সন্তানেরা মায়ের বন্ধু হয়ে যায় ৷ আপনার সন্তানেরা সেই বয়সে পৌছেছে ৷ তাদের কাছে লজ্জার কিছু নেই ৷ আপনি আপনার সন্তানদের সাথে কথা বলুন মন খুলে ৷ ওদের আপনি জন্ম দিয়েছেন ৷ ওদের মতো ভালো করে আপনাকে কেউ বুঝবে না ৷ আর একটা কথা , এই খবরটা এক সময় না এক সময় আপনার সন্তানদের কানে ঠিকই যাবে ৷ অন্য কোথাও থেকে শোনার আগে আপনিই বলুন এটাই ভালো ৷ আপনার কোন ভুল নেই ৷ আপনি কেন মরবেন ? আর একবার আপনার সন্তানদের কথা ভাবেন …ওদের কি হবে আপনি না থাকলে…
আপনার সমস্যার সমাধান আছে ৷ আমি খুবই দুঃখিত আপনার কাছে আমি ব্যুথটি বিক্রয় করবো না ৷ ”
উনি উত্তর দিলেন “আমি কি পারবো ?”
আমি অভয় দিয়ে বললাম “নিশ্চয় পারবেন…”
চলবে