প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প,২৭

0
339

প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প,২৭
লেখিকা-নৌশিন আহমেদ রোদেলা

আকাশ ভেঙে ঝুমঝুমিয়ে জল গড়াচ্ছে। কাঁচে ঢাকা জানলার এপাশে অনেকটা গাড়লের মতো দাঁড়িয়ে আছে লম্বা চওড়া মানুষটা। তরুর ঘরের ওপাশেই রান্নাঘর। কান খাঁড়া করে শুনছে দেয়ালের ওপাশ থেকে ভেসে আসা রিনরিনে হাসির শব্দ। প্রিয় নারীর চাপা অনুযোগ, শাসন। এই নারীটিকে ধ্রুব ভালোবেসেছিল অনেকটা বৃষ্টির মতো। গ্রীষ্মের বৃষ্টি যেমন আসে হুট করে? ঠিক তেমনই হুট করে ভালোবাসা এসে ভিজিয়ে দিল ধ্রুবর চির শুষ্ক মন। শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া মাটিতে যেমন বর্ষা আসে? ছড়িয়ে দেয় সোঁদা গন্ধ? তেমনই সোঁদা, নরম গন্ধে ভরে গেল ধ্রুবর হৃদয়। বন্য গোলাপের থেকেও প্রিয় হয়ে উঠল ত্রপা। তার চন্দ্রত্রপা। তারপর ঘটে গেল অজস্র অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। ভালোবাসাটা হয়ে গেল আজন্ম বেদনা। ধ্রুব কখনো ভাবেনি নিশিতা তার ভালোবাসা হবে। তারপর ধীরে ধীরে হয়ে যাবে জীবনের সব থেকে বড় ব্যথা। বিষাক্ত নরম ব্যথা।

ধ্রুবর আজও মনে পড়ে নিশিতার সাথে তার প্রথম দেখার কথা। ভীষণ বিভ্রান্ত, ভয়ার্ত রূপসী একটি মেয়ে। কবুতরের ছানার মতো কম্পিয়মান তার শরীর। কাঁপছে থরথর। এতো ভয় মেয়েটার! ধ্রুব যে সেই চির ভয়ার্ত মেয়েটিরই গল্প হয়ে যাবে ভাবতে পেরেছিল আদৌ? ঔপন্যাসিকের প্রতি খুব রাগ হয় ধ্রুবর। ঔপন্যাসিক বুঝি খুব নিমকহারামি করেই ব্যথার নাম দিয়ে দিলো ‘ধ্রুব’? সেদিন সেই ছোট্ট ক্ষুদেবার্তা আর প্রচ্ছন্ন ধমকি দিয়েই তো গল্পের সমাপ্তি টেনেছিল ধ্রুব। ভেবেছিল, আর কথা হবে না ভীষণ নরম সেই মেয়েটির সাথে। ছলছল যার দৃষ্টি? কিন্তু ধ্রুবর ভাগ্যটা বড়ো অন্যরকম। সমাপ্তির দাড়ি টানতে টানতেই হঠাৎ গল্প বদলে গেল। ধ্রুবকে ভীষণ অবাক করে দিয়ে নিশিতা ধ্রুবকে ফোন করল। কী আশ্চর্য! মেয়েটা নিজ থেকে তাকে ফোন করল! কেন করল? বিস্ময় চাপতে পটু ধ্রুব বিস্ময়টা চেপে গেলেও আশ্চর্য হলো। খুব আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করল, ধ্রুবর প্রতি নিশুর প্রছন্ন দুর্বলতা। নরম এক সন্দেহের বাতাস ছুঁয়ে গেল ধ্রুবর মন জুড়ে। এই গোটা ঘটনাটি কী তবে নিশুই ঘটিয়েছে? এই দুর্বলতা থেকেই কী এই গুজবের ছড়াছড়ি? বুদ্ধিদীপ্ত মস্তিষ্কে চাপা কৌতূহল খেলে গেলেও পাত্তা দিলো না ধ্রুব। বাচ্চা মেয়ের ইনফিচুয়েশন ভেবে এড়িয়ে গেল। এড়িয়ে গেল সকল গুজব, বন্ধুদের ঠাট্টা। কিন্তু নিশিতা যেন তাকে ঠিক ছাড়ল না। হঠাৎ করেই একদিন মাঝরাতে কল দিয়ে বসলো। ধ্রুবকে বিস্মিত হওয়ার ন্যূনতম সুযোগ না দিয়ে তীব্র অধিকার নিয়ে আবদার করল,

‘ আপনি একটু ছাদে আসুন। কথা আছে।’

কী তীব্র সেই আবদার। কী তীব্র সেই অধিকারবোধ! ধ্রুব যেন ক্ষণকালের জন্য থমকে গেল। এতোরাতে যুবতী একটি মেয়ে একদম একলা ছাদে আসতে চাইছে। দেখা করতে চাইছে তারই সাথে কলঙ্কে জড়িয়ে থাকা তাগড়া এক যুবকের সাথে। চিন্তা করা যায়? যদি কেউ দেখে ফেলে? কলঙ্কের ভয় নেই বুঝি মেয়েটার? এতো অবুঝ! এতো সরল! ধ্রুবর খুব মায়া হলো। প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করল, এই সরল মেয়েটি দুঃখ পেলে বড়ো কষ্ট হবে ধ্রুবর৷ নিশিতাকে কোনোরকমে পরাস্ত করতে না পেরে রাজি হলো ধ্রুব। ভাবলো, দেখা হলে বুঝিয়ে বলবে তাকে। এভাবে হয় না। এতো সরল হলে চলে না। একপাক্ষিক আকর্ষণ কষ্ট ছাড়া কিছু দেয় না। কিন্তু ছাদে গিয়ে মেয়েটির ভীষণ লাজুক মুখটি দেখে আবারও মায়ায় পড়ে গেল ধ্রুব। অনুভূতিতে ডুবে থাকা নরম হৃদয়টিতে হুট করেই কথার আঘাত করতে ইচ্ছে হলো না। মনের অজান্তেই মোলায়েম হয়ে গেল ব্যবহার। কিন্তু সত্য তো বলতে হবে। এই নরম হৃদয়টা ভবিষ্যতে অসংখ্য হুঁলে বিদ্ধ না হতে চাইলে সত্যটা তাকে জানতে হবে। ধ্রুব সেবার একটু রূঢ় হলো। সরাসরি বুঝিয়ে দিলো তার অপারগতার কথা। কিন্তু নিশিতার হঠাৎ অন্ধকার হয়ে যাওয়া সেই ছলছলে দৃষ্টি? সেই মন কেমনের দৃষ্টিতে মনটা কী একটু বিষিয়েছিল ধ্রুবর? থমকে গিয়েছিল?

ধ্রুব কিছুতেই অপমান করতে চায়নি মেয়েটিকে। কোমল মনটাকে আলগোছে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল শুধু। ভেবেছিলো, সদ্য যৌবনে পা দেওয়া ইনফেচুয়েশনটা কেটে যাবে চোখের আড়াল হলেই। কিন্তু ওইযে? গল্পটা বড়ো বেয়ারা। কিছুতেই দাড়ি টানতে চায় না। তাই এবারও ধ্রুবর মতামতকে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে গল্প দাড়ি টানলো না। ঠিক পরেরদিনই বাজারে যাওয়ার পথে চোখে পড়ে গেল নিশিতা। তাও আবার বাবার সামনে। ধ্রুবর কিছুতেই মনে পড়ে না, সত্যিই কী সেদিন প্রেমে পড়ার মতো কিছু করেছিল ধ্রুব? তবে কেন ওমন পাগল করা প্রেমে ভেসে গেল নিশু? কোমল, স্বচ্ছ হৃদয়টা ফুলে ফেঁপে উঠল অনুভূতিতে? বাজার থেকে ফিরে, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতেই ধ্রুব বুঝতে পারল, ঘটনা ঘটে গিয়েছে। নিশিতা তার প্রেমে পড়ে গিয়েছে। তার ছোটখাটো ইনফিচুয়েশনটা ধীরে ধীরে গভীর হয়ে যাচ্ছে। অথচ ধ্রুবর বুকে পাহাড় সমান কঠোরতা। এক চিলতে প্রেম নেই হুহু করা বালুচরে। এই শুষ্ক বালুচরে ওমন প্রেমের বর্ষণ মানায় না। লাগাম টানা উচিত। কিন্তু কী করে? কীভাবে পরাস্ত করবে এই কোমল, ফুলের ন্যায় মনটাকে? একটুও দুঃখ না দিয়ে? ধ্রুব কী করবে বুঝে না পেয়ে নিশিতাকে আগাগোড়া এড়িয়ে চলার সিদ্ধান্ত নিলো। আর তখনই নিশিতা তাকে তৃতীয়বারের মতো চমকে দিয়ে তৃতীয় কলটা করল। ধ্রুব বুঝে পেলো না, মেয়েটি কী চায়? সে কী ধ্রুবর সাথে কথা বলার উদ্দেশ্যেই নানা ছুতোয় ফোন লাগায়? নাকি অটোমেটিক ফোন দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে যায়? ধ্রুব সেদিন খুব বিরক্ত হলো। ঠান্ডা গলায় একটু বুঝি অপমানও করল। তবু মেয়েটার ইনফেচুয়েশন কেটে যাক। কল্পনায় বাষ্প না ছড়াক। এতটুকুন বাচ্চা একটা মেয়ে। তার সাথে কী ধ্রুবর প্রেম-ভালোবাসা মানায়? তার প্রেম হওয়ার কথা যে সমানে-সমানে। কিন্তু ধ্রুব কী নিজেই বুঝেছিল? নিশুর আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে নানা ছুতোয় বারবার তার কাছে ফিরে আসা, ছলছল দৃষ্টি আর নিখাঁদ প্রেমের বর্ষণে একটু একটু ভিজেছিল ধ্রুবও। নরম হয়েছিল মন।

ধ্রুবর শক্ত অপমান সেবার বেশ কাজে দিয়েছিল। নিশু হুট করেই বাসা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। মনে মনে খুশির পাশাপাশি একটু যেন কষ্টও হয়েছিল ধ্রুবর। একটি রমণীর হৃদয় ভাসানো প্রেম। অবচেতনেই সমর্পন। পুরুষ হৃদয়টিকে দোলা দিয়েছিল শরতের শিউলির উপর ঝরা কুয়াশা বিন্দুর মতো। ধ্রুব ভেবেছিল, এ হয়তো ক্ষণিকের মায়া। কিন্তু তা যে নরম, তুলতুলে ভালোবাসারই বিন্দু বিন্দু প্রদর্শন। তা কী এক বিন্দু বুঝেছিল? আহা! ধ্রুবর প্রাণ ভরা আফসোস। যদি এতটুকু বুঝতে পারতো! আরো একটু, আরো একটু গুছিয়ে মেয়েটিকে বুকে টানতে পারতো! তবে গল্পটা বড়ো অন্য রকম হতো। বড়ো সুন্দর হতো। কিন্তু ধ্রুব ভুল করল। নিশিতা যেদিন খুব অসুস্থ হয়ে সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ল? ভীষণ অপরাধবোধে ভেতরটা ছেয়ে গেল ধ্রুবর। সে কী তবে অবচেতনেই অপমান করে ফেলল কোমল মেয়েটির অনুভূতি? কষ্ট দিয়ে ফেলল? মায়ের মনে তৈরি হওয়া ভুল ধারণা, নিজের বুকে তৈরি হওয়া মায়া আর নিশুর মনে তৈরি হওয়া ইনফিচুয়েশনের সাগরটা মিটিয়ে দিতে খুব খুব খুব ভুল একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ধ্রুব। ভাবল, বিয়েই এই সমস্যার একমাত্র সমাধন। এবার নাহয় একটা বিয়ে করা যাক। মায়ের হাতে বিয়ের সমস্ত দায়িত্বটা তুলে দিয়ে নিজের কাজে মন দিলো। কাজের চাপে আর বেশ কিছুদিনের নিতান্তই অদর্শনে নিশিতা নামক কোমল মেয়েটা এবং তার আকাশ ভাঙা প্রেমের কথা মন থেকে বেরিয়েই গিয়েছিল ধ্রুবর। বাড়ি ফিরলে আবিরের ‘ভাবী ভাবী’ জয়ধ্বনিতে হৃদয়ে কদাচিৎ দোলা দিতো। তারপর আবারও কর্পূরের মতো হারিয়ে যেতো সেই ভাবনা। সপ্তাহখানেক সমান্তরালে চলা দিনগুলো, নিশুর পাগলামোহীন দিনগুলো দেখে ধ্রুব ভেবেছিল হয়তো সামলে নিয়েছে নিশু। কেটে গিয়েছে ইনফিচুয়েশন। কেটে গিয়েছে মায়া। কিন্তু মায়াটা আর কাটলো কই? জয়নুল আবেদীনে হঠাৎ মেয়েটির দেখা পেয়ে, তার শুষ্ক মুখ, বন্ধুদের দুষ্ট ইঙ্গিত আর বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় একা দাঁড়িয়ে থাকা বিভ্রান্ত চেহারাখানি দেখে হারিয়ে যাওয়া মায়াটা যেন দ্বিগুণ তেজে মাথা তুলে দাঁড়াল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, এই মেয়েটিকে এভাবে একা ফেলে যাওয়া ধ্রুবর পক্ষে অসম্ভব। অথচ মেয়েটিকে দেখো? কী জেদ! দৃষ্টির পরতে পরতে অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিমান। একদম অবুঝ প্রেমিকার মতো সবিমান। আহত বাঘিনীর মতো জ্বলজ্বলে দৃষ্টি। নিশিতার এই রূঢ়তায় থমকে গেল ধ্রুব। বহু ভেবেও বুঝে পেলো না, কী দোষ করেছে ধ্রুব? তার থেকে কী চায় এই মেয়ে? ভালোবাসা? প্রেম? স্ব-ইচ্ছা সমর্পন?

সেই বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় নিজেকে সমর্পন না করলেও স্ব-ইচ্ছায় সমর্পন করেছিল ধ্রুব। কী তীব্র ছিল সেই সমর্পন! কী তীব্র ছিল সেই অনুভূতির জ্বালা! এতো দিনে ধীরে ধীরে জমে উঠা কোমল, তুলতুলে মায়াগুলো কালবৈশাখীর ঝড়ের মতোই আকস্মাৎ আছড়ে পড়ল ধ্রুবর মনে। সাদা শাড়ি পরিহিতা সেই নারী নাড়িয়ে দিলো সকল অনুভূতির ঝাড়। মরে যাওয়া বিকেলের স্নিগ্ধ আলোয় সেই নারীর মুখের দিকে চেয়ে এক মুহূর্তের জন্য দুনিয়া ভুলে গেল ধ্রুব। উফ! উফ! কী আদর সে মেয়েটি! ধ্রুবর শিরায় শিরায় কাঁপন ধরিয়ে দিলো। ছলছল, সুন্দর ওই চোখদুটোর দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে থেকেই ধ্রুব বুঝেছিল, কবি গুরুর মতো আলোয় রাঙা চৈত্র মাসটিতে তারও খুব সর্বনাশ হয়ে গেল। এই সর্বনাশী মেয়েটিই তার চিত্তবাস হয়ে গেল। এই মেয়েটিকে ছাড়া তার চলবে না। পুরো পৃথিবীকে বিসর্জন দিয়ে হলেও তাকেই ধ্রুবর চাই। একান্ত নিজের করে চাই। তা হোক নীতিবিরুদ্ধ। অথবা খুব ভুল চাওয়া। তবুও, তবুও ধ্রুবর চাই। কেবল এই রমণীটিকেই চাই। আর কিচ্ছু না।

সেদিন থেকেই কী মারাত্মক মন ব্যথায় ক্লান্ত হচ্ছে ধ্রুবর হৃদয়। হুটহাট জ্বর হচ্ছে। কেবল তাকে পাওয়ার জ্বর। হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে থেকেও হঠাৎ হাহাকার করে উঠছে বুক। যেমনটা হয়েছিল সেই পুর্মিলনের সন্ধ্যায়। পুর্মিলনের মাঠে সাদায় মোড়ানো মেয়েটিকে শশকের মতো ছুটতে দেখে শরীরের শিরায় শিরায় জ্বর ছুটেছিল ধ্রুবর। বিবেকবুদ্ধি লোপ পেয়েছিল। কেবল মনে হয়েছিল, নিশুকে জানাতে হবে তার এই মন ব্যথার কথা। নিশু যে তার কত বড় সর্বনাশ করলো, সেই সর্বনাশের কথা। তারপর! তারপরের গল্পগুলো বড়ো সুন্দর। নরম। তুলতুলে। শরতের পেঁজা তুলোর মতো আদুরে। নিজের অনুভূতি সামলাতে না পেরে এই পরিণত বয়সে এসেও কত পাগলামো করে ফেলল ধ্রুব। উড়ু চিঠির মতোই প্রেম চিঠি পাঠাল কনফেশনের পাতায়। চিঠিতে লিখে দিল নিশুকে দেওয়া তার একান্ত ব্যক্তিগত নাম। অনুভূতিটুকু নিশুর ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়ে অনেকটা ভারমুক্ত হলো ধ্রুব। নিজেকে ধীরে ধীরে সামলে নিল। নিজেকে শক্ত একটি খোলসে আটকে নিয়ে নির্বিকার রইলো গোটা একটি সপ্তাহ। কিন্তু সেই খোলসও যেন সহ্য হলো না নিশুর। খোলসটাকে টেনে ছিঁড়ে দিয়ে, কোনো এক গোধূলিতে, মিহি কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,

‘ ত্রপা নাকি কাঠগোলাপ?’

ধ্রুবর মনে আনন্দের ঝুমঝুমি বয়ে গেল। কী ছিলো সেই প্রশ্নে? ধ্রুব জানে না। শুধু জানে, আর এক মুহূর্ত নির্বিকার থাকা যায় না। ধ্রুব তবুও চেষ্টা করেছিল। নিজেকে সংযত রেখে স্পষ্ট উত্তর দিয়েছিল। কিন্তু আবারও তালগোল পাকাল নিশু। ধ্রুবকে চাইতে দেখেই তিতির পাখির ছানাটির মতো থরথর করে কাঁপতে লাগল। বড় বড় চোখে দীর্ঘ কালো পাপড়িগুলো রজনীগন্ধার কঁচি ডগার মতোই তিরতির করে দুলতে লাগল। নিশুর ভয়ার্ত, লাজুক মুখটি দেখে মুহূর্তেই পৃথিবী ভুলে গেল ধ্রুব। তার উপস্থিতি প্রিয় নারীর অস্তিত্বে ঝড় তুলতে পারে ভাবতেই ঘুমিয়ে থাকা পুরুষালি সত্তাটা ঝিমঝিমিয়ে উঠল। তারপর কী থেকে কী হয়ে গেল। ভয়াবহ অঘটন ঘটে গেল। নিশিতার তুলতুলে গালে গাঢ় এক চুমু খেয়ে বসল। নিজের শরীরের এই নিমকহারামিতে নিজেই যেন স্তব্ধ হয়ে গেল ধ্রুব। নিশিতাকে বলার মতো দ্বিতীয় কোনো শব্দ ঠোঁটে জোগাল না। চুপচাপ সেখান থেকে সরে পড়ল। বুকের ভেতর উথাল পাথাল ভয় ছুটে গেল। নিশিতা কী ভাবছে তাকে নিয়ে? সে কী খুব কষ্ট পেয়েছে? ঘৃণা করছে ধ্রুবকে? করারই কথা। হুট করে এমন অসভ্যতাও কেউ করে? এমন হাজার হাজার চিন্তায় রাতের ঘুম হারিয়ে গেল ধ্রুবর। রাত-ভোর করে বারান্দায় পায়চারি করল। শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিলো, নিশুর সাথে কথা বলতে হবে। তার এই অন্যায়টা যদিও মেনে নেওয়ার মতো নয়। তবুও মহারাণীর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করলে সে নিশ্চয় এই গুরুতর অপরাধের সাজা কিছু কম করবে? খানিক হলেও হালকা করবে? অবচেতনে করে ফেলা বিশ্রী এই অপরাধবোধ থেকে মুক্ত হতেই ভোররাতে এই প্রথমবারের মতো নিশুকে ফোন করল ধ্রুব। অনুভূতি যেমনই হোক। নিশুর সাথে তার আলাপচারিতা খুব অল্প। দু’জনের কথা হয়েছে হাতের কড়ায় গুণে গুণে দুই থেকে তিনবার। ক্রিকেটের মাঠ কাঁপানো, অনুষ্ঠানের স্টেজ অথবা বিতর্কের মঞ্চ কাঁপানো, তুখোড় যুক্তিবাদী এএসএসপি মহাশয় এই প্রথমবারের মতো নার্ভাস হয়ে পড়লেন। কী বলবে নিশুকে ফোন করে? এমন একটা কান্ড ঘটানোর পর আর কথা বলা যায়? সেদিন খুব খাটতে হয়েছিল ধ্রুবর। বহু কাঠ-খড় পুড়িয়ে এই জেদি মহারাণীকে ছাদে আসতে বাধ্য করেছিল। মনে মনে বিশাল এক ক্ষমাপত্র তৈরি রেখেছিল। কিন্তু আবারও কেমন গুবলেট করে ফেলল ধ্রুব। মহারাণী যখন সামনে এসে দাঁড়ালেন; তার বিভ্রান্ত, ভয়ার্ত মুখখানি দেখে আবারও ছন্নছাড়া হয়ে গেল মন। সকল সৎ ইচ্ছে উবে গেল। অপরাধবোধ ডুবে গেল। এক লহমায় ব্যক্তিত্বে ঢাকা ধ্রুব মরে গেল। ভেতরের জেদী, বেপরোয়া পুরুষিত সত্তা ফুঁসে উঠে বলল,’ বেশ করেছি চুমু খেয়েছি। এই মেয়েটিকে দিন-রাত চুমু খাওয়া উচিত। একটা নয়। লক্ষ,কোটি চুমু খাওয়া উচিত।’ স্থির চিত্ত ধ্রুব সেদিন কী ভীষণ অস্থিরতায় সিদ্ধান্ত বদলে ফেলল। ক্ষমা পত্রের পরিবর্তে হৃদয়ে নিগরানো আত্ম নিবেদন দিয়ে বসল। প্রেম না হয়েও অন্যরকম এক প্রেমের রসে ভেসে গেল দু’জন। নিরন্তর কথার পরিবর্তে এক চিলতে হাসি৷ চাহনিতে ভালোবাসা আর তীব্র অধিকারবোধের রেশ। ধ্রুবকে দেখে নিশুর লজ্জায় মিঁইয়ে যাওয়া। লাল মুখ নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। লাজুক প্রেয়সীকে লজ্জার সাগরে ডুবিয়ে দিতে ধ্রুবর হুটহাট ছুঁয়ে যাওয়া। একদম বাক্যালাপহীন, নিশ্চুপ এ কেমন প্রেম ছিল তাদের? তবুও, কী ভীষণ মিষ্টি স্বপ্নের মতো গাঢ় অনুভূতি সেই নিশ্চুপ প্রেমের। বুক ব্যথা করার মতো ভালো লাগা। ভাবতে ভাবতেই বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথা করে উঠল ধ্রুবর। বৃষ্টির ছন্নছাড়া আওয়াজের সাথেই ত্রপা, ত্রপা জয়ধ্বনি করে উঠল পৃথিবী। ভীষণ অভিমানী মনটা ফুঁসে উঠে শুধাল, তুমি কেন আমায় বুঝলে না ত্রপা?

‘ এই ধ্রুব? খেতে চল। টুনটুনি আজ জব্বর রান্না চাপিয়েছে বুঝলি? খিচুড়ি, ইলিশ আর বেগুন ভাজা। একটু চাটনি হলে ব্যাপারটা একদম মাখো মাখো হতো। কী বলিস?’

ভাবনার পাহাড় কাটিয়ে তরুর ডাকে সাড়া দিলো ধ্রুব। বৃষ্টিটা কমে এসেছে। আষাঢ়িয়া জলে স্বচ্ছ, সুন্দর লাগছে পিচ ঢালা রাস্তা আর উত্তরের জারুল গাছ। জারুল গাছে জেঁকে ধরে ফুল এসেছে৷ বেগুনি ফুলে ফুলে নুঁয়ে পড়েছে গাছের নরম ডাল। ওই বৃষ্টিস্নাত কোমল জারুল ফুলগুলো দেখেই বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠল ধ্রুবর। মনে পড়ে গেল বৃষ্টিস্নাত সেই রাত। চারদিকে সাদা সাদা বৃষ্টির মালা। তার মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠা নিশু। বৃষ্টির ছাঁটগুলো বিন্দু বিন্দু জল জমাচ্ছে তার সারা মুখে। কমলার কোয়ার মতো কোমল ঠোঁটদুটো কাঁপছে। সেই সাথে কাঁপছে ধ্রুবর হৃদয়। মাঝ রাতের নিষিদ্ধ ইচ্ছেগুলো কাঁপিয়ে তুলছে নিউরন। রক্তে চলছে ভয়াবহ আন্দোলন! এক হাত দূরে বসে থাকা রমনীটির ওষ্ঠে জমা জলগুলো শুষে নেওয়ার ইচ্ছেটাও আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলন্ত। ভেজা গায়ে স্পষ্ট যৌবনের খেলা। গায়ে কম্পন ধরানো আবেদনময়ীতা। সে যেন বৃষ্টিস্নাত জারুলেরই রূপ। আশ্চর্য সুন্দর রূপ! ধ্রুব সেদিন ইস্পাতের মতো কঠিন করে রেখেছিল তার মনোবল। আর কোনো ভুল নয়, আর কোনো ভুল নয় জপতে জপতেই ঘটে গেল বৃহৎ এক ভুল। নিশু আচমকা তার কাছে এলো। ভীষণ কাছে এসে পান করাল অমৃত সুধা। ধ্রুব চমকাল। হৃদপিণ্ডটা খানিক থমকে গিয়েই অসহ্য পাগলামোতে কাঁপিয়ে তুললো বুক। রক্তে রক্তে উন্মাদনা। পেশীতে কাল বৈশাখী ঝড়। সেই ঝড়েতেই ভেঙে গেল সকল প্রতিরোধ। বৃষ্টির তেজ বাড়ল। গাছের ডগায় হাওয়া চলল। চলল দোলনায় বসে থাকা দুটো নর-নারীর উন্মাদ প্রণয়কথন। তীব্র হলো সুধা তৃষ্ণা। নিষিদ্ধ আদর। সেই বৃষ্টিস্নাত ওষ্ঠ, কাঁপা কাঁপা চাহনি আর অতৃপ্ত সুধা চুম্বনের কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতর দাউদাউ করে জ্বলে উঠল বিচ্ছেদের অনল। নতুন করে উপলব্ধ হলো, নিশুকে ছাড়া বর্ষা বড়ো নিষ্ঠুর হবে তার। বুকে ব্যথা হবে। খুব শূন্য লাগবে মরুভূমিসম শুষ্ক ওষ্ঠ, নিঃস্ব বুক।

ধ্রুবর হঠাৎ করেই মন খারাপ হয়ে গেল। পৃথিবী শীতল করে দেওয়া বর্ষাকে তরুর অকারণ ডাকের মতোই বিরক্ত লাগল। জানালার পাশ থেকে সরে এসে বিছানার উপর বসলো। তরু প্যান্টের উপর লুঙ্গি গুঁজে পরেছে। লুঙ্গির নিচে প্যান্ট পরতে পেরে তাকে বহু আকাঙ্ক্ষিত প্রেমিকা পেয়ে যাওয়ার মতোই আনন্দিত দেখাচ্ছে। সে আনন্দিত কন্ঠে বলল,

‘ বসে পড়লি যে? টেবিলে খাবার দিয়েছে। ওই আপদ, বিপদও বোধহয় তোর মুখ চেয়ে অপেক্ষা করে বসে আছে। আপদটা কঠিন পাঞ্চুয়াল বুঝলি? এক মিনিট এদিক-ওদিক হলেই ফায়ার। চল, জলদি।’

ধ্রুবর মাঝে কোনো হেলদোল দেখা গেলো না। উরুতে কনুই ঠেকিয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাতদুটোতে ঠোঁট চেপে নিশ্চুপ বসে রইলো। তামাটে চোয়ালটা শক্ত দেখালো। কপালে পড়ল গম্ভীরতার ভাঁজ। তরু অধৈর্য হয়ে বলল,

‘ ব্যাপারটা কী? খাবি না?’

ধ্রুব রয়েসয়ে উত্তর দিলো,

‘ না।’

‘ না মানে? কেন, না?’

ধ্রুব জবাব দিলো না। সব প্রশ্নের জবাব দেওয়া যায় না। এইযে, ভেতর ভেতর নিশিতাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠলেও কী জানি কেন ধ্রুবর একদমই নিশিতার মুখোমুখি হতে ইচ্ছে করছে না। এইযে এই ‘কেন’-এর উত্তরও তো ধ্রুব জানে না। আচ্ছা, ধ্রুব কী তবে ভয় পাচ্ছে? কিন্তু কীসের ভয় তার? সে নিজে একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার। বাবা ছিলেন উচ্চ পদস্থ সেনা কর্মকর্তা। দাদা-পরদাদার বনেদি আধিপত্য এখনও গর্ব করার মতোন। আপাতত বাপ-দাদার এই শহরটাতে তার একচুল ভয় পাওয়ার কথা নয়। তবুও সে ভয় পাচ্ছে। নিশিতা নামের আত্মসম্মানে জ্বলতে থাকা এক মেয়ের ভয়ে এএসএসপি ধ্রুবর কন্ঠ শুকিয়ে যাচ্ছে। ধ্রুব বেশ খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল,

‘ তোর ভাগ্নীগুলো খুব বেয়াদব। বড়-ছোট বাছবিচার নেই। আসার সময় আমাকে দেখে কী রকম অশ্লীল মন্তব্য করেছে তুই চিন্তাও করতে পারবি না। আমি ওদের সামনে যাব না।’

তরু খুব বিরক্ত হলো,

‘ এমন একটা ভাব করছিস যেন তুই কচি খোকা। ভালো দেখতে ছেলেদের দেখে প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েরা একটু আধটু অশ্লীল কথা বলবে, এটাই তো স্বাভাবিক। আমরাও তো বলি, বলি না? ওরা তো আর তোকে ডেকে তোর সামনে বলেনি। বলেছে, নিজেদের মাঝে, চুপিচুপি। তুই যদি ফট করে সেটা শুনে ফেলে থাকিস, তাতে তো তাদের কোনো দোষ নেই। দোষ তোর। তুই শুনলি কেন?’

ধ্রুব খুব আশ্চর্য হয়ে চাইল। বলতে ইচ্ছে হলো,

‘ তাই বলে, মামার বন্ধুকে দেখে অশ্লীল অশ্লীল মন্তব্য করে ফেলতে হবে?’

কিন্তু বলল না। সে নিজেও বন্ধুর ভাগ্নীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। হাবুডুবু খেতে খেতে দুই দুইবার চুমুও খেয়ে ফেলেছে। একই নৌকোর যাত্রীকে আর যায় হোক নৌকোয় উঠা নিয়ে চোখ রাঙানো যায় না। অতএব চুপ থাকতে হবে। ধ্রুব চুপ করে বসে রইলো। ধ্রুবকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে খেঁকিয়ে উঠল তরু,

‘ এই তোকে পুলিশ ক্যাডার বানালো কে বল তো? যে বানিয়েছে তার নাম্বার দে। আমি অতি অবশ্যই তার স্পর্শকাতর জায়গায় দু’দুটো লাথি কষে আসবো৷ আরে ব্যাটা! তুই হলি একজন পুলিশ মানুষ। পুলিশ মানুষের আবার এতো লজ্জা-শরম থাকবে কেন? তাদের হতে হবে দুনিয়ার বেশরম। তাদের মুখ থেকেও বেরুবে বেশরম বেশরম কথা। এই মুহূর্তে তুই আমায় একটা বেশরম কথা বলে শুনাবি। রেডি ওয়ান, টু, থ্রী… বল!’

ধ্রুব তার গম্ভীর চোখদুটো তুলে তরুর দিকে চেয়ে রইলো।তরু তাড়া দিয়ে বলল,

‘ কী হলো? বল!’

ধ্রুব আগের মতোই নিশ্চুপ চেয়ে রইলো। বলল,

‘ তোর ভাগ্নীকে নিয়ে অশ্লীল কথা আসছে। বলবো?’

তরুর চোখদুটো মার্বেলের মতো গোল গোল হয়ে গেল। ধ্রুবর থেকে এমন উত্তর পেয়ে সে হতভম্ব, হতচকিত, ব্যথিত। চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,

‘ একদম না। তুই মামা হয়ে ভাগ্নীকে নিয়ে অশ্লীল চিন্তা-ভাবনা করতে পারিস তাই তো আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।’

হতভম্ব তরুকে আরও একটু হতভম্ব করে দিয়ে নির্বিকার কন্ঠে উত্তর দিল ধ্রুব,

‘ নিশিতার মতো সুন্দরী রমণীকে কোনো পুরুষই পাতানো ভাগ্নী হিসেবে মেনে নিবে না। তুই বরং তাকে আমার পাতানো প্রেমিকা হিসেবে কনসিডার করতে পারিস। আমি কিছু মনে করব না।’

বর্ষার জলে ভিজে, থানার যাবতীয় কাজ ফেলে যে সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ধ্রুব টাউনহলে ছুটে এসেছিল। তার কিয়দংশ পূরণ হওয়ার ভাগ্যও ধ্রুবর হলো না। নিশিতা ধ্রুবকে তার অজ্ঞাত, অজানা সেই ভয় থেকে পুরোপুরি মুক্তি দিয়ে একটা বারের জন্যও রান্নাঘর থেকে উঁকি দিলো না। খাবার খাওয়ার পুরোটা সময় প্রিয়তা তার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। আতিথেয়তার পুরোটাই নিজ হাতে সমাধা করলো। নিশিতার খাবার টেবিলের ধারেকাছে আসার প্রয়োজনই পড়লো না। খাবার ঘরে নিশিতাকে না দেখে প্রথমটাই খুব স্বস্তি পেলেও ধীরে ধীরে বুকের ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠল ধ্রুবর। থেকে থেকে অদ্ভুত এক অপমানবোধেও থম ধরে উঠল মন। দীর্ঘশ্বাসে দীর্ঘশ্বাসে ছেয়ে যাওয়া মন নিয়ে উপলব্ধি করল, তার আর নিশিতার কঠিন গল্পটার আরও কঠিন হয়ে যাওয়া। নিশিতাকে হারিয়ে ফেলার গল্পটার স্পষ্ট পাখির মতো উড়ে যাওয়া। কিন্তু কী-ই বা করবে এখন ধ্রুব? নিশিতাকে কী করে বুঝাবে তার গল্প; তার কথা? সেই সুযোগটা তো নিশিতা তাকে দিচ্ছে না! এ কেমন নীরব প্রতিশোধ নিচ্ছে নিশিতা? যে প্রতিশোধের আগুনে দাউদাউ করে জ্বলে উঠছে ধ্রুবর অনুশোচনা। জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে ধ্রুবর বুক।

#চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here