প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প,১৪,১৫

0
311

প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প,১৪,১৫
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

|১৪|

ফাল্গুনের গোধূলি বিকেল। প্রাণচঞ্চল শহরটিতে কপোত-কপোতীদের ঢল। সার্কিট হাউজের নির্জন পথ, পার্কের বিস্তৃত নদীর পাড় সর্বত্রই প্রাণোচ্ছল তরুণ-তরুণীর উচ্ছল হুল্লোড়। কোথাও গিটার হাতে বসে থাকা বাউন্ডুলে বন্ধুমহল। কোথাও আবার চায়ের কাপে ডুবে থাকা বেকারদের রাজমহল। বিকেলের মরে আসা রোদে সদ্য প্রেমে পড়া লাজুক কিশোরী মুখ। কোথাও বা মান-অভিমানের সন্ধি চলা দীর্ঘ তর্কভাস। পার্কের মাঝামাঝি ইট বাঁধানো মসৃণ এক বেঞ্চিতে বসে আছি আমি। খোলা চুলগুলো মৃদু হুল্লোড় তুলছে বাতাসে। কোলের উপর পড়ে থাকা ফোনটির দিকে দৃষ্টি যাচ্ছে থেকে থেকে। মন মেজাজের চূড়ান্ত অসন্তোষ ঘটিয়ে ফোনটা বাজল আরও মিনিট দশেক পর। আমার থেকে হাত পাঁচেক ওপাশে, বেঞ্চিতে বসে থাকা প্রিয়তা প্রায় ফিসফিসিয়েই বলল,

‘ রাগ করেছিস জান?’

মনের বিরক্তিটুকু গিলে ফেলে মৃদু নিঃশ্বাস ফেললাম। কাঠ কাঠ কন্ঠে বললাম,

‘ রাগব কেন? তোদের প্রেম পর্ব শেষ হলে বাসায় ফিরতে পারি? সন্ধ্যা হলো প্রায়!’

প্রিয়তা একটু ইতস্তত করে বলল,

‘ ও না একটু নদীর পাড় ধরে হাঁটার বায়না ধরছে। আবহাওয়াটা কী সুন্দর! রাগ করিস না জান। তুইও চল না আমাদের সাথে।’

শেষ বাক্যটা বেশ উৎসুক্যের সাথে বলল প্রিয়তা। আমার ভেতরটা বিরক্তিতে জ্বলে গেলেও চুপ করে রইলাম। দীর্ঘ অবসন্নতার পর খোলা হাওয়া পেতেই প্রিয়তার প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলাম তখন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ভুল হয়েছে। অন্যের প্রেমে পাহারাদারের মতো বসে থাকার মতো অবসন্নতা আর কী কিছু হতে পারে? আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,

‘ তোরা যা। আমি এদিকটাই হাঁটাহাঁটি করব। একা থাকতে ভালো লাগছে।’

আমার উত্তরে প্রিয়তা খুশি হলো নাকি নাখোশ, বুঝা গেল না। তবে থেমে থেমে, গলার স্বর খাদে নামিয়ে অপ্রস্তুত কন্ঠে বলল,

‘ তুই শিওর?’

‘ হান্ড্রেড টেন পার্সেন্ট।’

প্রিয়তা ফোন কাটল। আমি ঘাড় ফিরিয়ে ওদের দেখলাম। মরে আসা রোদে প্রিয়তার আরক্ত সুন্দর মুখ। বাতাসে হুল্লোড় তোলা রেশম কেশরাশি। তার পাশেই সুন্দর দেখতে একটি যুবক। প্রিয়তার বর্তমান প্রেমিককে এর আগে কখনো দেখিনি আমি। প্রিয়তার কোনো প্রেমিকের সাথেই ঘটা করে পরিচয় থাকে না আমার। কর্পোরেট পৃথিবীর ভদ্রতাসূচক হাই/হ্যালোও না। তবে এই প্রেমিকটা বোধহয় অন্যরকম। একটু বেশিই লাজুক কী? আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললাম। বুকের ভেতর বসে থাকা শিশু মনটা ঠোঁট উল্টালো। বুকের পাটাতনে পা দুলিয়ে বসে বলল,

‘ এতো এতো বসে থাকা যায়? যা না একটু হেঁটে আয়। কী সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে চারপাশ।’

মনরাজ্ঞীর আবদারটা বিনাবাক্য ব্যয়ে মেনে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করলেও ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলাম ইটের সরু পথ ধরে। ফেব্রুয়ারীর শেষ। হাওয়ায় হাওয়ায় ঝরে পড়ছে শুকনো পাতার ঝাড়। বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে মুক্তকেশী মাথার উপর। পায়ের নিচে স্তুপ হয়ে থাকা শুকনো পাতা মড়মড় শব্দ তুলছে। ফুসকার দোকানে বসে থাকা উচ্ছল প্রেমিকার হাসির মতোই ছাড়া ছাড়া, সুশ্রী আওয়াজ তার। আমার অপ্রস্তুতভাব কেটে গেল। আশেপাশের মানুষ আমায় দেখছে, কী ভাবছে সকল চিন্তা শুকনো পাতার মতোই উড়ে গেল বহুদূরে। বন্ধনহীন চুলগুলো হাওয়ায় উড়িয়ে। ঠোঁটের কোণে অকারণ মৃদু হাসি নিয়ে মেঘলা আকাশ, ঝরা পাতা আর ন্যাড়া গাছের ছবি তুলতে তুলতেই এগিয়ে গেলাম কিছুটা। হঠাৎ কোথা থেকে ছুটে এলো গিটারের শব্দ। আমি চোখ ফেরালাম। নদীর পাড়ের দীর্ঘ এক কাঠের বেঞ্চিতে চোখ বোজে গিটার বাজাচ্ছে এক যুবক। তাকে ঘিরে বসে আছে উৎস্যুক বন্ধুমহল। আমি সেদিকটাই কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে একরকম আনমনা হয়েই আরেকটু দূরের এক বেঞ্চির দিকে চাইতেই অপরিচিত এক চোখে চোখ আটকাল। সেকেন্ডের চোখাচোখিতেই ছেলেটি নির্মল হেসে পাশের কাউকে ইশারা করল। আমি তখনও গোটা ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারলাম না। অপ্রস্তুত হয়ে জায়গাটা ছেড়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই কেউ একজন সম্বোধন ছুঁড়লো,

‘ আরে, নিশু আপু না? কেমন আছো ছোট আপু?’

আমি চমকে চাইলাম। ভালো করে চেয়ে বুঝলাম, এদের কাউকেই আমি চিনি না। ইহজীবনে দেখেছি বলেও মনে পড়ছে না। বুকের ভেতরটা ঝুপ করেই অস্বস্তির সাগরে ডুবে গেল। আড়ষ্ট হয়ে পড়লাম। কী বলব, কী করব বুঝতে না পেড়ে ঠোঁট টেনে হাসার চেষ্টা করলাম। এতোগুলো যুবকের উৎসুক দৃষ্টিতে কিছুটা এলোমেলো হয়েই উত্তর দিলাম,

‘ আলহামদুলিল্লাহ, ভালো।’

তারা আমার অপ্রস্তুতভাবটা ধরতে পারল কি-না বুঝা গেল না। আমি জায়গাটা থেকে সরে পড়ব কিনা সেও বুঝতে পারলাম না। মান্ধাতার আমলের ভীষণ স্লো মস্তিষ্ককে সেকেন্ডে প্রশ্ন ছুঁড়লাম, এবার কী করব? গিভ মি আ গুড আন্সার। মস্তিষ্ক ‘গুড আন্সার’ দিলো না। কোনোরকম উত্তর না দিয়ে ঝিম ধরে বসে রইলো। আমি ভীষণ অসহায় বোধ করলাম। মান্ধাতার আমলের ভীষণ বেয়াদব মস্তিষ্ককে কঠিন কিছু গালি দিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম, কেটে পড়ব। ঠিক সেই সময়টাতেই প্রস্তাব এলো,

‘ আপু, আমাদের সাথে আসো না। এক কাপ চা বড় ভাইয়াদের পক্ষ থেকে।’

আমার গলা শুকিয়ে গেল। এই আট-দশজন যুবকের মাঝে একটি মুখ দেখেই অমীমাংসীত সমীকরণটা পানির মতো সহজ হয়ে গেল। চোয়াল শক্ত হলো। বুকের ভেতরের তীব্র ক্ষোভটা মাথা চাঁড়া দিলো। তবুও মুখে সরল অভিব্যক্তি নিয়ে বললাম,

‘ না ভাইয়া, ঠিক আছে। অন্য কোনোদিন।’

আমার এই প্রত্যাখান খুব আন্তরিকতার সাথেই এড়িয়ে গেল তারা। সরল হেসে বলল,

‘ অন্য কোনোদিন ইকুয়াল টু কোনোদিনই নয়। কোনোদিনই নয় এর থেকে এখনই ভালো নয়? চলে আসো। যত কাপ চা খেতে পারো। ধরা বাঁধা নিয়ম নেই। আজকের চায়ের বিল দিবে ধ্রুব।’

কথাটা বলেই ধ্রুবর দিকে চাইল সবাই। ঠোঁটের কোণে ইঙ্গিতমূলক হাসি চেপে ফোঁড়ন কাটল,

‘ কী ধ্রুব সাহেব? দিবেন না?’

ধ্রুব একবার চোখ তুলে আমার দিকে চাইল। গভীর, শান্ত চোখদুটো নিরুত্তর ভাবেই নেমে গেল সেকেন্ড কয়েক পর। কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ চুমুক দিলো চায়ের কাপে। ধ্রুবর বন্ধুদের জোরাজুরি এবার মাথায় উঠল। এরা প্রত্যেকেই পরিণত। পরিণত তাদের ব্যবহার। তাদের জোরাজুরির ধরনও ভিন্নরকম। হুট করে প্রত্যাখান করা যায় না। তাদের এই অজস্র বিনয় যে কেবল ধ্রুবর জন্যই তা বুঝা গেলেও সরাসরি ধ্রুবময় সম্বোধন না টানায় প্রতিবাদ করা যায় না। আবিরের মতো হুটহাট ‘ভাবী’ নয়। একদম মাপা মাপা তাদের সম্বোধন। তাদের এই পীড়াপীড়িতে হার মানতে বাধ্য হলাম আমি। তিনটা বেঞ্চি দখল করে বসে থাকা ছেলেদের একটা বেঞ্চি ফাঁকা হয়ে গেল ফটাফট। একটু দূর থেকে আরেকটা বেঞ্চি তুলে এনে তাতে চেপে বসল বাকি ক’জন। গোটা বেঞ্চিতে ধ্রুবকে একা, একলা, অসহায় করে দিয়ে তারা আমাকে ঠিক তার পাশটিতে বসারই অদৃশ্য আহ্বান জানালো। ধ্রুব ফাঁকা বেঞ্চিটির এক কোণায় চুপচাপ বসে থেকে চোখ তুলে আমার দিকে চাইল। তার শান্ত, গভীর দৃষ্টিতে শিরশির করে উঠল দেহ। বুকের ভেতরটাই উথাল পাথাল ঢেউ উঠলো। ভীষণ, ভীষণ, ভীষণ অনুভূতিতে দমবন্ধ হয়ে এলো। আমি কিছুক্ষণ ইতস্তত করে এগিয়ে গিয়ে বেঞ্চির আরেক কোণায় বসলাম। দুজনের মাঝখানে প্রায় হাত তিনেক ব্যবধান। এতটুকু সময়ে ধ্রুব টু শব্দটি পর্যন্ত করল না। তার বন্ধুরা আমাদের এই অসম দূরত্ব নিয়ে আকার ইঙ্গিতে প্রাণঢালা মজা লুটলো। আমি অস্বস্তিতে কাদা হয়ে গেলেও ধ্রুব নির্বিকার ভঙ্গিতে চায়ের কাপে চুমুক দিলো একের পর এক। প্রায় মিনিট দশেক পর অস্বস্তিতে হাঁপিয়ে উঠেই প্রিয়তাকে ফোন লাগালাম আমি। ফোন ধরতেই নিচু কন্ঠে বললাম,

‘ কোথায় তুই? আকাশে মেঘ করেছে। সন্ধ্যা নামলো বলে। বাসায় ফিরবি না?’

প্রিয়তা তার থেকেও নিচু কন্ঠে বলল,

‘ দোস্ত! প্লীজ রাগ করিস না! দিস ইজ দ্য লাস্ট টাইম। আরেকটু পরে যাই? ও আমার জন্য সারপ্রাইজ প্ল্যান করেছে। প্লীজ! প্লীজ!’

বিরক্তিতে মাথা ধরে গেল আমার। তেতো হয়ে উঠল কন্ঠনালী। বিরক্ত কন্ঠে বললাম,

‘ তুই থাক তবে, আমি চলে যাই।’

প্রিয়তা অসহায় কন্ঠে বলল,

‘ রাগ করলি?’

‘ রাগ করিনি। আমার ভালো লাগছে না। ফিরে যাচ্ছি। তুই কাজ শেষে ফিরে আসিস। সমস্যা নেই।’

ফোন কেটে চায়ের কাপে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে পাশে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালাম। বিব্রত কন্ঠে বললাম,

‘ আমি আসছি। আমার বন্ধু অপেক্ষা করছে। বাড়ি ফিরতে হবে।’

সবাই এক পলক ধ্রুবর দিকে চেয়ে থেকে আমায় বিদায় দিলো। ধ্রুব তখনও নির্বিকার, নিরুত্তর। সেখান থেকে সরে এসে যেন শ্বাস নিয়ে বাঁচলাম আমি। ধরফর করতে থাকা বুকের উপর হাত রেখে বুঝতে পারলাম বুকের সাথে সাথে হাতটাও কাঁপছে। পা’টাও কাঁপছে কী? আকাশে তখন খুব মেঘ। সন্ধ্যাও ঘনিয়ে এসেছে প্রায়। প্রিয়তার কাণ্ডজ্ঞানহীনতায় বিরক্ত হয়ে পার্কের গেইট পর্যন্ত আসতেই মনে পড়লো, বাসা থেকে বের হওয়ার সময় পার্স আনা হয়নি। কী সাংঘাতিক! এই সন্ধ্যায় হেঁটে বাড়ি ফিরতে হবে নাকি? কপালে চিন্তার ভাঁজটা আরও একটু দৃঢ় করতেই যেন আচমকা আষাঢ়ের মতো ঝমঝমিয়ে শুরু হলো বৃষ্টি। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। পায়ের জোরটা বাড়িয়ে, অনেকটা দৌঁড়েই সার্কিট হাউজের পাশে একটি ছাউনির নিচে দাঁড়ালাম। কাঁধ ও চুলের পানি ঝাড়তে ঝাড়তে প্রিয়তাকে ফোন লাগালাম। একবার, দুইবার, তিনবারের মাথাতেও লাইন পাওয়া গেল না। আমার চিন্তা গাঢ় হলো। আধঘন্টার ব্যবধানেই প্রাণের শহরটা ঝুপ করে তলিয়ে গেল বিষণ্ণ এক সন্ধ্যায়। অবিরল বৃষ্টি পড়ছে। নিস্তব্ধ, শান্ত পরিবেশ। আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলো। প্রিয়তাকে আবারও ফোন লাগালাম। একবার, দুইবার, একে একে অনেকবার। লাইন পাওয়া গেল না। মুঠো ফোনটা শক্ত করে চেপে ধরে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু বৃষ্টি থামলেই বা কী? কী করে যাব এতোটা পথ একা? সার্কিট হাউজের পেছনের রাস্তাটা বরাবরই নির্জন, নিস্তব্ধ। দুশ্চিন্তায় ঝিম ধরে এলো মস্তিষ্ক। আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে বৃষ্টির গতি বাড়লো বই কমলো না। জলের ছাঁটে ভিজে গেল আমার সফেদ সালোয়ার। চারদিকে ভয় ধরানো অন্ধকার। আমার ঠিক মাথার উপর ঝুলছে হলদেটে স্ট্রিট ল্যাম্প। ঠান্ডা হাওয়ায় থেকে থেকেই কামড়ে ধরছে শরীর। আমি ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতেই চাতক পাখির মতো এদিক ওদিক চাইলাম। অপেক্ষায় রইলাম। কীসের অপেক্ষা, কার অপেক্ষা জানা নেই। কেবল জানি, অপেক্ষায় রইলাম। জীবনে প্রথমবারের মতো, আমাকে একদম চমকে দিয়ে, ভাগ্যবিধাতা আমার অপেক্ষার এক অপ্রত্যাশিত অবসান ঘটালেন। কোথা থেকে একটা রিকশা এসে থামল আমার পায়ের কাছে। রিকশার অন্ধকার থেকে মুখ এগিয়ে ঝংকার তোলা এক কন্ঠ শুধাল,

‘ নিশু! এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন নিশু?’

এই প্রথম বুঝি নিজ থেকে কথা বলল ধ্রুব। আমি চোখ তুলে চাইলাম। ধ্রুব একটু ভেবে বলল,

‘ রিকশা পাচ্ছো না?’

আমি উত্তর দিলাম না। ধ্রুব অবশ্য আমার উত্তরের অপেক্ষাও করল না। রিকশা থেকে নেমে, এক ছুটে আমার পাশে এসে দাঁড়াল। ঝাকড়া চুলগুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,

‘ এই রিকশা করে চলে যাও।’

আমি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কঠিন কন্ঠে বললাম,

‘ লাগবে না।’

‘ এই রাস্তায় এখন আর রিকশা পাবে না,নিশু।’

আমি উত্তর দিলাম না। ধ্রুব আমাকে ভালো করে লক্ষ্য করে বলল,

‘ পার্স আনোনি। রিকশা ভাড়া নেই? সেটা তো বাসায় ফিরেও দিতে পারো।’

ধ্রুবর কথায় সূক্ষ্ম মেজাজ খারাপ হলেও মাথায় ভর করল অন্য এক চিন্তা। বুকের ভেতরটা ধরাস করে উঠল। চট করে মনে পড়ে গেল, আমার কাছে তো ঘরের চাবি নেই। পার্স আনিনি। টাকা আর চাবি সবই তো প্রিয়তার ব্যাগে। সর্বনাশ! আমি অস্থির মনে প্রিয়তাকে ফোন লাগালাম। এবারও কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। ধ্রুব আমাকেই খেয়াল করছিল। বলল,

‘ কোনো সমস্যা? তুমি বললে, আমি রিকশা ভাড়াটা মিটিয়ে দিতে পারি।’

আমি রক্তিম চোখে চাইলাম। ধ্রুব চুপ হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,

‘ তুমিই ব্যতিক্রম? নাকি সব লেখিকাদেরই এমন তেজ?’

আমি চিড়চিড়ে মেজাজ নিয়ে বললাম,

‘ সমস্যা কী আপনার? এখানে অযথা দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’

ধ্রুবর স্পষ্ট স্বীকারোক্তি,

‘ তোমার জন্যই তো দাঁড়িয়ে আছি।’

আমি চোখ ছোট ছোট করে চাইলাম,

‘ কেন? আমি বলেছি?’

‘ উঁহু। বলোনি। কিন্তু এই ভর সন্ধ্যায় তোমায় একা ফেলে যেতে বিবেকে বাঁধছে।’

আমি কিছুক্ষণ গজগজ করে বললাম,

‘ এতোটুকু বিবেকবোধ দেখানোর জন্য ধন্যবাদ। আপনি যেতে পারেন।’

ধ্রুব আমার দিকে চেয়ে হাসল। একদম সরল প্রশ্ন নিয়ে বলল,

‘ আমার প্রতি তোমার এতো রাগ কেন? কী করেছি? কী চাও তুমি?’

আমি থমকালাম। মনের আনাচে-কানাচে সত্য কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে চুপ করে রইলাম। ধ্রুব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে ঘড়িতে সময় দেখল। তারপর আকাশের দিকে চেয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বলল,

‘ আমার এক্ষুনি বাসায় যাওয়া প্রয়োজন। বৃষ্টিটা খুব সহজে থামবে বলে মনে হয় না। আমরা একই রিকশায় যেতে পারি। আমি বাসার একটু আগেই নেমে যাব।’

ধ্রুবর কথায় চাপা এক অভিমান ফুঁসে উঠল বুকে। নিজের অজান্তেই অভিমান ঢেলে দিয়ে আস্ত এক ভুল কথা বলে বসলাম, খুব ভুল এক মানুষকে,

‘ কেন? আমার সাথে কেউ দেখে নিলে আপনার বিয়ে ভেঙে যাবে বলে?

ধ্রুব এবার পূর্ণদৃষ্টিতে চাইল। একটু হেসে বলল,

‘ সম্ভবনাটা খুব মিথ্যে নয়।’

আমি চোখ ফিরিয়ে চুপ করে রইলাম। নিজের মনটাকে গলা টিপে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করল। আবিরের থেকে শোনা ছোট্ট কথাটা সেদিন যতটা হালকা মনে হয়েছিল। আজ ততটাই গভীর হয়ে বিস্ফোরণ ঘটালো৷ মনটাকে কেটেকুটে রক্তাক্ত করে তুললো চোখের পলকে। ধ্রুব নামক মানুষটিকে সটান একটি চড় বসিয়ে বলতে ইচ্ছে করল, ‘গেট লস্ট’। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এই হৃদয়বিদারক নিস্তব্ধতাকে আমার কোমল হৃদয়ের মতোই ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে বেজে উঠল ধ্রুবর ফোন। ধ্রুব অপ্রস্তুত চোখে একবার আমার দিকে চেয়ে ফোন তুললো। গম্ভীর, শান্ত স্বরে বলল,

‘ হ্যালো।’

বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে ওপাশের আওয়াজ পাওয়া গেল না। ধ্রুব গলার স্বর নিচু করে বলল,

‘ বেশি দেরী হবে না। আমি আসছি।’

তারপর একটু চুপ থেকে আবার বলল,

‘ আমার টেবিলের উপরই রেখে এসেছি ছবিগুলো। সবাই-ই তো সুন্দর। সব ছবি আমার কাছে এক রকমই লাগে। তুমি তোমার পছন্দ মতো সিলেক্ট করে নাও। আমার কোনো আপত্তি নেই।’

মন কী বুঝলো, জানি না। অদ্ভুত এক ব্যথায় টন টন করে উঠল গোটা বুক। ধ্রুব একবার আমার দিকে চেয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। মৃদু কন্ঠে বলল,

‘ বললাম তো তোমার ইচ্ছে। আমি আসছি। বাসায় এসে আলোচনা করি?’

আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চুপচাপ বৃষ্টির দিকে চেয়ে রইলাম। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, বৃষ্টিতে ভিজেই বাড়ি ফিরবো। এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা চলবে না। ধ্রুব ফোন কেটে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ তুমি যাচ্ছো আমার সাথে?’

আমার নিষ্কম্প উত্তর,

‘ না।’

‘ আমার সাথে যাবে না? নাকি আমার সাহায্যই নিবে না?’

ধ্রুবর মন পড়ে ফেলার ক্ষমতায় কিছু চমকালাম আমি। কঠিন কন্ঠে বললাম,

‘ দুটোই। আই ক্যান ম্যানেজ।’

ধ্রুব আমার দিকে অপলক চেয়ে রইল। মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে বলল,

‘ এমন একটা মুহূর্তে জেদ ধরাটা কী খুব গুরুত্বপূর্ণ?’

#চলবে……

প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

|১৫|

‘ এমন একটা মুহূর্তে জেদ ধরাটা কী খুব গুরুত্বপূর্ণ?’

ভীষণ অন্ধকারে ঢাকা মেঘাবৃত আকাশ। আলোহীন, রুদ্ধ শহরটিতে ঝমঝমে বর্ষা। মাথার উপর স্বল্প আলো ব্যতিত চারপাশটা ধরণি বিচ্ছন্ন লোমহর্ষক উপত্যকা। পায়ের কাছে ঝমঝমিয়ে জল পড়ছে। স্তব্ধ আকাশটা থেকে থেকেই ঝিলিক দিয়ে উঠছে নিষ্ঠুর আর্তনাদে। ঠিক তখনই চোখে পড়ছে হাতখানেক দূরের নির্বিক গাছগাছালি আর খুব নির্জন পথটা। গায়ের জামাটা ভিজে একাকার। শরীরটা কাঁপছে থরথর। বুঝতে পারছি, মাত্র সেড়ে উঠা জ্বরটা আবার ফোঁড়ন কাটছে গায়ে। চেপে বসতে চাইছে মাথায়। কন্ঠনালিতে। ধ্রুবর গায়ের শার্টটা ভিজে গিয়েছে আরও আগে। বৃষ্টির ছাঁটে বিন্দু বিন্দু জল জমেছে শ্যামবর্ণ মুখে। পুরু ভ্রু জোড়ায় ঢেউ খেলানো ভাঁজ ফেলে আমার দিকে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। কাঙ্ক্ষিত জবাব না পেয়ে একবিন্দু রাগ করলো না। বিরক্ত হলো না। হাতে থাকা মুঠোফোনটা সচল করে সেকেন্ড কয়েক অপেক্ষা করল। ওপাশে ফোন রিসিভ হতেই ভূমিকাহীনভাবে বলল,

‘ তোর ভাবীকে নিয়ে যা।’

আমি চমকে চাইলাম। অবাক চোখে চেয়ে থেকে নিজের অজান্তেই ফোনটা ছিনিয়ে নিলাম হাতে। কিছুটা অপ্রস্তুত হলাম। নিজের অভদ্রতায় অবাক হলাম। তবুও বেশ তেজ নিয়ে বললাম,

‘ ভাবী বলতে কাকে বুঝাচ্ছেন?’

ধ্রুব তার ভাসা, ভাসা গম্ভীর চোখদুটো ফিরিয়ে আমার হাতের দিকে চাইল। তারপর চোখ তুলে চাইল আমার চোখে। তার সেই চাহনিতেই কালবৈশাখীর ঝড়ের থেকেও ভয়াবহ ঝড় বয়ে গেল মনে। থরথর করে কাঁপতে লাগল প্রেমে ডুবন্ত হৃদয়। সব ছেড়ে ছুঁড়ে জানতে ইচ্ছে হলো, ‘এমন ঘোর ধরানো দৃষ্টি আপনি কোথায় পান?’ কিন্তু জানা হলো না। চোখের দৃষ্টিটাও শিথিল হলো না বিন্দুমাত্র। চোয়াল শক্ত করে নির্বিকার চেয়ে রইলাম। ধ্রুব বলল,

‘ তোমাকেই বুঝাচ্ছি।’

‘ আমাকে বুঝাচ্ছেন? আশ্চর্য! আমি কারো ভাবী হতে যাব কেন?’

ধ্রুবর তেমন ভাবান্তর হলো না। সহজ কন্ঠে বলল,

‘ আবির তো তোমায় তাই বলে।’

আমার মেজাজ বিগড়ে গেল। কঠিন কন্ঠে বললাম,

‘ আবির বলে! আবির বললেই আপনি মেনে নিবেন?’

ধ্রুব এবার পূর্ণদৃষ্টিতে চাইল। কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,

‘ আবির তোমাকে ভাবী ডাকছে, আমাকে নয়। তাহলে আমার মেনে নেওয়া না নেওয়ার প্রশ্ন আসছে কেন?’

আমি চোখ বড় বড় করে চাইলাম। থতমত খেয়ে বললাম,

‘ আপনার মেনে নেওয়া না নেওয়ার প্রশ্ন আসবে না?’

ধ্রুব কঠিন কন্ঠে বলল,

‘ না। আসবে না।’

এরপর কী বলা যায় বুঝে না পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। আমার স্তব্ধতা কাটাতেই বুঝি সচল হয়ে উঠল মুঠোফোন। অধৈর্য হয়ে বলল,

‘ ভাইয়া-ভাবী, তোমরা ঝগড়াটা একটু বন্ধ করবে, প্লীজ? কোথায় আছো?’

আমি উত্তর দিলাম না। ধ্রুব আবারও সহজ রূপে ফিরে এলো। সহজ কন্ঠে বলল,

‘ পার্কের পেছনে ব্যাটমিন্টন ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। বাসা থেকে বেরিয়ে চট করে একটা রিকশা নিয়ে চলে আয়। তোর ভাবীকে উদ্ধার কর।’

আমি তপ্ত চোখে চাইলাম। আবির অবাক হয়ে বলল,

‘ মানে কী? এই বৃষ্টিতে ওখানে কেন? আর তুমি তো আছোই। তুমি থাকতে আমাকে আসতে হবে কেন?’

ধ্রুব বুঝি একটু ফোড়ন কাটল। বলল,

‘ ভাবী তো তোর, আমার না। আমার সাথে যেতে তার দুনিয়ার অসুবিধা।’

আমি রাগী চোখে চাইলাম। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,

‘ আমি বলেছি কাউকে আসতে? আবির? তোমার আসার কোনো প্রয়োজন নেই। তোমার ভাইয়াকেও বলো চলে যেতে। আই ক্যান হ্যান্ডেল মাইসেল্ফ।’

আবির হতাশ হয়ে বলল,

‘ তোমরা কী দয়া করে ঝগড়াটা বন্ধ করবে?’

ধ্রুব বা আমি কেউই প্রত্যুত্তর করলাম না। আবির কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে অসহায় কন্ঠে বিড়বিড় করল,

‘ মা কী এই ঝড় বৃষ্টিতে বেরুতে দিবে? কী বলে বেরুবো? আচ্ছা, আমি আসছি।’

অপরিচিত এক মেয়ের জন্য আবিরের এই আত্মোৎসর্গে বিস্মিত হলাম আমি। স্তম্ভিত হয়ে কিছু বলার আগেই কল ডিসকানেক্ট হলো। ধ্রুব হাত বাড়িয়ে আমার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে পকেটে পুড়ল। রোমশ হাতের উপর পড়ে থাকা ঝকঝকে ঘড়িটিতে সময় দেখল। তারপর আমার দিকে চেয়ে বলল,

‘ এখানে আমার কোনো প্রয়োজন দেখছি না। থাকো তবে। আমার বাসায় ফেরা প্রয়োজন।’

আমি সরু চোখে চাইলাম। শক্ত কন্ঠে বললাম,

‘ যান। কেউ মানা করেছে আপনাকে?’

ধ্রুব মৃদু হাসল। আমি বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে দেখলাম আমাকে একা ফেলে সেই রিকশাটিতে চেপে ধ্রুব সত্যি সত্যিই চলে গেল। এই অন্ধকার আষাঢ়িয়া রাতে, একদম একা দাঁড়িয়ে থেকে, ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ধ্রুবর চলে যাওয়া দেখলাম। কয়েক মুহূর্তের জন্য নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। ধ্রুব চলে গেল? সত্যিই চলে গেল? একবারও ফিরে এলো না? মানুষের মন কী এতোটা নিষ্ঠুর না হলে চলে না? ‘ধ্রুব চলে গেছে’ — এই ঘোর থেকে বেরিয়ে আশেপাশে চাইতেই ঝুপ করে বাস্তবতায় নেমে এলাম আমি। চারদিকে নির্জন, নিস্তব্ধতা। নির্বিক দৈত্যের মতো অন্ধকার মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছপালা। জনমানবহীন দীর্ঘ পথ। ঝমঝমে বৃষ্টির ফোঁটা ব্যতিত কোথাও কোনো নেড়ি কুকুরের আর্তনাদও নেই। আমি এই প্রথম নিজের দুরবস্থাটা গভীরভাবে উপলব্ধি করলাম। ভয়ে সিঁটিয়ে গেল মন। প্রিয়তাকে আরও একবার ফোন করার কথা মনে রইলো না। গলা শুকিয়ে এলো। মস্তিষ্কটা বাবার কথা মনে করিয়ে দিতেই আহ্লাদে ভিজে এলো চোখ। ধ্রুব আমায় এতোটা গুরুত্বহীন ভাবে ভাবতেই কোমল মনটা রক্তে রক্তে ভেসে গেল। এই পৃথিবীতে এই মুহূর্তে নিজেকে পথের মোড়ের ওই নেড়ি কুকুরটির থেকেও অসহায় মনে হলো। মনে হলো, এই পৃথিবীতে আদতে আমার কেউ নেই। কেউ না৷ নয়তো এতোক্ষণের বিপদ সময়ে কেউ তো একটিবারও মনে করলো না আমায়। একটু আদর দিয়ে আগলে নিলো না। উদ্বিগ্ন হলো না। নিজেকে আমার আবারও খুব অযথা মনে হলো। ভুল জন্মের পাপে পাপিষ্ঠা মনে হলো। ভেতরের অবুঝ মনটা খুব অবুঝ হয়ে বলল, মা থাকলে নিশ্চয় মনে করতো আমার কথা? আমি কোথায় আছি ভেবে উদ্বিগ্ন হতো? আকাশে মেঘ করেছে দেখেই চিন্তায় অস্থির হতো? আমার চোখ উপচে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। প্রায় মিনিট দশেক পর, যখন আমার মনে হলো এই পৃথিবীতে আমি বড়ই প্রয়োজনহীন। আমার হারিয়ে যাওয়া কাউকে ভাবায় না ঠিক তখনই টং টং ঘন্টি বাজিয়ে একটা রিকশা এসে থামল আমার সামনে। প্রথম দফায় ধ্রুব ভেবে খুব চমকালাম। কিন্তু পরমুহূর্তেই ওই সরল মুখে সহজ হাসি দেখে চমকটা কেটে গেল। আবির অর্ধসিক্ত শরীরে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। ডানহাত দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে নির্মল হাসল,

‘ খুব দেরী হয়ে গেল? রাস্তায় একটা রিকশাও নেই, জানো? এই রিকশাটা পেয়েছি খুব যুদ্ধ করে। জলদি চলো তো, ভাবী। ভিজে গেছো।’

আমি অপলক চেয়ে রইলাম। এই সহজ-সরল ছেলেটির সহজ আন্তরিকতায় হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল। আমি যেন তার খুব কাছের এমনভাবেই উদ্বিগ্ন হলো আবির। চোখেমুখে চিন্তার ছাপ ফেলে তাড়া দিলো। একই চেহারার দুটো মানুষের চারিত্রিক ভিন্নতায় কিছুটা স্তব্ধ হয়েই রিকশায় উঠলাম। প্রতিবাদ করলাম না। রিকশায় উঠেই হুটটা ফেলে দিয়ে মাথার উপর ছাতা মেলে ধরল আবির। হাজারও কথায় নিরন্তর ছুটে চলল তার ঠোঁট। আমি আবিরের দিকে চাইলাম। বিষণ্ন কন্ঠে বললাম,

‘ তুমি এতো মিষ্টি তবে তোমার ভাইয়া এতো অসভ্য কেন?’

আবির থমকাল। অবাক চোখে চেয়ে বলল,

‘ ভাইয়া আবার কী করল?’

‘ কী করল! আমাকে এখানে একা ফেলে চলে যাওয়াটা অভদ্রতা নয়? বিন্দুমাত্র মানবিকতা নেই। আমি জাস্ট বিশ্বাস করতে পারছি না।’

আবির হেসে ফেলল। একটুও না চমকে সহজ কন্ঠে বলল,

‘ ভাইয়া আরও অনেক কিছু করতে পারে যা তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না।’

আমি প্রশ্নবোধক চাহনিতে চাইলাম। আবির খুব উৎসাহ নিয়ে বলল,

‘ তোমাকে একটা উদাহরণ দিই। আমি যখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি তখন ভাইয়া হাই স্কুলের ছাত্র। আমাদের গ্রামের বাড়ি মুক্তাগাছা। তো, ঈদের ছুটিতে সবাই গ্রামের বাড়ি ঘুরতে গেলাম। আমার দাদুবাড়িতে সেই সময়ই দু’তলা বিশাল এক বাড়ি ছিলো। ছোট রেলিঙের ছড়ানো ছাদ। তখন বর্ষাকাল। ছাদে শ্যাওলা জমে একাকার অবস্থা। আমি ছাদের রেলিঙ ধরে হাঁটছি। বাবা-মা অনেকবার নিষেধ করেছেন। পা পিছলে গেলে সর্বনাশ। ছাদে হাঁটাহাঁটি করো না। কিন্তু কে শুনে কার কথা? আমার তখন সেটাই সবচেয়ে মজার খেলা। বাবা-মা সবাই যখন বলতে বলতে অতিষ্ঠ তখন এলো ভাইয়া। একদম সহজ কন্ঠে বলল, ‘ রেলিঙের কাছে যাস না। পড়ে যাবি।’ আমি ঠোঁট উল্টিয়ে বললাম, ‘পড়ব না।’ ভাইয়া আরও একবার নিষেধ করল। কান দিলাম না। তারপর কী হতে পারে ভাবতে পারছ?’

আমি বিভ্রান্ত চোখে চাইলাম। অনিশ্চিত কন্ঠে বললাম,

‘ তারপর কী? মেরেছে তোমায়?’

আবির হেসে ফেলল। মাথা নেড়ে বলল,

‘ উঁহু। আমাকে তোলে ডিরেক্ট ছাদ থেকে নিচে ফেলে দিয়েছে।’

আমি চমকে উঠলাম। স্তব্ধ চোখে চেয়ে থেকে বললাম,

‘ মানে! সত্যি! তুমি ব্যথা পাওনি?’

আবির হাসল,

‘ গোটা দুইমাস বেড রেস্টে থাকতে হয়েছিল। স্কুলে যেতে পারিনি।’

আমি হতভম্ব চোখে চেয়ে রইলাম,

‘ তোমার মা-বাবা উনাকে কিছু বলেনি?’

‘ না। বাবা একটু বকেছিল। তবে মা কিছু বলেনি। মা-ও ভাইয়ার মতোই। ভাইয়া মার মতো হয়েছে। খুব কঠিন। আর আমি হয়েছি বাবার মতো। কল্প কারো মতোই হয়নি। ও হয়েছে চূড়ান্ত বেয়াদবের মতো। আমার জীবনটা নাশ নাশ করার জন্যই ওর জন্ম।’

আমি প্রত্যুত্তর করলাম না। বড় ভাইকে এরা কেন এতো ভয় পায় বুঝতে পেরে স্তব্ধ হয়ে গেল বুক। আবির একটু হেসে বলল,

‘ ভাইয়া যে তোমায় ফেলে গিয়েছে এটা তার খুবই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। নিশ্চয় জেদ ধরেছিলে খুব?’

আমি উত্তর দিলাম না। এমন একটা ভয়ঙ্কর মানুষের প্রেমে পড়েছি ভেবেই তওবা পড়লাম। কী সাংঘাতিক কান্ড!

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here