প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প,১৯,২০

0
381

প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প,১৯,২০
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

|১৯|

আমি চিঠিটা বার দুই পড়লাম। দ্বিতীয়বারের মাথাতেই চট করে বুঝে ফেললাম চিঠির ভাঁজে উহ্য থাকা বেসামাল প্রেমিকের নাম। এই ছোট্ট, ভারী নামটা মনে আসতেই আঁতকে উঠল মন। বাস্তব আর কল্পনা গুলিয়ে একাকার হয়ে গেল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলাম। নিজের মনটাকেও ভরসা হলো না। ভীষণ আশ্চর্য মনটা আরেক দফা আশ্চর্য হয়ে ভাবল, এ-ও বুঝি সম্ভব? ধ্রুবর মতো শক্ত, অহংকারী মানুষের পক্ষেও এইরকম প্রেম নিবেদন সম্ভব? কপালে চিন্তার বলিরেখা নিয়ে চোখ তুলে প্রিয়তার দিকে চাইলাম। প্রিয়তার চোখদুটোতে চকচকে কৌতূহল। আমাকে চাইতে দেখেই বলল,

‘ কাউকে গেইস করতে পারলি? কে হতে পারে বল তো?’

আমি উত্তর দিলাম না। চোখ নামিয়ে আবারও স্ক্রিনের দিকে চাইলাম। ঘোলাটে এক চিন্তার ঢেউ খেলে গেল গোটা মস্তিষ্ক জুড়ে। চোখেও ভর করল ঘোলাটে এক দৃষ্টি। আমি ঘোলাটে দৃষ্টি মেলে স্ক্রিনের দিকে চেয়ে রইলাম। ‘ক্রাশ এন্ড কনফেশন’ পেইজে তখন কাল বৈশাখের ঝড়। চিঠিটা আপলোড করা হয়েছে কেবল ঘন্টাখানেক আগে। অথচ রিয়েক্টে, কমেন্টে নাভিশ্বাস অবস্থা। চোখের পলকে বেড়ে যাচ্ছে কমেন্টের সংখ্যা। অধিকাংশ কমেন্টেই ধ্রুবর আইডি ম্যানশন করা হচ্ছে। ম্যানশনকারী ব্যক্তিদের কাউকেই আমি চিনি না। তবে বুঝা যাচ্ছে, তারা আমায় খুব চিনে। আপাতত ডিপার্টমেন্টের নাম, রোল আর নিশু নামটা তাদের মুখস্থ। ধ্রুবকে উদ্দেশ্য করে মশলাদার, সাবলীল সব মন্তব্য আসছে। এরা বোধকরি বেশিরভাগই ধ্রুবর বন্ধু। বাকি কিছু ভাই অন্তঃপ্রাণ ছোট ভাই। কেউ কেউ আফসোস নিয়ে লিখছে, ‘ বড় ভাইয়ের বুকিং। রং নাম্বারে ডায়াল করে ফেলেছেন ভাই। পাখি এমনিতেও কাছে আসবে না। ক্যান্টিনের চা খেয়ে আপাতত মাতাল হয়ে যান। চান্স নাই।’ কেউ কেউ খুব দুঃখ প্রকাশ করছে। কেউ আবার জবরদস্ত আনন্দ লুটে মসজিদে মিলাদের ব্যবস্থা, ক্যাম্পাসে জিলাপি বিতরণের উপদেশ দিচ্ছে। দোয়া করে ভাগ্য পাল্টে ফেলার দায়িত্বও তুলে নিচ্ছে নিজ কাঁধে। ধ্রুব বা আমাকে চিনে না অথবা আমাদের প্রেম কাহিনি জানে না এমন ব্যক্তিদেরও উৎসাহ দেখা যাচ্ছে খুব। কমেন্টে কমেন্টে জিজ্ঞেস করছে, ‘ব্যাপার কী?’ সর্বোপরি, ধ্রুবর এই ছোট্ট কনফেশনটা হঠাৎ করেই আজকের রাতের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে রটে গিয়েছে। আমি পোস্টের ত্বরান্বিত কমেন্টের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। উৎসাহীদের কেউই বুঝতে পারিনি চিঠি প্রেরকের আপাত উহ্য নাম। আমার মস্তিষ্কটা হঠাৎই খেলে উঠল। চট করে মনে হলো, সবাইকে নয় ধ্রুব চিঠিটা শুধু আমাকে জানাতেই লিখেছে। ত্রপা নামটা আমার নামের খাতায় ধ্রুবর দেওয়া নতুন সংযোজন। এই নামে ইতোপূর্বে কেউ ডাকেনি আমায়, ডাকে না, ডাকবে না। অর্থাৎ, ধ্রুব চেয়েছে একমাত্র আমি তাকে জানি। তার মনের আকুতি একমাত্র আমার কাছেই প্রকাশ পাক। কিন্তু কেন? এই সাধারণ কথাগুলো মস্তিষ্কে ছুটে যেতেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। ধ্রুবর কার্যকলাপ, উদ্দেশ্য সম্পর্কে আরও এলোমেলো হয়ে গেল মন। তবে কী চাইছে ধ্রুব? নতুন কোনো সম্পর্ক? নাকি চাপা কোনো অর্থ আছে এই চিঠির? আমার ভাবনা কোনো কূল-কিনারা পেলো না। আমি কিছুতেই ধ্রুবর চাওয়াটা বুঝতে পারলাম না। বুঝতে পারলাম না তার উদ্দেশ্য। সেই সাথে বুঝলাম না ধ্রুবর আচমকা প্রেমে পড়ার কথা। হঠাৎ করেই কী করে প্রেমে পড়ে গেল ধ্রুব? একদম আচমকা?

ধ্রুবর এই কনফেশন নিয়ে প্রিয়তা খুব হৈ হৈ করলেও আমি কোনো উৎসাহ দেখালাম না৷ সারা গায়ে শামুকের মতো ‘ডোন্ট কেয়ার’ এর খোলস টেনে চুপচাপ রইলাম। সিঁড়িতে আসতে যেতে ধ্রুবর সাথে বেশ কয়েকবার দেখা হলো। চোখাচোখি হলো। দু’জনের কারো মাঝেই কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। ধ্রুবর স্বাভাবিকতা যেন আমাকে ছাড়িয়ে গেল। চোখ-মুখ আগের মতোই গম্ভীর করে রাখলো। যেন সর্বদা বিরক্ত। আমিও আগ বাড়িয়ে তাকে নিয়ে বিশেষ ঘাটাঘাটি করলাম না। প্রত্যেকবারের মতো তাকে দেখে লজ্জায় লাল হলাম না। যে ছেলেটাকে প্রথম দেখায়, সাধারণ মনে হয়েছিল। সেই ছেলেটাকে দিনকে দিন হৃদয় মন্দিরের রাজপুত্রটির মতো সুন্দর দেখালেও আগের মতো ‘হা’ করে চেয়ে থাকলাম না। হৃদপিণ্ডটাকে মনের সমস্ত শক্তি দিয়ে দাবিয়ে রেখে সপ্তাহখানেকের মাঝেই গুলকিপাড়ার আশেপাশে একটা বাসা ঠিক করে ফেললাম। বাসা ছেড়ে দেওয়ার সপ্তাহ দুই আগে দ্বিতীয় তলার গোড়ায় ধ্রুবর সাথে আবারও দেখা হয়ে গেল আমার। ধ্রুবর গায়ে অফিসের পোশাক। চোখে-মুখে ক্লান্তি। সুঠাম শরীর জুড়ে অদ্ভুত পুরুষালী গন্ধ। চলনে-বলনে গম্ভীর দাপটের স্পর্শ। বড় বড় চোখে নেশাতুর বিষণ্ণ দৃষ্টি। চলতে চলতে হঠাৎ চোখ তুলে চাইলে মনে হয়, সে কেবল দেখছে না, ছুঁয়ে যাচ্ছে দেহ-মনের প্রতিটি কোণ। রাত তখন আটটা বাজে। আমি নিচে যাব বলে ভাবছি। এমন সময় ধ্রুবকে দ্রুত পায়ে উপরে উঠতে দেখা গেল। তার দৃষ্টি ঝুঁকানো। সিঁড়ি দেখে দেখে উঠছে। অফিসের ইউনিফর্মে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে পেশীবহুল বাহু। আমি তিন তলার সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছি। ধ্রুব দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ডিঙাতে ডিঙাতেই চোখ তুলে চাইল। ভাসা ভাসা গম্ভীর দৃষ্টি। আমাকে এক নজর দেখে চোখ ফিরিয়ে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পাশ কাটাল। আমি বহুদিন পর তার দৃষ্টিতে থমকে গেলাম। ধ্রুবর গম্ভীর মুখ, গম্ভীর চাহনি বহুদিন পর আমায় চৌম্বকের মতো টানল। হৃদয়ে শীতল বাতাস বয়ে গেল। প্রেমে ডুবন্ত মনটাকে একটুখানি প্রশ্রয় দিলাম। গলার স্বরটা খানিক বাড়িয়ে ভাববাচ্যে শুধালাম,

‘ উহুম…এক্সকিউজ মি, ত্রপা নাকি কাঠগোলাপ?’

ধ্রুব আমাকে রেখে কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়েছিল। আমার কন্ঠে থমকাল। চকিতে পিছু ফিরে প্রশ্নবোধক চোখে চাইল। তার সেই দৃষ্টি! আমি আহত হয়ে গেলাম। ভীষণ ব্যথায় চিনচিন করে উঠল বুক। ভেতরটা কেঁপে কেঁপে উঠল ভয়াবহ ভূমিকম্পের মতো। ধ্রুব দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করার অপেক্ষায় রইলো না। কোনো লুকোচুরির চেষ্টা করল না। সরাসরি আমার চোখের দিকে চাইল। আমাকে অবাক করে দিয়ে দ্বিধাহীন স্পষ্ট স্বীকারোক্তি টানল,

‘ ত্রপা।’

আমার গোটা দেহে অনিয়ন্ত্রিত অনুভূতির ঢেউ খেলে গেল। নিজের কানকে বিশ্বাস হলো না। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলো। মন ও মস্তিষ্ক নিজের আয়ত্তে রইলো না। ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে অস্পষ্ট প্রশ্ন ছুড়লাম,

‘ কেন?’

ধ্রুব নিঃশব্দে আমার দিকে চেয়ে রইল। আমার প্রশ্ন বুঝতে বুঝি সেকেন্ড কয়েক সময় লেগে গেল। তারপর ধীরে ধীরে নেমে এলো আমার কাছে। ধ্রুবকে নিজের কাছে আসতে দেখেই বক্ষপিঞ্জর ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইল হৃদপিণ্ড। হাত-পায়ের কাঁপনটা স্থায়ী হলো। কপালে ঘাম ছুটলো। দূর্নিবার অনুভূতিতে ভারী হয়ে এলো নিশ্বাস। ভারী পা’দুটো নাড়িয়ে সরে যাওয়ার শক্তিটুকু পর্যন্ত হলো না। ধ্রুব আমার অবস্থা বুঝল কী-না বুঝা গেল না। আমি সিঁড়ির রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ধ্রুব সামনে এসে দাঁড়াতেই আবেগের হুড়োহুড়িতে বলহীন দেহটা রেলিঙের উপর ছেড়ে দিয়ে ভারমুক্ত হলাম। লম্বা একটা দম নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। ধ্রুব আমার চেষ্টা সফল হতে দিলো না। জিরাফের মতো লম্বা দেহটা ঝুঁকিয়ে নিঃশ্বাসটা ফেলল আমার ঘাড়ের ওপর। ধ্রুবর অদ্ভুত পুরুষালী গন্ধে রোমকূপ পর্যন্ত কেঁপে উঠল আমার। আমি কাঠের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ধ্রুব নিচু কন্ঠে শুধাল,

‘ তুমি জানো না?’

প্রশ্নটা করেই চোখ তুলে আমার চোখের দিকে চেয়ে রইল ধ্রুব। আমার শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া কন্ঠে কোনো আওয়াজ খেলে গেল না। ধ্রুব আমার দিকে একইভাবে চেয়ে রইল। আমার দু’পাশের রেলিঙে দুই হাত রেখে তার স্বাভাবিক আচরণের ধাপগুলো ছাড়িয়ে যেতে লাগল ফটাফট। আমি খুব অসহায়বোধ করলাম। জীবনে প্রথমবার বুঝতে পারলাম, মুখে যতই খই ফুটুক। অনুভূতিতে ডুবানো নির্দিষ্ট ব্যক্তিটির সামনে খই ফোটানো যায় না। ‘সর্বদা খই ফোটা’ মানুষটিও তখন বোবা, অসহায়৷ সে কারণেই হয়তো, আবিরকে সটান চড় বসিয়ে দেওয়ার সাহস থাকলেও, প্রিয়তাকে ধমকে থামিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা থাকলেও ধ্রুবর সামনে টু শব্দটি পর্যন্ত করতে পারলাম না। আমি লম্বা দম নিলাম। কঠিন গলায় ধ্রুবকে সরতে বলব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। এমন সময় আমায় তৃতীয় বারের মতো চমকে দিয়ে পৃথিবীর সব থেকে অদ্ভুত আবদার করে বসল ধ্রুব। একদম দ্বিধাহীন কন্ঠে শুধাল,

‘ তোমাকে চুমু খেতে ইচ্ছে করছে। সবসময়ই করে। আমার উচিত এই প্রবৃত্তিটা লুকিয়ে যাওয়া। কিন্তু পারছি না। মে আই?’

আমি বাক্যহারা হয়ে গেলাম। শরীরের প্রতিটি রক্তকণা উনুনে বসানো বাষ্প পানির মতোই ফুটতে লাগল। ধ্রুব অনুমতি চাইল ঠিক কিন্তু অনুমতির অপেক্ষা করল না। বিনাবাক্য ব্যয়ে তপ্ত ওষ্ঠাধর চেপে ধরল আমার গালে। চেপে রাখল অনেকক্ষণ। গালের উপর অযাচিত এই স্পর্শে থরথর করে কেঁপে উঠল আমার শরীর। স্তব্ধ হয়ে গেল মন। বলহীন শরীরে, তীব্র অবিশ্বাস নিয়ে ধ্রুবর দিকে চেয়ে রইলাম। খানিকক্ষণ কাটল। ঘটনার আকস্মিকতা কেটে সচল হলো মস্তিষ্ক। ধ্রুবর বুকে ধাক্কা দিয়ে প্রতিবাদের চেষ্টা করতেই তীব্র এক ভূমিকম্প অনুভূত হলো তার ইস্পাত কঠিন বুকে। হৃদপিণ্ডটা যেন এক্ষুনি বেরিয়ে আসবে ওই নিষ্ঠুর বুক ফোঁড়ে। আমি অবাক হয়ে ধ্রুবর চোখে চাইলাম। অস্পষ্ট কন্ঠে ডাকলাম,

‘ ধ্রুব…!’

ধ্রুব গাল থেকে ঠোঁট সরাল। দ্বিধাহীন, নির্বিকার মুখটিতে চকিতে ছুটে গেল এক ঝলক অস্থিরতা। আমি রেলিঙের উপর শরীরের সমস্ত বল ছেড়ে দিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এলেমেলো হয়ে গেল চিন্তা-চেতনা। ঘুরে গেল পৃথিবী। ধ্রুব সেকেন্ড কয়েক নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকে চুপচাপ উপরে উঠে গেল। আমি ডানহাতে কপাল চেপে ধরে বসে রইলাম সিঁড়ির গোড়ায়। রাত বাড়তে লাগল। অনেক দূর থেকে ভেসে আসা ট্রেনের হুইসেল ছাড়া কোথাও কোনো জনারব নেই। এমন নিস্পন্দ সিঁড়ি গোড়ায় বসে তীব্র মানসিক দ্বন্দ্বে ছটফট করে উঠলাম আমি। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা নিঃসার। ধ্রুবর হঠাৎ পরিবর্তিত রূপ, মাত্র ঘটে যাওয়া অগ্রহণীয় অন্যায় সবকিছুই মুহূর্তের জন্য অলীক কল্পনার মতো ঠেকলো। এই ধ্রুবকে, এই ধ্রুবর আচরণকে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারলাম না। সব থেকে বিশ্বাস করতে পারলাম না নিজেকে। এলোমেলো ঘটনাসমূহ নিরেট, হতভম্ব মস্তিষ্কে তালগোল পাকিয়ে আরও অসহায় করে দিলো আমায়। বুকের ভেতর উথলে উঠল ঝড় বওয়া কান্না। তবে সেই কান্নাগুলো অদৃশ্য এক বাঁধায় আটকে রইল। কেন জানি কিছুতেই গাল ছুঁতে পারল না।

তখন গভীর রাত। বসার ঘরে মিটমিট আলো জ্বলছে। নিস্তব্ধ রাতকে চিরে দিয়ে টুং টাং ছুটে চলেছে ঘড়ির কাটা। প্রিয়তা সোফায় এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে আছে। মৃদু, মোলায়েম আলোয় নিষ্পাপ দেখাচ্ছে তার ছোট্ট কোমল মুখ। আমি প্রিয়তার গায়ে কম্বল টেনে দিয়ে আবারও জিনিসপত্র গোছাতে মনোযোগ দিলাম। বইপত্রগুলো বাক্সে গুছিয়ে রাখতে রাখতেই কপালে চিন্তার বলিরেখা পড়ল। আনমনে আবারও ছুটে এলো ধ্রুব সম্পর্কিত চিন্তা। সন্ধ্যা থেকে অসংখ্যবার ধ্রুবকে ভেবেছি আমি। তার আচার-আচরণ বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছি। বুঝতে চেয়েছি। কিন্তু কোনো কূল-কিনারা পাইনি। চিন্তার অথৈ সমুদ্র পেরিয়ে বারবারই আরও সপ্তাহখানেক আগে বাসা ছাড়ার চিন্তাতেই থমকে গিয়েছে মন। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসটা বন্ধ ঘরের বাতাসে ছড়িয়ে পড়তেই ধ্রিম ধ্রিম করে বেজে উঠল অবহেলায় ফেলে রাখা মুঠোফোন। আমি ফোনের দিকে চাইলাম। স্ক্রিনে ভেসে উঠা অপরিচিত নাম্বারটা দেখে হঠাৎই আমার ধ্রুবর কথা খেয়াল হলো। ফোনটা মিনিটখানেক বাজলো। তারপর কেটে গিয়ে আবারও বাজতে লাগল নতুন উদ্যমে। একবার, দু’বার, তিনবার, চারবার বাজার পর ম্যাসেজ এলো।

‘ আমি জানি তুমি জেগে আছো। রিসিভ দ্য কল।’

আমার সন্দেহটা এবার পাকাপোক্ত হলো। এতোকিছুর পরও ধ্রুবর এই মাঝরাতে আমায় কল করার সাহসে রীতিমতো অবাক হলাম। ম্যাসেজটা সীন করে আলগোছে নাম্বারটাকে ব্লকলিস্টে ছুঁড়ে ফেললাম। এবার অন্য নাম্বার থেকে বার্তা এলো। লিখল,

‘ রিসিভ দ্য কল নিশু। নয়তো আমি তোমার বাসায় চলে আসব।’

ধ্রুবর এই রূপে আমার ছোটখাটো মাথায় বিশাল এক আকাশ ভেঙে পড়ল। আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। ধ্রুবর মতো মানুষ মাঝরাতে আমায় বিরক্ত করছে। স্বয়ং একজন পুলিশ অফিসার হয়ে আমায় বিরক্ত করছে, ব্যাপারটা আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না। ধ্রুব আবারও কল করল। রিসিভার না উঠায় পরিচিত একটি নাম্বার পাঠিয়ে পৃথিবীর সবথেকে বেয়াদবের মতো বলল,

‘ সবার মতে, এটা আমার অ-প্রেমিকার পিতৃদেবের নাম্বার। শ্বশুরমশাইকে এই মাঝরাতে কল করলে কী তিনি বিরক্ত হবেন নিশু?’

আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। বিরক্তিতে রিরি করা মেজাজ নিয়ে কল ব্যাক করলাম। ফোন রিসিভ হতেই ঝাঁঝিয়ে উঠে বললাম,

‘ সমস্যা কী আপনার? এভাবে বিরক্ত করার মানে কী? আমি এবার সত্যি সত্যি খুব বিরক্ত হচ্ছি ধ্রুব। স্টপ ইরিরেটিং মি!’

ধ্রুব ছোট্ট শ্বাস নিয়ে নম্র, ভদ্র, শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ ছাদে আসো।’

আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। কোন অলক্ষুণে সময়ে ধ্রুবকে সেই প্রশ্ন করেছিলাম তা ভেবে খুব আফসোস হলো। অসহ্য বিরক্তিতে জ্বলে উঠল শরীর। রাগ নিয়ে বললাম,

‘ আপনি কী পাগল ধ্রুব?’

‘ হ্যাঁ, আমি পাগল। এবার আসো।’

বিরক্তিতে এবার কেঁদে ফেলার জোগার হলো আমার। গম্ভীর ধ্রুবকে দেখে যতটা আদর পেতো। এই পাগল প্রায় ধ্রুবকে দেখে ততটাই ভয় হলো। প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বললাম,

‘ কেন বিরক্ত করছেন?’

ধ্রুব ঠান্ডা গলায় শুধাল,

‘ তুমি আসছো? নাকি না?’

আমি ফোন কেটে চুপচাপ বসে রইলাম। ঘড়িতে তখন রাত দুটোর ঘণ্টা বাজছে। সেই সাথে বাড়ছে আমার মেজাজ খারাপের পারদ। আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। ধ্রুবর সাথে বিষয়টা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনার চিন্তাটাও মাথায় এলো। সোফা থেকে শীত চাদরটা টেনে নিয়ে লম্বা দম ফেললাম। মূল ফটকটা পেরিয়ে কচ্ছপ গতিতে পৌঁছে গেলাম ছাদে। অন্ধকারাচ্ছন্ন শীতের রাত। এখানে সেখানে কুন্ডলী পাকাচ্ছে সফেদ রঙা কুয়াশা। আমি বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলাম। খুব সাহস নিয়ে ছাদে পা দিতেই দক্ষিণের কোণ থেকে মৃদু কাশির আওয়াজ ভেসে এলো। গমগমে কন্ঠে বলল,

‘ এদিকে আসো।’

ঠিক সেই মুহূর্তে প্রচন্ড ভয় হলো আমার। আবিরের থেকে যতটা শুনেছি তাতে ধ্রুবকে ভয় পাওয়াটা সঙ্গত কারণেই সঙ্গত। আমি কিছুক্ষণ দ্বিধান্বিত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে সম্মোহিতের মতো এগিয়ে গেলাম। ছাদের রেলিঙের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার সময়টুকু পাওয়ার আগেই ভয়াবহ এক কাজ করে বসলো ধ্রুব। চোখের পলকে ছাদের রেলিঙ টপকে ওপাশের ছাদে গিয়ে দাঁড়াল। ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্ময়ে হা হয়ে গেল আমার মুখ। আমাকে ঠিকঠাক বিস্মিত হওয়ার সময়টুকুও না দিয়ে আরও একবার বিস্ময়কর কাজ করে ফেলল ধ্রুব। আবছা অন্ধকারেই নিজের সুঠাম হাতখানি বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

‘ হাত দাও।’

আমার চোয়ালটা এবার ঝুলে যাওয়ার জোগার। শুকিয়ে যাওয়া গলায় শুকনো ঢোক গিলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বললাম,

‘ মানে!’

ধ্রুব ভাবান্তরহীন, নির্বীক কন্ঠে বলল,

‘ আওয়াজ করবে না। হাত দাও।’

আমি অসহায় চোখে চাইলাম। আবছা অন্ধকারে ধ্রুবর চোখ-মুখ ভালো দেখা গেল না বলেই হয়তো মনের ভেতর এক ঝাঁক সন্দেহ উঁকিঝুঁকি দিয়ে গেল। এই ছেলে সত্যিই ধ্রুব তো? নাকি আবির? আমার সাথে ফাজলামো করছে? আমার ভাবনার মাঝেই চাপা কন্ঠে তাড়া দিলো ধ্রুব,

‘ বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? হাত দাও।’

আমি সতর্ক চোখে দুই ছাদের মধ্যবর্তী দূরত্ব পর্যবেক্ষণ করলাম। আতঙ্কে পাংশুটে মুখ নিয়ে এক পা পিছিয়ে গিয়ে বললাম,

‘ অসম্ভব। আপনি পাগল। আপনার সাথে আমি কোথাও যাব না।’

ধ্রুব কোনোরকম প্রত্যুত্তর না করে শীতল চোখে চেয়ে রইল। আবছা অন্ধকারেও তার দৃষ্টির তীব্রতা গ্রাস করে গেল আমায়। পা নাড়ানোর ন্যূনতম শক্তি হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার এহেন দূরাবস্থায় আমার ওভার স্লো মস্তিষ্কের বড় দয়া হলো। বিজ্ঞের মতো পরামর্শ দিল, ‘নিশু ভেগে যা।’ আমি বিজ্ঞ মস্তিষ্কের পরামর্শে সায় দিলাম। কিন্তু লাভ বিশেষ হলো না। পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করার আগেই হাতে টান পড়ল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ধ্রুব লম্বা শরীরটা ঝুঁকিয়ে লম্বা সুঠাম হাতটি বাড়িয়ে চেপে ধরেছে আমার ডানহাত। আমি আঁতকে উঠলাম। ধ্রুব যেন খুব মজা পেলো। হেসে বলল,

‘ এবার?’

আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। ধ্রব শান্ত স্বরে বলল,

‘ লাফালাফি না করে শান্ত হও। নয়তো পড়ে যাবে।’

ধ্রুবর কথাটা কানে যেতেই সটান আবিরের কথাটা মনে করিয়ে দিল মস্তিষ্ক। আবিরকে ছেলেবেলায় ঠিক এমনই এক উপদেশ দিয়েছিল ধ্রুব। নিশ্চয় এমনই শীতল ভঙ্গিতে? আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। এই লোক কী আবিরের মতো সত্যি সত্যিই পাঁচ তলা থেকে ফেলে দেবে আমায়? আবির নাহয় বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু আমার কী হবে? আমি কাঁদো কাঁদো অসহায় চোখে ধ্রুবর দিকে চাইলাম। পৃথিবীর সবথেকে উম্মাদ পুরুষটির প্রেমে পড়েছি ভেবে বড় আফসোস হলো। আমাকে শান্ত হয়ে দাঁড়াতে দেখে আমার হাত টেনে রেলিঙের কাছে এনে দাঁড় করালো ধ্রুব। ডানহাতে শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরল আমার কোমর। আমি আতঙ্কে,ভয়ে খামচে ধরলাম ধ্রুবর বুকের শার্ট। ধ্রুব মৃদু হাসল। তারপর চোখের পলকেই, একদম ম্যাজিকের মতো অন্য ছাদের মেঝে স্পর্শ করল আমার পা। অতি সন্তপর্ণে আটকে থাকা দম ফেলে তীব্র অভিযোগ নিয়ে বললাম,

‘ আপনি কী পাগল! যদি আমি পড়ে যেতাম?’

ধ্রুব উত্তর দিল না। আমাকে ছেড়ে হেঁটে হেঁটে ছাদের অপর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। আমি বিরক্তির শেষ পর্যায়ে পৌঁছে, অধৈর্য হয়ে ধ্রুবর পিছু পিছু ছাদের রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়ালাম। অবাক চোখে নিজেদের বিল্ডিংয়ের ছাদের দিকে চেয়ে তীব্র ক্ষোভ নিয়ে কিছু বলব তার আগেই ধপাস এক শব্দে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে পাশ ফিরে চাইলাম। আঁতকে উঠে দেখলাম, ধ্রুব আমার পাশে নেই। আতঙ্কে, ভয়ে দম আটকে এলো আমার। ধ্রুব আবারও পাশের ছাদে লাফিয়ে পড়েছে। এই এলাকায় পাশাপাশি তিনটি সমান উচ্চতার বিল্ডিং বোধহয় কেবল এই জায়গাটিতেই আছে। ছাদে ছাদে আধহাত মতোন দূরত্ব। আর ধ্রুব তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করছে। আমি দরফর করতে থাকা বুকে হাত চেপে তপ্ত শ্বাস ফেললাম। ধ্রুব এবারও আগের মতোই হাত বাড়িয়ে দিল। কৌতুক করে বলল,

‘ চলে আসুন ম্যাডাম। এখন আর ধরা পড়ার চান্স নেই। প্রেম করার মতো সুন্দর আবহাওয়া। সুযোগটা লুফে নিন। সবাই প্রেমিকের সাথে প্রেম করে। আপনি নাহয় অ-প্রেমিকের অ-প্রেমিকা হোন।’

#চলবে….

প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

|২০|

আকাশে শুল্কপক্ষের চাঁদ। দুধ সাদা জ্যোৎস্নায় ছেঁয়ে আছে ছাদ। বসন্তের হিমেল হাওয়ায় কাঁপন ধরছে গায়ে। হুহু করে কাঁপছে সমস্ত শরীর। ছাদের টবে মাঝারি দেখতে জবা গাছটায় রক্তজবার বাহার। জ্যোৎস্নালোকিত স্বর্গীয় লালিত্য ছাপিয়ে ধরাস ধরাস লাফাচ্ছে, হৃদপদ্মের ছোট্ট অবাধ্য খাঁচা। ঠান্ডা হাওয়াতেও কপাল জু্ড়ে ঘাম ছুটছে। জ্যোৎস্না আর কুয়াশায় আবছা হয়ে আসা দূরের ছাদটির দিকে চেয়ে মূর্ছা যাওয়ার মতোই হিম হয়ে আসছে শরীর। ভয়াবহ এ্যাক্রোফোবিয়া নিয়েও দু’দুটো ছাদ মেঘের মতো উড়ে এসেছি ভাবতেই কন্ঠ শুকিয়ে যাচ্ছে। ফাঁকা ফাঁকা লাগছে মস্তিষ্ক। অথচ পাশের মানুষটি নির্বিকার। যুবতী একটি মেয়ের আপাত ভারী শরীরটা এক ছাদ থেকে অপর ছাদে পার করিয়েও শ্বাসে টান পড়েনি একবিন্দু। এক মাথা ঝাঁকড়া চুল হাওয়ায় উড়িয়ে স্টিলের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেটে গেছে একটু আগের নাছোড় ভাব। গম্ভীরতায় গা ঢেকে পাল্টে ফেলেছে নতুন রূপ। আমি ভয়ে, আতঙ্কে অস্থির চোখে ধ্রুবর দিকে চাইলাম। নিজের ভয়টুকু প্রাণপণ ঢাকার চেষ্টা করে ধ্রুবকে কড়া এক ধমক দেব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। তার আগেই মুখ খুললো ধ্রুব। রূপালি জ্যোৎস্নার রূপালি আলোয় বড় বড় বিষণ্ণ চোখদুটো মেলে আমার দিকে চাইল। শুধুমাত্র সেই দৃষ্টিতেই পাল্টে গেল অনেক কিছু। আমি চট করেই বুঝে ফেললাম অ-প্রেমিকের মনে জমিয়ে রাখা প্রগাঢ় এক অনুভূতির কথা। ধ্রুব হতাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রেলিঙে ঠেস দিয়ে আমার পাশাপাশি দাঁড়াল। গলার শ্লেষ্মা পরিষ্কার করে খানিক চুপ থেকে নিজের মনে কথা গুছিয়ে নিলো। বলল,

‘ জ্যোৎস্না যে চাঁদের আদুরে লজ্জার নাম, জানো? চাঁদের বিশেষত্ব কেবলই জ্যোৎস্না। জ্যোৎস্নার জন্যই মানুষ চাঁদের প্রেমে পড়তে চায়। আমারও চাঁদ খুব পছন্দ। আদতে চাঁদ নয় জ্যোৎস্নাটাই আমার বেশি প্রিয়। আমি এই জ্যোৎস্নার একটা নাম দিয়েছি।’

আমার জিজ্ঞাসাগুলো কন্ঠনালীতেই আটকে গেল। ধ্রুবকে কঠিন কিছু কথা শুনাতে গিয়েও কেমন মায়া হলো। সবসময় শক্ত দেখে আসা মানুষটির আচমকা পরিবর্তন, হুটহাট অদ্ভুত কথার পেছনে অস্পষ্ট কারণগুলোও নারী গুণেই স্পষ্ট বুঝলাম। অজানা আনন্দাশঙ্কায় কাঁপতে থাকা বুক নিয়ে ধ্রুবর দিকে চেয়ে রইলাম। ধ্রুব আমার নীরব প্রশ্ন বুঝতে পেরে চোখ নামিয়ে আমার দিকে চাইল। ঠোঁটের কোণে মিহি অথচ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হাসিটি নিয়ে বলল,

‘ তার নাম দিয়েছি চন্দ্রত্রপা।’

আমার বুক কেঁপে উঠল। মন বুঝল, ধ্রুব চাঁদের নয় আমার কথায় বলছিল। দিচ্ছিল আমারই রূপের বর্ণণা। ধ্রুব যখন আমার খুব কাছে এসে দাঁড়াল। পাশের জবা ফুলের ঝাড় থেকে গোটা দুই রক্তজবা ছিঁড়ে দ্বিধাহীন হাতে গুঁজে দিলো আমার হাওয়ায় উড়তে থাকা চুলে ঠিক তখনই আমি ভুলে বসলাম পারিবারিক অনুশাসন। আমার পুলিশ বিদ্বেষী বাবা। বাল্যকালের দৃঢ় বিশ্বাস। বাবার কথা বেদবাক্যের মতো মেনে নেওয়া কোমল মন সবই যেন যৌবনের প্রথম প্রেমে অস্পষ্ট হয়ে এলো। মুখে কিছু না বললেও নীরব সম্মতি পেল নতুন এক সম্পর্ক। আমি মৃদু স্বরে বললাম,

‘ আপনার নামে থানায় কঠিন মামলা করব ধ্রুব।’

ধ্রুব হাসল। কানের কাছে মুখ নামিয়ে আমার মতোই ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ কোতোয়ালি থানায় করবে? আমি বলে দেব, তারা তোমাকে সাহায্য করবে ত্রপা।’

কথাগুলো বলতে বলতে খেয়ালে-বেখেয়ালে কানের পাশটা স্পর্শ করে গেল এক জোড়া তপ্ত ঠোঁট। আমি কেঁপে উঠলাম। হৃৎযন্ত্রটা কেমন থমকে গেল। তারপর আবারও ছুটতে লাগল ঠিক পাগলা ঘোড়ার মতো। বুকের ভেতর ধুপধাপ শব্দ তুলতে লাগল পাগলা ঘোড়ার নিষ্ঠুর খুঁড়ের আওয়াজ। ধ্রুব নিজ মুখে ভালোবাসার কথাটা না বললেও তার আচার-আচরণ, চোখের দৃষ্টিতে তার ভালোবাসাটা বিশ্বাস করে নিলাম আমি। ভেবে নিলাম, কিছু মানুষের ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়। মুখে নয় কেবল চোখেই ভাসে। কিন্তু কে জানতো? কী ভয়ংকর ভুল ছিল আমার ভাবনা? এখনও ভাবি, এই বয়সে এসেও বুঝি দৃষ্টি চিনতে এতো ভুল হয় কারো? নিশ্চয় হয়। তাইতো আমার হলো। ভুল জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা আমি সেদিনই করে ফেললাম। ধ্রুবকে বিশ্বাস করলাম।

সেদিনের পর, ক্যাম্পাস, মহল্লায় ছড়িয়ে পড়া প্রেম-অপ্রেমের গল্পের পেছনেও আমাদের নতুন এক গল্প তৈরি হলো। সূর্য উঠার সাথে সাথেই দুজনেই কেমন মিইয়ে গেলাম। নিশ্চুপ হলাম। দু’পক্ষের দ্বারেই প্রেম-অপ্রেমের মাঝামাঝি মিষ্টি এক মধুরতা ছড়িয়ে গেল। দুটো মনেই নতুন করে বসন্ত এলো। মনে মনে কোকিল হয়ে ঘুম হারালেও। ধ্রুবর অনুভূতি বুঝতে পেরে জমিলা আপার ভাষ্যমতে একদম টাইট হয়ে বসে রইলাম। চোখমুখে গম্ভীরতা ছড়িয়ে ঘুরতে লাগলাম। ভাবখানা এই ধ্রুবকে কিছুতেই পাত্তা টাত্তা দেওয়া হচ্ছে না। ধ্রুব নামক ব্যক্তিকে আমি ইহজীবনেও চিনি না। আমার এই নির্লিপ্ততায় ধ্রুবর খুব একটা যায় আসলো বলে মনে হলো না। সে আগের মতোই দ্বিধাহীন দিন কাটাতে লাগলো। তবে তার সিঁড়িতে যাওয়া আসার মাত্রাটা একটু বেড়ে গেল। আমার ফ্ল্যাটের সামনে এসেই তার যক্ষা রোগটা হঠাৎ হঠাৎ উদয় হতে লাগল। আমার এই নির্লিপ্ত মুখভঙ্গি দেখে মাঝে মাঝেই মিটিমিটি হাসতে লাগল। আসতে-যেতে, অথবা বারান্দার কোণে দাঁড়িয়ে চোখেচোখে হওয়া কথাগুলোর গভীরতা খানিক বাড়তে লাগল। আমি চোখ-মুখ অন্ধকার করে রাখলে সিঁড়ি উঠতে উঠতেই পরিচিত পুরুষালি হাত খুব দুঃসাহসিকভাবে আঙুলে আঙুল ছুঁতে লাগল। কখনো-বা ছুঁয়ে যেতে লাগল আরও গভীরভাবে। আমার অন্ধকার মুখ আরও অন্ধকার হয়ে গেলে পুরুষালি ঠোঁটে খেলে যেতে লাগল পাতলা-মিহি হাসি। সন্ধ্যার পর, বন্ধুদের আড্ডায় মজে গিয়ে ছেলে বন্ধুদের খুব কাছাকাছি চলে গেলে শাসন আর রাগটাও চলতো ওই চোখে চোখেই। আমাদের মিষ্টি প্রেম-অপ্রেমের গল্পে ধ্রুবর অস্থিরতা বাড়তে লাগল সমানুপাতিক হারে। লেখালেখি বা নির্দিষ্ট কোনো বইয়ে ডুবে দিন দুই ঘরের সীমানা না পেরুলেই, বারান্দায় না দাঁড়ালেই ক্ষ্যাপাটে হতে লাগল ধ্রুব। ফোন নয়, ম্যাসেজ নয়। কেবল বারান্দায় মেলে রাখা জামা-কাপড়গুলো উপরতলার বারান্দার ঢালা পানিতে ভিজে একাকার হতে লাগল। সেই রাতের পর আমাদের মাঝে এক টুকরো বাক্য বিনিময় না হলেও কোমল এক সম্পর্ক কীভাবে যেন গড়িয়ে গড়িয়ে একদম পাকাপোক্ত হয়ে গেল। দু’জনেই উপলব্ধি করতে লাগলাম, একে-অপরের প্রতি একচ্ছত্র অধিকারবোধ। ক্যাম্পাসে, মহল্লায় আমাদের প্রেমের চর্চা কমে এলো। কিন্তু এবার পুরো পৃথিবীকে লুকিয়ে আমরা সত্যি সত্যিই প্রেম-অপ্রেমের নতুন এক গল্প লিখতে বসলাম। বাসা ছাড়ার ডেইটটাও ইচ্ছে করেই ভুলে গেলাম। ইচ্ছেকৃত ভুল করেই পিছিয়ে গেলাম। এভাবে সপ্তাহখানেক কাটার পর হঠাৎ একদিন পথ আগলে দাঁড়াল ধ্রুব। তখন দুপুর হবে হবে ভাব৷ সিঁড়িতে কোনো জনারব নেই। ধ্রুবর গায়ে সাধারণ সাদা পোশাক। ধ্রুবকে সাধারণ পোশাকে দেখে চট করেই মনে প্রশ্ন জাগল, ধ্রুবর আজ অফিস নেই? ধ্রুব আমার প্রশ্নমাখা চোখের দিকে চেয়ে হাসলো। মিটিমিটি পাতলা হাসি। আমি পাশ কাটানোর চেষ্টা করে ভ্রু কুঁচকালাম। খুব বিরক্ত হওয়ার চেষ্টা করে বললাম,

‘ কী হচ্ছে?’

ধ্রুব আবারও আমার সামনে পথ আগলে দাঁড়াল। তার পর্বতের মতো বিশাল শরীরটা ভেদ করতে পারব না বুঝে শান্ত হয়ে দাঁড়ালাম। আবারও শুধালাম,

‘ কী হচ্ছে?’

ধ্রুব চকচকে ঘড়ি পরা হাতটা রেলিঙে রেখে অপর হাত পকেটে পুড়ে খুব ভাব নিয়ে দাঁড়াল। ঠোঁটের কোণে অল্প একটু হাসি ঝুলিয়ে বলল,

‘ অসভ্যতা হচ্ছে।’

আমি ভ্রু কুঁচকে চাইলাম। পেট ফেঁটে হাসি পেলেও চোখ-মুখে গম্ভীরতা ছড়িয়ে বললাম,

‘ পথ ছাড়ুন নয়তো ইভটিজিংয়ের মামলা করব।’

‘ ওহ্ প্লিজ! আমার থানায় আসুন না। বহুদিন সুন্দরী কোনো ভিক্টিম পাচ্ছি না। মন, থানা সবই কেমন মরুভূমি লাগছে।’

ধ্রুবর ফ্লার্টিং স্কিলস্ দেখে চোখ বড় বড় করে চাইলাম আমি। বিস্মিত হলাম। প্রথম দেখায় এই ছেলেটিকে শান্ত, বোকা ভেবেছিলাম বলে নিজের প্রতিই মায়া হলো। চোখ-মুখ যথাসাধ্য অন্ধকার করার চেষ্টা করে বললাম,

‘ পথ ছাড়ুন।’

ধ্রুব পথ ছাড়লো না। খপ করে ওড়নার এক কোণা মুঠোয় পুড়ে কাছে টানলো। আমি ওড়না টেনে রক্তিম চোখে চাইতেই চোখে চোখ পড়ল। ধ্রুব একটু ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে বলল,

‘ এতো ভাব কেন তোমার? একটা নিষ্পাপ পুরুষ পাত্তা না পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। মায়া হয় না? ‘

আমি আঁতকে উঠে দুই পা পিছিয়ে গেলাম৷ ধ্রুবর হাতে আটকে থাকা ওড়নার কোণা মুক্ত করার চেষ্টা করে গরম স্বরে বললাম,

‘ আপনার নামে সত্যিই মামলা করা উচিত ধ্রুব৷ আপনি যে মেয়েদের এমন উত্যক্ত করেন সেটা আপনার বাবার জানা উচিত। তিনি এই মুহূর্তে সিঁড়ি বেয়ে নামলে কেমন হবে? অথবা আপনার ছোট ভাই?’

ধ্রুব দারাসারা কন্ঠে বলল,

‘ আমি মেয়েদের নয় শুধুমাত্র তোমাকে উত্যক্ত করি। সেজন্য আমি মামলার আসামি হতেও রাজি। তাছাড়া এখন দুপুর। সবাই ঘুমে বিভোর। তোমাকে-আমাকে দেখার জন্য কেউ বসে নেই। আর দেখলেই বা কী? তাদের তো আমাদের আগে থেকেই জানার কথা, আমাদের চলছে!’

আমি চোখ ছোট ছোট করে চাইলাম। কথার কী ছিঁড়ি! আমাদের চলছে! আমাদের চলছে, এটা আবার কেমন ভাষা? অসভ্য! আমার অবচেতন মন খুব সন্দেহ নিয়ে শুধাল,’ হ্যাঁ রে নিশু? এটা কী সত্যিই ধ্রুব? নাকি ধ্রুবর তৃতীয় কোনো ডুপ্লিকেট ভাই? ভুল করে অ-বর রেখে অ-দেবরের সাথে ইটিশপিটিশ করে ফেলছিস না তো ভাই?’

তারপর আরও একদিনের কথা। মাস ফুরিয়ে বাসা ছাড়ার তারিখ ঘনিয়ে এসেছে। আমি আর প্রিয়তা বাসার পাশের এক কফিশপে বসে কবে বাসা ছাড়া যায় তার বিস্তর পরিকল্পনা করছি। এমন সময় কোথা থেকে আচমকা হাওয়ার মতো উড়ে এলো আবির। ঘর্মাক্ত শরীরটা নিয়ে আমার সামনের চেয়ারটিতে ধপ করে বসে পড়ল। হাতে ভাঁজ করা এপ্রোনটা টেবিলের উপর রেখে শার্টের উপরের বোতাম দুটো খোলে আরাম করে বসলো। প্রচন্ড গরমে কলার ঝাড়তে ঝাড়তে কোনো ভূমিকা ছাড়ায় বলল,

‘ ব্রেকিং নিউজ ভাবী। ক্লোড কফি খাওয়াও। ব্রেকিং নিউজ কোল্ড কফি খেতে খেতে বলতে হবে।’

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ওয়েটারকে ডেকে একটা কোল্ড কফি অর্ডার করতেই সরু চোখে চাইল প্রিয়তা। ধারালো কন্ঠে বলল,

‘ এই! আপনি কী মাছি নাকি? শুকে শুকে ভাবী ভাবী করতে চলে এসেছেন?’

আবির বিরক্ত চোখে চাইল। খুব সিরিয়াস কন্ঠে বলল,

‘ তুমি চুপ করো ঝগড়াঝাঁটি। আমরা ভদ্র মানুষ। ভদ্র মানুষরা ভদ্র জায়গায় ঝগড়াঝাঁটির সাথে কথা বলতে পছন্দ করে না।’

প্রিয়তা বিস্ফারিত চোখে চাইল। প্রায় ফেঁটে পড়ে বলল,

‘ হ্যাঁ, খুব ভদ্র। এজন্যই তো আপনার ভদ্র ভাই আমার বোনকে চেপে ধরে চুমু খেয়েছে। তাও উইদআউট পারমিশন!’

আবির চোখ বড় বড় করে চাইল। তবে বড় ভাইয়ের সম্পর্কে দেওয়া এতোবড় অপবাদ সে এক সেকেন্ডের জন্যও বিশ্বাস করলো বলে মনে হলো না। প্রিয়তার কথাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে খুব দুঃখ নিয়ে বলল,

‘ ব্রেকিং নিউজটা পেটে থাকছে না। বলে ফেলি। ক্লোড কফি এলে নতুন করে বলব, সমস্যা নেই। কথাটা হলো, তোমার স্বামী তো বিপথগামী হয়ে যাচ্ছে ভাবী৷ আমার খুব সন্দেহ তার কোনো মেয়ের সাথে চক্কর চলছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি। রশি টেনে ধরো। নয়তো শ্যাষ!’

আবির কী দেখেছে সে নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখালাম না আমি। আমাদের ধীরে ধীরে গড়ে উঠে কোমল সম্পর্কটা আড়াল করতেই হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,

‘ স্বামী স্বামী করবে না আবির। তোমার ভাইয়ের সাথে আমার রশি টানার মতো কোনো সম্পর্ক নেই।’

আবির এবার আরও মর্মাহত হলো। অসহায় কন্ঠে বলল,

‘ কেন নেই?’

আমি উত্তর দিলাম না। তবে তার পরেরদিনই অস্বাভাবিক এক দৃশ্যে চমকে গেলাম। এলেমেলো হয়ে গেলো মস্তিষ্ক!

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here