সেদিনও_জ্যোৎস্না_ছিল #তানিয়া পর্ব:২৭

0
490

#সেদিনও_জ্যোৎস্না_ছিল

#তানিয়া

পর্ব:২৭

মেহুকে একটা অন্ধকার ঘরে আটকে রাখা হয়েছে। রাত না দিন কিছু বোঝা যাচ্ছে না।ক’দিন হলো মেহু সেটাও জানে না।ঘরে আলো বাতাস ঢোকার কোনো সুযোগ নেই। খাবার দেওয়া হয় একবেলা তাও যখন দেয়া হয় তখন আলোর মুখ দেখা যায় না।শুধু জমাট বাঁধা অন্ধকার থেকে একটা আওয়াজ আসে সেই সাথে খাবারটা।মেহু দৌড়ে গেলে সেটা বন্ধ হয়ে যায়।

মেহু আসার পর থেকে চিৎকার করে কাঁদছে কিন্তু কেউ নেই সেই আওয়াজ শুনার।ঘরে গুমোট গরমে মেহুর প্রাণ যায় যায় অবস্থা। তাছাড়া যে রুমে আছে সেটাও দেখতে কেমন মেহুর জানা নেই। চোখ খুলার পর থেকে যেমন করে বসেছিল ঠিক তেমন করে বসে আছে। কয়েকবার হাটার চেষ্টা করেছিল বটে কিন্তু কোথাও যেন হোটচ খেয়ে পড়ে গেছে। সাথে শাড়ীর সাথে টান খেয়েছে যার কারণে শাড়ী ছেড়ার আওয়াজ কানে এলো।

মেহু যখন হাসপাতাল থেকে বের হলো তখনি একটা গাড়ি এসে তাকে তুলে নেয়। এরপর কি হলো,কীভাবে হলো কিছুই মেহু জানে না কারণ গাড়িতে উঠার পরই মেহুকে অজ্ঞান করে ফেলা হয়। এরপর যখন জ্ঞান ফিরে দেখে একটা অন্ধকার ঘরে তাকে আটকে রাখা হয়েছে। সেটা কোথায় এবং কেমন তা জানেও না।চোখ খুলতেই মেহু দেখে চারপাশে কুচকুচে অন্ধকার। এরপর এখানে তার সময় কাটছে। বুঝতে পারছে না দিন না রাত।কারণ আলো ঢোকার মতো একটা ফুটো রাখে নি।তবে একটা নিদিষ্ট সময় এসে মেহু বুঝতে পারে তাকে একবেলা খাবার দেওয়া হয় আর সেটা রাতেই। কারণ মেহু খাবার দেওয়ার পর বেশ সময় নিয়ে হিসাব করে যে পরবর্তী খাবার কখন দেয় হয়।এতে নিশ্চিত হয় তাকে দু’বার খাবার দেয়া হয়েছে। মেহু বসে বসে ভাবে এ অন্ধকার থেকে কি সে বের হতে পারবে না।কেউ কি তার খোঁজ করছে না?

আহসান ভিলায় একটা উত্তেজনা চারপাশকে গমগম করে রেখেছে। আদ্য আরিফ সবাই ছোটাছুটি করছে মেহুর খবর জানতে কিন্তু কেউ কোনো তথ্য পায় নি।নীলা যখন বুঝতে পারলো মেহুকে কিডন্যাপ করা হয়েছে তখনি সে ফোন করে আরিফকে।আরিফ তাড়াতাড়ি জানায় আদ্যকে।এরপর একে একে বাসার সবাই সবটা জানতে পারে।তখনি শুরু হয়ে যায় দৌড়াদৌড়ি।তবে দুদিন হয়ে গেছে এরমধ্যে এখনো মেহুর খবর পায় নি।তারা থানায় যাওয়া আসা করছে কিন্তু পুলিশও কোনো তথ্য তাদের দিতে পারেনি।

মেহু আগের ন্যায় বসেছিল একটু পর খাবার আসবে।সে দোয়া করছে যেন সে একটু হলেও আলো পায়।অন্তত কোথায় আছে সেটা জানার জন্য হলেও যেন সামান্য আলো সে দেখতে পায়।

দরজা খোলার আওয়াজ ভেসে আসছে কিন্তু এখনো কেউ ঢুকে নি।মেহু আল্লাহকে ডাকছে অন্তত যেন এবার কারো দেখা পায়।আল্লাহ সত্যি ডাক শুনলো কিনা কে জানে তবে মোমবাতি হাতে একজন খাবার নিয়ে ঢুকলো।আর তাকে দেখেই মেহু ভয়ে জমে গেলো।আজগর,তার চাচাতো ভাই সেই তাকে কিডন্যাপ করিয়েছে?কিন্তু কোথায় রাখলো তাকে,নিজ বাড়িতে নাকি অন্য কোথাও?

“কেমন আছো বউ?কতদিন পর তোমারে দেখলাম প্রথমে দেখেই তো অবাক তুমি এত সুন্দর হইছো?নিশ্চয়ই বড়লোক জামাই তোমারে দামী স্নো পাউডার মাখায় তাই না?”

মুখের ওপর হাত রেখে কথা বলে আজগর।মেহু এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দেয়।আজগর হেসে উঠে। মেহু অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে বলে,

“আমাকে এখানে তাহলে আপনারাই ধরে এনেছেন।এত সাহস আপনাদের? কেনো ধরে এনেছেন?’

“আরে বউ এত প্যাচাল পাখাও ক্যান?সাহস তো আমাগো ন সাহস তোমার।যে ভেলকি দেখাইছিলা বা বা গো আমাগো মতো চালাক মাইনসেরে তুমি একদম বেকুব কইরা ছাড়ছো।তয় তুমি শিক্ষিত মাইয়া তোমার বুদ্ধি একটু বেশিই হইবো।একদম জেঠীর মতো হইছো।আমরা বেবাগ খবর রাহি।তোমার স্বামী তো নাকি বিলাতি মাইয়া বিয়া করবো।তুমি আমার কাছে চইলা আসো আমি পুরান কথা ভুইলা যামু। ”

“দরকার পড়লে মরে যাবো তবুও আপনাদের মতো কুৎসিত মানুষের কাছে আসবো না।আরেকটা কথা আমার স্বামী যেমনি হোক তিনি আমাকে ভালোবাসেন আমার বিশ্বাস তিনি আমাকে খুঁজতে এখানে আসবেন।”

“হা হা কি যে কও তোমার স্বামী আইয়া আবার চইলা গেছে। সে পুলিশ নিয়া আইছিলো তোমারে খুঁজতে।আহা বেচারা তো জানেও না তার বউরে আমরা কোথায় আটকাই রাখছি?”

“ওনি এসেছিলেন।আমাকে আপনারা কোথায় আটকিয়ে রেখেছেন?”

“সব কমুনে একটু কাছে আসো তো দেখি।ঐ পোলায় তো তোমারে আদর করে না তাই না।আমি একটু আদর কইরা লই।”

আজগর মেহুর খুব কাছে যেতেই মেহু আজগরকে একটা ধাক্কা দিলো।দৌড় দিতেই শাড়ীর একাংশ প্রায় কীসের সাথে লেগে ছিড়ে গেলো।মেহু মোমবাতির সামান্য আলোতে তাকাচ্ছে যদি কিছু পাওয়া যায়? সৌভাগ্যক্রমে কোত্থেকে একটা দা পেলো আর সেটা নিয়েই দাঁড়াতে আজগর সাহস পেলো না আগানোর।ফোসফাস করে সে বের হয়ে গেলো।

মোমবাতি প্রায় শেষের দিকে মেহু সেটা নিয়ে চারপাশটা চোখ বুলালো। এটা অনেকটা পাতাল ঘরের মতো যেখানে আলো বাতাস ঢুকার ফুটো নেই। তাছাড়া এ ঘরে প্রায় অপ্রয়োজনীয় আর লোহালক্কড়ের জিনিস।মেহু এবার বুঝলো আজগর যখন আসতো তখন গমগমে শব্দ হতো তার মানে এটা কোনো বাড়ি নয় বাড়ির নিচের অংশ। কিন্তু কার বাড়ি মেহুদের নাকি অন্য কারো??

মেহু মনের আনন্দে কেঁদে উঠলো।আদ্য তাকে খুঁজতে এসেছে এরচেয়ে আনন্দের আর কি আছে? বেচারা নিশ্চয়ই এ জায়গাটার হদিশ পায় নি নাহলে এখানে চলে আসতো।মেহু প্রাণ পণে আল্লাহকে ডাকছে।

আদ্য যখন কাছাকাছি সব জায়গায় খোঁজ করে মেহুকে পেলো না তখনি সন্দেহ করলো এ কাজ মেহুর চাচা।তাই সে কুষ্টিয়া রওনা হলো।সেখানে গিয়ে সেই থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসারের সাথে বিষয়টা আলাপ করলো আর ঢাকার পুলিশের সাহায্য নিলো।সবমিলে যখন মোজাম্মেলের ঘরে গেলো তখন সে আয়েস করে পান চিবুচ্ছে। আদ্যকে দেখে সে খুশি মনে এগিয়ে এলো,

“আরে জামাই নাকি,কেমন আছো বাবা?কি মনে কইরা, আমাগো মাইয়া কই?”

“একদম নাটক করবেন না।মেহু কোথায় তাকে কোথায় নিয়ে রেখেছেন?”

মোজাম্মেল জিভে কামড় দিয়ে এমন ভাব করলো যেন এ বিষয়ে কিছুই জানে না।

“আরে জামাই কি কও হেরে আমরা কই পামু।তুমিই তো তারে বিয়া কইরা নিছো।আমরা আর হের খোঁজ রাখি নাই। তয় মাইয়াডার পালানোর স্বভাব আছে। দেহো নাই আমার পোলারে থুইয়া তোমাগো বাড়িতে উঠছে।”

আদ্য তেড়ে আসে মোজাম্মেলকে মারতে।পিক ফেলতে ফেলতে মোজাম্মেল বলে,

” এ ভুল কইরো না বাবা।ঐডা তোমার ঘর তোমার এলাকা,এইডা আমার ঘর আমার এলাকা।তাছাড়া তোমার বউরে লইয়া আমাগো কাম কি?তুমি তারে লইয়া সংসার করতাছো তা আমরা জানি।তাই তোমাগো ডিস্টার্ব করোনের মন নাই। ”

আদ্য মোজাম্মেলের কথাকে পাত্তা না দিয়ে পুলিশকে ঘর সার্চ করার আদেশ দিলো।মোজাম্মেল বাধা দিয়ে জানায়,

“আরে মিয়া শহরের পোলা হইয়া দেহী তুমি কিছুই জানো না।আরে কারো ঘর তল্লাশি করনের আগে হেই ঘর তল্লাশির অনুমতি নিতে হয় আছে অনুমতি?”

এ কথা শুনে আদ্য থমকে যায়। সত্যিই তো তার কাছে অনুমতি নেই। সে আহত চোখে পুলিশের দিকে তাকায় কিন্তু তিনিও অপারগ।এক প্রকার বাধ্য হয়ে তারা সেখান থেকে চলে আসলো।আসার সময় শাসিয়ে আসলো যে মেহুকে খুঁজে বের করবে।মোজাম্মেল সেই কথার উওর দিলো না একটা বড় হাই তুললো।

আজকে খাবার দিতে শুধু আজগর নয় মোজাম্মেলও এসেছে। চাচাকে দেখে সে মোটেও অবাক হলো না কারণ এসব কাজ যে তার করা সেটা মেহু জানে।

“আম্মা আপনের কোনো কষ্ট হয় নাই তো?আপনারে এরা খাওন দেয় তো?”

“আপনি জঘন্য জানতাম এতটা জঘন্য জানতাম না।কেনো আনলেন আমাকে?”

“আহা এভাবে কথা কও ক্যান।আমি তোমার বাবার বয়সী। তাছাড়া এহোন আমি তোমার অভিভাবক কিন্তু তুমি আমারে না জানাইয়া বিয়া করলা এটা ঠিক হইলো।আমারে কতো বেইজ্জতিই না করলা।সেসব আমি ভুইলা গেছি।তয় তোমারে এহানে আনার কারণ হইলো গিয়া তুমি যহোন আর এইহানে আসবা না আমাগো সম্পত্তি আমাগো দিয়া যাও।তোমার বাপে সব তোমার নামে কইরা গেছে তাই আমরা কিছুই করতে পারি না।এই নাও দলিল সই কইরা দাও।”

“আমি সই করবো না।এগুলো আমার বাবার সম্পত্তি আমি কেনো আপনাকে লিখে দিবো।”

“আরে মাইয়া কয় কি?এগুলো তোমার বাপের একার না। আমারও ভাগ আছে তয় আমার বাজান আমার ত্যাজ্য করছে বইলা সব তোমার বাপের হইছে।এত কথা কইতে ভালো লাগে না আমার তুমি সব লিইখা দাও তারপর তোমারে ছাইড়া দিমু।নইলে….”

“নাহলে কি করবেন?”

“নাহলে তোমার বাপ মারে যেমন লেক লাগাইয়া মারছি তোমারেও তাই করমু।অবশ্যি তোমার মতো দুধের মাইয়ারে একাই মারোন যায় তয় রিস্ক নিতে চাই না আরকি।এখন কও ভালোই ভালোই করবা?”

মেহু চাচার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায়। এ মানুষটা তার বাবা মাকে মেরেছে? এ মানুষটা তার জীবনের সকল সুখ কেড়ে নিয়েছে। মেহুর সারা শরীর জ্বলতে থাকে।সে ক্ষুধার্থ বাঘিনীর মতো মোজাম্মেলের ওপর হামলে পড়ে। তাকে নখ দিয়ে আঁচড়াতে থাকে।আজগর বাবাকে বাঁচাতে চেষ্টা করে কিন্তু পারে না।মনে হচ্ছে মেহুর মধ্যে আলির বল চলে এসেছে। মোজাম্মেল সজোরে একটা চড় দিতেই মেহু দেয়ালের সাথে বাড়ি খেয়ে জ্ঞান হারায়।

“মা**র তেল আইছে।আমার গায়ে হাত তুলে।এ মা**রে কিছু দিবি না।মরুক এ মাইয়া। ”

বলে হনহন করে বাপ ছেলে বের হয়ে গেলো।অনেক্ক্ষণ পর যখন জ্ঞান ফিরলো তখন মেহু বোঝার চেষ্টা করে কোথায় সে?মাথায় রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। শরীরে শক্তি নাই। সে আবারও ক্লান্ত ভঙ্গিতে জ্ঞান হারায়।

মেহুর যখন জ্ঞান ফিরে সে দেখে একটা সুন্দর রুমে সে শুয়ে আছে। রুমটা তার চেনা তবে কোথায় মনে করতে পারছে না।সে মাথায় হাত দিয়ে উঠার চেষ্টা করলো তখনি আমেনা খালা এসে দেখে মেহুর জ্ঞান ফিরেছে।তিনি চিৎকার করে সবাইকে ডাকলো।সাথে সাথে লুৎফা,নীলা সূচী আদ্য সবাই চলে আসে।মেহু বুঝতে পারে সে এখন আদ্যর রুমে আছে কিন্তু এখানে কি করে এলো সে?লুৎফা মেহুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

“মা তুমি শুয়ে থাকো।তোমার শরীর দূর্বল ডাক্তার জানিয়েছেন তোমার শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব সাথে যথেষ্ট পরিমানে প্রসার লো।তুমি গরম দুধটা খেয়ে শুয়ে পরো।আর কোনো ভয় নেই আমরা আছি তোমার পাশে?”

প্রায় দেড় দিন পর মেহুর জ্ঞান ফিরে।এরমধ্যে অনেক কিছু ঘটে যায়। মেহুকে পাওয়ার সম্ভবনা ছিল ক্ষীণ যদি না মেহুদের বাড়ির কাজের মেয়েটা তাদের সাহায্য না করতো।মোজাম্মেলের সাথে কথা বলে এসে আদ্য ইমিডিয়েট খবর পাঠায় যেন একটা তল্লাশি অনুমতি পত্র পাঠায়।আরিফ সেই অনুযায়ী কাজে লেগে পড়ে। আদ্য যখন অফিসারের সাথে আলাপ করছিল তখনি কোত্থেকে আধবয়সী এক মহিলা এসে তাদের কাছে দাঁড়ায়।ভয়ে এদিক ওদিক দেখে। আদ্য মহিলাকে চিনতে পারলো কারণ ইনিই মোজাম্মেলকে পান বানিয়ে দিচ্ছিলেন।আদ্য মহিলাকে বসিয়ে কারণ জিজ্ঞেস করতে তিনি গড়গড় করে সবটা জানায়।

মেহুদের বাড়ির পেছনে একটা সুরঙ্গ আছে সেখানেই তাকে আটকে রাখা হয়েছে।ওপর থেকে বোঝার উপায় নেই মাটির নিচে একটা ঘর আছে। কীভাবে সেখানে যেতে হবে সবটা তিনি জানালেন।আদ্য মহিলার কথা শুনে রেগে আগুন হয়ে গেলো।আর তখনি হাজির হয় ঐ বাড়িতে।মোজাম্মেল ওদের দেখে এগিয়ে আসতে আদ্য তাকে একটা ঘুষি লাগায়।মোজাম্মেল ছিটকে পড়ে।আদ্য পুলিশ নিয়ে বাড়ির পেছনে চলে যায় আর তথ্য মতে সেই সুরঙ্গটা পেয়ে যায়। সবাই মিলে সেখানে ঢুকলে একটা বড় ঘর দেখে তার একপাশে দরজা বন্ধ আরেকটা।সেটা খুলে আলো জ্বলাতেই মেহুকে এলোমেলো অবস্থায় পায়।আদ্য একটা কাপড় দিয়ে মেহুকে জড়িয়ে বাইরে আনে।তখনো তার অচেতন অবস্থা। পালস দ্রুত উঠা নামা করছ।তাড়াতাড়ি সেখানে সদর হাসপাতালে এডিমট করিয়ে মেহুকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনে।তারপর কড়া ঘুমের ঔষধ দিয়ে তাকে ঢাকার পথে রওনা হয়।আর ঢাকায় এসেই বাসায় রেখে তার চিকিৎসা হয়।এভাবে প্রায় দেড়দিন পর মেহু হুঁশে আসে।মোজাম্মেল আর আজগরকে পুলিশে নিয়ে গেছে।

মেহু আগে থেকে অনেকটা সুস্থ। এখন সে নিজের ঘরেই থাকে যদিও আগে থেকে সে নিজের ঘরে থাকতো।আদ্য তার অসুস্থ শরীর নিয়ে আদ্যর সাথে থাকতে বলে কিন্তু কোথাও যেন মেহু একটা আতঙ্কে ছিল আদ্য সেটা বুঝতে পেরে একটা কষ্টের শ্বাস ফেলে।তারপর মেহুকে নিজের ঘরে রেখে আসে সাথে আমেনা খালাকে বলে যেন সে মেহুর সাথে থাকে।সেই থেকে মেহু এখন নিজের ঘরে আছে।অনেকটা সুস্থ সে।আবারও স্বাভাবিক ভাবে জীবন করছে।তবে এরমধ্যে আদ্য অনেকভাবে মেহুর সেবা করেছে তার যত্ন নিয়েছে। তার প্রতি সদয় হয়েছে যা দেখে মেহু অনেকবার খুশিতে কান্নাও করেছিল।

মেহু বিছানায় ঘুমোনোর চেষ্টা করছে অথচ তার ঘুম আসছে না।বারবার একটা অস্থিরতা অনুভব করছে।মনে হচ্ছে আদ্য তার আশেপাশেই আছে। কিন্তু এতরাতে আদ্য কোত্থেকে? আমেনা খালা ভালোই ঘুমোচ্ছে কিন্তু মেহুর চোখে ঘুম নেই। অগত্যা বিছানা ছেড়ে মেহু ছাদে এলো আর দেখে আদ্য ছাদের শেষ কিনারায় গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। মেহু যাবে কি যাবে না ভেবে এগিয়ে গেলো?

“কি হলো এতরাতে না ঘুমিয়ে উঠে এলে যে?”

মেহু চমকে যায়। এখনো আদ্যর সামনে যায় নি অথচ কতো সহজ ভঙ্গিতে আদ্য তাকে বুঝে নিলো।মেহু কি বলবে বুঝতে পারলো না।মেহু সামনে না গিয়ে সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো।আদ্য পেছনে ফিরে মেহুর কাছে এগিয়ে আসলো।মেহু শাড়ীর আঁচলাটা কচলাতে থাকে।

“মেহু দাঁড়িয়ে পরলে যে।আমার কথায় কি ভয় পেয়েছো?”

মেহু মাথা নেড়ে না জানায়।আদ্য হেসে দেয়।কারণ মেহু ভয় না পেলে এক জায়গায় দাঁড়াতো না আর আদ্যকে সামনে দেখে মাথা নিচু করে রাখতো না।

“মেহু চলো ঐ জায়গায় গিয়ে বসি।আমার কেনো জানি মনে হচ্ছিল তুমি আসবে তাই আগে থেকে এখানে একটা চাদর বিছিয়ে রেখেছিলাম।কারণ তোমার সাথে বসে আকাশ দেখবো বলে।”

মেহু দেখলো সত্যি সত্যি আদ্য ছাদের এক পাশে একটা চাদর বিছিয়ে রেখেছে।তার মানে কি আদ্যর উপস্থিতি ছিল বলে মেহু এতক্ষণ অস্থিরবোধ করছিল।তাদের মধ্যে কি সত্যি এত টান!

মেহু গুটিগুটি পায়ে চাদরে গিয়ে বসলো।আদ্যও গিয়ে মেহুর পাশে বসলো।তবে কিছুটা ফাঁক আছে দু’জনের মধ্যে। কেউ কথা বলছে না।হঠাৎ আদ্য মেহুকে অবাক করে দিয়ে হাতে কোলে শুয়ে পরলো।

“মেহু মাথা ধরেছে একটু টিপে দাও না।”

আচানক আদ্যর এহেন কাজে মেহু থতমত খেয়ে ফেলে।কি করবে ভেবে হাত দিয়ে আসতে করে আদ্যর কপালে হাত রাখলো।আদ্য চোখ বুজে রইলো।

“মেহু অনেক কথা আছে যেগুলো দিনের আলোতে চোখে চোখ রেখে বলা যায় না।তাই রাতের আধারটা খুঁজে নিতে ভালো লাগে।তবে সব রাত সবসময় উপযুক্ত হয় না।যেমন ধরো আজকের রাতটাই আমাদের দু’জনের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়।তোমাকে কিছু কথা বলার ছিল তবে সুযোগ হচ্ছিল না।কেনো জানি আজকেই মনে হলো সেই সুযোগটা পাবো কারণ আজ আমার প্রিয় রাত।তুমি কি জানো আমি জ্যোৎস্না কতো পছন্দ করি?বিশেষত মেয়েরা জ্যোৎস্না পাগল হয় কিন্তু আমি তাদের চেয়েও বেশি।আকাশ থেকে জ্যোৎস্না নামলেই আমি আর ঘরে থাকি না উন্মুক্ত আকাশের নিচে এসে দাঁড়ায়।মেহু আমার জীবনের আনন্দময় প্রতিটি ঘটনা কিন্তু জ্যোৎস্নার সময় ঘটেছিল তাই এ রাতটা আমার কাছে সবসময় স্পেশাল। মেহু শুনছো?”

মেহু ছোট করে জবাব দিলো,হু!

“জানো মেহু তোমাকে যখন আমি প্রথম দেখি সেটাও কিন্তু জ্যোৎস্নার রাত ছিল।আমি ছাদে হাটছিলাম হঠাৎ তোমার জানলায় চোখ পড়তেই দেখি পরীর মতো একটা মেয়ে ঘুমচ্ছে।আমি অবাক হলাম এ ঘরে একটা কালো মেয়ে থাকে তাহলে এ মেয়ে কোত্থেকে এলো।তারপর তোমাকে দেখার জন্য কতরাত ছুটে আসতাম।এরপর কতো ঘটনা ঘটলো শেষে তোমাকে বউ হিসেবে পেলাম। যেদিন আমাদের বিয়ে হলো সেদিন বোধ হয় আমার মতো খুশি কেউ ছিল না।জ্যোৎস্না রাতের সেই পরীটা আমার বউ ভাবতেই আমার সারা শরীর খুশিতে দুলতে লাগলো।কিন্তু মনে সংশয় ছিল তুমি আমাকে ভালোবাসো কিনা কারণ তোমার দূরত্বে বারবার মনে হতো হয়তো তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে।কিন্তু না পরে বুঝলাম তোমার মনেও আমার জন্য একটু হলে অনুভূতি আছে সেটা বুঝলাম তখন যখন সোহানার সাথে আমার মেলামেশা নিয়ে তুমি জেলাস হতে।কতো যে আনন্দ পেতাম আমি বলা বাহুল্য। কিন্তু ভার্সিটি গিয়ে রাহাতের সাথে তোমাকে দেখে রাগ হলো।আর তাই তোমাকে কষ্ট দিতে শুরু করলাম।মেহু আমি জানি আমি অনেক অন্যায় করেছি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি কিন্তু তারচেয়ে হাজার কষ্ট আমি পেয়েছি।মেহু ছেলেরা কাঁদে না তারা চেষ্টা করে নিজেকে শক্ত রাখতে কিন্তু আমি কতোরাত কেঁদে পার করেছি তার হিসাব নেই। মেহু সেদিন হয়তো মাতাল ছিলাম কি বলেছি বা কি বলিনি জানি না তবে এ তিমিরে,নির্জন মধ্যদুপুরে তোমাকে আমি শুধু একটা কথাই বলবো,আমাকে ছেড়ে যেও না আমি পাগল হয়ে যাবো তোমাকে ছাড়া। অনেক ভালোবাসি মেহু অনেক ভালোবাসি!”

মেহুর কোলের দিকটা পুরো ভিজে গেছে কারণ আদ্যর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জল মেহুর শুষ্ক শাড়ীকে ভিজিয়ে দিয়েছে। আদ্য এত কথা বললো কিন্তু একবারের জন্য চোখ খুললো না।যদি খুলতো তাহলে দেখতো তার ভালোবাসার যন্ত্রণায় একটা মানুষ কতটা কষ্ট পেয়েছে। পরীক্ষা করতে গিয়ে সে ভালোবাসার মানুষটাকে কতটা আঘাত করেছে।হয়তো আদ্য জানতো চোখ খুললে সে মেহুর বিমর্ষ আর অশ্রুপাত চোখ দেখবে তাই নিজের অপরাধটা সে চোখ বন্ধ করেই স্বীকার করছে।

শূন্য জনমানবহীন একটা রাত যেন আজ শুধু তাদের। দুজনে কাঁদছে কেউ দেখছে কেউ বা অনুভব করছে।কিন্তু কারো মুখে কথা নেই। আদ্য পাশ ফিরে মেহুর কোমড় জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।আর মেহু আকাশের দিকে তাকিয়ে আদ্যর মাথায় হাত বুলাতে লাগলো।

আমেনা মেহুকে না পেয়ে দরজার দিকে তাকাতে দেখে দরজা খোলা।সে বের হয়ে আসতেই দূরে অস্পষ্ট দুজম মানুষকে দেখে। দেখেই বুঝতে পারে এরা কারা।আমেনা ওদের দৃষ্টির আড়ালে গিয়ে আবারও বিছানায় শুয়ে পড়ে। এ মুহুর্তে তার কাজ হচ্ছে শান্তিতে ঘুমানো।
,
,
,
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here