#সেদিনও_জ্যোৎস্না_ছিল
#তানিয়া
পর্ব:৩
টেবিলে সবাই খেতে বসল একমাত্র লুৎফা ছাড়া। মেহুর সন্দেহ হলো কারণ লুৎফা সবার আগে এসে তদারকি করে সবার চাহিদানুযায়ী খাবার সার্ভ হয়েছে কিনা কিন্তু আজ তিনি এলেন না।বিষয়টা মেহুকে ভাবাচ্ছে। তাই মেহু সবার পাতে খাবার দিতে শুরু করলো আর অপেক্ষা করলো লুৎফা আহসানের আসার।
ছোট খালাম্মাও আসছেন কিন্তু তিনি একা।টেবিলে বসতেই ছোট চাচা জিজ্ঞেস করলেন
“কি গো তুমি একা ভাবি আসবে না?”
“আর বলো না আপার নাকি গতকাল থেকে শরীর খারাপ। প্রেশারের নাকি সমস্যা করছে তাই তিনি এখন আসবেন না।পরে এসে খেয়ে নিবেন।”
কথাটা শুনে শাহেদ সাহেব বলে উঠলেন,
“কই আমাকে তো এ বিষয়ে কিছু বললো না।বেশি খারাপ লাগছে ডাক্তার ডাকবো?”
“না ভাইজান।একটু টক শরবত করে দিয়েছি।এখন রেস্ট নিচ্ছে। ভালো লাগলে খেয়ে নিবে।আপনারা শুরু করুন।”
সবাই খাওয়া শুরু করলো।কিন্তু মেহুর খারাপ লাগলো।কারণ সকাল বেলা সবার আগে মেহুর সাথে লুৎফার আলাপ হয় তিনি মেহুকে টুকটাক কাজ দিয়ে এদিক ওদিক হাটেন।আজকে এলেন না ভেবে চিন্তা হচ্ছিল। তাই সবার খাওয়া শেষ হতেই দ্রুত সবটা সেরে খাবার নিয়ে ওপরে গেলো।
“খালাম্মা আসমু?”
“আরে মর্জিনা এসো।নিচের সবার খাওয়া হয়েছে? ”
“জ্বি খালাম্মা। কিন্তু আফনে যান নাই ক্যান?”
“আরে বলো না শরীরটা খারাপ লাগছিলো তাই। তা তুমি এলে কেনো?কিছু বলবা?”
“খালাম্মা আফনার লাইগা খাওন আনছি।হগলে খাইছে আফনে ছাড়া তাই খাওন নিয়া আইছি।এহানে খাইয়া লোন আমি নিয়া যামু।”
লুৎফা বেশ সময় নিয়ে মর্জিনাকে দেখলেন।মনে মনে বললেন,
“কালো হলেও চেহারাটা বেশ মিষ্টি। নিশ্চয়ই খুব কষ্ট থেকে কাজ করতে এসেছে। ”
“আচ্ছা মর্জিনা তোমার বাসায় কে কে আছে?”
মর্জিনা হকচকিয়ে যায়।
“ক্যান খালাম্মা? ”
“না এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম।মানে তোমাকে যে মাস শেষে একটা বেতন দিবো সেটা কি বাড়িতে পাঠাবে নাকি নিজের কাছে রাখবে তাই জিজ্ঞেস করছিলাম?”
“আসলে খালাম্মা আমার বাপ মা অনেক আগে মইরা গেছে। গ্রামে এক বুইড়া চাচা আছে। তেনি আমারে বড় করছে তাই তার খরচ চালাতে মাসে মাসে টেহা পাঠানো লাগে।আমি তো এহানে খায়দায় থাহি এর লাইগা আমার আর কি খরচ। এহোন যদি আফনে কিছু টেহা দেন তইলে টেহাডা গেরামে পাঠামু।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। দিবো তোমাকে।”
“খালাম্মা আফনারে আরেকটা কথা কওনের ছিলো?”
“বলো”
“খালাম্মা আফনা গো আপত্তি না থাকলে আমি সকাল বেলা একটা কাম পাইছি।
আমারে কইছে ৫০০ টেহা দিবো।আমি করমু খালাম্মা? আফনে চিন্তা কইরেন না আমি ঘরের কামে হেলা করমু না। ”
“এখানে কাজ থাকতে আবার বাইরে কেনো?তাছাড়া তুমি বাইরে কাজ করলে এদিকে তো কাজ জমে যাবে। তোমার অসুবিধা হবে না?”
“না খালাম্মা হইবো না। আসলে একটা ছুডো মাইয়ারে স্কুলে আওন নেওয়া লাগবো।বাপ মা দুজনে চাকরি করে।তাই সকাল সাতটা বাজে দিয়া আমু নয় টায় নিয়া আমু।বাসায় দিয়া আইসায় ঘরে চলে আসমু।আফনে শুধু অনুমতি দেন খালাম্মা? ”
“আচ্ছা যাও তুমি যখন করতে চাইছো আপত্তি করবো না।তবে আমার কাজ যাতে পরে না থাকে তাহলে কিন্তু কাজ থেকে বের করে দিব!”
“আফনারে অসংখ্য ধন্নবাদ খালাম্মা। আমি আফনা গো কামে কোনোরূপ হেলা করমু না এই শপথ লইলাম।এবার খাইয়া লোন।”
মর্জিনার কথা শুনে লুৎফা হেসে দেয়।তারপর আনা খাবারগুলো নিয়ে খেতে বসে।খাওয়া শেষ হলে মর্জিনা এঁটো নিয়ে রান্নাঘরে যায়। কোনোরকমে একপাশে থালা রেখে আমেনাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো।আমেনা তখন মাছ ধুচ্ছিল।
“কি করো মাইয়া?আমি মাছ ধরছি গন্ধ লাইগা যাইবো তো?”
“আরে লাগুক গন্ধ। এখন তো মনের খুশিতে আমার মন টিকতাছে না।”
“কি হইছে এতো খুশি ক্যান?হাঙা হইবো নি?”
“কি যে কও খালা।আমার অহোন হাঙা।হুনো বড় খালাম্মা রে কইছি আমি সকালবেলার কামটা করমু।প্রথম প্রথম আপত্তি জানাইছে কিন্তু পরে রাজি হইছে।অহোন আমি কাল থেইকা রোজ সকাল সাতটা থেকে নয়টা পর্যন্ত বাইরের কাম করমু।তুমি পারবানা খালা এদিকটা সামলাইতে?”
“আমি পারমু মা।তই এইডা একটু কঠিন হইয়া গেলো না।আমার তো ডর করতাছে যদি ধরা খাইয়া যাও?”
“না খালা, দোয়া করো যাতে তেমনডা না হয়।ইনশাআল্লাহ আগামীকাল হইতে আমার নতুন কাম শুরু হইবো।”
ভোর পাঁচটায় ঘুম ভেঙে যেতে মেহু তাড়াতাড়ি করে পরিষ্কার হয়ে নেয়। দ্রুত করে হাতের কাছে পাওয়া কাজগুলো শেষ করে আমেনা খালাকে ডেকে দেয়। আমানে খালা মূল কাজগুলো ধরলে মেহু হাত হাতে সাহায্য করে ছয়টা বাজতেই আমেনা খালা তাড়া লাগায় মেহুকে।
“যাও মা। তোমারে অনেকটা পথ হাঁটতে হইবো।তুমি আর দেরী কইরো না।তাড়াতাড়ি যাও।চেষ্টা করবা সবাই ঘুম থেকে উঠার আগে চইলা আসতে।তাইলে ওরা আর তোমারে লইয়া সন্দেহ করবো না।”
“জ্বি খালা চেষ্টা করমু।তুমি একটু এদিকটায় সামলায় লও।আমি আইলাম।”
কথা শেষ মাত্রই মেহু দৌড়ে রুমে যায়। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বাহিরে বের হয় হাতে একটা পোটলা।এ পোটলাতে আছে তার জিনিস যা দিয়ে সে তৈরি হবে।
আজ ভার্সিটির এডমিশন কোচিং এর প্রথম দিন।অরিয়েন্টেশন ক্লাস হওয়াতে প্রচুর স্টুডেন্ট হয়েছে। মেহু ক্লাসে এসে থমকে যায়। এতো বেশি স্টুডেন্ট যে বসার জো নেই। এতো সকালে যদি এতো স্টুডেন্ট হয় তাহলে সারাদিনের অন্য ব্যাচগুলোতে কেমন হবে তা ভেবে ঘাম ছুটে যায় মেহুর।হঠাৎ একটা মেয়ে তাকে ডাক দেয়।
“এ মেয়ে শুনো,তুমি এখানে এসে বসো!”
মেহু পেছনে ফিরে দেখে তার থেকে দুই হাত দূরে বেঞ্চে বসা একটা মেয়ে তাকে ডাকছে।মেহু এগোতে পাশের মেয়ে টা বলে উঠে,
“কীরে তুই যে ওকে ডাকলি বসাবি কোথায় মাথার ওপর?”
বলে বাকিরাও হেসে উঠে। মেয়েটা ওদের কথায় পাত্তা না দিয়ে সবাইকে চাপতে বলে মেহুকে জায়গা দেয়।
“এটা কি ঠিক করলি? আমরা কি বসতে পারছি?”
“এখন থেকে বসার চেষ্টা কর,দেখছিস না হু হু করে স্টুডেন্ট বাড়ছে,যদি এরচেয়েও বেশি হয় তখন তো স্যার আরো স্টুডেন্ট বসাবে তখন যদি বসতে হয় তাহলে আগে থেকে ওকে নিয়ে বসে যাওয়াটা ভালো না?”
“তুই একটু বেশিই বুঝিস ধ্যাত!”
কথাটা বলেই মেয়েটা একটু চেপে বসে।
“হাই আমার নাম মুনা তুমি?”
“আমি মেহু!”
“ওহো!ইন্টার কোত্থেকে দিয়েছো?”
“আমি গ্রাম থেকে এসেছি। গ্রামেই দিয়েছি তুমি?”
“আমি এখানে থাকি।ভিকারুননিসা কলেজ থেকে ইন্টার পাশ করেছি।এখন পাবলিকের জন্য পড়বো।তুমি কোথায় কোথায় পরীক্ষা দিবে?”
“এখনোও বলতে পারছিনা তবে ঢাকার মধ্যে যেসব ভার্সিটি পড়ে সেগুলোতে দিবো।তুমি?”
“আমি মোটামুটি ঢাকা ছাড়াও অন্যান্য জেলাতেও পরীক্ষা দিবো।তোমার বাসায় কে কে আছে? ”
কথাটা শুনেই মেহুর বুকটদ ধ্বক করে উঠলো।কি উত্তর দিবে সে?
“কি হলো বলো কে কে আছে? ”
“আমার বাবা মা কেউ নেই তবে এক খালা আছে তার সাথে থাকি।”
“ওহ্ সরি কিছু মনে করো না।”
“না সমস্যা নেই। ”
মুনা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই স্যার চলে আসে।স্যার ঢুকেই বেশকিছু মোটিভেশান স্পিচ দেয় এরপর পড়া শুরু করে।
মেহু তাড়াতাড়ি করে বাসায় এসে দেখে আমেনা খালা একা হাতে নাস্তা বানাচ্ছে।
“খালা তোমার কাজ হয়েছে? ”
”
না মা এহোনো হয় নাই। এদিহে কিছু বাকি আছে তা তুমি চইলা আইলা কাম শেষ? ”
“হো খালা।বিশ্বাস করবা না কামডা শেষ হইতেই দৌড়াতে শুরু করছিলাম।মা গো কেমনে যে পৌঁছাইলাম।দাও দাও বাকিটা আমারে দাও আমি করতাছি তুমি রান্না দেখো।”
মেহু হাতের কাজটা কেড়ে নিতে আমেনা চুলার কাজে লেগে পড়ে। এরমধ্যে নীলা চলে আসে।
“আমেনা খালা আজকে আরাফের জন্য একটু বেলের শরবত করো তো!”
“আইচ্ছা খালা করমু নে!”
“কি গো মর্জিনা তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?মনে হচ্ছে অনেক যুদ্ধ করে এলে।কাপড়ের এ অবস্থা কেন?”
নীলার কথায় মেহু হকচকিয়ে যায়। তাড়াতাড়ি আমেনার দিকে তাকায় কিছু বোঝা যাচ্ছে কিনা।আমেনা ইশারাতে না বলে।
মেহু বুঝতে পারে রং এর সমস্যা নয় তাড়াতাড়ি করে ওড়না পেচাতে গিয়ে ভালো হয় নি।
“আরে ভাবি আর কইয়েন না।যুদ্ধ তো এক প্রকার লাগছিলো।আমি যে বেয়ান বেলা নতুন একটা কাম ধরছি হেইডা কইরা আইতে দেরী হইছে তাই একটু দৌড়াইতে হইলো।ভাবি বড় খালাম্মা আর ছোট খালাম্মারা কি উঠছে?”
“মা উঠেছে তবে চাচি এখনো উঠে নি।তা কি কাজ করছো?”
মেহু চুপ হয়ে যায়। আমেনা বুঝতে পেরে বলে,
“আরে ঐ মর্জিনা তাড়াতাড়ি লো অহোন খাওন দিতে হইবো।”
“ভাবি আফনে অহোন যান।মেলা কাম পইড়া আছে পরে কথা কমুনে।”
সাথে সাথে আরাফের ডাক আসে নীলা না ভেবে ওপরে চলে যায়। মেহু হাঁফ ছেড়ে বাঁচে!
,
,
,
চলবে……