এল_এ_ডেইস পর্ব ৪৬ (অন্তিম পর্ব)

0
715

#এল_এ_ডেইস
পর্ব ৪৬ (অন্তিম পর্ব)
লেখনী- মাহীরা ফারহীন

‘মাহীন! মা একটু এদিকে আয়তো।’ বাবার ডাকে ফিরে তাকাল মাহীন। মাহীন, রাবিত ও নাইম বুক সেলফের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। রাবিত সেখানে মেঝেতে হাঁটু গেঁড়ে বসে সেলফ থেকে একটা বাক্স বের করছে। মাহীন এগিয়ে আসল সোফার দিকে। সাথে সাথে নাইমও আসল। রাবিত বাক্সটা আবার ঢুকিয়ে রাখতে ব্যস্ত হলো। মিসেস রহমান সকলের সামনে একটা ছোট বাক্স নিয়ে সোফায় বসে আছেন। রায়েদ মাত্র এসে ওনার সোফার পেছনে দাঁড়িয়েছে। মাহীন সেখানে এসে বলল, ‘জ্বী বাবা?’
‘মিসেস রহমান কিছু একটা বলবেন তোকে।’ বলে মিসেস রহমানের দিকে ইশারা করলেন মি.মোর্শেদ। মাহীন গিয়ে ওনার পাশে বসল। মিসেস নাসরিনের বিভ্রান্তী ভরা দৃষ্টি। মিসেস মাদিহকে বেশ খুশি খুশি লাগছে। রায়েদ নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। মাহীন প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাল মিসেস রহমানের দিকে। মিসেস রহমান অবশেষে মুখ খুললেন, ‘দেখেন আপনারা তো জানেনই আপনার মেয়েটা আমার জন্য এবং আমার পরিবারের জন্য কী করেছে। সেটার তো আর ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব নয়। তবে…তার কথার মাঝখান দিয়ে মিসেস নাসরিন অমায়িক হেসে বললেন, ‘আপনি কিন্তু আমাদের লজ্জা দিচ্ছেন এখন। এত ঋণ টিনের কথা বলবেন না তো।’
মিসেস রহমান হাসলেন। বললেন, ‘তা বললে কী হয়? যাই হোক আমি মাহীনকে কিছু একটা দিতে চাই। আশা করছি আপনারা কিছু মনে করবেন না।’ বলেই সেই বাক্সটা হাতে নিলেন। মাহীন বিব্রতভঙ্গীতে তাকিয়ে রইল সেটার দিকে। মিসেস রহমান সেটা খুলে একটা স্বর্ণের ব্রেসলেট বের করে আনলেন। তা দেখেই মাহীন চোখ বড় বড় করে তাকাল। মি.মোর্শেদ এবং মিসেস নাসরিন দুজনেই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। মি.মোর্শেদ বললেন, ‘মিসেস রহমান তাই বলে এতটা করার দরকার ছিলো না।’ তবে মিসেস রহমান এর উত্তরে কিছু বললেন না। মাহীনের বাম হাতটা আলতো করে ধরে ব্রেসলেটটা ধীরে ধীরে পরিয়ে দিলেন। নাইম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। মিসেস মাদিহ আন্তরিক হেসে বললেন, মা তোর ব্রেসলেটটা ভালো লেগেছে তো? এটা আমি নিজে পছন্দ করে দিলারাকে দিয়েছিলাম।’
মাহীন বিচলিত ভাবে হাসার চেষ্টা করল। বুক ধুকপুক করছে। ভাবছে, ‘ইয়া আল্লাহ যেই ব্রেসলেট মিসেস মাদিহ ওনার বৌমাকে দিয়েছিলেন সেটা মিসেস রহমান আমাকে কেন দিচ্ছেন? ওফ তাও বাবা – মায়ের সামনে। ওনারা কী ভাববেন?’
রাবিত রায়েদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। ফিসফিস করে টার্কিশ ভাষায় বলল, ‘ভাই মা এটা কী করছে? এটা তো আরো কয়েকছর পর দেওয়ার কথা ছিলো। তাই না?’
রায়েদ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। শুকনো কন্ঠে বলল,
‘মার আর ধৈর্য্য কুলচ্ছে না। উনি মাহীনের মা-বাবাকে এখনি সব জানাতে চান।’

‘এই যাহ ঝামেলা হয়ে গেলো তো। মা এসব না জানলেই ভালো ছিলো।’

‘হুম…এই একমিনিট মা এসব জানলেন কী করে?’ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রাবিতের পানে তাকিয়ে বলল রায়েদ।

রাবিত অপ্রস্তুত কন্ঠে বলল, ‘আমি কী জানি? তোমাদের হাবভাবে দেখে বুঝে নিয়েছে বোধহয়।’
রায়েদ এখনো সন্দেহ ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তীব্র কন্ঠে শুধালো, ‘তো তোর এরকম চোরা চোরা ভাব কেন? নিশ্চয়ই তুই বলেছিস তাই না?’

রাবিত জুলজুল চোখে চেয়ে বলল, ‘দেখো আমি বাবান্নেমের সঙ্গে এটা নিয়ে কথা বলছিলাম এবং মা শুনে ফেলেছে।’ এক টানে বলে গেল কথাগুলো। রায়েদ নিরাশা জনক দৃষ্টিতে তাকাল। তখনই মিসেস রহমান বললেন, ‘আমি আপনাদের সঙ্গে আলাদা করে কিছু কথা বলতে চাই।’ বলেই ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের দিকে তাকালেন। বললেন,
‘আরেহ তোরা সবাই চুপচাপ কেন এত? একে অপরের সঙ্গে কথা বল।’ মাহীন সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল। এই ব্রেসলেট পরে সকলের মাঝে বসে থাকতে চরম অস্বস্তি ও লজ্জা হচ্ছিল ওর। মিসেস রহমান যে ইনডিরেক্টলি সকলকে এখান থেকে সরে যেতে বলেছেন সেটা বুঝতে আর কারোও বাকি নেই। নাইম সাথে সাথে মাহীনকে ধরে বসল। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, ‘এই মিসেস রহমান এখুনি তোকে নিজের গয়নাগাটি দিয়ে দিচ্ছেন কেন? তোদের বিয়ে তো এখনো ঠিক হয়নি। মা-বাবার সামনে তো ঝামেলা হয়ে যাবে।’

মাহীন উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ‘ধ্যাৎ ফালতু কথা বলি্স না। তবে ওনার এই কাজের কূলকিনারা আমিও করতে পারছি না।’

‘রায়েদের সঙ্গে কথা বল। হয়তো ও জেনে থাকতে পারে ঘটনা কী।’ মাহীন উপরে নিচে মাথা নাড়ল। রাবিত এবার নাইমকে টেনে আবারও সেই বুক সেলফের নিকট নিয়ে গেল। কী যে দেখাতে এত উদগ্রীব কে জানে। মাহীন সিঁড়ির পেছনে বাগানে বের হওয়ার দরজার দিকে এগিয়ে গেল। রায়েদও ওর সাথে সাথে চলেছে। মাহীন দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ঘেমেও উঠেছে ও। চরম উদ্বিগ্ন এবং উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। এবার রায়েদের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে অস্থির গলায় বলল, ‘এ্যই মিসেস রহমান আমার বাবা-মাকে কী বলছেন? আর উনি আমাকে এভাবে ওনার ব্রেসলেট দিয়ে দিলেন কেন? তুমি জানো এটার মানে কী দাঁড়ায়?’
রায়েদ মাহীনের বাম হাতটা ধরে আমুদে গলায় বলল, ‘বাহ ব্রেসলেটটা তো খুব সুন্দর মানিয়েছে!’
মাহীন বিরক্ত হলো। বলল, ‘ধ্যাৎ! ফাজলামো করো না। বলো হঠাৎ মিসেস রহমানের কী হলো?’
রায়েদ এবার পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে মাহীনের দিকে তাকাল। বলল, ‘কী আবার, মা আমাদের সম্পর্কের কথা জানেন এবং এখন সেটা তোমার মা-বাবাকে জানাচ্ছেন।’
যদিও মাহীন আন্দাজ করতে পেরেছিল তবুও আঁতকে উঠল। জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু উনি জানলেন কী করে? তুমি বলেছো? আর এজন্যেই এই ব্রেসলেটটা আমাকে দিলেন?’
রায়েদ সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। ভারি কন্ঠে বলল,
‘হ্যা। তবে এটা ঠিক আমি বলিনি। রাবিতকে বাবান্নেমের সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলতে শুনে ফেলেছেন মা।’
মাহীন হতাশ ভাবে প্রলম্বিত শ্বাস ফেললো। ওকে এত দুশ্চিন্তায় ডুবে থাকতে দেখে রায়েদ বলল,
‘তুমি এত চিন্তায় কী নিয়ে? তোমার বাবা-মা সবকিছু জানার পর আমাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে দিতে বলতে পারেন এমন কিছু ভেবে?’
এই কথায় যেন মাহীন কোনো অশরীরী দেখার মতো চমকে উঠল। তারপর তীব্রভাবে বলল, ‘ওফ তুমি এসব বলে আমাকে আরোও ভয় দেখাচ্ছ! এটা তো আমার মাথায়ও আসেনি। এমন কিছু এট লিস্ট ওনারা করবেন বলে মনে হয় না। তবে এরপর আমি ওনাদের সামনে যাবো কী করে? আল্লাহ কী ইমব্যারেসিং!’
রায়েদ চাপা হাসলো। মাহীনের রেশমি চুলগুলো আঙ্গুলে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে প্রমত্ত কন্ঠে বলল, ‘হুম নতুন এক্সপেরিয়েন্স হচ্ছে।’
মাহীন নিজের চুল টেনে সরিয়ে নিল। বলল, ‘কিসের এক্সপেরিয়েন্স?’

‘এই যে এর আগে কখনো তোমাকে এত দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হতে দেখিনি। এটা নতুন দেখছি। নতুন এক্সপেরিয়েন্স না?’

মাহীন হতাশ কন্ঠে বলল, ‘রায়েদ!’
রায়েদ মাহীনের ঘাড়ের পেছন দিয়ে এক কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল, ‘চলো তোমাকে কিছু দেখাই।’
মাহীন প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাল। তবে কিছু বললো না। ওর সাথে এগিয়ে গেল। রায়েদ বাগানের অপর পাশে এসে একটা লাল রঙের পাতাবাহারের সামনে দাঁড়াল। তারপর নিচে ঝুঁকে বলল, ‘দেখো ওখানে কী?’
মাহীনও ওর কথা মতো ঝুঁকে বুঝার চেষ্টা করল ও কী দেখাচ্ছে। প্রথমে মাটি,ঘাস ও পাতাবাহার ভিন্ন কিছু চোখে পরল না। এরপর খেয়াল করল সেখানে একটা ছোট মতো চারাগাছ লাগান। মাহীন ভ্রু কুঁচকে বলল,’এটা কিসের চারা?’

রায়েদ নিগূঢ় কন্ঠে বলল, ‘তুমি বুঝার চেষ্টা করো।’

‘আহা বলো না। চেনাচেনা লাগছে কিন্তু বুঝতে পারছি না।’

‘এটা ভারবেনা ফুলের চারা।’ মাহীন অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর ধীরে ধীরে ওর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। উৎফুল্ল কন্ঠে বলল, ‘ওহ ওয়াও! তুমি এই ফুলের চারাই বাগানে লাগিয়ে রেখেছ! আমাকেও চারা এনে দাও।’

‘আচ্ছা আচ্ছা এরপরের বার তোমাকেও সাথে নিয়ে যাবো।’

‘এগুলো কী শুধু চারা থেকেই হয়?’

‘না বীজ থেকেও হয়।’

‘বীজ কোথায় পাবো?’

‘কোথায় আবার ফুলের মধ্যেই থাকে।’

মাহীন ভ্রু উঁচু করে বলল, ‘আহ তুমি আমাকে আগে বলবানা।’

‘কেন কী হয়েছে?’

‘আমার কাছে তো ফুল ছিলোই। আগেই বীজ রোপণ করে বসে থাকতাম।’

রায়েদ অবাক হয়ে বলল, ‘তোমার কাছে এখনো সেই ফুল আছে?’

‘আরেহ থাকবে না কেন? সেই পিকনিক টু লস এঞ্জেলস সবটুকু ফুলই যত্ন করে রেখে দিয়েছি। যদিও তা শুঁকিয়ে গিয়েছে।’

‘তুমি পারোও বটে। ফুল আবার যত্ন করে তুলে রেখেছো বাহ!’ মাহীন হাসল। বলল, ‘হ্যা বইয়ের মাঝে রেখেছি। আর যাই হারিয়ে যাক বই হারাবে না। সাথে ফুলো না।’
রায়েদ মাহীনের প্রমত্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হাসল।
.
.
.
.
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা নাগাদ মিসেস বিং এসে হাজির হলেন। যদিও ওনার আসার কথা ছিলো বিকেল পাঁচটায়। তবে তাতে কেউ কিছু মনে করে না। কারণ এই তল্লাটে খুব অদ্ভুত একটি নিয়ম প্রচলিত রয়েছে। যা হলো কেউ কাওকে দুপুর চারটার দাওয়াত দিলেও সে আসবে সন্ধ্যা আটটায়। এটাই স্বাভাবিক। দুপুর চারটার দাওয়াতে আদৌতেও আমন্ত্রণকারীও দুপুর চারটা বোঝায় না। এরপর এলেন মিসেস রে। অবশ্য এটা অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো। মিসেস রেকে মূলত দাওয়াত দেওয়ার বুদ্ধিটা রাবিতের ছিলো। যতই হোক এই মানুষটাও এত বছর রায়েদকে স্নেহ করে, যত্ন করে ওর পাশে ছিলেন। তিনিও কৃতজ্ঞতা পাওয়ার অধিকার রাখেন। সকলে বেশ আনন্দিতই হলো তার আগমনে। সবচেয়ে বেশি খুশি হলো মাহীন। সকলে এসে পৌঁছার পরই রাতের খাবার আরম্ভ হলো। মাহীন সেই বিকেলে মিসেস রহমান ওর মা-বাবার সাথে কথা বলার পর থেকে যথাসম্ভব ওনাদের থেকে দূরে দূরে থেকেছে। ভয় করছে বড্ড! কী যে ওনারা বলবেন এ সম্পর্কে তার কোনো ঠিক নেই। তবে খাওয়া দাওয়ার সময় কিছু বললেন না। সকলে একসাথে গল্পে মশগুল থাকল। টেবিল সাজানো নানা ধরনের সুস্বাদু খাবারে। টার্কিশ খাবারগুলোর মাঝে আবার বিরিয়ানি ও কোর্মা রয়েছে। বিরিয়ানিটাও আবার এক দেখার মতো জিনিস। বিরিয়ানি তো ঠিকই আছে তবে তা একটা বড় রুটির মধ্যে বাক্স আকারে মুড়িয়ে রান্না করা হয়। সেটা হয়ে যাওয়ার পর খাওয়ার সময় কেকের মতো রুটিগুলো কেটে বিড়িয়ানি বের করতে হয়। এটা নাকি আজারবাইজানী ঐতিহ্যবাহী বিরিয়ানি। যা পাশের দেশ তুরস্কতেও জনপ্রিয়।

মিসেস রে আন্তরিক ভাবে বললেন, ‘সত্যি বলতে আমি কখনো ভাবিনি একদিন এই দিন দেখারও সৌভাগ্য হবে।’

‘কেই বা ভাবতে পেরেছিল। কত বছর আপনার কাছ থেকে কত যে ফোন কল পেয়েছি রাবিতের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে তার কোনো ইয়ত্তা নেই অথচ কখনো দেখাই হয়নি।’ হাসতে হাসতে বললেন মিসেস রহমান। রাবিত লজ্জায় মিইয়ে গেল। ওনারা হাসলেন। মিসেস বিং পানি সিপ করে বললেন,
‘আর আমার বিষয়টা দেখেন। আমার ক্যারিয়ারে কত পেশেন্ট দেখেছি অথচ এতটা পার্সোনাল ভাবে কারোও সাথে মেশা হয়নি যে তার বাড়ি দাওয়াত খেতে যাওয়া হবে।’ ওনার পাশ থেকে ফ্র্যাঙ্ক বলল, ‘হোয়য়ার? ডিডেন্ট ইউ ওয়েন্ট টু ন্যইম ব্রাদারস হাউজ সেভারাল টাইমস?’
মিসেস বিং মুচকি হেসে বললেন, ‘গিয়েছি তবে ওনারা তো আমার প্রতিবেশী বাবা।’
‘ওহ আই সি। আই থট দেই উয়েয়ার ইওর পেশেন্টস।’
ওনারা সকলে হেসে উঠলেন।
মিসেস রে মাহীনের পাশেই বসে ছিলেন। উনি মাহীনের হাতের দিকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘বাহ তোমার ব্রেসলেটটা তো বেশ!’ ব্রেসলেটের প্রসঙ্গ উঠতেই মাহীন পুনরায় বিব্রতবোধ করল। মা-বাবার দিকে দৃষ্টি ফেরাল। মি.মোর্শেদ ভাবলেশহীন। তবে মিসেস নাসরিন কেমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। এদিকে মিসেস রহমান ও মিসেস মাদিহ বেশ উদ্ভাসিতমুখে তাকিয়ে আছেন। যেহেতু ব্রেসলেটের কথা উঠলো অবশ্যই এটা কার দেওয়া সেটা বলতে হয় এখন। বিশেষ করে যখন তাঁরা সামনেই বসে আছেন। মাহীন শুঁকনো গলায় বলল, ‘তা বটে। এটা মিসেস রহমান আমাকে দিয়েছেন।’ বলেই খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। যেন এই মুহূর্তে খাবারের থেকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নেই। মিসেস রে এবার মিসেস রহমানের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললেন, ‘ওহ আচ্ছা তো এটা আপনার পছন্দ। কোথা থেকো নিয়েছেন?’
‘নাহ এটা মায়ের পছন্দ উনি আমাকে দিয়েছিলেন।’
মিসেস বিং হেসে বললেন, ‘বাবাহ এটা তো দেখি অনেক হাত ঘুরল।’
মিসেস মাদিহ বেশ গর্বের সঙ্গে বললেন, ‘এটা ১৯৬৭ তে ভ্যালেন্টিনো থেকে আমিই পছন্দ করে কিনেছিলাম।’

মিসেস বিং বললেন, ‘হুম আপনার পছন্দ আছে বলতে হবে। তবে ভ্যালেন্টিনো তে এই ডিজাইন এখন আর তৈরি হয় না।’

মিসেস নাসরিন বললেন, ‘হ্যা তবে আগেকার ডিজাইনার দের ডিজাইনগুলো সেইরকমই ছিলো। এখন অনেক বেশি এক্সপেন্সিভও হয়েছে বটে।’

‘এজন্যেই আজকাল শেনেলে ও প্রাডায় বেশি যাওয়া হয়। ভ্যালেন্টিনোতে তেমন একটা ঢুকি না।’

মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এই শুরু হয়েছে গয়নাগাটি নিয়ে আলোচনা। তা এখন বহু লম্বা সময় পর্যন্ত চলবে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে উঠতেই রাবিত এসে মাহীনকে বলল,
‘দেখো এত প্যানিক করার কিছু নেই। মা যখন এসব তোমার মা-বাবাকে বলল আমি তো ঔখানেই ছিলাম। মনে তো হলো না ওনারা এসব নিয়ে অমত করবেন।’
‘না মানে তা তো আমারও মনে হচ্ছে না। তবে কোনো কিছুরই ঠিক নেই। তার ওপর ওনারা যখন আমাকে এসব নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন তখন কী বিব্রতকর পরিস্থিতিতেই না পরবো আমি।’ বিচলিত ভাবে বলল মাহীন।
‘এভরিথিং উইল বি ফাইন বালদিজ।’
‘কী বললা?’
‘না তারপর কী বললা?’ শুধালো মাহীন।
‘কোই আর কিসু বলিনি তো।’ বলেই প্রায় ঝড়ের বেগে চলে গেল ও। মাহীন মিসেস মাদির দিকে এগিয়ে গেল। উনি এখনো ডাইনিং টেবিলে বসে আছেন মিসেস রেয়ের সঙ্গে। ওনাকে আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবান্নেম, বালদিজ মানে কী?’
‘কী মানে?’ ভ্রু কুঁচকে তাকালেন উনি।
‘বালদিজ?’
‘ওহ ভাবী। কিন্তু এই শব্দ কোথায় শুনলি তুই?’
‘কোথাও না একটা টিভি সিরিজে।’ বলেই এসে পরল। তারপর ভাবতে লাগল, ‘এইরে এটা এতদিন খেয়াল করিনি কেন? রাবিত দেখি তখন থেকেই মাঝেমাঝে আমাকে টার্কিশ ভাষায় ভাবী বলে ডাকে যখন আমার আর রায়েদের মধ্যে কিছু ছিলোও না!’
কিছুক্ষণ ওর মিসেস নাসরিন মোটামুটি জেরা করেই মাহীনকে ধরে নিয়ে গেলেন একপাশে। মূলত মিসেস রহমানের কামরায়। মিসেস রহমান নিজেই ওনাদের ফ্রেস হতে চাইলে সেখানে যেতে বলেছেন। মাহীনের মনে হলো যেন ওকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মিসেস নাসরিন বেশ কঠোরভাবেই বললেন, ‘তোর এই ব্রেসলেট সম্বন্ধে কী অভিব্যক্তী?’
মাহীন স্তিমিত কন্ঠে বলল, ‘এটা সুন্দর।’
‘আমি জিজ্ঞেস করেছি তোর কী মনে হয় মিসেস রহমান তোকে এটা কেন দিয়েছেন?’
মাহীন প্রথমেই কিছু বলতে পারলো না। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলল, ‘উপহার স্বরুপ দিয়েছেন।’
মিসেস নাসরিন বেশ ঝাঁজের সঙ্গে বললেন, ‘এই একদম এমন ভাব দেখাবি না যেন কমলার খোসা ছিলে খেতে পারিস না! তোকে এটা দেওয়ার পর উনি আমাকে এবং তোর বাবাকে সবই খুলে বলেছেন। তোকে দুটো চড় দেওয়া উচিৎ!’ মাহীন চোয়াল বুকের সঙ্গে লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিসেস নাসরিন বলে গেলেন, ‘তোরা একে অপরকে পছন্দ করিস সেজন্যে নয়। বরং এই কথাটা আমার ওনার মুখ থেকে শুনতে হলো সেজন্যে। কেন তোর মুখে কী কুলুপ এঁটে বসে ছিলিস? তুই আমাকে আগে বলতে পারলি না?’
মাহীন মিনমিন করে বলল, ‘মা আমি আসলে ভয়ে ছিলাম তুমি ব্যাপারটা কীভাবে নিবা সেই ব্যাপারে।’
মিসেস নাসরিন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, ‘আমি ব্যাপারটা কীভাবে নিবো সেটা পরের কথা। তোর আগে আমাকে জানানো উচিৎ ছিলো।’ বলে থামলেন। তারপর আবার বললেন, ‘তোদের সম্পর্কের কত দিন হলো?’
‘আগস্টের নয় তারিখই শুরু হয়েছে।’
মিসেস নাসরিন হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পরলেন। বললেন, ‘ইশ বেশি দিন নয়। তোদের যদি আরেকটু বয়স বেশি হতো বিয়ের কথা ভাবা যেত। আচ্ছা রায়েদের দুইদিন আগে আঠারো হলো না?’
মাহীন সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল।
‘আর তোর এই নভেম্বরে সতেরো হবে। নাহ দেরি আছে এখনো। ওফ ঝামেলা!’
মাহীন মায়ের পাশে বসে আকুতি ভরা স্বরে বলল,
‘মা প্লিজ আমাকে এই সম্পর্ক ভেঙ্গে দিতে বলো না।’
‘আরেহ ওফ আমি কী এই কথা একবারো বলেছি। অহেতুক ঘ্যানঘ্যান করবি না কানের কাছে।’ বিরক্ত কন্ঠে বললেন মিসেস নাসরিন। মাহীন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। যাক অন্তত ওদের একে অপরকে পছন্দ করা নিয়ে ওনাদের কোনো সমস্যা নেই।
.
.
এর বেশ কিছুক্ষণ পর সকলে প্রস্থান করতে প্রস্তুত হলো। দু’পক্ষর দিক থেকেই সবুজ বাতি জ্বলতে দেখে মাহীনের মনটা বেশ প্রফুল্ল হয়ে উঠেছে। এই সময়ের মধ্যেই মহিলাদের মাঝে বেশ ভালোই সক্ষ্যতা গড়ে উঠেছে। বারবার একটা কথা কানে এলো, এরপরের বার জমায়েতটা বোধহয় মাহীনের বাড়িতেই হতে পারে। এদিকে নাইম, রাবিত ও ফ্র্যাঙ্ক পিএসফাইভে জমিয়ে গেম খেলেছে। মাহীন শুধু অবাক হয়ে দেখলো উনিশ বছর থেকে ষোলো এবং ষোলো থেকে সাত বছরের তিনটা ছেলে কী সুন্দর বন্ধুত্ব পাতিয়েছে। বাড়ির বাইরে উবার এসে দাঁড়িয়েছে। প্রথমে মাহীনরা চলে যাচ্ছে। মিসেস রহমান বাইরে বেরিয়ে এসেছেন। মিসেস নাসরিন এবং মি.মোর্শেদ তার কাছ থেকে বিদায় নিতে ব্যস্ত। মাহীনের সাথেই রায়েদ দাঁড়িয়ে ছিলো। মাহীন ব্রেসলেট পরা হাত উঠিয়ে ঝাঁকি দিয়ে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, ‘দেখো তোমার পরিবারের একটা বিশেষ জিনিস এখন থেকে আমার!’
রায়েদ মুখে মিটিমিটি হাসি ঝুলিয়ে বলল, ‘কিছুক্ষণ আগ পর্যন্তও না তোমার এটা দেখে সাফোকেশন হচ্ছিল?’

‘এখন আর হচ্ছে না। বরং এটা দেখে ভালোই লাগছে।
আর হ্যা এখন থেকে আমি কিন্তু প্রতিদিন তোমার বাসায় আসব।’
‘তাই? ভালো খবর তো। তো আমাকে দেখতে আসবা?’
‘নাহ শখ কত। আমি তো আমার প্রতীকী ফুল ভারবেনা কতটুক বড় হলো এটা দেখতে আসব।’

‘বাহ দেখেছ তুমি কিন্তু ফাঁদে পা দিলা।’

‘কিসের ফাঁদ শুনি?’ ভ্রু কুঁচকে বলল মাহীন।
‘ভারবেনার ফাঁদে। তুমি দেখতে আসবা ভারবেনার গাছ। কিন্তু আমার আসল ভারবেনা তো তুমি।’
মাহীন লাজুক হাসল। আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তখনই মি.মোর্শেদ বললেন, ‘মাহীন আয়, আর কত গল্প করবি।’
নাইম গাড়িতে উঠে বসেছে। মিসেস নাসরিন গাড়িতে উঠে বসে বললেন, ‘আসলেই আমার মেয়েটা অনেক বেশি বাঁচাল কিন্তু। মিসেস রহমান হেসে বললেন, ‘আহ এভাবে বলবেন না। ওর কথা শুনতে কিন্তু বেশ লাগে।’ মাহীনও গিয়ে গাড়িতে উঠল। ফ্র্যাঙ্ক মিসেস বিংয়ের হাত ঝাঁকিয়ে বলল, ‘মাম্মা ডু ইউ নো নেইম ব্রাদার এন্ড র‌্যবিট ব্রাদার ইজ দ্যা বেস্ট পারসন আই হ্যাভ এভার মেট। উই বিকেম বেস্ট ফ্রেন্ডজ।’ ওনারা হেসে উঠলেন। রায়েদ বলল, ‘বাহ কী ট্রিও!’
মাহীনদের গাড়িটা এবার চলতে শুরু করল। মাহীন এবং নাইম জানালা দিয়ে হাত নাড়তে থাকল। তাদের গাড়িটা ক্রমশই যানবাহনের ভিরে হারিয়ে গেল। মনের মানুষগুলো দূরে চলে গেলেও আসলে তারা কাছেই থেকে যায়। আবারও ফিরে আসে কাছে। উপরে অন্ধকার আকাশে শিল্পী জোছনা ভরা শুক্লপক্ষের দশমী চাঁদ এঁকেছে। সেই চাঁদ থেকে রুপোলী আলো বরফ গলা পানির মতো গলে গলে পরছে। রায়েদ সেই রুপোর থালার দিকে দৃষ্টি রেখে ভাবল, যাহ মাহীনের সঙ্গে চাঁদটা তো দেখা হলো না। তবে কী হয়েছে, ও আবার আসবে। আবার দেখা হবে। আবার শুক্লপক্ষের চাঁদও উঠবে।

সমাপ্তি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here