বোধোদয়,অন্তিম পর্ব
প্রচলিত সামাজিক নিয়মে নিজের মনের ভাব গোপন রেখেই শাফায়াত ও তার মা’কে নিজ গৃহে আন্তরিক আমন্ত্রণ জানালেন সুফী সাহেব। জামাইয়ের প্রতি ক্ষোভ থাকলেও সেটা সামনাসামনি প্রকাশ করলেন না ঐন্দ্রিলাও। তবে নিশিতা সামনে আসলো না। আসার পর থেকেই শাফায়াত অধীর হয়ে ছিল নিশিতাকে দেখার জন্য। যদিও প্রকাশ করলো না তেমন। তার এই আকুলতা লক্ষ্য করলেন সুফী সাহেব। নিজের স্ত্রীর কাছে যেতেও আজ অনুমতির প্রয়োজন পড়ছে শাফায়াতের। কোথায় নামিয়ে এনেছে সে নিজেকে, ভাবতেই কষ্টের একটু মুচকি হাসি বেরিয়ে এলো।
এদিকে ঐন্দ্রিলার কাছে দুঃখ প্রকাশ করলেন সাফিয়া,
– ‘বেয়াইন, যা হয়েছে, খুবই অন্যায় হয়েছে, স্বীকার করছি। এবারের মতো আমার ছেলেটাকে ক্ষমা করে দিন। ওদের বয়স কম। যা করেছে, সেটা যে কত বড় ভুল, সেটা দেরীতে হলেও তো বুঝতে পেরেছে। নিশিতা মা কে ছাড়া আর একটা দিনও থাকা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে আমার জন্য। ও যে আমার কাছে কি, সেটা যদি বোঝাতে পারতাম।’
বেয়াইনের মেয়ের প্রতি এমন মনোভাবে মনটা নরম হয়ে এলো ঐন্দ্রিলার। শুরু থেকেই তার মেয়েকে কিভাবে ট্রিট করেছেন সাফিয়া, সেটা তো মেয়ের কাছে, স্বামীর কাছে অনেকবারই শুনেছেন। নিজের চোখেও দেখেছেন। শাশুড়িও যে ছেলের বউকে এভাবে ট্রিট করতে পারে, সেটা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতেন না। ঐন্দ্রিলার নিজের জীবনের অন্যতম বাজে অভিজ্ঞতা হয়ে আছে তার শাশুড়ির সাথে কাটানো সময়গুলো। ঐ মানুষটার কথা আজও তিনি মনে করতেও চান না। হয়তো তার নিজেরও ভুল ছিল। তবে মুরুব্বী হিসেবে শাশুড়িদেরও কিছু দায়িত্ব থাকে। ডমিনেট করে আর যাই হোক, সম্পর্ক হয় না। আর শাশুড়ি যেমন নিজে একজন মা, তাঁর পুত্রবধূও কিন্তু একজন মা। নিজে মা হয়ে আরেক মা’কে অপমান করে সন্তুষ্টির খোঁজ করে কিংবা ছেলের কান ভারী করে পুত্রবধূর জীবন নরক বানিয়ে যে মানুষ তৃপ্তি পায়, তিনি যে মানুষ হিসেবে অযোগ্য, সেটা নিশ্চিত। সাফিয়ার হাত দু’টো ধরে ঐন্দ্রিলা বললেন,
– ‘আপা, আমি জানি, আপনি কতোটা করেছেন নিশিতার জন্য। আপনাকে তো মায়ের মতোই দেখে সে। সমস্যা তো আসলে আপনার ছেলের। যেখানে সে চায় না, সেখানে আমাদের কি করার থাকতে পারে, বলেন?’
এবার শাফায়াত মুখ খুললো,
– ‘মা, আমার মনে হয় আপনারা আমাকে ভুল বুঝছেন। বাবার কাছে হয়তো জেনেছেন, আমি ইতোমধ্যেই ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছি। আর আপনারা হয়তো আমাকেই সম্পূর্ণভাবে দোষী ভাবছেন। আসলে তা নয়।’
একটু থামলো শাফায়াত। মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে উনি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। ছেলে তাঁর সম্মান রাখে কিনা, সেটাই ভাবছিলেন হয়তো। তবে শাফায়াতের দৃষ্টি তার কাছে সুবিধার লাগলো না। ছেলে যে আজকে একটা বিহিত করেই ফিরবে, সেটা অবশ্য বুঝতে পেরেছিলেন আগেই। তাই ছেলেকে থামানোর চেষ্টা করলেন না। শাফায়াত শুরু করলো আবার,
– ‘মা’কে আমি বিয়ের আগে সরাসরিই বলেছিলাম নিশিতার ব্যাপারে যে ওকে আমার খুব পছন্দ হয়নি। কিন্তু মা’র ওকে অসম্ভব পছন্দ হয়ে যাওয়ায় বিয়েটা হয়ে যায়। এখন হয়তো বলতে পারেন নিজের বক্তব্যে কেন অটল থাকলাম না। এটা আসলে বড় ভুল ছিল, স্বীকার করছি। আর নিশিতার সাথে যা করেছি, সেটাও আসলে ক্ষমার অযোগ্য। তবে ওর মানসিকতা, ধৈর্য, কেয়ারিং, ভালোবাসা – এসবই আমাকে বদলে যেতে বাধ্য করেছে। সত্যি বলছি, ওকে ছাড়া থাকাটা আমার জন্য সম্ভব না।’
এত অকপট স্বীকারোক্তি, তাও শ্বশুর-শাশুড়ি বা নিজের মায়ের উপস্থিতিতে ! একটু হলেও বিব্রত হয়ে উঠলো পরিস্থিতি। সুফী সাহেব মনের ভাব প্রকাশ না করলেও ঐন্দ্রিলা একটু অপ্রস্তুত হয়ে উঠলেন। আর সাফিয়া তো আগে থেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন। তবুও তার অপ্রসন্ন ভাব চোখ এড়ালো না শাফায়াতের। ঐন্দ্রিলা’কে সহজ করার জন্য মুচকি হেসে বললো,
– ‘আমি আসলে এমনিই, মা। যা বলার সরাসরিই বলি। একটু ভাবুন তো? আমি কি পারতাম না সারাজীবন নিশিতার সাথে সুখে থাকার, ভালো থাকার অভিনয় করতে? খুব ভালোভাবেই পারতাম। আপনারা কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারতেন না। এমনকি, নিশিতাও পারতো না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমার নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ ঠিকই চলতো। তবে এখন আমি জানি, আমি ঠিক কি চাই, কতোটা চাই। জীবনে সব নেগেটিভ ঘটনার মাঝেই পজিটিভ কিছু থাকে। কখনও সেটা আমরা বুঝি, কখনও বুঝি না। নিশিতা এই ক’দিন আমার কাছে ছিল না, এটা একদিক থেকে আমার উপলব্ধির জন্য ভালো হয়েছে, যদিও কিভাবে ছিলাম এই দিনগুলো, সেটা সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন। বাকী জীবনটা নিশিতা’কে এক মুহূর্তের জন্যও কাছ ছাড়া করবো না, এটা আমার ওয়াদা।’ – দৃঢ় কণ্ঠে বললো শাফায়াত।
নীরবতা নেমে এলো ঘরে। সুফী সাহেব ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না কি বলবেন শাফায়াত’কে। এত বড় পরিবর্তন তো সচরাচর দেখা যায় না। বিশ্বাস করবেন কি করবেন না, এই দোলাচল শুরু হলো তার মধ্যে। ঐন্দ্রিলাও যেন কিছুক্ষণের জন্য ভাষা হারিয়ে ফেললেন। তবে শাফায়াতের প্রতি ক্ষোভের পরিমাণ যে এখন অনেকটাই কম, সেটাও বুঝলেন।
সাফিয়া এরই মধ্যে নিশিতাকে দেখতে চাইলেন। এতক্ষণে সে একবারও সামনে আসলো না, ব্যাপারটা ভালো লাগলো না তাঁর। তবে একটু পর নিশিতা এলো। গোসল সেরে নামাজে ছিলো সে। এর আগে শাশুড়ির পছন্দের কিছু আইটেমও বানিয়েছে। শাফায়াতের কাছে বেশ স্নিগ্ধ লাগছে তাকে, যেন প্রস্ফুটিত গোলাপ। রুমে ঢুকে শাশুড়িকে জড়িয়ে রাখলো কিছুক্ষণ নিশিতা। এই মা কে ছেড়ে সে এতোগুলো দিন কিভাবে থাকতে পারলো, ভেবে নিজের কাছে খারাপই লাগলো তার। সাফিয়াও চেষ্টা করলেন নিজেকে সামলাতে। মেয়েটা তাকে যে মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলেছে, এর থেকে তাঁর মুক্তি নেই। সুফী সাহেব -ঐন্দ্রিলা’ও মুগ্ধ চোখে দেখলেন এই যুগলবন্দী।
নিশিতার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সাফিয়া বললেন,
– ‘আর রাগ করে থেকো না, মা। ফিরে চলো। ঐ সংসার যে তোমাকে ছাড়া অপূর্ণ। আমার ছেলের কথা ছেড়েই দাও। আমার কথা একটু ভাবো। কিভাবে এই মা’কে ছেড়ে এতোগুলো দিন এভাবে থাকতে পারলে, বলো তো?’
নিশিতা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। অশ্রুসজল চোখে শাশুড়িকে জড়িয়ে তার পাশে বসে বললো,
– ‘আমাকে ক্ষমা করবেন। মা। এক মুহূর্তের জন্য হলেও স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলাম। আসলে কি মা, কিছু মানুষের জীবনে হারানোর বেদনা এত বেশী, যে প্রাপ্তির আনন্দও সেখানে ফিকে হয়ে যায়। যা চেয়েছিলাম, তা তো পেলাম না, অন্তত আপনার জন্য হলেও নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করবো। আপনার দোয়া যেন সবসময় আমার সাথে থাকে, মা।’
– ‘অবশ্যই আমাকে তোমার পাশে পাবে, মা। আর কখনও নিজেক একা ভেবো না।’ – সস্নেহে বললেন সাফিয়া।
সুফী সাহেব শাফায়াতের রিয়্যাকশন লক্ষ্য করছিলেন। কিছুক্ষণ আগেই তার নিজের করা প্রতিজ্ঞার মান সে কিভাবে রাখবে, সেটাই হয়তো দেখছিলেন। নিশিতা ঘরে ঢুকার পর থেকে কোন কথাই বলেনি শাফায়াত। নিশিতার সাথে মা’য়ের কথোপকথনে বিরতি পড়তেই সে ঐন্দ্রিলাকে বললো,
– ‘মা, আমি কি একটু নিশিতার সাথে আলাদা কথা বলতে পারি?’
– ‘নিশ্চয়ই। নিজের স্ত্রীর সাথে কথা বলতে আবার অনুমতি কিসের? যাও। নিশিতা, ওকে নিয়ে তোমার ঘরে যাও।’
নিশিতা এই ঘরে আসার পর থেকে শাফায়াতের দিকে খুব একটা তাকায়নি। এত সহজে তার অভিমানের পাহাড় গলবে না। মা’য়ের কথায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজের রুমে নিয়ে যায় শাফায়াত’কে। রুমে ঢুকতেই দরজা লাগিয়ে দেয় শাফায়াত। নিশিতা চমকে উঠে। শাফায়াত’কে তার দিকে এগুতে দেখে পিছিয়ে যায় সভয়ে। একদম কাছে এসে নিশিতাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে চিবুকটা উঁচু করে চোখে চোখ রাখে শাফায়াত। এমন গভীর স্পর্শে অদ্ভুত এক ভালো লাগা ছড়িয়ে যায় নিশিতার শরীর জুড়ে। তিরতির করে কাঁপে তার চোখের পাতা। যেন আচমকা লজ্জা গ্রাস করেছে তাকে। একসময় চোখ নামিয়ে নিলো নিশিতা। তবে নিজেকে সরিয়ে নিলো না। ওর ঠোঁটে আঙ্গুল বুলাতে বুলাতে শাফায়াত বলে,
– ‘ঐদিন যা হয়নি, সেটা যদি আজ হয়, কেমন লাগবে?’
– ‘জানি না, যাও !’ – লজ্জাবনত কণ্ঠে বলে নিশিতা।
নিশিতার কপালে চুমু খায় শাফায়াত। নিশিতার চোখ বন্ধ হয়ে আসে ভালোবাসার আবেশে। হঠাৎ উষ্ণ অশ্রুর স্পর্শে চমকে উঠে সে। শাফায়াতের দিকে তাকিয়ে দেখে তার চোখে জল।
– ‘কি হলো? কাঁদছো কেন?’ – উদ্বিগ্ন কণ্ঠ নিশিতার।
– ‘আমাকে ক্ষমা করেছো তো, নিশু?’ – আবেগাপ্লুত স্বরে জিজ্ঞেস করলো শাফায়াত।
– ‘যাকে সত্যিকারের ভালোবাসা যায়, তাকে কোনোদিন ঘৃণা করা যায় না। অভিমান হয়েছে, এটা সত্যি। রাগও হয়েছে। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও তোমাকে ঘৃণা করতে পারিনি।’ – শাফায়াতের চোখের পানি মুছিয়ে দিতে দিতে বললো নিশিতা।
– ‘কত অপমান যে তোমাকে করেছি আমি। একবারের জন্যও ভাবিনি এতোটা অমানুষ কিভাবে হলাম !’ – নতমুখে বললো শাফায়াত।
– ‘এই যে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছো, এটাই আমার প্রাপ্তি। স্বামীর ভালোবাসাই স্ত্রী’র কাছে পরম পাওয়া।’
শাফায়াত মনে মনে নিজের সাফল্যে খুশীই হলো। তার চেহারাতেও হয়তো ফুটে উঠলো মনের অবস্থা। এত সহজে সমাধান হবে, ভাবেনি। তবে নিশিতার পরের কথায় তার ভুল ভাঙ্গলো,
– ‘ক্ষেত্রবিশেষে, দ্বিতীয় সুযোগ সবারই প্রাপ্য। আর আমাদের বিয়ের বয়সও বেশী নয়। তাই সম্পর্কটাকে আরও একবার সুযোগ দিলাম। কিন্তু পরের বার লিমিট ক্রস করলে আর কোন অপশন থাকবে না কিন্তু।’ – হাসিমুখে কথাগুলো বললেও নিশিতার দৃঢ়তা টের পেলো শাফায়াত। সতর্ক হয়ে উঠলো সে। সাবধানে নিজেকে গুছালো,
– ‘এমন আর হবে না, নিশু। বিশ্বাস রাখতে পারো। আমার নিশু এখন থেকে কোন কষ্ট পাবে না, পেতে দিবোই না।’ – বলেই শক্ত করে জড়িয়ে রাখলো নিশিতাকে। স্বামীকে পরম ভালোবাসায় জড়িয়ে তার বুকে মুখ গুঁজে নিশিতা। কিছুক্ষণ পর শাফায়াত আলতো করে নিশিতার চিবুক উঁচু করে তার পিপাসার্ত ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। উষ্ণ চুম্বনে ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে যায় দু’জন।
নিশিতা’র রুম থেকে দু’জনের হাস্যোজ্জ্বল মুখে বেরিয়ে আসা স্বস্তি দেয় বাকীদের। সুফী সাহেব-ঐন্দ্রিলা একে অপরের দিকে চেয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসেন। নির্ভার হন সাফিয়াও। গত কিছুদিনের জমে থাকা গুমোট আবহাওয়া অবশেষে কেটে যায়। বেশ শান্তিপূর্ণভাবেই সকল আয়োজনের সমাপ্তি ঘটে।
Aditya Kingshuk