প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প,২৯,৩০
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
|২৯|
বৃষ্টির ধার কমে এসেছে। ঝমঝমে বৃষ্টির গায়ে এখন হাঁপিয়ে উঠার ছাপ। হঠাৎ হঠাৎ থেমে গিয়ে জিরিয়ে নিচ্ছে যেন। ধ্রুব এগিয়ে গেল। ঠোঁটের কোণে পরিচিতির স্মিত হাসি ল্যাপ্টে বলল,
‘ আরে! নিশিতা? কেমন আছো?’
ধ্রুবর প্রশ্নটা যতটা স্বাভাবিক? নিশিতা ততটাই অস্বাভাবিক রকম স্বাভাবিক দৃষ্টিতে চাইলো। চোখের কোণে বিস্মিত হওয়ার, অপ্রস্তুত হওয়ার লেশমাত্র নেই। ক্ষণিক আগের আতঙ্কটাও কাটিয়ে উঠেছে চোখের পলকে। বহু বহুদিন পর প্রিয় নারীকে দেখে খুব অন্যরকম মনে হলো ধ্রুবর। অপরিচিত মনে হলো। সেই শীতল, ঠান্ডা দৃষ্টি দেখে বুকের ভেতর জেগে উঠল স্বয়ং জীবনানন্দ। অদ্ভুত, বিষণ্ণ সুরে বেজে উঠল জীবনানন্দের কন্ঠস্বর,
‘চোখে তার-
যেন শত শতাব্দীর অন্ধকার!
স্তন তার-
করুণ শঙ্খের মতো দুধে আদ্র- কবেকার শঙ্খিনীমালার!
এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।’
ধ্রুবর বুক বেয়ে বেরিয়ে এলো চাপা দীর্ঘশ্বাস। চোখে-মুখে অন্যমনস্ক গাম্ভীর্য নিয়ে বলল,
‘ এই রিকশা তো আর যাবে না। তুমি চাইলে আমি তোমাকে পৌঁছে দিতে পারি।’
চির অভিমানিনীর কন্ঠে ধ্রুব উত্তর আশা করেনি। অথচ ধ্রুবকে চমকে দিয়ে অভিমানিনী উত্তর দিলো। ভীষণ স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
‘ সমস্যা নেই। সামান্য পথই বাকি, হেঁটে চলে যাব।’
খুব স্বাভাবিক সময়ে যেমন অস্বাভাবিকতা মেনে নেওয়া যায় না? ঠিক তেমনই খুব অস্বাভাবিক সময়ে স্বাভাবিকতার হাওয়া পেলে চমকে উঠতে হয়। আতঙ্কিত হতে হয়। ধ্রুব চমকে উঠলো। বুকের ভেতর তীব্র এক অস্বস্তি দানা বাঁধছে বুঝতে পেরে ভ্রু জোড়া খানিক কুঁচকে এলো। অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
‘ ক্যাম্পাসের সামনের রাস্তায় জল জমেছে। হেঁটে গেলে অসুবিধায় পড়তে হবে তোমায়।’
নিশিতার চোখে-মুখে স্বাভাবিক উদ্বেগ দেখা গেল। একটু ভেবে রিকশা থেকে নেমে দাঁড়াল। বলল,
‘ তাহলে বরং একটা রিকশার জন্য অপেক্ষা করি। বৃষ্টি দেখতে ভালো লাগছে। আমার কোনো তাড়া নেই।’
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া মোম স্নিগ্ধ মুখের দিকে চেয়ে ধ্রুবর বলতে ইচ্ছে হলো,
‘ সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকলেও আমার ইচ্ছের বাইরে কোনো রিকশা পাবে না নিশিতা। যতক্ষণ আমি না চাইবো ততক্ষণ কেউ তোমার দিকে চোখ তুলেও চাইবে না। অযথা অপেক্ষা করো না।’
কিন্তু মুখে বলল,
‘ তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে নিশিতা। কথাগুলো বলা খুব দরকার।’
নিশিতা চমৎকার হাসলো। সাথে সাথেই ক্লান্তি কাটিয়ে আবারও ঝমঝম করে ঝরতে লাগলো শরতের ঠান্ডা বৃষ্টি। নিশিতার গায়ের গোলাপি জামার অর্ধেকটা ভিজে গেল। ধ্রুব নিশিতার গায়ের দিকে চাইলো না। স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো নিশিতার চোখে। বুকের ভেতর দলা বেঁধে থাকা অপরাধবোধটা নিশিতাকে বলতে না পারলে যে বাঁচা যাচ্ছে না। এই বৃষ্টি, প্রিয় নারীর ভেজা সৌন্দর্য কোনো কিছুই মনে ধরছে না। তার কেবল শান্তি চাই। অনুশোচনা থেকে; মন থেকে লুকিয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়া ক্লান্তি থেকে। নিশিতা কপালের উপর আড়াআড়ি হাত রেখে দৌঁড়ে গেল একটি ছাউনির নিচে। ধ্রুব বুকের ভেতর ঢিপঢিপ এক অস্বস্তি নিয়ে ছাউনির দিকে এগিয়ে গেলো। চোখদুটোতে অন্যমনস্ক বিষণ্ণতা। ধ্রুব পাশে দাঁড়াতেই ওড়নার ভেজা আঁচল দিয়ে মুখ মুছলো নিশিতা। বড়ো শান্ত, স্বাভাবিক তার ব্যবহার। কোথাও কোনো ক্ষোভ নেই, রাগ নেই, অভিযোগ নেই। ধ্রুবর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রমণীকে চির অভিমানিনী, চির চন্দ্রত্রপা বলার উপায় নেই। ভেজা আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে নিজে থেকেই কথা বলল নিশিতা। চমৎকার হেসে বলল,
‘ মানুষ নিয়ে আমার নিজস্ব একটা লজিক আছে। সেই লজিক অনুযায়ী, আমি আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মানুষগুলোকে ভালোবাসার থেকেও শ্রদ্ধা করি বেশি। এই লজিকের দ্বিতীয় ধাপে তারা আছেন, যারা আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ নয় অথচ আমি তাদের মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা করি। আর তৃতীয় ধাপে আছে তারা যাদের আমি কখনো শ্রদ্ধা করতে পারি না। অথবা একসময় শ্রদ্ধাটা এসেছিলো নদীর জোয়ারের মতোন তারপর আচমকা তান্ডবে শুকিয়ে গিয়েছে মধ্য গ্রীষ্মের খরার মতোন। রাগ ভাঙানো যায়, অভিমান ভাঙানো যায় কিন্তু অশ্রদ্ধা ভাঙানো যায় না। তাই বোধহয় তৃতীয় ধাপের মানুষগুলোর সাথে আমার কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। তাদের কথা শুনতে ইচ্ছে হয় না। তাদেরকে দেখতেও ইচ্ছে বোধ করি না। আমি মানুষকে অশ্রদ্ধা করতে খুব অপছন্দ করি। তৃতীয় ধাপের মানুষগুলোর উপর আমার অশ্রদ্ধার ছায়া পড়ুক তা চাই না বলেই তাদেরকে আমি এড়িয়ে চলি। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই তৃতীয় ধাপের মানুষগুলো বোকা হয়। তারা বিষয়টা বুঝতে পারে না। অভিমান বা রাগ ভেবে ভুল করে। বিষয়টা খুবই বিরক্তিকর। মানুষের কী এতোটা বোকা হওয়া উচিত অফিসার?’
ধ্রুব স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। অপ্রত্যাশিত অপমানে থমথমে হয়ে উঠলো মুখ। পরিচিত পৃথিবীটা যেন দোলে উঠে শুধাল, ‘এতো! এতোটাই নিকৃষ্ট সে?’ নিশিতা হাসিমুখে বলল,
‘ আমার লজিকটা কী আপনার পছন্দ হয়েছে অফিসার? লজিকটা বুদ্ধিমানদের জন্য। আপনি যথেষ্ট বুদ্ধিমান। লজিকটা আপনার পছন্দ হওয়ার কথা।’
ধ্রুব কোনো উত্তর দিতে পারলো না। নিস্পন্দ চোখে চেয়ে দেখলো গোলাপি জামা গায়ে একটি মেয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। ঝমঝমে বৃষ্টিতে তার জামা ভিজে যাচ্ছে। মেয়েটা আচমকা থেমে জুতো খুলে ফেললো। কাদামাখা জুতো হাতে নিয়ে মেয়েটি তার মোমের মতো ফরসা পায়ের দিকে চেয়ে চেয়ে হাঁটছে। শরতের বৃষ্টিতে তার মোম রঙা পা’দুটোতে ফোঁটা ফোঁটা বর্ষণ যে পৃথিবীর সবথেকে মধুর দৃশ্য, তা বোধহয় মেয়েটি জানে। মেয়েটি আরও অনেক কিছুই জানে। মেয়েটির সাথে সাথে ধ্রুবও জানে, এই চমৎকার মেয়েটির সাথে আর কক্ষনো দেখা হবে না তার। তার বুকে জমে থাকা অনুশোচনার আগুন কখনো নিভবে না। দলা পাকানো কথাগুলো বুকে বেঁধে রাখতে রাখতে ধ্রুবর বুক ব্যথা হবে। এই তীব্র বুক ব্যথা ধ্রুবকে বয়ে বেড়াতে হবে সারাটা জীবন। ধ্রুব হঠাৎ খেয়াল করলো বৃষ্টির ঠান্ডা জলের সাথে সাথে এক ফোঁটা আগুন গরম জলও ছিটকে পড়লো তার গালের উপর। এই প্রথম ধ্রুবর অভিমান হলো। আবিরের মতো মুখ ভার করতে ইচ্ছে হলো না। খুব লজ্জার ব্যাপার হলো, ভীষণ অভিমানে ধ্রুবর কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে হলো। ধ্রুব হঠাৎ কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। ফাঁকা মস্তিষ্ক নিয়ে রেইনকোটটা খুলে ফেলে খুব ধীর পায়ে এগিয়ে গেল গাড়ির দিকে। শরতের জলে ভিজে গেল ধ্রুবর শ্যামলা সৌম্য দেহ। প্রশস্ত কাঁধ। মাঝারি করে ছাঁটা চুল। বৃষ্টির শীতলতা ধ্রুবর ভেতরটাকে শীতল করতে পারলো না। হাত নেড়ে খুব মৃদু কন্ঠে কনস্টেবলকে বলল,
‘ যেতে দিন ওকে। লেট হিম ফ্রী।’
দৈত্যের মতো বিশাল কনস্টেবল তখন ছোকরা রিকশাচালকের কলার চেপে শাসাচ্ছিল। স্যারের হঠাৎ বোল পরিবর্তনে অবাক হলো। তার থেকেও বেশি চমকালো ধ্রুবর চেহারা দেখে। ওমন সুন্দর চেহারার হঠাৎ এমন বেহাল দশা হলো কী করে? ছোকরাটাকে দুটো দানবীয় ঝাঁকি আর ভয়ানক চোখ রাঙানি দিয়ে ছেড়ে দিয়ে ধ্রুবর দিকে চাইলো কনস্টেবল। কাঁচুমাচু, অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
‘ আপনি ঠিক আছেন স্যার? অসুস্থ দেখাচ্ছে।’
ধ্রুব উত্তর দিলো না। কনস্টেবলের প্রশ্ন সে আদৌ শুনতে পেয়েছে কিনা বুঝা গেল না। অন্যমনস্ক, শান্ত হয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। রেইনকোটটা বেখেয়ালে কোলের উপরই রেখে দিলো। যেন নিশ্চল, সর্বশান্ত এক মানুষ। ক্ষনিক আগেই হারিয়ে ফেলেছে বেঁচে থাকার শেষ সম্বল। কনস্টেবল ড্রাইভিং সীটে বসে অনেকটাক্ষণ স্যারের পরবর্তী আদেশের জন্য অপেক্ষা করলেন। অথচ ধ্রুবর মুখে ‘রা’ নেই। শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে কী এতো ভাবছে কে জানে? অনেকটাক্ষণ অপেক্ষা করে সাহস নিয়ে প্রশ্নটা করেই ফেললেন মধ্যবয়স্ক কনস্টেবল,
‘ কোথায় যাব স্যার?’
দুইবার একই প্রশ্ন করার পর যেন ঘোর কাটলো ধ্রুবর। ক্ষীণ চমকানো চোখে চাইলো। হঠাৎ যেন কিছু বুঝতে পারছে না এমন বিভ্রান্ত তার দৃষ্টি। তারপর মৃদু অথচ জলদগম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ বাসায় চলুন।’
কনস্টেবল কোনোরকম প্রত্যুত্তর না করে গাড়ি ঘুরালো। তাদের চির গম্ভীর স্যারকে এমন এলোমেলো দেখে সে কিছুটা স্তম্ভিত, বিস্মিত।
এমন ভরা সকালে ভাইকে বাড়ি ফিরতে দেখে অবাক হলো আবির। দরজা খুলে দিয়ে সরে দাঁড়াতে পর্যন্ত ভুলে গেলো সে। ভাইয়ের ভেজা ঝপঝপে পোশাক। শুকিয়ে যাওয়া মুখ। শূন্য, অন্যমনস্ক দৃষ্টি দেখে চোখের পলকে আত্মা কেঁপে উঠলো তার। ধ্রুব শান্ত চোখে চেয়ে একটু বিরক্ত কন্ঠে বলল,
‘ কী ব্যাপার? দরজা আগলে দাঁড়িয়ে রইলি কেন? ভেতরে যেতে দে।’
আবির কলের পুতুলের মতো সরে দাঁড়ালো। তার পিঠের উপর চড়ে গলা জড়িয়ে থাকা ছোট্ট প্রাণ কল্পও যেন বুঝে গেল কোথাও একটা গন্ডগোল আছে। বড়ো ভাইয়াকে এই সময়ে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গিয়েছে কখন। ধ্রুব এই প্রথম ভাইদের দিকে নজর দিলো না। গাড়লের মতো হেঁটে গেল নিজের শোবার ঘর পর্যন্ত। ভেজা রেইনকোটটা অন্যমনস্ক মনে বিছানার উপর রাখলো। তারপর নিজেও বসে পড়লো ভেজা কাপড়ে। স্তব্ধ, স্থির মূর্তির মতো বসে থাকা ভাইয়াকে দরজার বাইরে থেকেই লক্ষ্য করতে লাগল দুই ভাই। দু’জনের কারোরই ভেতরে ঢুকার সাহস হচ্ছে না। আবার ভাইকে এভাবে ছেড়ে যেতেও মন মানছে না। আবিরের একবার বলতে ইচ্ছে হলো,
‘ ভাইয়া পোশাকটা পাল্টে নাও। এই সময়ে জ্বরে পড়লে ভুগতে হবে খুব।’
কিন্তু বলে উঠতে পারলো না। মনের কোথাও একটা খুব করে বুঝতে পারলো, ভাইয়ার বুক ভরা মনের জ্বর। এই মারাত্মক জ্বরকে পৃথিবীর কোনো বৃষ্টির পানিই অতিক্রম করতে পারবে না। আবিরের বুকটা জ্বলে উঠল অসহ্য যন্ত্রণায়। তার ভাইয়া! তার ভাইয়ার এতো কষ্ট কেনো? কী হয়েছে তার সাথে? কে দিলো তাকে এতো কষ্ট? সেই মানুষটার প্রতি ঘৃণায় বুক ভরে উঠলো আবিরের। থম ধরা মন নিয়ে পা ছড়িয়ে বসে পড়লো দরজার কাছের মেঝেতে। তাকে দেখে দেখে কল্পও বসে পড়লো লক্ষ্মী ছেলে হয়ে। তার আজ দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। বড়ো ভাইয়ার কাছে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে শুধু। বড়ো ভাইয়া যে তার দিকে একবার তাকালোও না? কল্প বড়ো ভাইয়ার মতোই গম্ভীর হয়ে বসে রইলো। অনেক অনেকটাক্ষণ হাঁটুতে কনুই ঠেকিয়ে থম ধরে বসে থেকে কী মনে করে মাথা তুলে দরজার দিকে চাইলো ধ্রুব। ততক্ষণে গায়ের তাপে শুকিয়ে গিয়েছে পোশাক। ধ্রুব দুই ভাইকে দরজার পাশে পা ছড়িয়ে বসে থাকতে দেখে আশ্চর্য হয়ে বলল,
‘ কী ব্যাপার?’
কেউ কোনো উত্তর দিলো না। কারো থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে শক্ত কন্ঠে ধমক দিয়ে উঠল ধ্রুব,
‘ এখানে বসে আছিস কেন? আশ্চর্য! ঘরে যা।’
এবারও কারো মাঝে কোনো হেলদোল দেখা গেলো না। কল্প একবার আবিরের মুখের দিকে চেয়ে ধ্রুবর দিকে চাইলো। নিজের ছোট মনের বিশাল ইচ্ছেকে সে খুব গুরুত্বের সাথে গুরুত্ব দিলো। ছোট ছোট পায়ে ধ্রুবর দিকে এগিয়ে গিয়ে বড়ো বড়ো চোখ মেলে চাইলো। দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে খুব গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ কোয়ে।’
ধ্রুব চোখ তুলে কল্পর মুখের দিকে চাইলো। তাদের তিন ভাইয়ের চেহারাই মায়ের মতো হয়েছে। গায়ের রঙও অনেকটা সেরকমই। কিন্তু কল্পর গায়ের রঙ হয়েছে বাবার মতো। টকটকে হলুদ ফরসা। চোখদুটোতে টলমলে আস্ত দুটো বিল। বড়ো ভাইয়া তাকে কোলে নিতে অসম্মতি জানাতে পারে বা এমন কিছু হতে পারে তা সে কখনো বিশ্বাস করতে শেখেনি। ধ্রুবর মনটা আষাঢ়ের কালো মেঘের মতো থম ধরে থাকলেও কল্পর এই সরল বিশ্বাসটা ভাঙতে ইচ্ছে হলো না। হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিলো তাকে। কল্প বরাবরের মতোই দুইহাতে গলা জড়িয়ে কাঁধে মুখ গুজল। ধ্রুবর জড়িয়ে ধরা হাতদুটো ক্রমশই শক্ত হতে লাগল। এই ছোট্ট দেহটাতেই যেন ভরসা খুঁজছে একবিন্দু। কল্প কী বুঝলো বুঝা গেল না। ভাইয়ের হাতের জোরে সে কোনো আপত্তি করলো না। বরং আরও শক্ত করে গলা জড়িয়ে মুখ গুজল ঘাড়ে৷ ততক্ষণে আবিরও এসে বসেছে ধ্রুবর পায়ের কাছে। ধ্রুবর কোলের উপর মাথা রেখে দুই হাতে কোমর পেঁচিয়ে ধরে বলল,
‘ ভাইয়া তুমি কেমন আছো?’
ধ্রুবর চোখদুটো লাল হয়ে উঠল এবার। জবাব না দিয়ে অন্যমনস্ক স্বরে শুধাল,
‘ আমায় ভালোবাসিস আবির?’
‘ বাসি।’
‘ শ্রদ্ধা করিস?’
‘ ভালোবাসার থেকেও বেশি।’
ধ্রুবর লাল চোখদুটো টলমল করে উঠলো,
‘ আমি কী খুব খারাপ মানুষ আবির?’
আবির এইবার মুখ তুলে চাইল। ভাইয়ের হেরে যাওয়া মুখটির দিকে চেয়ে গোটা পৃথিবীর প্রতিই রাগে জ্বলে উঠলো বুক। কোনো বাচ্চামো নয়। একেবারে নিরেট পুরুষ মানুষের গলায় খুব শান্ত কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ যে এই কথা বলার সাহস রাখে তাকে আমি ঠান্ডা মাথায় খুন করবো ভাইয়া।’
ধ্রুব প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। কিন্তু বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। আজ বোধহয় বৃষ্টি নামার দিন। সেই বৃষ্টির সাথে সাথেই ধ্রুব জীবনে এই প্রথমবারের মতো নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারলো না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল কল্পর ছোট্ট শরীরকে আঁকড়ে ধরে। তার যে বুকে ব্যথা। এই বুক ব্যথা তাকে বয়ে বেড়াতে হবে সারাজীবন। এই গল্প কেউ জানবে না। ধ্রুব নিজের বিবেকের কাছে অস্বচ্ছ থেকে যাবে সারাজীবন। একটা অপ্রকাশিত গল্প বেঁধে রাখতে হবে মেরুদণ্ড বরাবর। এই গল্প ভরা অশ্রদ্ধার মোড়ক। এই মোড়কে বড়ো জ্বালা। নিশিতা তাকে আমৃত্যু এই জ্বালা বওয়ার দায়িত্ব দিয়ে গেলো। এই দায়িত্ব যে কতো ভারী নিশিতা কী জানে না? বড়ো ভাইয়ার আচমকা বাঁধ ভাঙা কান্নায় কল্প আতঙ্কে আরও শক্ত করে চেপে ধরলো তার গলা। অবিচ্ছেদ্য অঙ্গের মতো ল্যাপ্টে রইলো তার গায়ে। যেন ভাইকে বুঝাচ্ছে, ‘এইতো কল্প আছি। ভয় কী?’ আবির ভেতরে ঢোকার সময় দরজায় ছিটকানি তুলে দিয়েছিলো। ভাইয়ের কান্নায় সে মাথা তুলে তাকাল না। ভাইয়ের কোলে মুখ চেপে চুপচাপ বসে রইলো। মনে মনে বুঝলো, এই ভাইয়ার শেষ কান্না। এরপর এই মানুষটাকে কেউ কখনো কাঁদাতে পারবে না। এই বন্ধ ঘরের অপ্রকাশিত গল্পটা আর কেউ জানবে না। কোনোদিনও না।
# চলবে….
প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
(তৃতীয় অধ্যায়)
|৩০|
গরম চায়ের কাপে বাষ্প উড়ছে। ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ আর দুধ চায়ের মিষ্টি সুবাসে ম ম করছে অফিস ঘর। ধ্রুব হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা টেনে নিতেই প্রচন্ড শব্দ তুলে বিভীষকাময় অন্ধকারে তলিয়ে গেল গোটা কোতোয়ালি থানা। ধ্রুবর কপাল কুঁচকে গেল। সামনের চেয়ারে বসে থাকা ডিউটি অফিসার ভরাট পুরুষালি হাঁক ছাড়তেই ছুটে এলো এক কনস্টেবল। অফিস ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সেলাম ঠুকলো। একহাতে মোমবাতি ধরে রেখে অপরাধী কন্ঠে বলল,
‘ ঝড়বৃষ্টির তান্ডবে এলাকার ট্রান্সমিটারটা অকেজো হয়ে গেছে স্যার। থানার জেনারেটরটাও কাজ করছে না।’
মোমবাতির হালকা বাদামি আলোয় চায়ের কাপে চুমুক দিলো ধ্রুব। ডিউটি অফিসার ধমকে উঠে বলল,
‘ কাজ করছে না মানে কী?জেনারেটর কাজ করছে না সেটা তোমরা এখন দেখছো? জেনারেটর ঠিক করার ব্যবস্থা করো, দ্রুত।’
কনস্টেবল মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যরাতে জেনারেটর ঠিক করার মিস্ত্রি কোথায় পাওয়া যাবে, জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না। ধ্রুবর টেবিলের উপর দুটো মোমবাতি রেখে ম্লান কন্ঠে বলল,
‘ ইয়েস, স্যার।’
কনস্টেবল সেলাম ঠুকে বেরিয়ে যেতেই চোখ ফিরিয়ে ধ্রুবর দিকে চাইলেন অফিসার। মোমের কমলা আলোয় ধ্রুবর শক্ত বাদামি চিবুক, গভীর চোখ, সুস্বাস্থ্য যেন ঈর্ষা জাগালো বুকে। ধ্রুব চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে হাত বাড়িয়ে সিগারেট ধরালো। সিগারেট পোড়া পাতলা ঠোঁটের মাঝে সিগারেটটা চেপে ধরে দেশলাই জ্বালালো। দেশলাইয়ের আচমকা আগুনে পেটানো মূর্তির মতো দেখালো ধ্রুবর মুখ। কুঁচকে থাকা সুচালো ভ্রু জোড়ার নিচে গভীর চোখদুটো কি ধূর্ত! সেই সাথে মিশে আছে অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা। ধ্রুব সিগারেট ধরিয়ে অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে সিগারেটের প্যাকেটটা এগিয়ে দিলো ডিউটি অফিসারের দিকে। ডিউটি অফিসার হাত বাড়িয়ে নিলো ঠিক কিন্তু স্যারের সামনে অভদ্রতা হয়ে যাওয়ার ভয়ে জ্বালানোর সাহস করে উঠতে পারলো না। ধ্রুব দুই ঠোঁটের মাঝে সিগারেটটা চেপে রেখে ফাইলে চোখ নিবন্ধ করলো। কুঁচকানো কপাল নিয়ে বার দুয়েক ঘড়ি দেখলো। কখন বৃষ্টি থামবে কে জানে? ডিউটি অফিসার কিছুক্ষণ কাঁচুমাঁচু করে আগের কথার খেঁই ধরলো,
‘ আপনার ভাই তো ডাক্তার স্যার?’
ধ্রুব চোখ তুলে পূর্ণদৃষ্টিতে চাইলো। যার অর্থ, ‘তো?’ ডিউটি অফিসার বিব্রত হাসলো,
‘ আসলে স্যার, আমার মেয়েটাকে ডাক্তার দেখাবো ভাবছিলাম। এই শহরে নতুন এসেছি তো, কোন ডাক্তার দেখাবো বুঝে উঠতে পারছি না। পরিচিত ডাক্তার হলে ভরসা করা যেতো। উনি কী মেডিসিন ডাক্তার?
ধ্রুব মাথাটা আলতো হেলিয়ে ধোঁয়া ছাড়লো। শীতল কন্ঠে বলল,
‘ ঠিক তা নয়। আবির অর্থোপেডিক ডাক্তার। আপনার মেয়ের জন্য মেডিসিন ডাক্তার প্রয়োজন?’
‘ বুঝতে পারছি না স্যার। মেয়েটা ছোটবেলা খেলতে গিয়ে পা ভেঙে ফেলেছিলো। পা ঠিক হয়ে গিয়েছে অনেক বছর হলো। কিন্তু কিছুদিন যাবৎ সেই পায়ের জয়েন্টে নাকি ব্যথা করে। ব্যথার কারনে রাতে ঘুমুতে পারে না।’
ধ্রুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ তাহলে দেখাতে পারেন। আবির ভালো এডভাইস দিতে পারবে এই ব্যাপারে।’
‘ উনি কোথায় বসেন? ময়মনসিংহ মেডিকেলে? নাকি নিজস্ব চেম্বারে? ঠিকানাটা যদি….’
‘ হ্যাঁ, মেডিকেলে বসে। একটা প্রাইভেট হসপিটালেও বসে। চেম্বারও আছে। আমি ওকে বলে রাখবো। আপনি যেকোনো জায়গায় দেখাতে পারেন। সমস্যা নেই।’
ডিউটি অফিসার আপ্লুত চোখে চাইলো। এই স্যারকে বিনা কারণেই ভীষণ শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে করে তার। চাল-চলনে গাম্ভীর্যের সাথে সাথে কেমন স্পষ্ট বিনয়। চোখের দৃষ্টিতেই মোহাচ্ছন্ন ব্যক্তিত্ব। ডিউটি অফিসার আর ধ্রুবর আলাপের মাঝেই দরজায় এসে দাঁড়াল সেই পুরনো কনস্টেবল। ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে বলল,
‘ একটা ঝামেলা হয়ে গিয়েছে স্যার।’
ডিউটি অফিসার বিরক্ত চোখে চাইলো। তীক্ষ্ণ কন্ঠে শুধাল,
‘ কী ঝামেলা?’
কনস্টেবল মুখ কাঁচুমাচু করে বলল,
‘ একটা মহিলা এসেছেন জিডি করতে। ছিনতাই কেস।’
অফিসারের ভ্রু কুঁচকে এলো। চিন্তিতমুখে একবার ঘড়ির দিকে চাইলেন, বারোটা বিশ। বিস্মিত কন্ঠে বললেন,
‘ এতোরাতে মহিলা? এই ঝড়বৃষ্টিতে?’
‘ জি, স্যার।’
অফিসার উঠে দাঁড়ালেন। চিন্তিত কন্ঠে বললেন,
‘ চলো তো দেখি।’
অফিসার বেরিয়ে যেতেই আরেকটা সিগারেট ধরালো ধ্রুব। রিভলভিং চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করতেই মাথায় খেলে গেল একটাই চিন্তা, দেরী হয়ে যাচ্ছে! মিনিট দশকের মাঝেই ফিরে এলো অফিসার। ধ্রুবর অনুমতি নিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ধ্রুব টোকা দিয়ে সিগারেটের ছাই ঝাড়ল,
‘ কী ব্যাপার?’
অফিসার বেকায়দায় পড়া কন্ঠে বলল,
‘ আচ্ছা একটা বিপদে পড়ে গেলাম স্যার! এক ভদ্রমহিলা এসেছেন কমপ্লেইন নিয়ে অথচ জিডি করতে রাজি নন। তিনি কোনো কথায় শুনছেন না। ডিরেক্ট এ্যাকশন চাইছেন। একে তো মহিলা মানুষ তারওপর এতোরাত, ধমক-টমক যে দেব সেই উপায়ও নেই। কী করব স্যার?’
ধ্রুব কৌতূহলী চোখে চাইল। সেকেন্ড কয়েক চুপ থেকে বলল,
‘ এখানে আসতে বলুন। আপনিও বসুন। শুনি কী ব্যাপার।’
অফিসার মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কনস্টেবলকে ডেকে ভদ্রমহিলাকে খবর পাঠাল। মিনিট দশেক বাদে শাড়ি পরিহিত চমৎকার দেখতে এক ভদ্রমহিলা ভেতরে প্রবেশ করলেন। ধ্রুব সিগারেট নিভিয়ে আঁশ ট্রে তে ফেলে সোজা হয়ে বসলো। বুদ্ধিদীপ্ত চোখে ভদ্রমহিলার আগাগোড়া নিরক্ষণ করলো। সেকেন্ডের ব্যবধানে চোখে চোখে নোট করে ফেলল ভদ্রমহিলার ভাবগতি। শাড়ির আঁচলে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। দৃষ্টি অস্থির। পিঠ বেয়ে নেমে গেছে লম্বা এক বিনুনি। মোমের বাদামি আলোয় ক্লান্ত, মোলায়েম দেখাচ্ছে মুখ। ধ্রুব গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ বসুন।’
ভদ্রমহিলা চেয়ার টেনে বসেই চমকে উঠলেন। ধ্রুব! মোমের আলোতে ধ্রুব তীক্ষ্ম চোখে চেয়ে আছে তার দিকে। কোথাও কোনো আবেগ নেই। পরিচিতের ছাপ নেই। কী আত্মবিশ্বাসী দৃষ্টি! নিশিতা ভেতর ভেতর থমকে গেলেও বাইরে প্রকাশ করলো না। ধ্রুব যদি তাকে না চিনে থাকে তবে নিশিতার আগ বাড়িয়ে চিনতে পারার প্রশ্নই উঠে না। ধ্রুব প্রশ্ন করলো,
‘ আপনার নাম?’
নিশিতা চোখ তুলে চাইলো। ভেতর ভেতর নড়বড়ে ঠেকলেও সমান প্রতাপে ধ্রুবর অন্তর্ভেদী চোখে চোখ রাখলো। নম্র কন্ঠে বলল,
‘ নিশিতা হক।’
‘ একা এসেছেন?’
‘ জি।’
‘ আপনার ঠিকানা? ময়মনসিংহের স্থায়ী বাসিন্দা?’
‘ আমি ঢাকায় থাকি।’
মৃদু মাথা ঝাঁকাল ধ্রুব,
‘ ময়মনসিংহে আসার কারণ?’
‘ এখানে একটা সেমিনার এটেন্ট করতে এসেছিলাম। জয়নুল আবেদীনে নবীন-প্রবীণ লেখকদের নিয়ে একটা সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল। আমি লেখালেখি করি। আই হ্যাড টু এটেন্ট দ্যাট সেমিনার। তাছাড়া, ব্যক্তিগত কিছু কাজ ছিলো।’
ডিউটি অফিসার খাতা, কলম হাতে লিখছিলেন। এবার চোখ তুলে শুধালেন,
‘ এতোরাতে ফিরছিলেন কেন?’
নিশিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল,
‘ ঢাকায় কিছু দরকার ছিলো। তাছাড়া এখানে থাকার মতো তেমন কোনো জায়গা নেই। একা একা হোটেলে থাকা সেইফ মনে হয়নি।’
ধ্রুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো। বরাবরের মতোই ভ্রু’জোড়া কুঁচকে রইলো তার। শুধাল,
‘ ঘটনাটা বলুন। কী ঘটেছে আপনার সাথে?’
কিয়ৎক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর ঘটনাটা মনে পড়তেই শিউরে উঠলো নিশিতা। বুকের শক্ত বেড়িটা আগলা হয়ে যেতে লাগল ধীরে ধীরে। ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখ নিয়ে বলল,
‘ আমি ঢাকা ফিরছিলাম।’
‘ বাসে করে?’
নিশিতা মাথা নাড়লো,
‘ না। ভাড়া গাড়ি করে। শম্ভুগঞ্জ ব্রিজ থেকে ড্রাইভারের ত্রিশাল রোড ধরার কথা ছিলো। কিন্তু ব্রিজেই হঠাৎ কোথা থেকে কয়েকটা ছেলে এসে গাড়ি থামাতে বললো। ড্রাইভার গাড়ি থামাতেই ওরা খুব উগ্র আচরণ করতে লাগল। ড্রাইভারকে মারধোর করে আমাদের সকল জিনিসপত্র নিয়ে নিলো।’
‘ গাড়িতে শুধু ড্রাইভার আর আপনিই ছিলেন?’
নিশিতা মাথা দোলালো। ডিউটি অফিসার বিস্মিত চোখে চাইলেন। অতঃপর কটাক্ষ করে বললেন,
‘ মহিলা মানুষ ইজ মহিলা মানুষ স্যার। এই মাঝরাতে ভাড়া গাড়ির অপরিচিত ড্রাইভারের সাথে কেউ এতোদূরের পথ পাড়ি দেয়? তারওপর ঝড় বৃষ্টির রাত। ড্রাইভারই যদি উলটাপালটা কিছু করে রাস্তায় ফেলে যেতো তাও তো কারো কিছু করার ছিলো না। এমন বোকামো কাজ এনারা করবে আর নিউজে ছাপবে আমাদের দুর্নাম। যত্তসব।’
অফিসারের মন্তব্যে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো নিশিতার। ধ্রুব কোনো মন্তব্য করলো না। সাবলীল কন্ঠে শুধাল,
‘ ড্রাইভারকে মারধোর করলো, আপনাকে কিছু করেনি? কোনো রকম শারিরীক ক্ষয়ক্ষতি?’
নিশিতার মনের আগল ভেঙে যাচ্ছে। জীবনের প্রথম সে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়েছে। তার সাথে এমন কিছু ঘটে যেতে পারে তা যেন তার নিজেরও বিশ্বাস হচ্ছে না। হাত-পায়ের কাঁপনটা বেড়ে যাচ্ছে। ধ্রুব কী তাকে সত্যিই চিনতে পারছে না? প্রায় পাঁচ বছর হতে চললো। দু’জনই আলাদা দুটো পৃথিবীর মানুষ এখন। ভুলে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। তবু, এভাবেও ভুলে যাওয়া যায়? কই, নিশিতা তো ভুলে যায়নি? হঠাৎ করেই যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল নিশিতা। চিন্তিত মুখে মাথা নাড়ল। অন্যমনস্ক কন্ঠে বলল,
‘ না।’
‘ আপনার আঁচলে রক্তের দাগ। এই রক্ত কার?’
এমন এক পরিস্থিতির পর এতো এতো জেরায় বিরক্ত হয়ে উঠল নিশিতা। রূঢ় কন্ঠে বলল,
‘ সেটা আপনাদের দেখার বিষয় নয়। গাড়িতে আমার ব্যাগ ছিলো। ব্যাগে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজ ছিলো। আমার ওগুলো চাই। ওগুলো ফিরিয়ে আনার একটা ব্যবস্থা করে দিন প্লিজ!’
ধ্রুব স্থির চোখে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল। টেবিলের উপর খোলা ফাইলটা বন্ধ করে পাশে রাখতে রাখতে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। শীতল কন্ঠে বলল,
‘ আচ্ছা, বেশ! আপনি অফিসারের কাছে একটা জিডি করে রেখে যান। উই উইল টেক কেয়ার অফ ইট। আপনি এখন আসতে পারেন।’
নিশিতা অধৈর্য হয়ে বলল,
‘ আপনি এভাবে দায়সারা উত্তর দিতে পারেন না। আমার ব্যাগে আমার সকল প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট ছিলো। পরশু আমার বিসিএসের ভাইভা। কাগজগুলো না পেলে কত বড়ো ক্ষতি হয়ে যাবে আপনি বুঝতেই পারছেন না!’
ধ্রুবর মাঝে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। সে আগের মতোই শীতল কন্ঠে বললো,
‘ আমাদের কাজ করার নিজস্ব একটা নিয়ম আছে ম্যাডাম। সেই সকল প্রসিডিওর মেইনটেইন করেই কাজটা করতে হবে আমাদের। আপনি জিডি করুন। আপনার লিখিত অভিযোগ মোতাবেক আমরা ব্যবস্থা নিব। জিডি ছাড়া আমরা কোনো এ্যাকশন নিতে পারব না।’
নিশিতার বুকের ভেতর হুহু করে উঠল। আতঙ্কে তার মাথা কাজ করছে না। এতোক্ষণ একটা ঘোরের মাঝে থাকলেও সময়ের সাথে সাথে দুর্বল লাগছে শরীর। চোরা বালির মতো ঝুরঝুর করে ঝড়ে পড়তে চাইছে দেহ। নিচের ঠোঁটটা দাঁতের সাথে চেপে ধরে ভেতরের অস্থিরতা কমানোর চেষ্টা করলো নিশিতা। চেয়ারের হাতলে কনুই ঠেকিয়ে ডান হাতের তালুতে কপাল চেপে ধরলো। উত্তেজনায় হাত-পা কাঁপছে। যদি কাগজগুলো না পাওয়া যায় তবে কী হবে? নিশিতার এতোদিনের পরিশ্রম চোখের পলকে শেষ হয়ে যাবে। মুখ উঠিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
‘ জিডি করলেই যে আপনারা ব্যাপারটা সিরিয়ালি নিবেন তার কী নিশ্চয়তা আছে? প্রতিদিন অসংখ্য জিডি করা হয় থানায়। আপনারা…’
ধ্রুব ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
‘ আপনি জিডি না করে বসে থাকলে যে আমরা ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিব তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই ম্যাডাম। পুলিশের সাহায্য চাইলে পুলিশের প্রতি বিশ্বাস রাখতে শিখুন। পুলিশ আপনাকে গ্যারেন্টি কার্ড দেবে না।’
ঠান্ডা গলায় শীতল অপমানের পর আর কোনো প্রত্যুত্তর করা চলে না। নিশিতা আর কথা বাড়ালো না। টেনশনে তার পৃথিবী ঘুরছে। এই মাঝরাতে একা একা কী করবে মাথায় আসছে না। কিছু উপরি টাকা পয়সা দিলে বোধহয় কাজটা এগুতো। কিন্তু নিশিতার কাছে এই মুহূর্তে টাকা তো দূর মুঠোফোনটা পর্যন্ত নেই। এমন বিপদে সে জীবনে পড়েনি। এই পঁচিশ বছরের জীবনে এই প্রথম তার থানায় আসা। কারো সাথে কথা বলতে পারলে ভালো হতো। থানা সম্পর্কে ভালো ধারণা আছে এমন পরিচিত কেউ কী তার আছে? নিশিতার মনে পড়ছে না। নিশিতার ভাবনার মাঝেই উঠে দাঁড়ালেন ডিউটি অফিসার,
‘ আসুন, ম্যাডাম।’
নিশিতা চিন্তিত মুখেই উঠে গেল। জিডির কাজ শেষ হতেই মুখ তুলে চাইলো অফিসার। সাধারণ কন্ঠে বলল,
‘ আপাতত আপনার কোনো কাজ নেই ম্যাডাম। আপনি এখন আসতে পারেন। কোনো খোঁজ পেলে আমরা আপনাকে জানাবো।’
অফিসারের মুখে বাড়ি ফেরার কথা শুনে অস্থিরতার সাথে সাথে নতুন চিন্তা যুক্ত হলো। এই ঝড়-বৃষ্টির রাতে কোথায় যাবে নিশিতা? ময়মনসিংহে রাত কাটাবার মতো নির্ভরশীল জায়গা তার নেই। গ্রাজুয়েশন চলাকালীনই ঢাকা শিফট হয়ে গিয়েছে সে। পরীক্ষা ব্যতিরেকে ক্যাম্পাসে খুব একটা আসা হয়নি। দুই একটা বন্ধু তবু পাওয়া যেতে পারে কিন্তু তাদের নাম্বার মুখস্থ নেই। চিন্তায় চিন্তায় গলা শুকিয়ে গেল নিশিতার। সে উঠে গিয়ে বারান্দায় রাখা একটা বেঞ্চিতে বসলো। বৃষ্টির দাপটটা এখন একটু কমে এসেছে। থেকে থেকে প্রচন্ড শব্দে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। গাছের মাথায় পাগলা হাওয়ার নৃত্য হচ্ছে। নিশিতা অন্যমনস্ক হয়ে অন্ধকারে ডুবে থাকা রাস্তার দিকে চেয়ে রইলো। বেশ কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে উঠে গিয়ে ডিউটি অফিসারকে শুধাল,
‘ একটা ফোন করা যাবে অফিসার?’
অফিসার মোমের আলোয় পুরাতন এক ফাইল ঘাঁটছিল।মুখ তুলে অবাক হয়ে বলল,
‘ আপনি এখনও যাননি?’
এতোরাতে পুলিশ স্টেশনে সে কতটা সুরক্ষিত তাই নিয়েও সন্দেহ জাগলো নিশিতার। সেকেন্ডের মাঝে অসংখ্য চিন্তা খেলে গেল মাথায়। বলল,
‘ একটা ফোন করা যাবে?’
অফিসার কিয়ৎক্ষণ ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থেকে নিঃশব্দে টেলিফোন সেট এগিয়ে দিলো। নিশিতা টেলিফোনের রিসিভারটা হাতে নিয়েই উপলব্ধি করলো উত্তেজনা আর অস্থিরতায় কারো নাম্বারই মাথায় আসছে না তার। নিশিতা চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস নিলো। নিজেকে শান্ত করে মস্তিষ্কে জোর দিলো। কাকে ফোন দিবে সে এতোরাতে? তূর্য? নাকি বড়ো ভাইয়া? তূর্য বড়ো অস্থির মানব। নিশিতা বড়ো ভাইয়াকে ফোন করার সিদ্ধান্ত নিলো। ভাইয়া ঠান্ডা মাথার মানুষ। কিছু একটা সমাধান দিতে পারবেন। কয়েক বারের চেষ্টায় বড়ো ভাইয়ের নাম্বার মনে করলো নিশিতা। দুই বারের মাথায় ফোন রিসিভ হলো। ভাইকে শান্ত গলায় পরিস্থিতি জানাতেই ডিউটি অফিসারের সাথে কথা বলতে চাইলো তিশান। নিশিতা ফোনটা অফিসারের দিকে বাড়িয়ে দিতেই বিনাবাক্যে রিসিভার উঠাল অফিসার। যেন এমন একটা সিচুয়েশন আসবে সে ব্যাপারে তিনি অবগত। অফিসার রিসিভার উঠাতেই ওপাশ থেকে বলল,
‘ হ্যালো অফিসার। আমি নিশিতা হকের বড়ো ভাই বলছিলাম।’
‘ জি, বলুন।’
‘ আপনাদের থানায় এএসপি ধ্রুব নামে একজন কর্মরত ছিলেন। উনি কী ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছেন?’
অফিসার খানিক অবাক হলো। ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ না। উনি এখনও এখানেই কর্মরত আছেন।’
ওপাশ থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। ব্যস্ত হয়ে বলল,
‘ উনি আমার মামার বন্ধু। আমার পরিচিত। উনি কী থানায় আছেন? থেকে থাকলে উনাকে একটু লাইনটা দিবেন? আপনি তার আগে যাচাই করে নিতে পারেন। উনাকে বললে, উনি আমাকে চিনবেন।’
জনৈক যুবকের কথা খুব একটা বিশ্বাস হলো না অফিসারের। ধ্রুবর মতো সৌম্যকান্ত যুবক এতো বড়ো পুরুষের মামার বন্ধু হয় কী করে? বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দো-চলা নিয়েও উঠে দাঁড়াল অফিসার। বিরস কন্ঠে বলল,
‘ আপনার ভাগ্য ভালো স্যার আজ থানাতেই আছেন। অপেক্ষা করুন। আমি জিজ্ঞেস করছি।’
ধ্রুব তখন বেরিয়ে যাওয়ার উদযোগ করছিলো। এহেন সময়ে ডিউটি অফিসারের আগমনে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো। ডিউটি অফিসার মুখ কাঁচুমাচু করে বলল,
‘ স্যার, একটা সমস্যা।’
ধ্রুব জবাব না দিয়ে ভ্রু কুঁচকে নিশ্চুপ চেয়ে রইলো। যার অর্থ, বাকিটা বলুন। অফিসার তার দৃষ্টি বুঝতে পেরেই কথা এগুলো,
‘ নিশিতা হক মানে সেই ভদ্রমহিলার ভাই লাইনে আছেন। তিনি বলছেন, সে নাকি আপনার পরিচিত। আপনার বন্ধুর ভাগ্নে। আপনার সাথে কথা বলতে চায়। লাইন কী দেব স্যার?’
ধ্রুব কয়েক সেকেন্ড ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বলল,
‘ দিন।’
লাইন দেওয়া হলো। ধ্রুব রিসিভার তুলে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে শান্ত কন্ঠ ভেসে এলো। খানিক অস্বস্তি নিয়ে বলল,
‘ মামা আমি তিশান বলছিলাম। একবার আপনার সাথে দেখা হয়েছিলো ময়মনসিংহে। তরু মামার সাথে গিয়েছিলাম। চিনতে পারছেন কিনা…’
ধ্রুব আন্তরিক কন্ঠে বলল,
‘ আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি তিশান। পরিচয় দিতে হবে না।’
ধ্রুবর আন্তরিক কন্ঠে ভারমুক্ত হলে তিশান। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ মামা আসলে একটু বিপদে পড়েই মনে করেছি। আমার ছোটবোন নিশিতা ময়মনসিংহে গিয়ে একটু বিপদে পড়ে গিয়েছে। আপনাদের থানাতেই জিডি করেছে ঘন্টাখানেক আগে। মাঝরাতে এমন একটা দুর্ঘটনায় কী করবো বুঝতে পারছি না। ময়মনসিংহে আমাদের তেমন কোনো আত্মীয়ও নেই। আপনি যদি ডাকবাংলোতে আজকের রাতটা থাকার ব্যবস্থা করে দিতেন। তাহলে খুব উপকার হতো। মেয়েটার হাতে আপাতত টাকাপয়সা, মোবাইল কিছুই নেই।’
ধ্রুব বলল,
‘ আচ্ছা, আমি দেখছি।’
রিসিভার নামিয়ে রেখে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো ধ্রুব। অতঃপর ডিউটি অফিসারকে ডেকে বলল,
‘ ডাকবাংলোতে খবর নিয়ে দেখুন তো কোনো ঘর ফাঁকা আছে কিনা। আর সেই ভদ্রমহিলাকে আমার ঘরে এসে বসতে বলুন। কাউকে বলে উনাকে চা দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। তার আগে একজন মহিলা কনস্টেবলকে পাঠান উনার কাছে। উনার বোধহয় ফার্স্ট এইড এর প্রয়োজন হবে। শী ইজ ইঞ্জুরড্।’
ডিউটি অফিসার সম্মত হয়ে বেরিয়ে যেতে নিতেই পিছু ডাকলো ধ্রুব। একটু চুপ থেকে বলল,
‘ ভদ্রমহিলার কেসটা একটু সিরিয়াসলি হ্যান্ডেল করবেন। ব্রীজের কাছে যারা রেগুলার এসব কান্ড ঘটায় তাদের পাঁকড়াও করে খোঁজ নিন। কাল সকালের মাঝে ম্যাডামের কাগজপত্র, ব্যাগ উদ্ধার হওয়া চাই।’
অফিসার ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে গেল। ধ্রুবর ঘরে তখন পুরাতন মোম পাল্টে নতুন মোম দেওয়া হয়েছে। পুরো ঘর জুড়ে ঠান্ডা নরম আলো ছড়াচ্ছে। নিশিতাকে ভেতরে আসতে দেখে চোখ তুলে চাইলো ধ্রুব। স্বাভাবিক ভদ্রতা নিয়ে বলল,
‘ বসুন।’
নিশিতা একটা চেয়ার টেনে বসলো। চেয়ারে বসা মাত্রই চোখ গেলো টেবিলের মাঝ বরাবর রাখা একটি ফটো ফ্রেমে। মোমের মৃদু হলদে আলোয় দেখতে পেলো উচ্ছল এক যুবতীর মুখ। মেয়েটি একটি শিশু কোলে হাসছে। শিশুটিও দন্তহীন হাসি নিয়ে চেয়ে আছে মায়ের মুখে। এক ঝলক মাত্র! তার পরপরই ফটোফ্রেমটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে ঠিক করে রাখলো ধ্রুব। গম্ভীর, শান্ত মুখে ব্যস্ত হয়ে রইলো কোনো এক ফাইলে। নিশিতার মনে মিলি সেকেন্ডে খেলে গেল প্রাসঙ্গিক এক প্রশ্ন, ‘ধ্রুব তবে ছেলের বাবা হয়েছে?’ যদিও মামার কাছে ধ্রুবর বিয়ে নিয়ে হালকা পাতলা কিছু শুনেছিল একসময়। তখন ততটা গা করেনি নিশিতা। কিন্তু আজ, এতোদিন পর, সেই বাস্তবটা চোখের সামনে দেখে বুকের ভেতরটা অযথা চিনচিন করে উঠল। অথচ সেও এখন আলাদা পৃথিবীর বাসিন্দা। এই এতোগুলো বছরে ভুল করেও সে ধ্রুবর পৃথিবীতে পা মাড়াতে চায়নি। ধ্রুবকে পেতে ইচ্ছে হয়নি। অথচ আজ মনে হচ্ছে, কোথাও একটা গভীর ক্ষত। সেই ক্ষত ধীরে ধীরে আরও নতুন হচ্ছে। বিশ্রী হচ্ছে। মনটা থেকে থেকেই বিষণ্ণ হয়ে যাচ্ছে। তীব্র অভিমান হচ্ছে। নিশিতা ভেবে পায় না, নারী মন এতো আশ্চর্য কেন? তারা ভালোবাসুক বা না বাসুক প্রতিপক্ষের চোখে সারাটি জীবন নিরবিচ্ছিন্ন ভালোবাসা দেখতে চায় কেন? এইযে ধ্রুবর চোখে কোনো আবেগ নেই। নিশিতার প্রতি কোনো মুগ্ধতা নেই। জড়তাহীন অপরিচিত ব্যবহার। এই স্বাভাবিক ঘটনায় নিশিতার এতো ক্রোধ হচ্ছে কেন? অথচ ধ্রুব কখনো তার প্রেমিক ছিলো না। কখনো তাদের ভালোবাসাবাসির শর্ত ছিলো না। ছিলো না আজীবন ভালোবেসে যাওয়ার কোনো দায়। তবুও কেন এতো দুঃখ হচ্ছে? নিজে সুখে থেকেও অ-প্রেমিক ধ্রুবর সুখ দেখে কেন এতো ঈর্ষা হচ্ছে? তবে কী তার নারী মন চেয়েছিলো ধ্রুব চির অসুখী হোক? সব দায় নিজের ঘাড়ে নিয়ে বেঁচে থাকুক দুঃখী হয়ে? খুব একলা হয়ে?
#চলবে…