এল_এ_ডেইস পর্ব ৪৪

0
330

#এল_এ_ডেইস
পর্ব ৪৪
লেখনী মাহীরা ফারহীন

এক চিলতে সোনালি রোদ তীর্যক ভাবে জানালা ভেদ করে ধূসর কার্পেট বিছানো কাঠের মেঝেতে এসে পরছে। ফুরফুরে মন ভালো করা বাতাস তিরতির করে ঘরে ঢুকছে। রান্নাঘরের কল থেকে এক এক বিন্দু পানি টপ টপ শব্দ করে সিঙ্কের মধ্যে পরছে। মাহীন মিসেস রহমানের সেল ফোনে একটা নম্বর সেভ করল। তারপর ওনার হাতে ফিরিয়ে দিলো। ওর চোখে মুখে প্রশ্ন। বেশ কিছুদিন হলো মাহীন আর খুব একটা এ বাড়িতে আসে না। এবার মিসেস রহমানই ফোন করে আসতে বলেছে ওকে। প্রথমেই তিনি মাহীনের কাছে ওর মায়ের নাম্বারটা চাইলেন। মাহীন নাম্বারটা সেলফোনেই তুলে দিল। এবার জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু আপনি আমার আম্মুর নাম্বার দিয়ে করবেনটা কী?’
মিসেস রহমান প্রথম থেকেই কেমন জানি গম্ভীর হয়ে আছেন। কোনো কিছু নিয়ে গভীর চিন্তায় আছেন বলে মনে হলো। তিনি মনে মনে কথা গুছিয়ে নিলেন। মাহীন আর কিছু না বলে অপেক্ষা করছে কোনো উত্তরের আশায়। মিসেস রহমান অবশেষে স্তিমিত কন্ঠে বললেন, ‘আসলে জানিস তো আজকাল মনে হচ্ছে আমি আসলে মানুষ হিসেবে কেমন? আমি তো এত খারাপ ছিলাম না। রায়েদের সাথে এত অন্যায় কিভাবে করলাম।’ বলে থামলেন। প্রশ্নটা যেন নিজেকেই করলেন। ওনার চোখের কোণে নোনাপানি চিকচিক করে উঠল। গম্ভীরতার পরিবর্তে এখন ক্লেশপূর্ণ মুখভাব। মাহীন ঠিক কী বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। প্রায় তিন মাসের অধিক সময় পার হয়েছে তার কাউন্সিলিং এবং চিকিৎসার। এর মধ্যে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছেন তিনি। রায়েদের সাথে স্বাভাবিক আচরণই করেন। তবে একটা দূরত্ব হয়ে গিয়েছে মা ছেলের মাঝে যেটা কিছুতেই ঘুচচ্ছে না। তবে এতটুকুতেই সন্তুষ্ট আছে রায়েদ। এতটুকুও যে ও পাবে সেটাই তো ছিলো অপ্রত্যাশিত। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মিসেস রহমান বলে চললেন, ‘আমার আজকাল সারাদিন শুধু গিল্টি ফিল হয়। রায়েদকে দেখলে তো আরো বেশি। ওর সাথে কথা বললেও মনে হয় অপরাধ করছি। এত বছর এত কষ্ট যে দিয়েছি ওকে। নিশ্চয়ই অনেক বদদোয়া লেগেছে আমার। আমি তো..মাহীন ওনাকে থামিয়ে দিল। তীব্র কন্ঠে বলল,
‘আপনি কী বলছেন এসব? আপনি তো জানেন এসব আপনি ইচ্ছাকৃতভাবে করেননি। এটা আপনার একটা মানসিক সমস্যা ছিলো যেটা এখন বলা যায় ঠিক হয়ে এসেছে।’
মিসেস রহমান অস্থির হয়ে বললেন, ‘হ্যা জানি। কিন্তু এতে রায়েদের কী দোষ ছিলো। মানসিক সমস্যা আমার ছিলো। তার জন্য এতদিন ভুগতে হয়েছে ওকে। এটা ভেবেই বারবার খারাপ লাগছে। এজন্যেই তো ওর সাথে কথা বলতেও অপরাধবোধ হয়।’
ওনার ফর্সা মুখমন্ডল লাল হয়ে উঠেছে। মাহীন লম্বা একটা শ্বাস ফেললো। শান্ত কন্ঠে বলল, ‘একটু শান্ত হন। রায়েদ তো আর আপনার ওপর রেগে নেই তাই না? বরং ও আরোও খুশি হয় আপনি ওর সাথে কথা বললে। ওর সাথে বেশি বেশি করে কথা বলুন। ওকে আগের কথা মনে করার সুযোগই দিয়েন না।’
মিসেস রহমান অন্য দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এবার মাহীনের দিকে নরম দৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর মাহীনের হাত ধরে বললেন, ‘দেখ তুই আমার পরিবারের জন্য অনেক করেছিস। মানে আমি এখনো ভাবতে পারি না তুই এতকিছু করে আমাকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানোর ব্যবস্থা করলি। তোকে ধন্যবাদ দিলেও তো কম হয়ে যাবে।”
‘আরেহ আপনি আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চান? আমি কিছু চাই না। শোনেন আপনি এক কাজ করেন সামনে রায়েদের জন্মদিন আসছে তখন কিছু একটা করেন। আইমিন পুরনো তিক্ত দিনগুলো ভুলিয়ে নতুন করে সবকিছু শুরু করার জন্য একটা ছোট খাটো অনুষ্ঠান বা কিছু করলে ভালো হয় না?’
মিসেস রহমান চমকে তাকালেন। বললেন, ‘বুদ্ধিটা খারাপ না। তবে রায়েদের জন্মদিনে এসব না করাই ভালো। কারণ ওর জন্মদিনের দিনই ওর বাবার মৃত্যুবার্ষিকী।’
‘ওহ আইএম সরি আন্টি। আপনি ঠিকই বলেছেন।’ একটু থেমে কিছু একটা ভেবে আবার বলে উঠে মাহীন, ‘আচ্ছা সেই এক্সিডেন্টের পর কত তারিখে রায়েদ হসপিটাল থেকে বাসায় ফিরেছিল?’
মিসেস রহমান একটু ভেবে বললেন, ‘উম একদিন পর। মানে আঠাশই আগস্ট।’
মাহীন প্রসন্ন কন্ঠে বলল, ‘এইতো। সেদিন ও বাসায় ফিরেছিল। ইট মিনস সেদিন থেকেই এসব ঝামেলা শুরু হয়েছিল। তাহলে আঠাশ তারিখেই অনুষ্ঠানটা ফেলা যায়। কেমন হবে বলুন তো?’
মিসেস রহমান হালকা হেসে বললেন, ‘তোর পুরো পরিবারকে বাসায় দাওয়াত দিবো ভাবছিলাম। এখন তাহলে সেইদিনই দাওয়াত দিবো কি বলিস।’
‘ওহ এজন্যে আমার আম্মুর নম্বর নিয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ এই পরিকল্পনা কেন?’
‘কেন আবার। যে আমার জন্য এতকিছু করলো সেই মেয়ের মা-বাবাকে একটু দেখা লাগবে না?তোর জন্য তোর পরিবারকেও ধন্যবাদ জানাতে চাই।’
মাহীন মিষ্টি করে হাসল। তারপর হঠাৎ বলল,’আঠাশ তারিখের কথা কিন্তু রায়েদকে বলবেন না। এটা সারপ্রাইজ। মিসেস রহমান মুচকি হাসলেন। তখনই দরজা খোলার শব্দ হলো। মাহীন ও মিসেস রহমান মাথা ঘুরিয়ে মূল প্রবেশদ্বারের দিকে চাইলেন। দরজা খুলে রাবিত ভেতরে প্রবেশ করল। প্রথনে মাহীনকে খেয়াল করল না। জুতা খুলতে খুলতে চোখে পরল বোধহয়। অবাক হলো। ওর পর রায়েদ ভেতরে প্রবেশ করেই মাহীনকে দেখল। রাবিত হাত নেড়ে বলল, ‘হেই! তুমি এখানে আছ জানতাম না তো। ভেবেছিলাম ক্যারোলের বাসায় আছো।’
‘আমি নিজেও জানতাম না আমি এখানে আসবো। তবে এখান থেকে এয়ারপোর্ট যাবো। তোমরা যাবা না?’
রায়েদ জুতা খুলতে খুলতে বলল, ‘যাবো তো। নায়েল বলল, ওরা গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার পর এখান থেকে ঘুরে যাবে। আমাদের আলাদা আসা লাগবে না।’
রাবিত সোফার ওপর গিয়ে ধপ করে বসে পরল। মিসেস রহমান বললেন, ‘কী আজ ক্যারোল চলে যাচ্ছে?’
মাহীন মাথা নাড়ল। রাবিতকে স্বাভাবিকই দেখাল। তবুও চোখে মুখে কেমন জানি একটা বিষন্ন বেদনার ছাপ। রায়েদ নিচে বসল না। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার সময় বলল, ‘ওরা আসলে আমাকে ডেকে দিও।’
মাহীন ও রাবিত দুইজনই সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। রাবিত বলল, ‘তো তুমি ক্যারোলের সাথে নাই কেন?’
‘এইতো সকাল থেকে গোছগাছে সাহায্য করতে আমরা সকলেই ওর বাড়িতেই ছিলাম। ঘন্টাখানেক আগে বেরিয়ে ছিলাম।’
মিসেস রহমান রাবিতকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘কিছু খাবি? তোকে অনেক ক্লান্ত লাগছে।’
রাবিত শুকনো কন্ঠে বলল, ‘নাহ কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।’
.
.
.
.
প্রায় আধাঘন্টা পর গাড়িটা এলো ওদের বাড়ির সামনে। এর মধ্যে মাহীন ফোন করে বলেছিল ও রায়েদের বাড়িতেই আছে। ওদের সাথে নিয়ে গাড়ি রওনা হলো লস এঞ্জেলস এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। গাড়িতে ক্যারোল ও তার দাদিও আছে। ওনার বোধহয় বেশ অদ্ভুতই লাগছে ছেলেমেয়েদের কান্ডকারবার। এর পূর্বে অনেক জায়গা বদল করেছেন। কিন্তু নাতনির জন্য সারাদিন তার বন্ধুরা বাড়িতে বসে গোছগাছে সাহায্য করেনি। বিদায় দিতে এত বড় বহর নিয়ে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যায়নি। এর পূর্বে ক্যারোল সিফট করা নিয়ে কষ্ট পেত ঠিকই কিন্তু রাগ হতো না। এবার আগের দিন থেকে দাদির সঙ্গে কথা বলা বন্ধ রেখেছে। নাতনির বন্ধুদের প্রতি এত গভীর টান তাকে ভাবাচ্ছে বটে। বিকেলের রাস্তার জাম কাটিয়ে আধাঘন্টা পর গাড়ি লস এঞ্জেলস এয়ারপোর্টে পৌঁছলো। বোর্ডিং সাতটার সময়। এখন পাঁচটা বাজে। তবে বাকিরা দু’ঘন্টা পর্যন্ত বসে থাকবে না। সকলের কাছ থেকে শেষ বিদায় নিয়ে ক্যারোল এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি গেট দিয়ে ডিপার্চার লাউঞ্জে চলে যাওয়ার পরই সকলে বেরিয়ে গেলো। এর ভেতর পর্যন্ত ওরা যেতে পারবে না। এখান থেকে বেরিয়ে স্যান্টা মনিকায় পৌঁছে ওরা মাহীনকে একই গাড়ি করে ওর বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে গেল। বিষন্ন মনে হেলেদুলে বাড়িতে প্রবেশ করল মাহীন। মিসেস নাসরিন সোফায়ই বসে ছিলেন। মি.মোর্শেদও সোফায় বসে চা খাচ্ছেন। মাহীন জুতা খুললো ক্লান্ত ভঙ্গিতে। বড় থাই গ্লাসের স্লাইডিং ডোর দিয়ে তেমন একটা আলো আসছে না। বাইরে সূর্য ডুবে গিয়েছে সেই কিছুক্ষণ আগেই। আকাশের বুক থেকে সূর্যের সিঁদুর রঙা শেষ রেখাটুকুও মুছে যাচ্ছে দ্রুত। ড্রইং রুমে বৈদ্যুতিক বাতি জালানো। রান্নাঘর ও তার সংলগ্ন ডাইনিং আঁধারে ঘেরা। মিসেস নাসরিন ও মি.মোর্শেদ দুজনের হাতেই চায়ের কাপ। এসময় প্রতিদিন মি.মোর্শেদ বাড়ি ফিরে সবে খেতে বসেন। তবে আজ উইকেন্ড। ফলে তিনি বাসায়ই আছেন। কাঁচের স্লাইডিং ডোর দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরে আকাশ জুড়ে অন্ধকার নেমে আসছে। মাহীন ধীর পায়ে হেঁটে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। মি.মোর্শেদ বললেন, ‘মাহীন একটু থাম তো। বস এখানে।’
মাহীন ফিরে তাকাল। তারপর এসে ধপ করে সোফায় বসল। টঙ্কস বুক কেসের তাঁকের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে। মি. মোর্শেদ জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর বান্ধবী চলে গিয়েছে?’
মাহীন আলতো করে সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। মিসেস নাসরিন হাতে ধরা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘মিসেস রহমান ফোন দিয়েছিলেন। অনেকক্ষণ কথা বললেন।’
মাহীন ভ্রু উঁচু করল। ভাবল, বাহ এর মধ্যে কাজ সেরেও ফেলেছেন।’ মুখে বলল, ‘তো কী বলেছেন উনি?’
মিসেস নাসরিন গাঢ় কন্ঠে বললেন, ‘তো তুই জানিস না বুঝি। ওখানেই নাকি বসে ছিলি?’
মাহীন বিচলিত হাসল। মি.মোর্শেদ বলল, ‘মিসেস রহমান আমাদের সপরিবারে আঠাশ তারিখে ওনার বাসায় দাওয়াত করেছেন।’
‘হ্যা এইজন্যেই উনি মায়ের নম্বর নিলেন আজ।’ বলল মাহীন।
‘তো তুই এত ঘটনা ঘটিয়েছিস কিন্তু তোর এই দুজন বন্ধু আর ওদের পরিবার সম্বন্ধে তো কিছু শুনলামই না আমি।’

মাহীন ইতস্তত হেসে বলল, ‘এই যে এখন শুনলা। সে তো মেলা কাহিনী। এখন অবশ্য উনি ঠিক আছেন।’

মিসেস নাসরিন বললেন, ‘হ্যা সেটা তো উনি নিজের মুখেই বললেন। তবে তুই ওনার বাসায় এত ঘনঘন যেতিস সেটা আমার জানা ছিলো না।’
মাহীন ইতস্তত হেসে বলল, ‘হয়েছে কী সেলি বলেছিলেন…”
এতটুকু বলতেই ওদের মূল প্রবেশদ্বারটা খুলে গেল। নাইম ভেতরে প্রবেশ করল। সকলকে একপলক দেখে নিয়ে দরজা বন্ধ করলো। তারপর জুতা খুলে সোফার দিকে এগিয়ে আসল। মাহীনের পাশে ধপ করে বসে ওর মাথায় টোকা দিয়ে বলল, ‘হিন হিন! কী খবর?’

‘কী আবার ক্যারোলকে বিদায় দিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে আসলাম।’ ক্লান্ত স্বরে বলল মাহীন।

মি.মোর্শেদ বললেন, ‘আচ্ছা তোদের মাথায় এই মিসেস বিংয়ের সাহায্য নেওয়ার বুদ্ধিটা আসলো কোথ থেকে?’

নাইম মুচকি হেসে বলল, ‘মায়ের বুদ্ধি এটা।’
মি.মোর্শেদ মুচকি হাসলেন। মিসেস নাসরিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা ওনার কথা শুনেতো মনে হলো উনি বেশ ভালোই হয়ে গিয়েছেন। এখন রায়েদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার কেরন?’
‘এখন তো স্বাভাবিক ব্যবহারই করেন। তবে ওর সাথে কথা বলতে ওনার একটু গিল্টি ফিল হয়। আন্টি আজই এইসব খুলে বলছিলেন।’ বলল মাহীন।
নাইম ফিসফিস করে বলল, ‘আরেহ হঠাৎ এই প্রসঙ্গ উঠলো কীভাবে? বাবা তো এটার কথা জানতেন না।’
মাহীনও ফিসফিস করেই জবাব দিলো, ‘মিসেস রহমান আমাদের সপরিবারে আঠাশ তারিখে ওনার বাড়িতে দাওয়াত দিয়েছেন। তাই মা বোধহয় বাবাকে সবকিছু খুলে বলেছে।’
‘রায়েদ জানে?’ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল নাইম।
‘না ওর জন্য সারপ্রাইজ থাকবে এটা।’
‘বাহ এটা নিশ্চয়ই তোর বুদ্ধি?’
‘আর নয়তো কী?’
‘বাহ কী ভালোবাসা।’ মাহীন কটমট দৃষ্টিতে নাইমের দিকে তাকিয়ে পিঠে চিমটি কাটলো। নাইম ‘আউ’ করে উঠল। মিসেস নাসরিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর আবার কী হলো?’
‘কিছু না।’ পিঠ মালিশ করতে করতে বলল নাইম।
.
.
এরপর মাহীন উঠে নিজের কামরায় চলে আসল। বিছানায় সটান শুয়ে পরল। হঠাৎ মনে পরল এই সপ্তাহের ফিজিক্স এসাইনমেন্ট সাবমিট করা হয়নি। সেটা ডেক্সটারকে জানানোর কথা ছিলো। ও সাবমিট করে দিতো। মাহীনকে আর ঝামেলা করা লাগতো না। ভাবতে ভাবতেই সেল ফোনটা হাতে তুলে নিলো। কল লিস্টে ড অক্ষর দিয়ে সেভ করা কনট্যাক্টগুলো বের করল। তারপর কল দিয়ে কানে ধরল। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পরই ওপাশ থেকে ভেসে এলো উচ্ছ্বসিত ডিস্টার্বারের কন্ঠস্বর। মাহীন চমকে উঠে ফনটা কান থেকে সরিয়ে নিয়ে স্ক্রিনের দিকো তাকাল। ভুলবশত ডেক্সটারের বদলে ডিস্টার্বার কে কল দিয়ে ফেলেছে। ওপাশ থেকে বলছে, ‘ওহ মাহীন! কী খবর? আজ কী সূর্য পশ্চিম উঠল নাকি তুমি আমাকে ফোন দিচ্ছো।’
‘না ভুলে গিয়েছে। সে যাই কেমন আছো তুমি? অনেকদিন দেখি আমাকে আর ডিস্টার্ব করোনি।’
ওপাশ থেকে সে হালকা হাসল। বলল, ‘হ্যা করিনি। জানো তে কী হয়েছে, আমি একজন নতুন ফ্রেন্ড পেয়েছি। বা বলা যায় বেস্ট ফ্রেন্ড! এখন আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি ওর কাছে একজন সৎ ফ্রেন্ড হিসেবে নিজেকে উপস্থিত করতে।’
মাহীন ম্লান কন্ঠে বলল, ‘তাই ভালো। আমার সাথে ওইসব গোলমাল করার পর আশা করি একই ভুল এবার আর হবে না। তাই না? নাহলে এই ফ্রেন্ড কেও হারিয়ে ফেলবা।’
‘জানি। এবং আমি তোমার কাছে হাজার বার ক্ষমা চেয়েছি। নিজের ভুল যখন বুঝতে পেরেছি আমি আর সেই ভুল দ্বিতীয় বার করবো না। তবে সেই আফসোস আর থাকতো না যদি তোমার আমার সম্পর্ক আবার আগের মতো হয়ে যেত।’
‘জানো তো আমার ট্রাস্ট ইস্যুর সমস্যাটা শুরু হয়েছে তোমার থেকে। আর একটা কথা আমরা যদি আবার আগের মতো ফ্রেন্ড হয়ে যেতাম তাহলে তোমার শিক্ষাটা আর হতো না। যাই হোক তাহলে ভালো থেকো। রাখি।’
‘ঠিক আছে। তুমি ভালো থেকো।’ বলে ফোনটা রেখে দিলো।
মাহীন ফোনটা কান থেকে নামিয়ে কনট্যাক্টে নম্বরটা ডিস্টার্বার থেকে পাল্টিয়ে নামিরা দিয়ে সেভ করল। তারপর ভাবতে লাগল, আহ নামিরা এখনোও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হতে পারতো ঠিক আগের মতো। কিন্তু তখন ও যে আমার অজান্তে আমার নামে এদিক ওদিক কথা লাগাত, আমার বদনাম করত সেটা তো আমি ভুলতে পারি না। এরকম চিট করল কেন আমার সাথে? এখন যদি সত্যি ও শুধরে যেয়ে থাকে। তাহলে ওর জন্যেই ভালো।
.
.
.
.
স্যান্টা মনিকার বু্কে অন্ধকার নেমে এসেছে। তবে এই অন্ধকার কৃত্রিম আলোর ঝলকানির সামনে কিছুই না। শহরতলীতে আলোর বন্যা বয়ে চলেছে। পথঘাট আলো করে রেখেছে অসংখ্য গাড়ির হেডলাইট ও দুপাশ ঘেরা ব্র্যান্ডের শপগুলোর জাঁকজমকপূর্ণ আলোকসজ্জা। পিকো বুলেভার্ড স্ট্রিটে লেগেছে লম্বা জাম। লাগবে নাই বা কেন? এটা রাশ আওয়ার। এই সময় সকল কর্মস্থল গুলো একে একে কাজের সমাপ্তি টানে। কর্মচারীরা হন্যে হয়ে বাড়ির পথ ধরে। রায়েদ ও রাবিত পিকো বুলেভার্ডে নেমে গেলো। আর বাড়ির সম্মুখ পর্যন্ত গাড়ি নিয়ে গেলো না। তাতে গাড়ি জামে পরে সময় নষ্ট হতো শুধু শুধু। পাশের ফুটপাথ ধরে দুভাই হেঁটে চলেছে। ফুটপাথেও পথচারীদের ঠেলাঠেলি। অনেক টিনএজাররা এর মাঝেও স্কেটবোর্ড নিয়ে বেরিয়ে পরেছে। রাস্তার অপর পাশের ফুটপাথের পাশের স্টারবাক্স থেকে হলদে নিয়ন আলো এসে পরছে গাড়িগুলোর গায়ে। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির নিকট এসে পৌঁছেছে। রাবিত সারা পথ কেমন গুম মেরে ছিলো। রায়েদও আর বিরক্ত করেনি। সাধারণত দুভাই একত্রে থাকলে রাবিতই বেশি বকবক করে। রায়েদ নির্বাক শ্রোতা বনে থাকে। বাড়ির সম্মুখের লোহার গেটটা ঠেলে খুললো রাবিত। রায়েদ পেছনে। “রায়েদ!” গাড়ির হর্ন,পথচারীদের কোলাহলের মাঝে কার যেন ডাকে রায়েদ থেমে গিয়ে ঘার ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল। রাবিতও ভেতরে ঢুকে থেমে গেছে। কন্ঠটা কেমন পরিচিত ঠেকল। ভির ঠেলে ফুটপাথ ধরে বিল মুরেই প্রায় ছুটতে ছুটতে এগিয়ে আসছে। যখন রায়েদ বুঝলো যে ওদের দিকেই এগিয়ে আসছে বিল যারপরনাই অবাক হলো। অবাক হয়েছে রাবিতও। রায়েদ রাবিতকে ভেতরে যেতে ইশারা করল। এখনো গেট ধরেই দাঁড়িয়ে আছে ও। রাবিত আর কথা না বাড়িয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। না জানি বিল আবার কী করতে আসছে এমন একটা ভাবনাই খেলে গেলো রায়েদের মাথায়। তবে বিল কাছিয়ে আসতেই ধারনাটা কিছুটা পরিবর্তন হলো। চোখে মুখে কোনো তেজ নেই ওর। কেমন ক্লান্তিতে ভরা মলিন চেহারা। বিল কিছুটা হাঁপিয়ে উঠেছে। বুক ভরে লম্বা লম্বা শ্বাস নিলো। রায়েদ নির্বিকার চিত্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিল অবশেষে কিছুটা ইতস্ততভাবে বলল, ‘আম হাই রায়েদ। ক্যান আই হ্যাভ সাম মোমেন্ট?’
রায়েদ ভারি গলায় বললো, ‘ফর হোয়াট?’
‘আই হ্যাভ গট সামথিং টু টক উইত ইউ।’
রায়েদ ভ্রুক্ষেপহীন। বলল, ‘আমার সময় নেই।’ বলে ঘুরে দাঁড়াতে যাচ্ছিল তখনই বিল তাড়াহুড়ো করে বলল,
‘ওয়েল দেখো অনেক দিন আমাদের কোনো কথা হয়নি। তবে কিছুই যে আর বলার থাকতে পারে না তেমনটাও তো নয়।’ রায়েদ আবার ঘুরে দাঁড়াল। বলল, ‘মাহীনকে নিয়ে কিছু বলতে চাও?’
বিল এ প্রশ্নে অবাক হলো। একই সাথে অপ্রস্তুত ভাবে উত্তর দিলো, ‘অফ কর্স না। ওর কথা এর মাঝে কোথা থেকে আসলো। এন্ড যেহেতু তুমি টেনেই আনলা তাহলে ক্লিয়ারলি বলি, আই নো তোমরা রিলেশনে আছো এন্ড আই এম ওকে ইউত দ্যাট।’
‘তো তুমি কী নিয়ে কথা বলতে চাও আসলে?’
‘আমরা কী হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে পারি?’
অগত্যা রায়েদ কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে।’ বিল হাঁটতে শুরু করলো। রায়েদও ধীরে ধীরে হাঁটছে।
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর বিল বলতে আরম্ভ করল,
‘আমি জানি এত বছর আমাদের সম্পর্কটা খুবই খারাপ ভাবে গিয়েছে।’
‘আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক ছিলোই না। আর বন্ধুত্ত্ব তো অনেক দিন আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।’ তিক্ত ভাবে বলল রায়েদ।
‘জানি। বাট যেটাই ছিলো সেটাও জাস্ট ওয়ার্স ছিলো। বাট দেখো আমি আজও জানি না তোমার সাথে একচুয়েলি সেসময় কী হয়েছিল। জানার সুযোগও হয়নি কখনো।’
রায়েদ মাঝখান দিয়ে বলল, ‘জানার চেষ্টা করলে তবে তো জানতে। কিন্তু তোমার কাছে তো তোমার ইগোটাই অনেক বড় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। তাই না?’
বিল পুনরায় কিছুক্ষণ মৌন থাকল। তারপর মলিন স্বরে বলল, ‘তা আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি। আমারও তখন বয়স কম ছিলো। বন্ধু হিসেবে যে আমার কী করণীয় ছিলো আমি বুঝে উঠতে পারিনি। কিছুটা চাপা অভিমানও হয়েছিল আমার। কারণ…রায়েদ আবারও ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিলো, ‘এতদিন পর এসব কথা নতুন করে টেনে আনার মানে কী?’
বিল ইতস্ততভাবে বললো, ‘তুমি কী সেসব তিক্ত ঘটনা ভুলে গিয়ে লাইক নতুন করে..আই মিন ফ্রেন্ড…রায়েদ ওকে থামিয়ে দিলো। ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘তোমার ফ্রেন্ডরা কী তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে যে শেষ পর্যন্ত তোমার আমার কথা মনে পরেছে? লাইক সিরিয়াসলি তুমি আবার নতুন করে ফ্রেন্ডশিপের কথা ভাবছো?’ বলে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বিলের দিকে। বিল রাস্তায় চলাচলরত গাড়ির গুলোর দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। রায়েদ আবার বলল, ‘দেখো সেসব ঘটনা আমি অনেক আগেই মাথা থেকে বের করে ফেলেছি। আবার সেগুলো মনে করার থেকেও অনেক বেশি জরুরি কাজ আছে আমার। এবং তোমার সাথে ফ্রেন্ডশিপ তো হতেই পারে নতুন করে তবে সেরকম করে আগে যতটা ক্লোজ ছিলাম আমরা, যতটা বিশ্বাস করতাম তোমাকে সেটা আর কখনো হবে না। এটা জেনে রাখো।’
বিল যেন কিছুটা মিইয়ে গেলো এ কথা শুনে। অবশ্য এমন কিছু শোনার জন্য সে প্রস্তুতও ছিলো বটে। শুকনো কন্ঠে বলল, ‘আই নো বিশ্বাস স্পর্শকাতর একটা জিনিস। একবার সেটা ভেঙ্গে গেলে নতুন করে তৈরি হতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। তবে এর জন্য আমি তোমাকে দোষারোপ করতে পারি না। দোষটা আমার ছিলো। তাই আমি বলছি আমরা কী একটা নতুন ফ্রেন্ডশিপকে সুযোগ দিতে পারি না?’ বলে আগ্রহী চিত্তে তাকাল রায়েদের দিকে। রায়েদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘কী দরকার আর এসব করার? আমরা আবার ফ্রেন্ড না হলেও তো সবকিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে না। যেটা যেমন আছে সেরকমই থাকুক না।’
বিলের উৎসুকভাব মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। তবুও আশাহত হলো না। হাঁটতে হাঁটতে ওরা বিলের বাড়িও পেরিয়ে এসেছে কিছুক্ষণ হলো। ওদের বাড়ি সবসময় থেকেই একই রাস্তায় ছিলো। তাঁরা শুধু ছোটবেলার বন্ধু নয় প্রতিবেশীও ছিলো বটে। বিল গাঢ় কন্ঠে বলে, ‘ বাট একটা চান্স দিতেও তো ক্ষতি নেই। এন্ড আমি গ্যারান্টি দিলাম এবার আর আগের বারের মতো কোনো ভুল করবো না।আমি তোমাকে বলছি না ফার্স্টেই তোমার আমাকে বিশ্বাস করতে হবে ব্লাহ ব্লাহ ব্লাহ…বাট আমরা ট্রাই করতে পারি। প্লিজ আমাকে না করে দিও না।’ অনুনয়ের স্বরে বলল বিল। এতে বোধহয় কিছুটা মন গললো রায়েদের। তবুও এত সহজে রাজি ও হলো না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বিলের দিকে চাইল। বলল, ‘আসলে হঠাৎ আমার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করতে হবে এই চিন্তাটা তোমার মাথায় চেপে বসলো কেন?’
বিল অপ্রস্তুত হলো। কিভাবে বুঝিয়ে বলবে হঠাৎ কী হয়েছে? কিছুই তো হয়নি। কয়েনদিন যাবৎ এ বিষয়টা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছে। মূলত এর সূচনালগ্ন হয়েছে মাহীনের হাতে। সেদিন বিলকে বলা মাহীনের কথাগুলোই ওর মনে প্রতিনিয়ত খচখচ করে গিয়েছে। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিল না। অবশেষে বুঝতে পেরেছে রায়েদের সঙ্গে ঝামেলার মিটমাট না হলে ওর শান্তি নেই। বিল কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘জানি না। কয়েকদিন ধরে জাস্ট এইসব নিয়ে খুব গভীর ভাবে চিন্তা করেছি। তারপর এই স্টেটমেন্টে এসেছি যে যেভাবেই হোক আমি আবার সবকিছু আগের মতো ফিরিয়ে আনবো।’
রায়েদ আনমনে হাসল। ভাবল, কী অদ্ভুত না? গত চার বছর যাবৎ যখন আমার জীবনটা দুঃস্বপ্নের মতো কাটলো তখন একবারও কারোর মনে হলো না যে তার কোথাও কোনো ভুল ছিলো। চাইলেই সবকিছু ঠিক করা যেতে পারে না। যখন এমনিতেই আমার জীবনের সুন্দর সময় ফিরে এসেছে তখন ওর মনে পরলো যে আমার সাথে সবকিছু আবার ঠিক করে নেওয়া উচিৎ? কেনো? আমি কী জানি না ভেবেছে? মাহীন আমাকে না বললেও তুমি আমাকে না বললেও আমি বুঝতে পারছি, মাহীন সেদিন সেরকম কিছু একটা তো তোমাকে বলেছিলো। সেটা হয়তো আমার সাথে আসলে কী হয়ছিলো তা নয় তবে এমন কিছু যেটা ওর গায়ে লেগেছে।’ ভাবতে ভাবতেই বলল, ‘ঠিক আছে। একটা সুযোগ দিতে বলছো যখন তো দিলাম। তবে আমি আগেই বলছি আমার কোনো দায় নেই এসবের মাঝে।’
বিলের মুখখানা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। হালকা হেসে বলল,
‘থ্যান্কস রায়েদ। আই উইল ট্রায় মাই বেস্ট টু কিপ দিজ ফ্রেন্ডশিপ।’
রায়েদ প্রতুত্তরে কিছুই বললো না। নিচে আলোর বন্যা বয়ে গেলেও মাথার ওপর আঁধার ঢাকা আকাশে মিটমিট করে কয়েকটা তাঁরা জ্বলে রয়েছে। রাস্তার পাশের রেলিঙ জুড়ে পেতুনিয়া ফুলের ঝাড় ঝুলে রয়েছে। বাতাসে তিরতির করে দুলতে থাকে ফুলগুলো। স্ট্রিট লাইটের হলদে আলোয় মেখে যায় পথচারীরা।

ইনশাআল্লাহ চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here