এল_এ_ডেইস পর্ব ৪৩

0
191

#এল_এ_ডেইস
পর্ব ৪৩
লেখনী মাহীরা ফারহীন

টুই টুই শব্দে গাছগাছালির আড়াল থেকে ভিরি পাখি ডাকছে। সোনালি রোদে ঝলমল করছে গাছপালা। কেন জানি সবকিছুই অতি সতেজ ও ঝকঝকে। আগস্টের অর্ধেক পেরিয়ে গিয়েছে। ধীর পায়ে শীত এগিয়ে আসছে সময়ের সাথে সাথে। আজকাল গরম তেমন একটা অনুভূত হয় না। মাহীন হেলেদুলে ধীরে ধীরে চত্ত্বর ধরে হাঁটছে। মনেও বড় শান্তি। চারিপাশের প্রতিটা জিনিস প্রতিটা ঘটনাকেই নিখুঁত সুন্দর মনে হচ্ছে। মন রঙিন থাকলে বোধহয় চারিপাশটাও রঙিন দেখায়। মাথার ওপর সুবিস্তীর্ণ নীল আকাশ। নিচে দেয়াল ঘেঁষে বেগুনি ডগলাস আইরিশ এবং সাদা ফ্রেসিয়া। কিছুদিন আগে আবার অল্প কিছু লাল ও হলুদ রঙের পেতুনিয়া লাগানো হয়েছিল। সেগুলোর কলি এসেছে।
‘মিহিন! মিহিন!” নিজের নামের এহেন বিকৃত উচ্চারণ শুনে ভ্রু সূঁচালো হলো মাহীনের। কে ডাকছে দেখতে আশেপাশে দৃষ্টি বুলাল। স্কুল বিল্ডিংয়ের দিক থেকে কিছুটা দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে একটা ছেলে। হালকা সোনালি চুল। ধূসর চোখের রঙ। এটা ম্যাট। ওকে চিনতে খুব একটা অসুবিধা হলো না। ছেলেটা সামনে এসে দাঁড়াতেই মাহীন বলল, ‘ইয়াহ?’
ম্যাট হাঁপিয়ে গিয়েছে। কয়েকটা লম্বা শ্বাস ফেললো। এবার বলল, ‘তুমি সেদিন আসলে না কেন?’
মাহীনের কপালে এখনো ভাজ। ম্যাটের কথা বোধগম্য হলো না। কী বলছে ও।
‘মানে? কোথায় আসিনি আমি?’ জিজ্ঞেস করল মাহীন।
‘ডোন্ট ইউ নো? ডেটে।’
মাহীনের ভাজ পরা ভ্রু জোড়া বিস্ময়ে উঁচু হলো?’
বলল, ‘কোন ডেট? আমি তো জানি না আমার আবার কারো সাথে ডেট ছিলো।’
ম্যাটও এখন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। ওর মুখশ্রী দেখেই ধারণা করা যায় মাহীনকে নিয়ে ও খুবই বিরক্ত। ওর সোজাসাপটা কথাগুলোও মাহীন বুঝতে পারছে না। তীব্র কন্ঠে বলল, ‘আর ইউ কিডিং উইথ মি! তোমার বিলের সাথে ডেট ছিলনা নয় আগস্ট?’
মাহীন দ্বিতীয় দফা বিস্মিত হলো। এসব কী বলছে এই ছেলে। মাহীন ভাবল, ব্যাপারটা ঠিক কোথা থেকে গোলমাল বেঁধেছে? নয় আগস্ট তো আমি ডেটে গিয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু রায়েদের সাথে। বিল মাঝখান দিয়ে কোথা থেকে আসল?’ মুখে বলল, ‘আজব তো! বিলের সাথে আমার কোনো কালেই ডেটে যাওয়ার কথা ছিলো না! ইভেন বিল তো আমাকে কখনো প্রস্তাবই দেয়নি। তুমি আমাকে এসে শুধাচ্ছ কিসের ভিত্তিতে?’
ম্যাট থতমত খেল। ভোঁতা মুখে চাইল। চোখ সরু করে বলল, হোয়াট! আর ইউ ইনসেন! বিলের চিঠিটা কী হাওয়ায় মিলিয়ে গেল?’
মাহীনের ভ্রু উঁচু হলো। অবাক কন্ঠে বলল, ‘বিলের চিঠি? আমি তো বিলের কেনো চিঠি পাইনি।’
ওরা দুজন গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে সমঝোতা করছে। অনেক ছেলেমেয়েরা হেঁটে যাচ্ছে নিজের মতো হইচই করতে করতে। ‘তাহলে বিলের চিঠিটা গেল কোথায়। আসলেই সিয়া ইচ্ছা করে ঝামেলা করেছে?’ কিছুটা মৃদুস্বরে কথাটা যেন নিজেকেই বললদ ম্যাট। তবে মাহীনও শুনতে পেল। বলল, ‘এসিসিয়া ঝামেলা করেছে মানে? এসিসিয়ার চিঠি দেয়ার কথা ছিলো?’
ম্যাট বলল, ‘হ্যা ওরই চিঠি দেওয়ার কথা ছিলো। এই মেয়েটা যে কী করে না! তুমি চিঠি না পেয়ে থাকলে নিশ্চিয়ই ওই গায়েব করেছে ওটা।’
মাহীন জিজ্ঞেস করল, কিন্তু এসিসিয়া কেন চিঠি গায়েব করবে? এর পেছনে কী স্বার্থ আছে ওর?’
ম্যাট বাঁকা হাসল। বলল, ‘কী স্বার্থ আছে? ওতো সেই কবে থেকে বিলকে পছন্দ করে। কিন্তু মাঝখান দিয়ে বিল তোমাকে পছন্দ করে বলে সেটা ওর সহ্য হচ্ছে না। তাই চিঠি ও তোমাকে দেইনি। সোজা হিসাব।’
মাহীন খুব একটা অবাক হলো না। বিল ওকে পছন্দ করে এটা ও আগেই আঁচ করতে পেরেছিল। এবং এসিসিয়ার ব্যাপারটাও অজানা নয়। বলল, ‘তোমরা যখন জানতে ব্যাপারটা ওকে দিয়ে চিঠি না পাঠালেই পারতে।’
ম্যাট বলল,’সিয়া নিজে ই যেচে পরে দায়িত্বটা নিয়েছিল।’
গেট দিয়ে ডজন ডজন শিক্ষার্থীরা হেঁটে আসছে দ্রুত গতিতে। ক্লাস আরম্ভ হওয়ার সময় এগিয়ে আসছে। হঠাৎ খেয়াল হতেই মাহীন বলল,
‘হেই ক্লাস শুরু হলো বলে। আমি যাই।’
‘ওহ ইয়াহ। বাই দ্যা ওয়ে থ্যাঙ্কস ফর দ্যা ক্লিয়ারিফিকেশন।’ মাহীন জবাবে হালকা হাসল।
.
.
.
১৮৪৮ সালের ২৪ জানুয়ারি শুরু হয় ক্যালিফোর্নিয়ার গোল্ড রাশ। সর্বপ্রথম ক্যালিফোর্নিয়ার কলোমায় সাটার মিলে জেমস ডব্লিউ মার্শাল সোনা খুঁজে পায়। এরপরই পুরো ইউনাইটেড স্টেটস এবং বিদেশ থেকে প্রায় তিন লক্ষ মানুষ ছুটে আসে ক্যালিফোর্নিয়ায়। ওদের ইতিহাস টিচার মি.ডিউইট পড়িয়ে যাচ্ছেন। অনেকে শুনছে অনেকে শুনছে না। মাহীন শুনছে আবার শুনছে না। বেশ কিছু ভাবনা মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। কোনোটার সাথে কোনোটা মিলে যাচ্ছে। কোনোটা মিলছে না। মাঝখান দিয়ে এত গোলমাল পেকে রয়েছে তা কে জানতো। যদিও এসব গোলমালে ওর কিছুই যায় আসে না। তবে অপ্রয়োজনে সবকিছু নিয়ে ভাবাটাই মাহীনের চিরাচরিত স্বভাব। অবশ্য একেবারেই এটা অপ্রয়োজনীয় তাও বলা যায় না। কোনো এক ভাবে ও এটার সাথে জড়িয়ে আছে। সেটা অস্বীকার করা যায় না। মাহীন কক্ষের মাঝের সারির একটি টেবিলে বসে আছে। ওর থেকে কয়েক টেবিল দূরে লিম জু রয়েছে। বাকি বন্ধু বান্ধবরা অন্যান্য কক্ষে অন্যান্য ক্লাসে রয়েছে। মাহীন বামে জানালার দিকে দৃষ্টি ফেরাল। বাইরে শুধু সবুজ দেখা যায়। সবুজ পাতা ছাওয়া গাছ। ঘন্টা পরতেই মি.ডিউইট ক্লাস ত্যাগ করতে উদ্যাত হলেন। এদিকে ছেলেরা মেয়েরা হইচই আরম্ভ করে দিয়েছে। মাঝে মাঝে মাহীন বুঝতে পারে না, ক্লাস চলা কালিন কী এরা শুধু এটাই ভাবতে থাকে যে ক্লাস শেষ হওয়ার পর কিভাবে হইহট্টগোল বাঁধানো যায়। অনেকে এথলেটের মতো ছুট দেয় লকার করিডরের উদ্দেশ্য। এদের লকারে অতি মূল্যবান কিছু থাকে বোধহয়।
লিম জু মাহীন ব্যাগ কাঁধে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। লিম জু ওর সাথে সাথে ক্লাস থেকে বের হলো। জানাল যে পনেরো আগস্ট ওরা লং বিচের ওদিকে যাবে ক্যারোলকে নিয়ে ঘুরতে। মাহীন সম্মতি জানাল। লং বিচ এখান থেকে কিছুটা দূরে। তবে খুব বেশিও না। পথে রাবিতকে দেখে মাহীন থামল। কিছু একটা জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করল। ওকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল,’আচ্ছা তুমি যে কয়েকদিন আগে আমাকে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছিলা। ওটা কোথায় পেয়েছিলা তুমি?’
রাবিত থতমত খেলো। হঠাৎ এই প্রশ্ন? দ্বিধানিত্ব হয়ে বলল, ‘ওহ দেখো আমি জানি না ওটা কিসের চিঠি ছিলো। বাট ওটা এসিসিয়া দিয়েছিল আমাকে।’
মাহীন সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। লিম জু প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মাহীন বললো, ‘পরে বুঝিয়ে বলবো। এখন ক্লান্ত লাগছে এসব নিয়ে ঘাটতে।’ লিম জু আর কথা বারাল না। ওরা সেই করিডরে এসে দাঁড়াল যেখানে সারি সারি চকচকে রুপালী লকার রয়েছে। মাহীন ব্যাগ থেকে বইগুলো বের করে লকারে রাখল। এবং পরের ক্লাসের জন্য নির্দিষ্ট বই ব্যাগে ভরে নিচ্ছে। তখনই দেখলো ওর থেকে প্রায় বিশটি লকার পরে বিল দাঁড়িয়ে আছে। মাহীন তড়িঘড়ি করে নিজের লকার বন্ধ করল এবং সেদিকে এগিয়ে গেল। বিল নিজের লকারটা বন্ধই করছিল। তারপর পেছনে ঘুরে চলে যেতে উদ্যাত হলো। তখনই মাহীন ওর সামনে এসে দাঁড়াল। কয়েকটা লম্বা শ্বাস নিল। হঠাৎ মাহীনকে নিজের সামনে দেখে অবাক হলো বিল। তারপর প্রায় ওকে না দেখার ভান করে চলেই যাচ্ছিল। মাহীন ওর সাথে আসতে আসতে বলল, ‘ওয়েল দেখো আই নো তুমি আমার ওপর রাগ করে আছো কিন্তু..বিল মাঝখান দিয়ে বলল, কী কিন্তু? এখন আর তোমার কী বলার আছে?’ ভির এড়িয়ে মাহীন দ্রুত গতিতে তাল রাখার চেষ্টা করছে। উৎকন্ঠিত গলায় বলল, হ্যা অনেক কিছু বলার আছে। আমি তো চিঠি…বিল আবার মাঝখান দিয়ে ওকে থামিয়ে দিল।

তীব্র কন্ঠে বলল, ‘তুমি ডেটে না আসতে চাইলে আমাকে জানিয়ে দিতে পারতে। জানো আমি প্যাসিফিক পার্কে দেড় ঘন্টা অপেক্ষা করেছি তোমার জন্য। ইভেন আমার কাছে তোমার নম্বরও নেই। আর…এবার মাহীন কিছুটা উচ্চস্বরেই বলে উঠল, জাস্ট সাট আপ! আমার কথা শোনো আগে!’ বলেই থেমে গেল। আশেপাশে উপস্থিত সকলেই প্রায় ওদের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাহীন বলল, ‘দয়া করে এখান থেকে চলো। আমার যা বলার আমি বলে চলে যাবো। আর বিরক্ত করবো না তোমাকে।’ বিল দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কিন্তু কিছুই বললো না। ওরা করিডোরটা পার করে গেল। তারপর আরো কিছু করিডোর পার করে বিল্ডিংয়ের বাম দিকের গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসল। এবার বিল ভারি কন্ঠে বলল, বলো তোমার কী বলার আছে।’
মাহীন লম্বা একটা শ্বাস নিলো। তারপর শান্ত কন্ঠে বলল, ‘দেখো আমি আসতাম কী আসতাম না সেটা পরের কথা। প্রথম কথা হলো আমি জানতামই না তুমি কখনো আমাকে ডেটের প্রস্তাব দিয়েছো। কারণ আমি কখনোই তোমার কাছ থেকে কোনো চিঠি পাইনি।’
বিল বিস্ফারিত নয়নে চাইল। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকার পর বলল, ‘ইউ মিন তুমি আমার চিঠি পাওইনি? হাউ ইজ ইট পসিবল!’
মাহীন বলল, আমি জানি না এটা কিভাবে পসিবল। বাট আজকে ম্যাটের সঙ্গে কথা হলো। সে আমাকে বলল যে তুমি নাকি আমাকে চিঠি দিয়েছিলা। বাট আমি তো জানি যে আমি কোনো চিঠি পাইনি। তাহলে এখানে আমার দোষ কোথায়?’
বিল নিজের মনে বোধহয় কোনো একটা হিসেব মেলাতে ব্যস্ত। ওর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল ক্রমেই। এরপর কিছুটা ঝাঁঝ ভরা কন্ঠে বলল, হোয়াই এসিসিয়া জুহোড!’ মাহীন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর বলল, দেখো শান্ত হও। এসিসিয়া তোমার খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড। সো তোমরা ব্যাপারটাকে কিভাবে সামলাবা সেটা আমার দেখার বিষয় নয়। তবে…বলে থামল। বিল প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাহীন ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করল। বিলও ওর পাশে পাশে হাঁটতে লাগল। মাহীন খালি রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল, প্রতিটা মানুষের জীবনেই আপস এন্ড ডাউনস আসে। অনেক সময় তার ফলে তারা আপনজনদের সাথে রুড বিহেইভও করে ফেলে। এমন সময় সেটাকে গায়ে না মেখে তাদের মনের অবস্থা বুঝতে হয়। যতই কাছের হওনা কেন তুমি হয়তোবা তবুও তারা তোমার সাথে সেই ব্যাপারগুলো শেয়ার করতে আনইজি ফিল করতেই পারে। তাই আমার এমন মানুষ একদম পছন্দ নয় যারা অপর মানুষটার মনের অবস্থা না বুঝেই ইগোকে সামনে রেখে দেয়। এতে অনেক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়।’ বলে থামল। বিল কী বুঝলো কে জানে কিছুই বললো না। মাহীন নিজের হাত ঘড়ির দিকে চাইল। পরের ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। তারপর বিলের দিকে তাকাল। বলল, ‘ওহ ইয়েস ওয়ান মোর থিং। আই এম সিইং রায়েদ। এন্ড উই বোথ লাইক ইচ আদার।’ বিল কিছুটা অবাক হয়ে তাকাল। ব্যাথাতুর দৃষ্টি। পানসে কন্ঠে বলল,’ওয়েল কনগ্র্যাচুলেশন!’
.
.
.
লাঞ্চের ঘন্টা পরেছে কিছুক্ষণ হলো। ক্রমেই ক্যাফেটেরিয়া ভরে উঠল ছাত্রছাত্রীতে। গল্প গুজব করতে ব্যস্ত সকলে। অনেকে চেয়ার ছেড়ে টেবিলের ওপর বসে আছে। রায়েদ একটা স্যান্ডউইচ কিনে সেখান থেকে বেরিয়ে আসল। আশেপাশে কোথাও মাহীনের দেখা মিললো না। আজকাল মেয়েটাকে খুঁজেই পাওয়া যায় না। ওর ফ্রেন্ডদের জিজ্ঞেস করলে ওরাও কিছু বলতে পারলো না। আবারও স্কুল বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে লাইব্রেরিতে চলে আসল রায়েদ। পূর্বের মতো এখনো লাইব্রেরিতে একা একা না বসে থাকলেও পারে। তবে এত বছরে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। না গেলেই বরং খালি খালি লাগে। তিনতলার লাইব্রেরিতে ঢুকে নিজের সেই কোণার টেবিলের কাছে পৌছুতেই দেখলো টেবিলে মাথা রেখে বসে আছে মাহীন। রায়েদ সন্তপর্ণে এগিয়ে যেতে যেতে ভাবল, ‘বাহ ম্যাডাম দেখি নিজে থেকেই আজ এখানে এসে হাজির। নিশ্চয়ই বলার মতো কোনো কথা জমা হয়েছে।’ মাহীনের মাথার কাছে একটা মাফিন রাখা আছে। বোঝা গেল না ও ঘুমিয়ে পরেছে নাকি এমনিই হেড ডাউন করে আছে। খোলা জানালা পার করে ফুরফুরে মিষ্টি বাতাস ভেতরে আসছে। ঘুমিয়ে আছে কিনা বোঝা না গেলেও মাহীনকে এভাবে খুব নিষ্পাপ দেখাচ্ছে। হালকা বাতাসে রেশমি চুলগুলো মাঝে মাঝে উড়ে এসে মুখের ওপর পরছে। তখন ওকে আরোও স্নিগ্ধ লাগে। রায়েদ মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকার পর নিঃশব্দে ওর পাশের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল। খুব সাবধানে মাহীনের মুখের ওপর থেকে চুলগুলে সরিয়ে দিতেই মাহীন কিছুটা চমকে উঠে চোখ মেলে তাকাল। ঘুমের কোনো রেশ নেই চোখে। সতেজ মুখভাব। শুধু একটু চমকে উঠেছে এই যা। রায়েদ বলল, ‘তুমি ঘুমিয়ে ছিলা না?’
মাহীন উঠে দাঁড়িয়ে আবার সোজা হয়ে ভালো ভাবে বসল। কোমড় বাঁকিয়ে হেড ডাইন করে থাকার কারণে মেরুদণ্ড সোজা করতে কষ্ট হচ্ছে। বলল, নাতো। ঘুমাবো কেন?’

‘নাহ এমনি তোমাকে দেখে মনে হয়নি তুমি জেগে আছ।’ মাহীন নিজের মাফিনের প্যাকেটটা খুলতে খুলতে বলল,’ওহ আচ্ছা। তোমার অপেক্ষা করছিলাম। বাই দ্যা আমার এত সহজে ঘুম আসে না।’
‘তোমার যত এনার্জি। ঘুম আসবে কী করে।’

মাহীন মুচকি হাসল। মাফিনে এক কামড় বসিয়ে কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা তুমি এখন কী পড়ছো?’

‘ফিজিক্স।’

‘আরেহ না। উপন্যাসের কথা বলছি।’

‘ওহ আচ্ছা। লাভ হাইপোথেসিস। পড়েছো তুমি?’

‘না। তবে টিবিআর লিস্টে আছে।’

‘আর তুমি কী পড়ছো?’

‘পথের পাচালি।’

রায়েদ ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কী?’

মাহীন হাসল। বলল, ‘একটা বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী ক্লাসিক্যাল বই। তবে তুমি নামটা উচ্চারণ করতে পারবা না।’

‘তাই? আবার বলো দেখি। উচ্চারণ করি।’

‘নাহ থাক বইটার অপমান হয়ে যাবে।’
‘নাহ বলো না।’

‘প..থের পাচা..লি।’
‘পথের পাচা.লি।’
মাহীন অবাক হলো। এবং সহাস্যে বলল, ‘ওহ ওয়াও! তুমি পারলে!’

‘কেন পারবো না। বাই দ্যা ওয়ে এটার অনুবাদ আছে।’
মাহীন দ্বিধান্বিত হলো। বলল, ‘উম থাকতে পারে। আমি খুঁজে দেখবো। পেলে তোমাকে দিব।’ রায়েদ সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। মাহীন ওর মাফিন খাওয়া শেষ করে বলল, ‘আচ্ছা শোনো।’
রায়েদ বলল, ‘হুম বল।’
‘ওই যে সেদিন আমি এবং তুমি যে চিঠি পেয়েছিলাম।’ বলে একটু থামল। রায়েদ আগ্রহ ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাহীন বলল, ‘সেটা সিয়া লিখেছিলো।’
রায়েদ কপাল কুঁচকে বলল, ‘ইউ মিন এসিসিয়া?’

‘হ্যা।’

‘কিন্তু কেন এতে ওর কী লাভ?’ আরেকটু বেশিই অবাক হয়ে বলল।

‘ওয়েল দেখো প্রথমত এসব শুরু হয়েছে বিল থেকে।’

‘মানে বিল মুরেই? ঠিকঠাক খুলে বলো। বিল এবং সিয়া এসবের সাথে কিভাবে জড়িয়ে আছে?’

‘একচুয়েলি আসল চিঠিটা লিখেছিল বিল।’

‘কাকে দেওয়ার জন্য? তোমাকে?’

‘হ্যা। তো সেটা সিয়ার দেয়ার কথা ছিলো। এখন সিয়া সেটাতো জীবনে আমাকে দেইনি। তারওপর আমার তরফ থেকে তোমাকে চিঠি দিয়েছে এবং তোমার তরফ থেকে আমাকে চিঠি দিয়েছে।’

‘ওফ বুঝেছি। এসব জট ঝামেলা পাকানোর কোনো মানে হয়? আর তোমার কী বিলের সাথে কথা হয়েছে?’

‘উম হ্যা। অবশ্য মূল ঘটনাটা ওর বন্ধু ম্যাটের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি।’
দুনিয়ার প্যাচানো ঘটনাগুলো দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে এলো রায়েদের বুক চিরে। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা বিলের চিঠিটা তোমার হাতে সত্যিই পৌঁছলে তুমি কী করতে?’

‘কী করতাম মানে?’

‘ওর সাথে যেতা ডেটে?’
মাহীন হালকা হাসল। আমোদিত কন্ঠে বলল, ‘আমার ফ্রেন্ডদের সাথে আলোচনা করলে ওরা আমাকে ঠিকই পাঠাতো। তবে আমি মনে হয় না যেতে আগ্রহী হতাম।’

‘ওহ তাই নাকি। তো আমার ক্ষেত্রে কী হয়েছিল?’
মাহীন হেসে বলল, ‘ওরা তো এখনোও জানেই না।’

‘মাহীন!’

‘আহা তুমি তোমার ফ্রেন্ডদের বলসো?’

‘কোন ফ্রেন্ডকে বলবো? আমার ফ্রেন্ড কোথায়?’

‘আরেহ বানিয়েছো না ফ্রেন্ড।’

‘নায়েল। ওতো তোমারও ফ্রেন্ড।’

‘হুম তা ঠিক।’ হেসে বলল। রায়েদও হাসল।

ইনশাআল্লাহ চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here