বোধোদয়,ষষ্ঠ পর্ব
ধারাবাহিক গল্প
নিজেকে যতই বাস্তববাদী ভাবুক না কেন, নিশিতা ভালো করেই জানে, তার মন এখনও আবেগকেই বেশী প্রাধান্য দেয়। শাফায়াতের সাথে যদিও তার স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্ক হয়নি এখনও, তবে এক ধরণের আকর্ষণ সে ঠিকই অনুভব করে। এর কোন ব্যাখা নেই তার কাছে। যে মানুষটি এত স্পষ্টভাবে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে, তার জন্য কেন এই গভীর রাতে শূন্যতায় ছেয়ে যায় বুকের ভেতরটা? কেন তাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে? এই মায়ার বাঁধন কি সে অগ্রাহ্য করতে পারবে আদৌ?
ব্যালকনিতে বসে জোছনা দেখতে দেখতে ভাবনায় ছেদ পড়ে মোবাইলের ভাইব্রেশনে। স্ক্রিনে ভেসে উঠে, শাফায়াতের ছবি। সাধারণত, রাত জাগার অভ্যাস নেই তার। নিশিতা একটু অবাকই হয়। তবে ভালো লাগার পাশাপাশি অভিমানও ঘিরে ধরে। কল’টা রিসিভ করে চুপ করে থাকে।
– ‘কেমন আছো?’ – শাফায়াতের কণ্ঠে প্রচ্ছন্ন জড়তা।
– ‘ভালো।’ – পাল্টা প্রশ্ন করলো না নিশিতা।
শাফায়াত আশা করেছিল নিশিতা হয়তো জিজ্ঞেস করবে, সে কেমন আছে। তবে নিশিতার চুপ করে থাকায় একটু দমে গেলো সে।
– ‘এত রাত হয়ে গেলো। ঘুমাচ্ছো না যে?’
– ‘তেমন কিছু না। ব্যালকনিতে বসে আছি।’
– ‘রেগে আছো অনেক?’ – কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করলো শাফায়াত।
– ‘না।’
– ‘তুমি না বললেও বুঝতে পারছি। আসলে, সেদিন তুমি চলে যাওয়ার পর থেকে কিভাবে যে আমার সময় কাটছে, তোমাকে বলে বুঝাতে পারবো না। শুধু মনে হচ্ছে, আমি যেন আর আমার মাঝে নেই। সবকিছু কেমন যেন অর্থহীন।’
বাঁকা হাসি খেলে গেলো নিশিতার ঠোঁটে। এত অপমান করে এখন ঢং করা হচ্ছে। শাফায়াত’কে সে আর বিশ্বাস করে না।
– ‘তোমাকে বিশ্বাস করা কঠিন। যখন কাছে ছিলাম, এতোটুকু মূল্যও দাওনি। যেভাবে অপমান করেছো, অন্য কোন মেয়ে হলে বিপদে পড়তে। এভাবে এতদিন সহ্য করতো না। শুধু মায়ের দিকে তাকিয়ে খুব বেশী সিন ক্রিয়েট করি নি।’
নিশিতার কণ্ঠে শীতলতা টের পেলো শাফায়াত। ভুল যা করার, করে ফেলেছে সে। নিশিতা এখন আগের মতো নেই। তবে তার মধ্যে যে একটু হলেও টান আছে শাফায়াতের জন্য, সেটা জানে সে। মাথা ঠাণ্ডা রেখে বোঝানোর চেষ্টা করলো শাফায়াত,
– ‘আমি জানি, যা করেছি, তার প্রায়শ্চিত এত সহজে ফুরাবে না। তবে বিশ্বাস করো, ঐ মুহূর্তটা ভুলতে পারছি না। কতো নিবিড় করে পেয়েছিলা তোমাকে। এখনও চোখ বন্ধ করলে তোমার স্পর্শ পাই। এটাই হয়তো ভালোবাসা।’
নিশিতা চুপ করে রইলো। নীরবতা বরফ গলার লক্ষণ, বুঝতে পারলো শাফায়াত। একটু থেমে আবার বললো,
– ‘নিশু, আমি মন থেকে ক্ষমা চাইছি। প্লিজ, ফিরে এসো। আর কোনোদিন অবহেলা করবো না।’
শাফায়াতের আদরের ডাকে এক ধরণের শিহরন খেলে গেলো নিশিতার শরীরে। কত রাত কেটেছে স্বামীর একটু আদরমাখা আচরণের আশায়। কিন্তু ভেতরের চাপা ক্ষোভ তো ছাইচাপা আগুন হয়ে জমে আছে। সেই আগুন হঠাৎ উস্কে উঠলো,
– ‘শরীর’টাই তাহলে মূল কারণ? তুমি এখন এসব মন-ভোলানো কথা বলছো কারণ তোমার এখন আমাকে পুরোপুরি লাগবে। শারীরিক চাহিদা তোমাকে বাধ্য করেছে ক্ষমা চাইতে। নইলে এতদিন ধরে যে আমার মন প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হয়েছে তোমার অবহেলায়, তার খোঁজ তো কখনও নিতে দেখলাম না। রাতের পর রাত কেঁদেছি, সাক্ষী শুধু আল্লাহ্। কোনোদিন দেখলাম না একবারের জন্যও নিজ থেকে আমার খোঁজ নিয়েছো, কাছে নিয়েছো। যখন ইচ্ছে করবে, তখন কাছে নিয়ে আবার দূরে ঠেলে দিবে, অপমান করবে, স্ত্রীর অধিকার’টুকু দিবে না, এতদিন পরেও। বিয়েটা কি ফাইজলামি? এখন এসব ঢং করে কি লাভ? লজ্জা করে না?’ – রাগে ফেটে পড়লো নিশিতা।
শাফায়াত এমন হঠাৎ আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়লো কেমন যেন। ভেবেছিল, নিশিতার দুর্বলতা কাজে লাগাবে। তবে যে শক্ত মানসিকতার পরিচয় দিলো নিশিতা, তাতে করে শাফায়াতের জন্য পরিস্থিতি সামলে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়লো। ডিফেন্সিভ অ্যাপ্রোচে গেলো সে,
– ‘আমি তো অস্বীকার করিনি কিছু। তোমার দোষও দিচ্ছি না। ভুলটা আমারই। আমার মানসিকতাই দায়ী, স্বীকার করছি। আর শরীরের ব্যাপারটা বললে না? আসলে এমন কিছু না। বিয়ে ছাড়াও কিন্তু শারীরিক চাহিদা মেটানো যায়। তাই না? হালাল-হারাম তো চাইলেই একপাশে সরিয়ে রাখা যায়। খুব কঠিন কিছু তো না। তবে আমি এতোটা অমানুষ না। নিজের স্ত্রী’র জন্যই সবকিছু এতদিন যত্ন করে রেখে দিয়েছি। তাই তোমাকেই চাইছি। সত্যি বলছি, এখন থেকে যেভাবে চাও সেভাবেই আমাকে পাবে। আর ভুল তো মানুষই করে, বলো? আমরা তো কেউ ভুলের ঊর্ধ্বে না। প্লীজ, রাগ করো না, নিশু।’ – অনুনয় ঝরে পড়লো শাফায়াতের কণ্ঠে।
নিশিতা’র রাগ কমেনি এখনও। মেজাজ এখনও গরম তার। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
– ‘তোমার কোন কথা শুনতে চাই না। আমার সংসার, স্বপ্ন – সব শেষ করে দিয়েছো। আর তোমার কাছে যেহেতু হালাল-হারাম ম্যাটার করে না, অন্য কাউকে জুটিয়ে নিতেও কষ্ট হবে না, আশা করি। আমি আর ফিরবো না আপাতত, ধরে নিতে পারো। রাখছি।’ – বলে কল কেটে দিলো নিশিতা। অপর প্রান্তে শাফায়াত কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বসে রইলো।
⭕️
সাফিয়া একটা বিষয় নিয়ে কিছুদিন থেকেই দ্বিধায় ভুগছিলেন। কিভাবে ঐন্দ্রিলাকে বোঝাবেন। বেয়াইন যে সহজ মহিলা নন, তা বিয়ের আগেই কয়েকটা ঘটনায় বুঝতে পেরেছিলেন। তবে সবকিছুর চাইতে মূল কাজ এখন নিশিতাকে ফিরিয়ে আনা। যদিও নিশিতার সাথে তার মাঝে মাঝে কথা হয় তবে ফিরে আসার ব্যাপারে বউমাকে কনভিন্স করতে পারেননি। কঠিন অভিমান, বোঝেন তিনি। কাঁচা বয়স। কোথায় নতুন জীবনে স্বামীর সাথে হাসিখুশি আনন্দে সময়গুলো কাটাবে, অথচ থাকতে হচ্ছে দূরে। যেন সব থেকেও কিছুই নেই।
সাফিয়া ঠিক করলেন বেয়াইনের সাথে কথা বলবেন। তবে নিশিতার মা’কে পেলেন না ফোন দিয়ে। অগত্যা নিশিতার বাবা’কে ফোন দিয়ে বেয়াইনকে চাইলেন।
– ‘সালাম নিবেন, আপা। ভালো আছেন?’
– ‘ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ্, আপা। ভালো আছি।’ – ঐন্দ্রিলা চেষ্টা করলেন নিজের কণ্ঠ স্বাভাবিক রাখতে, যদিও তিনি কথা বলতে চাননি। নেহায়েৎ স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে বাধ্য হচ্ছেন।
– ‘কি বলবো আসলে, আপা। সবই ভাগ্য। আমার ছেলেটা যে এমন করবে, ভাবতে পারিনি। কত আশা নিয়ে নিশিতা মা’কে ঘরে এনেছিলাম। আর কি হলো। শাফায়াত’কে নিজের ছেলে হিসেবে ভাবতেও লজ্জা লাগছে এখন।’ – সাফিয়ার কণ্ঠে হতাশা।
– ‘কিছু মনে করবেন না, আপা। মা হিসেবে আপনার দায়িত্ব ছিল ছেলেকে বোঝার। শাফায়াত যে নিশিতাকে মোটেই পছন্দ করেনি, সেটা নাকি সে বিয়ের আগেই আপনাকে বলেছিল? এরপরও কেন বিয়েটা আটকালেন না?’
মুহূর্তের জন্য সাফিয়া চুপ থাকলো। নিশিতা তাহলে সবই শেয়ার করেছে বাসায়। একটু মনঃক্ষুণ্ণ হলেও তা চেপে রেখে অভিযোগ খণ্ডানোর চেষ্টা করলেন,
– ‘সন্তান অবুঝ হলে তাকে বোঝানোর দায়িত্ব আমাদের, আপা। সত্যি বলতে, যা করেছিলাম, ভালো মনে করেই করেছিলাম। নিশিতার মতো মেয়ে যে কোন ঘরের লক্ষ্মী। কি সুন্দর করে যে মানিয়ে নিয়েছিলো সংসারটা। আপনার মেয়ে আসলেই ভালো একটা মেয়ে। আফসোস ! আমার ছেলেটা বুঝলো না। মানুষ করতে পারিনি আসলে। আমারই ব্যর্থতা। তবে মা’দের অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়। আমাদের তো একটু উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ। ছেলে মেয়ে দু’টো কষ্ট পাচ্ছে এভাবে !’
ঐন্দ্রিলার রাগ কমেনি এখনও। তবে বেয়াইনের ছেলের উপর কঠিন রাগ যেন কিছুটা প্রলেপ দিলো। সচরাচর মায়েরা শত অন্যায় করলেও ছেলের পক্ষে থাকে। তবুও কিঞ্চিৎ উষ্মা প্রকাশ করে বলেন,
– ‘এখন এসব বলে কি লাভ, আপা? যা হওয়ার তো হয়েই গিয়েছে। আপনার ছেলে শুনলাম আবার ক্ষমাও চেয়েছে? কি মনে করে ও নিজেকে? সবকিছু এত সহজ?’
– ‘ব্যাপারটা আমারও ভালো মনে হয়নি, আপা। সম্পর্ক এত ঠুনকো না। তবে শাফায়াতের শরীর বেশ খারাপ করে গিয়েছিলো বউমা চলে যাওয়া পর থেকে। নিতে পারেনি আসলে, যা বুঝলাম। হয়তো ভুল বুঝতে পেরেছে। সহজে আর পাওয়া যাবে না, সেটাও হয়তো বুঝেছে। প্রায় সময়ই মনমরা হয়ে থাকে। খাওয়া-দাওয়ায় রুচি নেই। এভাবে চলতে থাকলে আবারও অসুস্থ হয়ে পড়বে। কি করি বলেন তো?’
ঐন্দ্রিলা ভেবেছিলেন কঠোর হবেন। তবে মেয়ে জামাইয়ের এমন অবস্থা শুনে একটু চিন্তায় পড়লেন, যদিও পাত্তা দিলেন না।
– ‘ক্ষমা করবেন, আপা। ভুল যখন করেছে, ভুগতে হবেই। নিশিতা’র বাবা আপনাদের যা বলেছেন, আমিও সেই কথাই বলবো। আমার মেয়ের সিদ্ধান্ত তার নিজের। আমরা জোর করবো না। কোন কিছু চাপিয়েও দিবো না। ওর যদি মনে হয়, শাফায়াতকে ক্ষমা করবে, করতে পারে। আর যদি মনে করে মুভ অন করবে, সেটাও করতে পারে। আমাদের তরফ থেকে কোন আপত্তি নেই।’ – নিজের মেয়ের আগ্রহের কথা চেপে গিয়ে ঐন্দ্রিলা পরিষ্কারভাবেই জানিয়ে দিলেন।
– ‘এভাবে বলবেন না, আপা। বিয়ের মতো সম্পর্ক এভাবে শেষ হতে পারে? মানছি, আমার ছেলের ভুল। সেটা শোধরানোর দায়িত্ব আমাকে দিন কষ্ট করে। আমি যথেষ্ট বুঝিয়েছি ওকে। এখন ও আগের মতো নেই, বিশ্বাস করেন। এই ক’দিনে ওর মধ্যে যতোটা পরিবর্তন দেখেছি, মা হয়ে বলছি, সেখানে কোন মিথ্যে নেই, আপা। আমার ছেলেটা আসলেই নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। ওকে ক্ষমা করে দিন, আপা।’ – সাফিয়া’র কণ্ঠ যেন কেঁপে উঠলো হালকা।
– ‘ছিঃ ছিঃ এভাবে কেন বলছেন? আপনাকে শুধু বেয়াইন নয়, বোন হিসেবেও দেখি, আপা। তাই কষ্টটা বেশী। আপনি নিশিতাকে যথেষ্ট ভালোবাসেন, যত্ন করেন। সব খবরই পাই। তবে এটাও সত্য, জোর করে আর যাই হোক, সম্পর্ক হয় না। আমি বা আপনি চাইলেই হবে না। সংসারটা দিনশেষে ওদের। তাই সিদ্ধান্ত ওদেরকেই নিতে হবে। শাফায়াত এখন যতই নিজের ভুল বুঝুক, পরে যে আবারও একই ভুল করবে না সেটারও কোন নিশ্চয়তা নেই। আর নিশিতা যতোটা বুঝলাম, খুব আঘাত পেয়েছে। মা হয়ে মেয়েকে বার বার এভাবে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারি না। তবে ওকে আমি জোর করবো না কোন কিছুতে। নিজে যা ভালো বুঝে, করবে।’ – ঐন্দ্রিলা সংযত হয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলেন।
– ‘ছেলের মুখের দিকে তাকানো যায় না, আপা। এতোটাই ভেঙ্গে পড়েছে। যদি অনুমতি দেন, ওকে সঙ্গে নিয়ে একবার আসতে চাই। নিশিতা আমার বউমা না শুধু, আমার মেয়েও। আমার মেয়েকে আমি নিজে ফিরিয়ে আনতে চাই, আপা।’
এভাবে বলার পর মেয়ের শাশুড়িকে সরাসরি মানা করা যায় না। ঐন্দ্রিলা মনে মনে কিছুটা আশংকা আর বিরক্তি রেখে বললেন,
– ‘অনুমতির কিছু নেই, আপা। আপনার পুত্রবধূকে দেখতে আসবেন আপনি, আমি বাঁধা দেওয়ার কেউ না। এটা আপনার অধিকার। তবে আমি চাই না কোন সিনক্রিয়েট হোক বা আমার মেয়েটার মনের ওপর চাপ বাড়ুক।’
বেয়াইন যে প্রচ্ছন্ন’ভাবে কথা শুনিয়ে দিলেন, সেটা বুঝলেও কিছু বললেন না সাফিয়া। এখন ভালোয় ভালোয় সবকিছু শেষ হলেই হয়। হাসিমুখেই বিদায় নিলেন,
– ‘ধন্যবাদ, আপা। আল্লাহ্ আপনার মঙ্গল করুন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, আমি আসার চেষ্টা করবো। রাখছি তাহলে। ভালো থাকবেন। ফি আমানিল্লাহ্।’
কিছুটা দূরে বসে সূফী সাহেব লক্ষ্য করছিলেন ঐন্দ্রিলার পরিবর্তন। মেয়ের জীবনের এত বড় পরীক্ষায় একজন মা’য়ের শক্ত থাকা খুব জরুরী। শেষ পর্যন্ত যেন সঠিক সমাধানই হয়, সেজন্য মনে মনে সৃষ্টিকর্তার সাহায্য চাইলেন।
Aditya Kingshuk