প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প,২১,২২
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
|২১|
শেষ ফেব্রুয়ারির চমৎকার এক সকাল। আমি বসন্তের সুখ পাখিটির মতোই উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছি। গত রাতে ভয়াবহ এক দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনার পারদে মাপলে দুইশো পঞ্চাশ ডিগ্রি সেলসিয়াস ধরনের দুর্ঘটনা। দুইশো পঞ্চাশ ডিগ্রি সেলসিয়াস ধরনের দুর্ঘটনা ঘটিয়ে আমার উচিত অনুশোচনায় মরে যাওয়া। কেঁদেকেটে ভাসিয়ে ফেলা। ধ্রুবর প্রতি প্রচন্ড রেগে যাওয়া। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, আমার রাগ বা অনুশোচনা কিছু হচ্ছে না। যা হচ্ছে তা হলো আনন্দ। কালবৈশাখী ঝড়ের মতো তীব্র আনন্দ। এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে আনন্দিত হওয়াটা খুব লজ্জার। আমার উচিত লজ্জায় লাল, নীল, গোলাপি হয়ে যাওয়া। এবং আমি ইতোমধ্যে লাল, নীল, গোলাপি হয়ে যাচ্ছি। গতকাল রাতে হঠাৎ করেই ভীষণ বৃষ্টি শুরু হলো। আমি আর প্রিয়তা বারান্দায় বসে গানের সুর তুলছিলাম। এমন সময়ে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। বিশাল কালো চাদরে টুপটাপ মুক্তো ঝরে পড়ার মতো প্রাণবন্ত, সুন্দর। আমি কখনোই মায়ের মতো নই। আমার মা ছিলেন ভীষণ শক্ত মহিলা। উদাসী, জেদী, অনুভূতি প্রকাশে রিক্ত। আমি বোধহয় তার ঠিক উল্টো চরিত্রের নারী। তবে একটা মিল আমাদের আছে। বাবার ধারণা, এই মিলটা আমি পেয়েছি উত্তরাধিকার সূত্রে । মায়ের ছিলো রাতবৃষ্টির প্রতি অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ। বর্ষায় প্রায় প্রতি রাতেই মা বাবাকে নিয়ে ছাদে চলে যেতেন। কখনো বা যেতেন একা। কখনো সাথে থাকতো এক ফ্লাক্স চা। আমাদের ছাদের পাশে একটি কদম গাছ ছিলো। মাঝরাতে ছাদে উঠে মায়ের প্রথম কাজ ছিলো কদমফুল পেড়ে চুলে গুঁজা। তারপর দুই হাত মেলে নিরন্তর ভিজে চলা। মায়ের এই দোষটা আমি অক্ষরে অক্ষরে পেয়েছি। রাতের বৃষ্টির প্রতি আমারও টান অপ্রতিরোধ্য। বর্ষায় আমি ঘরে থাকতে পারি না। হিমোলিয়নের বাঁশিওয়ালার মতো সম্মোহিত হই, ছুটে যাই ছাদে। এবারও তাই হলো। প্রিয়তাকে নিজের মনোবাঞ্ছা জানাতেই প্রিয়তা দৌঁড়ে গিয়ে হাত-মুখ কাঁথায় ঢেকে শুয়ে পড়লো। ঘোষণা করল, বৃষ্টি মানেই ঘুমুনোর আহ্বান। অতএব সে ঘুমুবে। এসব বৃষ্টিবিলাস, টৃষ্টিবিলাশ তার দ্বারা হবে না। অসম্ভব। আমি হতাশ হলাম। অসহায় চোখে প্রিয়তাকে ঘুমের দেশে পাড়ি জমাতে দেখলাম। কিছুক্ষণের মাঝেই শহরজুড়ে নেমে এলো লোডশেডিং। পথের ধারের রাত বাতি থেকে শুরু করে গোটা শহরটা ডুবে গেল স্বর্গীয় অন্ধকারে। মুকুলের মতো ঝমঝমিয়ে পড়া বৃষ্টি যেন আচমকায় তার রূপ বাড়ালো। আমি আর বসে থাকতে পারলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম, একাই যাব৷ একা একা ছাদে যাওয়া আহামরি কোনো ব্যাপার না।
আমি দরজা খুলে খুব সন্তপর্ণে ছাদের দিকে এগোলাম। ঘড়ির কাটায় তখন বারোটা বাজে। এই মাঝরাতে ছাদের দ্বার খোলা থাকার কথা নয়। ছাদের দরজাটা বন্ধ থাকলে খুব মন খারাপের ব্যাপার ঘটবে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ছাদের দরজাটা খোলা। অন্ধকারে সিঁড়ি হাতড়ে কোনো রকমে ছাদের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম আমি। ছাদের দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকার ঠিক আগমুহূর্তে মনে হলো আমার থেকে হাতখানেক দূরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। চোখের দৃষ্টি আমার উপরই নিবদ্ধ। আমি বিজ্ঞানের ছাত্রী। ভূতপ্রেতে বিশ্বাস নেই। তবুও বুকের ভেতরটা ধরাস করে উঠল ভয়ে। মনে হলো, এক্ষুণি বুঝি ভয়ংকর চেহারার কেউ ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার উপর। আমার বৃষ্টিবিলাসের ভূত আপাতত নেমে গেলো। ভয়ে, আতঙ্কে শুকিয়ে আসা কন্ঠ নিয়ে পাশ ফিরে তাকালাম। আমার থেকে হাত তিনেক দূরে দীর্ঘদেহী একটা ছায়া চোখে পড়ল। চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। এক বিন্দু আগুনকে জ্বলতে নিভতে দেখা যাচ্ছে কেবল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। প্রচন্ড ভয়। আর ভয় পেয়েই উলোটপালোট কান্ড ঘটিয়ে বসলাম। অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে দৌঁড়াতে নিয়ে নিজের পায়ের সাথে পা বাঁধিয়ে ইহলোক ত্যাগ করার ব্যবস্থা করে ফেললাম। আমার যখন মনে হলো, এইবার মৃত্যু নিশ্চিত। অবধারিত। ঠিক তখনই শক্ত একটি হাত খপ করে আঁকড়ে ধরল আমার ডানহাতের কব্জি। এক টানে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে বিরক্ত কন্ঠে বলল,
‘ আহ! এতো তাড়া কীসের?’
নিরবিচ্ছিন্ন অন্ধকার থেকে মেঘমন্দ্র গম্ভীর কন্ঠটা ভেসে আসতেই ধপাস ধপাস ছুটতে থাকা হৃদপিণ্ডটা কিছু স্বস্তি পেলো। হাঁফ ছেড়ে বললাম,
‘ আপনি সিগারেট খান? হাতে ওটা কী? সিগারেট?’
ধ্রুব উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লো,
‘ কোথায় যাচ্ছ? এটা ছাদে যাওয়ার সময়?’
‘ বৃষ্টিতে ভিজব।’
‘ দরকার নেই। জ্বর হবে।’
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে নীরব প্রতিবাদ জানালাম। ধ্রুব বোধহয় আমার মনোভাব বুঝল। দীর্ঘকায় ছায়াটা এবার রেলিঙে ঠেস দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ আমাদের ছাদে ভূত আছে। ছেলে ভূত। এতোরাতে ছাদে গেলে ভূতে ধরবে।’
আমি ভ্রু কুঁচকে চাইলাম। ধ্রুব কী আমাকে বাচ্চাদের মতো ভয় দেখিয়ে ঠাট্টা করার চেষ্টা করল? আমি ভারিক্কি দৃষ্টিতে চেয়ে বললাম,
‘ আমি ভূতে ভয় পাই না।’
‘ হ্যাঁ, তা তো একটু আগেই প্রমাণ হয়ে গেল।’
আমি কয়েক সেকেন্ড বিরক্ত চোখে চেয়ে থেকে ধুম করে ছাদে গিয়ে ঝুম বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে পড়লাম। চোখের পলকে ভিজে গেল সমস্ত শরীর। দীর্ঘ ছায়াটা রেলিঙে ঠেস দিয়েই দাঁড়িয়ে রইলো। হয়তো এদিকেই চেয়ে আছে। আগুনের বিন্দুটা উঠানামা করছে। আমি সেদিক থেকে মন সরিয়ে আকাশের দিকে মুখ মেলে দাঁড়িয়ে রইলাম। ঠান্ডা জলের ধারাটা গা বেয়ে নেমে যেতেই অনুভূত হলো হৃদয়াচ্ছন্ন প্রশান্তি। আমি আড়চোখে আবার সিঁড়ি ঘরের দিকে চাইলাম। দীর্ঘ ছায়াটা এবার নড়েচড়ে উঠল। ফস করে এক টুকরো আগুন জ্বলে উঠে তামাটে এক জোড়া ঠোঁট আর টিকোলো নাকের দেখা দিয়ে আবারও অন্ধকারে ডুবে গেল। তারপর ধীর লহরে, আমার পাশে, ঝুম বৃষ্টিতে এসে দাঁড়াল। আমি আগের মতোই আকাশের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। পাত্তা না পেয়ে ধ্রুব মৃদু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
‘ তুমি যদি ভেবে থাকো আমি তোমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য এখানে এসে দাঁড়িয়েছি। তাহলে ভুল ভাবছ। আমি আসলে ছেলে ভূত। তোমার ঘাড়ে চাপতে এসেছি। তুমি আমাকে ধ্রুব ভেবে ভুল করছ।’
আমি বিরক্ত চোখে চাইলাম,
‘ ভূতেরা সিগারেট খায়?’
ধ্রুব হাসলো,
‘ কেন? ভূতদের সিগারেট খাওয়ার অধিকার থাকতে নেই?’
আমি উত্তর না দিয়ে ছাদের মাঝ বরাবর রাখা দোলনায় গিয়ে বসলাম। ধ্রুব সিগারেট খায় ব্যাপারটাতে খুব বিরক্ত হলাম। ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল। দীর্ঘদেহী ভূতটাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে অন্যদিকে চেয়ে রইলাম। অর্থাৎ, আমি কোনো সিগারেটখোর ভূত টূতের সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নই। ধ্রুব আমাকে থম ধরে বসে থাকতে দেখে দোলনার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে আচমকা দোলনায় প্রচন্ড এক ধাক্কা দিলো। দোলনা দোলে উঠে এগিয়ে গেল অনেকদূর। আমি প্রায় ছিটকে পড়তে পড়তেও বেঁচে গেলাম। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। ভয়ে থরথর করে উঠলো বুক। ভয়ে, আতঙ্কে প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বললাম,
‘ পাগল! পাগল আপনি?’
ধ্রুব শব্দ করে হেসে উঠল। ঝুম বৃষ্টির আওয়াজে তার হাসির শব্দটা ঢাকা পড়লেও আমি এই প্রথমবারের মতো ধ্রুবকে শব্দ করে হাসতে শুনলাম। দোলনাটা দোলতে দোলতে থেমে যাওয়ার আগেই ধপ করে আমার পাশে এসে বসে পড়ল ধ্রুব। আমি নিজের বুকে ফু দিতে অধৈর্য কন্ঠে বললাম,
‘ আপনার কী দুই সেকেন্ডও স্বস্তি নেই? চিওমিও এর থেকেও উশৃংখল আপনি।’
ধ্রুব যেন চিওমিও নামটা ঠিক ধরতে পারল না। একটু ভেবে বলল,
‘ চিওমিও? ওহ! কল্পর কথা বলছ?’
আমি উত্তর দিলাম না। বিরক্ত হয়ে বললাম,
‘ আপনি সিগারেট খান?’
ধ্রুবর সহজ স্বীকারোক্তি,
‘ হ্যাঁ, খাই। কেন? কোনো সমস্যা?’
আমি দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে রইলাম। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে ফুস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,
‘ আপনাকে আমি প্রথমে যেমন ভেবেছিলাম। আপনি আসলে সেরকম নন। অন্যরকম। আমার বর্ণনায় ভুল আছে। লেখিকা হিসেবে এতোবড় ভুল দৃষ্টি অন্যায়।’
ধ্রুব যেন খুব মজা পেলো। উৎসাহ নিয়ে বলল,
‘ কেমন ভেবেছিলে প্রথমে?’
আমি উত্তর দিলাম না। হাতে ধরা সিগারেটের দিকে চেয়ে বললাম,
‘ আমার সামনে এসব সিগারেট ফিগারেট খাবেন না। কী এমন আছে এতে যে এতো তৃপ্তি নিয়ে খান। অমৃত?’
ধ্রুব হাসি হাসিমুখে সিগারেট ঠোঁটে নিলো। একটা টান দিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে আয়েশ করে ধোঁয়া ছাড়লো। হেসে বলল,
‘ হ্যাঁ, অমৃত।’
আমি বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। ধ্রুব আচমকা আমার খুব কাছে এসে বলল,
‘ টেস্ট করতে চাও? আমি হেল্প করি?’
আমি চোখ রাঙিয়ে চাইলাম। ধ্রুবর ঠোঁটজুড়ে তখন সপ্রতিভ সরল হাসি। ভেজা ভেজা চঞ্চল দৃষ্টি। আমি সেই দৃষ্টিতেই আটকে গেলাম। চোখে চোখে চেয়ে থাকতে থাকতেই রাগ, বিরক্তি সব উবে গেল। আমি এক মুহূর্তের জন্য বিশ্বাস করে ফেললাম, ‘ এই বিশাল পৃথিবীতে ঠিক ধ্রুবর মতো করে কেউ তাকাতে পারে না। শুধুমাত্র চোখদুটোর মাঝে এতো এতো অনুভূতি, গাম্ভীর্য কেউ ধরে রাখতে পারে না।’ আমার বুকের ভেতর আবেগের ঝড় বয়ে গেল। প্রকৃতির থেকেও ভয়ঙ্কর, নিষ্ঠুর সেই ঝড়। বসন্তের বৃষ্টি, হাওয়ায় ভেসে আসা মাটি আর রজনীগন্ধার সুবাস সবকিছু কেমন অস্পষ্ট হয়ে এলো। যা কিছু স্পষ্ট রইলো তা কেবল ধ্রুব! ধ্রুব! ধ্রুব! আমি সম্মোহিতের মতো ধ্রুবর তামাটে গালে হাত রাখলাম। আমার শীতল হাতের স্পর্শে যেন চমকে উঠল ধ্রুব। আলতো কেঁপে উঠল। সকৌতুক দৃষ্টিতে নেমে এলো অনুভূতির জোয়ার। ‘কে প্রথম কাছে এসেছিলো?’– সেই প্রাচীন গানটির মতোই কে প্রথম পা বাড়িয়েছিলাম ঠিক মনে করতে পারি না। তবে তপ্ত, দীর্ঘ এক চুম্বনের সাক্ষী হতে ভুল করেনি প্রিয় বসন্ত।
সেই সিগারেট পোড়া বিশ্রী ঠোঁটে এমন সম্মোহিতের মতো চুমু খেয়ে যে পাপটা আমি করলাম? সেই পাপের লজ্জায় পরবর্তী দুটো দিন আমি গৃহবন্দী হয়ে বসে রইলাম। চোখে-মুখে লজ্জার সাথে সাথে ফুটে উঠলো অপ্রতিরোধ্য বন্য আনন্দ। জমিলা আপা বিস্ময় ধরে রাখতে না পেরে বার দুই বলেই ফেললেন,
‘ আইজ আপনারে খুব সুন্দর লাগতাছে বড় আফা। এক্কেবারে চাঁদের নাহাল সুন্দর।’
চাঁদের কথাটা বলতেই ধ্রুবর দেওয়া নামটির কথা মনে পড়ে গেল আমার। আবারও একরাশ কিশোরী লজ্জায় হাসফাস করে উঠল মন। আহ! আবারও সেই ধ্রুব! সেই সিগারেট খাওয়া বদ লোক! আমাকে উত্তর না দিয়ে লজ্জায় লাল হতে দেখে বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে চাইলেন জমিলা আপা। প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বললেন,
‘ আপনারে এহন গায়ে হলুদের কইন্যার মতো সুন্দর লাগতাছে বড় আফা। বিয়ার পানি গায়ে লাগলে মাইয়া গো যেমন লাগে তেমন। আপনে আর বড় ভাইজান চিপাই চুপাই বিয়েশাদী করে কেলেঙ্কারি ঘটায় ফেলেন নাই তো বড় আফা!’
আজ আর জমিলা আপার কথায় মন খারাপ করলাম না। রাগ করেও চাইলাম না। কেলেঙ্কারি সত্যিই একটা ঘটিয়ে ফেলেছি। অতি সত্যি কথায় রাগ করতে হয় না। আমি লজ্জা, অস্বস্তি আর নিষিদ্ধ আনন্দে চোখ-মুখ অন্ধকার করে বসে রইলাম। আমার এই হঠাৎ পরিবর্তনে প্রিয়তারও চোখ কপালে উঠলো। হঠাৎ রোদ, হঠাৎ বৃষ্টির কাহিনিটা বুঝতে না পেরে সন্দেহী চোখে চেয়ে রইল। গুণে গুণে দুইদিন বাদে বাধ্য হয়েই চার দেয়াল ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হলো আমায়। কিছুদিন হলো কাঁচিঝুলির কাছে একটি টিউশনি নিয়েছি। এভাবে আকাম ঘটিয়ে ঘরবন্দী থাকলে টিউশনি আমার টিকবে না। সুতরাং বুক ভরা সাহস নিয়ে দরজা পেরিয়ে বেরিয়ে এলাম। মনে মনে সহস্রবার ধ্রুবর সাথে দেখা না হয়ে যাওয়ার প্রার্থনা করলাম। কিন্তু বিধিবাম। ধ্রুবর সাথে আমার দেখা হলো। শুধু দেখায় হলো না, আমার জীবনে ভয়ংকর এক বিপর্যয় ঘটে গেল।
টিউশনি শেষ করে গোধূলির প্রায় শেষলগ্নে পার্কের একটি বেঞ্চিতে বসে প্রিয়তা আর অন্যান্য বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম আমি৷ ঠিক পাঁচটায় তাদের পার্কে আসার কথা। আড্ডা হয় না অনেকদিন। এখন চারটা পয়তাল্লিশ বাজে। তাদের আসতে আসতে আরো ঘন্টাখানেক দেরী। এক মুঠো ছোলা-বাদাম কিনে অলস মস্তিষ্কে অসংখ্য চিন্তার রঙ গড়াচ্ছিলাম। এমন সময় ব্রহ্মপুত্রের তীরে একটি পরিচিত চেহারা দেখে থমকে গেলাম। ধ্রুব নদীর তীর ধরে হাঁটছে। পাশে একটি মেয়ে। লম্বা-চওড়া, সুন্দর, ছিমছাম মেয়েটির গালে লজ্জার আভাস। ধ্রুবর ঠোঁটে স্বভাবজাত হাসি। আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম। তারা যে বন্ধু বা চিরচেনা কোনো আত্মীয় নয় তা তাদের আচরণেই উপলব্ধ হলো। আমার মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা হয়ে গেল। কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাব বুঝতে না পেরে বিভ্রান্ত চোখে চেয়ে রইলাম। ধ্রুব এবং সেই অপরিচিতা নদীর পাড়ের সিঁড়ি ভেঙে মূল পার্কের ভেতরে এসে ঢুকলো। আমি তখনও স্তব্ধ হয়ে চেয়ে আছি। কয়েক পা এগিয়ে আসার পর হঠাৎ আমাকে খেয়াল করল ধ্রুব। চোখে চোখ পড়া মাত্রই যেন চমকে উঠল তার সদা গম্ভীর দৃষ্টি। পা দুটো থমকে গিয়ে এক মুহূর্তের জন্য আমার দিকে চেয়ে রইল। ধ্রুবর এই চমক, থমকে যাওয়া যেন আরও বিভ্রান্ত করে দিলো আমায়। মুহূর্তেই সব স্পষ্ট হয়ে গেল। চোখদুটোতে ফুটে উঠল আহত অবিশ্বাস। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। নিজের অভিমানটুকু নিজের মাঝেই আবদ্ধ রেখে চুপচাপ উঠে এলাম। আমাকে উল্টোপথে হাঁটতে দেখে পিছু ডাকলো ধ্রুব। দ্রুত পা ফেলে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। অস্বস্তি নিয়ে বলল,
‘ তুমি এখানে? একা এসেছ?’
আমি শান্ত চোখে চাইলাম। ঠান্ডা কন্ঠে শুধালাম,
‘ মেয়েটি কে? আপনার বন্ধু?’
ধ্রুব আমার শান্ত মুখের দিকে অপলক চেয়ে থেকে পরিস্থিতি মেপে নিলো। ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,
‘ তোমার সাথে পরে কথা বলছি।’
আমি শান্ত জেদ নিয়ে বললাম,
‘ মেয়েটি কে তবে? প্রেমিকা?’
ধ্রুব উত্তর দিলো না। চোখ ফিরিয়ে দূরে বসে থাকা মেয়েটির দিকে চেয়ে বলল,
‘ এখানে সিনক্রিয়েট করো না নিশু। বাসায় যাও। এখানে আমার অনেক পরিচিত আছে। জুনিয়র আছে। স্ক্যান্ডেল হয়ে যাবে।’
আমি শক্ত কন্ঠে বললাম,
‘ মেয়েটি কে ধ্রুব?’
ধ্রুব হতাশ হলো। বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ ওর নাম সিন্থিয়া। ওর সাথে আমার বিয়ের কথা চলছে।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘ বিয়ের কথা চলছে? আর আপনি সেই মেয়েকে নিয়ে নদীর পাড়ে কাপলদের মতো ঘুরতে চলে এসেছেন?’
‘ তো?’
‘ তো? আর ইউ ইন্টারেস্টেড এবাউট হার?’
‘ ইয়েস্। আই অ্যাম।’
আমার পুরো পৃথিবীটা দোলে উঠল। অবিশ্বাস নিয়ে চেয়ে থেকে অস্পষ্ট কন্ঠে বললাম,
‘ তবে বাকিসব?’
ধ্রুব এবার খুব সহজ কন্ঠে খুব অপ্রত্যাশিত এক উত্তর দিলো,
‘ দেখো নিশু, বি প্রেকটিকেল। হ্যাঁ মানছি, তোমাকে আমার ভালোলাগে। কিন্তু বিয়ে করব এমন কিছু তো বলিনি? ভালোবাসা আর বিয়ে দুটো আলাদা ব্যাপার। তুমি দুটো ব্যাপারকে গুলিয়ে ফেলে প্লিজ সিনক্রিয়েট করো না।’
আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। জীবনের প্রথম ভয়াবহ অপমানে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ধ্রুব যে সিনক্রিয়েট, সিনক্রিয়েট বলে আতঙ্কিত সেই সিনক্রিয়েটটাই করলাম সবার প্রথম। জিরাফের মতো লম্বা, দীর্ঘদেহী ধ্রুবর গালে সজোরে একটা চড় বসিয়ে বললাম,
‘ জীবনের প্রথম আমি মানুষকে ঘৃণা করতে শিখে গেলাম। ট্রাস্ট মি, এতো ঘৃণা আমি আর কখনো কাউকে করবো না।’
হতভম্ব ধ্রুবকে পেছনে ফেলে আসতে আসতে নিজের প্রতিই প্রচন্ড ঘৃণা হলো আমার। ছি! আমার অবজারভেশন এতোটা জঘন্য! এতো নির্বোধ আমার মন? রাগে, অপমানে চোখদুটো টলমল করে উঠলো আমার। বিশ্বাসের দেয়ালগুলো বেলে মাটির মতো ঝরঝর করে ঝড়ে পড়ল। কল্পনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে শুনলাম ধ্রুবর হবু স্ত্রীর কন্ঠস্বর,
‘ কী হয়েছে ধ্রুব? আপনি ঠিক আছেন?’
‘ তেমন কিছু না। চলুন আপনাকে রিক্সা দেখে দিই। আমার একটু কাজ পড়ে গিয়েছে।’
আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম। মন ভাঙার করুণ আর্তনাদ। প্রথম প্রেমের নিদারুণ বিশ্বাস ভঙ্গে নিজের প্রতিই বড় মায়া হলো। ঘৃণা হলো তার থেকে বেশি। রাগে, দুঃখে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলতে ইচ্ছে হলো দেহের প্রতিটি রগ। ধ্রুবকে আরও দুটো থাপ্পড় দিয়ে বলতে ইচ্ছে হলো, ‘শুধু ভালো লাগা! শুধু ভালো লাগার বশবর্তী হয়ে কীভাবে আমায় স্পর্শ করতে পারলেন ধ্রুব! রুচিতে বাঁধলো না? একবারও না?’ সেদিনের রাতের কথা মনে পড়ে এই প্রথম আমার অনুশোচনা হলো। তীব্র পাপবোধ হলো। নিজের এই অধঃপতনে থতলে ফেলতে ইচ্ছে হলো পাপিষ্ঠ দেহ। সেই ভয়ংকর অনুশোচনায় তিলে তিলে ক্ষয়ে গিয়েই শেষ হলো আমার প্রথম প্রেমের গল্প! অ-প্রেমিকের দেওয়া অবিশ্বাসের গল্প। জীবনের প্রথম আমি কোনো মানুষকে ঘৃণা করলাম। ধ্রুবকে ঘৃণা করলাম। তার প্রতি অসীম ঘৃণা নিয়ে সেই বিকেলেই শুধুমাত্র কাপড় আর বইয়ের ব্যাগ হাতে বাসা ছাড়লাম। প্রিয়তা বিস্মিত হলো। আবির হতভম্ব হলো। একটা রিক্সা ডেকে আবিরের হতভম্ব, অসহায় মুখের দিকে চেয়ে বললাম,
‘ আমি তোমাকে আমার বড় ভাইয়ার মতো ভালোবাসি আবির। কিন্তু আফসোস! তোমার চেহারাটাকে আমি ভালোবাসতে পারি না। এই চেহারাটির প্রতি আমার আজন্মের ঘৃণা। এই ঘৃণা আজন্মেও কমবে না।’
#চলবে….
প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
|২২|
দ্বিতীয় অধ্যায়
সন্ধ্যায় এক পশলা বৃষ্টি হওয়ার পর পরই ভ্যাপসা গরম ছড়াল। হাওয়ায় ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ। পরিবেশটা থমথমে, নিশ্চুপ। মাথার উপর ক্যাটক্যাট করে ঘুরছে আদিযুগের বৈদ্যুতিক পাখা। বাতাস পাওয়া যাচ্ছে না। হাড় জ্বালানো গরমে অতিষ্ঠ হয়েই গরম চায়ে চুমুক দিলো ধ্রুব। বিশ্রী স্বাদ। টেবিলের উপর জমে থাকা ফাইলের স্তুপে নজর বুলিয়ে তিতকুটে স্বাদটা টনক নাড়ল মস্তিষ্ক পর্যন্ত। পুঁথিগত বিদ্যা আওড়ে চাকরি পেলেও হাতে কলমে আইন সামলানো বেশ মুশকিলের কাজ। ধ্রুব এই মুশকিলের কাজটা করছে দাঁতে দাঁত চেপে। দুইদিন আগে ধ্রুবর অধীনস্থ এক উপজেলায় জমি সংক্রান্ত তর্ক-বিতর্কে হত্যাহত্যির কান্ড ঘটে গিয়েছে। দায়িত্বে থাকা এসপি গোটা বিষয়টা ধ্রুবর কাঁধে ছেড়ে দিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে। এদিকে ধ্রুবর জীবন যায় যায় অবস্থা। এই মামলা নিয়ে দৌঁড়াদৌঁড়ির মাঝেই নতুন এক ঘটনা ঘটে গেল। টাঙাইল টু ময়মনসিংহ রোডে একটা বিবস্ত্র তরুণীর লাশ পাওয়া গিয়েছে। লাশের অবস্থা ভয়াবহ। টেলিভিশনে বড় বড় অক্ষরে ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছে, ‘ চলন্ত বাসে এক তরুণীর ধর্ষণ ও হত্যা। রাস্তায় পাওয়া গেল লাশ। স্থানীয় পুলিশ অপারগ।’ ধ্রুবর মেজাজ খারাপ হয়। অপারগ! অপারগ মানে কী? পুলিশ কী জানতো অমুক দিনে, অমুক তারিখে, অমুক সময়ে, অমুক নরপশু তার সেক্সিয়াল আর্জ নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পেরে এমন এক কান্ড ঘটাবে? আশ্চর্য! কাজের চাপে এমন এক নাভিশ্বাস অবস্থায় আবির জানাল, ‘ভাবী চলে গিয়েছে।’ ধ্রুবর মেজাজ খারাপটা এবার তরতর করে বাড়তে লাগল। ভাবী চলে গিয়েছে তো সে কী করবে? ভাবীর পা ধরে বসে থাকবে? যার চলে যাওয়ার সে যাবে, তাতে এতো অস্থির হওয়ার কী আছে? এতো আয়োজন করে তাকে জানানোরই বা কী প্রয়োজন? ধ্রুবর সবসময়ই চট করে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আজও হলো। কাজের চিন্তার সাথে সাথে আচমকা নিশুর জন্য চিন্তা হলো। টেবিলে স্তূপ হয়ে থাকা ফাইল ঘাটতে ঘাটতে হঠাৎ উপলব্ধি হলো, ধ্রুবর মন ভালো নেই। নিশুকে ব্যাপারটা যেভাবে বুঝাতে চেয়েছিল সেভাবে বুঝাতে না পেরে আফসোস হচ্ছে। নিশু নিশ্চয় তাকে দুশ্চরিত্র, লম্পট মনে করছে? মনে করুক। নিশুর মনে করা নিয়ে বিশেষ কিছু যায় আসে না ধ্রুবর। ধ্রুব ছোট থেকেই রিজার্ভড স্বভাবের ছেলে। আত্মগম্ভীর, আত্ম-অহংকারী। নিজের ইচ্ছা, আকাঙ্খার প্রতি সচেতন। তার এই আটাশ বছরের জীবনে নিজের কোনো চাওয়ায় সে অপূর্ণ রাখেনি। কোনো কিছুতেই কোনো সেক্রিফাইজ করেনি। আবিরকেও করতে দেয়নি। কিন্তু এবার সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
সাধারণ দৃষ্টিতে নিশু খুবই রূপবতী নারী। কাশ্মিরী আপেলের মতো টুকটুকে গাল। টসটসে ঠোঁট। একজন পূর্ণাঙ্গ পুরুষ হিসেবে রূপবতী নিশুর প্রেমে পড়ে যাওয়া ধ্রুবর জন্য ছিলো ফরজ কাজের মতোই অবধারিত। এই অবধারিত কাজটা ধ্রুব করেনি। নিশুর প্রেমে পড়েনি। নিশুর প্রেমে পড়ে যাওয়াটা কাশ্মিনকালেও তার পরিকল্পনার মাঝে ছিল না। আদতে নিশু সম্পর্কিত কোনো কিছুই তার পরিকল্পনায় স্থান পায়নি কখনো। নিশুর সুন্দর মুখ সম্পর্কে প্রথম থেকেই সচেতন ছিল ধ্রুব। প্রথম দেখায় অবাক হয়েছে কিন্তু কোনো আকর্ষণ বোধ করেনি। পৃথিবীতে বহু রূপবতী নারী আছে। সবার রূপ দেখে পিছলে যাওয়া উচিত কাজ নয়। বন্ধুদের দুষ্টুমি করে ছড়িয়ে দেওয়া এই গুজবে প্রথমটায় খুব বিরক্ত হয়েছিল ধ্রুব। পরবর্তীতে নিশুর হতাশ, ভয়ার্ত চেহারা দেখে কৌতুকবোধ করেছে। সব থেকে মজা পেয়েছে, নিশুর প্রেমে পড়ার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে। নিশু ধ্রুবর প্রেমে আকন্ঠ ডুবে আছে বুঝতে পেরেই নিশুর প্রতি তুলতুলে মায়া এসেছিল ধ্রুবর। খুব আলতো হাতে তাকে প্রশ্রয় দিয়েছিল। কষ্ট না দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বিধিবাম! ভার্সিটির পূনর্মিলন অনুষ্ঠানেই যা ঘটার ঘটে গেল। শাড়ি পরিহিতা নিশুকে দেখে ধ্রুবর মাথা ঘুরে গেল। তারপর থেকে মাথাটা দিনরাত ঘুরছে। সেই সাথে ঘুরছে নিশু নামের মেয়েটা। এই মেয়েটাকে এতো সুন্দর হতে হবে কেন? ধ্রুবর এই মুহূর্তে আলাওলের পদ্মাবতীর মতো নিশুর সৌন্দর্য নিয়েও লিখে ফেলতে ইচ্ছে করছে নারী সৌন্দর্যের মহাকাব্য। কিন্তু লেখা হচ্ছে না। ধ্রুব বিজ্ঞানের ছাত্র। এসব সাহিত্য টাহিত্য তার দ্বারা সম্ভব না। ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হাতের ফাইলটা বন্ধ করে ঘড়ির দিকে চাইল, বারোটা দশ। প্রায় মধ্যরাত। বাড়ি ফেরা উচিত। অথচ ফিরতে ইচ্ছে করছে না। গত দুইদিন যাবৎ বাড়ির বাইরে সে। থানাতেই রাত কাটিয়েছে। এখানে মশার খুব উপদ্রব, ঘুম ভালো হয় না। সারাদিন দৌঁড়ঝাপ করে নির্ঘুম রাত শরীরেও সহ্য হচ্ছে না।
‘ স্যার কী আজ থানাতেই থাকবেন? রাতের খাবার দিব? পুলিশ কোয়াটারের বাবুর্জির রান্নার হাত ভালো।’
মধ্যবয়স্ক কনস্টেবলের প্রশ্নে চোখ তুলে চাইল ধ্রুব৷ তারপর চোখের সামনে ফাইলটা মেলে ধরে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দিন তো।’
কনস্টেবল ঘাড় নাড়িয়ে সরে যেতেই আবারও ফাইল বন্ধ করল ধ্রুব। বাসায় ফিরবে কী ফিরবে না দু-টানায় শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ঘড়ির কাটায়। এই পৃথিবীতে মা সম্বোধিত মানুষটিকে সবথেকে বেশি ভালোবাসে ধ্রুব। নিজের থেকে, এই পৃথিবী, প্রিয়জন সবার থেকে বেশি ভালোবাসে। মায়ের একবিন্দু মানসিক কষ্টও তার বুকে তলোয়ারের মতো যুদ্ধ চালায়। রক্তাক্ত করে। সেই মা চাইছে ধ্রুব বিয়ে করুক। অতি অবশ্যই নিশুকে ব্যতিরেকে অন্য কাউকে বিয়ে করুক। বিয়ে করতে অবশ্য ধ্রুবর কোনো আপত্তি নেই। মায়ের কথায় যেকোনো মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি সে। সংসার করতেও কোনো বিবাদ নেই । কিন্তু একটা সমস্যা আছে। সমস্যাটা হলো নিশুকে নিয়ে। ধ্রুবর দেহ, মন ও মস্তিষ্ক অবিরল নিশুকে ভাবে। নিশুকে দেখার জন্য প্রাণ ফেঁটে যায়। মেজাজ খিটমিটে থাকে। এইযে দুইদিন ধরে নিশুকে দেখছে না এতেও তার মেজাজের পারদ ফেঁটে যায় যায় অবস্থা। থানায় রিমান্ডের আসামীদের অবস্থাও বেকাহিল। জীবন ওষ্ঠাগত। অধীনস্থ কর্মকর্তারাও শঙ্কায় অস্থির। সর্বোপরি, নিশুকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করলে ভয়াবহ ফ্যাসাদে পড়তে হবে ধ্রুবকে। দেখা গেল, ঘরে বউ রেখে তার নিশুর কথা মনে পড়ল। তাকে দেখতে ইচ্ছে করল। ছুঁতে ইচ্ছে করল। তাহলে ব্যাপারটা সরাসরি লম্পটের ক্যাটাগরিতে চলে যাবে৷ ধ্রুব নিজেকে আর যায়হোক লম্পট হিসেবে দেখতে চায় না। নিজের স্ত্রীর সাথে এমন অন্যায় আচরণ তার দ্বারা সম্ভব হবে না। ধ্রুব খুব অসহায়বোধ করল। ঠিক এই মুহূর্তে নিশুকে কাছে পেতে ইচ্ছে করল। কিন্তু মা? ধ্রুবর মায়ের বয়স খুব বেশি নয়। ধ্রুবর থেকে বড়জোর ষোল বছরের বড়। ধ্রুবর মা যখন কেবল নবম শ্রেণীর ছাত্রী তখনই আচমকা সেনাবাহিনীর এক অফিসারের সাথে বিয়ে হয়ে গেল তার। ধ্রুবর বাবা তখন ধ্রুবর মতোই তাগড়া যুবক। বয়স গড়িয়ে আটাশের কুঠায়। বিয়ের তিনমাসের মাথায় এই আদুরে স্কুল পড়ুয়া বাচ্চা মেয়েটা অন্তঃসত্ত্বা হলো। গর্ভে এলো ধ্রুব। তারপর শুরু হলো ভয়াবহ জীবন যুদ্ধ। সেই ভয়াল জীবন যুদ্ধ পেরিয়ে এতোটা পথ এগিয়ে আসা মাকে কী করে কষ্ট দেয় ধ্রুব? মা যদি নিশুকে শুধু অপছন্দ করতো তবুও সামলে নিতো ধ্রুব। কিন্তু সমস্যাটা তো মা-ছেলের বিশ্বাস আর আস্থায়৷ মায়ের এই প্রগাঢ় আস্থাটাই কী করে আঁচ আসতে দিবে ধ্রুব? ভাবতে গিয়েও কেঁপে উঠল ধ্রুব। বুকের ভেতর সুতীব্র এক ব্যথা খেলে গেল। চেয়ারের গায়ে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে কপাল চেপে ধরল। অতঃপর বিড়বিড় করে চলল, ‘নিশু, নিশু, নিশু, নিশু। তুমি আমায় শেষ করে দিয়েছ নিশু। ‘
ধ্রুব যখন বাড়ি ফিরল তখন রাত গড়িয়ে শেষ প্রহর। পুরো বিল্ডিংয়ে কোনো জনারব নেই। চারদিক নীরব, বিষণ্ণ। ধ্রুব দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে চারতলায় এসে থমকাল। নিশুদের নিস্তব্ধ ফ্ল্যাটের ঝুলন্ত তালার দিকে সেকেন্ড কয়েকের স্থবির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবারও পা চালাল দ্রুত। কাজের মেয়েটা দরজা খোলে দিতেই বসার ঘরটাকে বসার ঘর বলার অযোগ্য করে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকা কল্পকে চোখে পড়ল। ছেলেটা এখনও জেগে। চোখ-মুখ রাতের মতো অন্ধকার। অভিমানী। ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বসার ঘরের এহেন দশা দেখে কাজের মেয়েটিকে শুধাল,
‘ কী ব্যাপার?’
ঘুমে ঢুলতে থাকা মেয়েটি অসহায় মুখ করে বলল,
‘ ছোট ভাইজানের লগে কাইজ্জা লাগছে। ভাইজানের কলেজের থারুমমিটার না কি-জানি নষ্ট কইরা ফেলছে। ভাইজান কল্প ভাইজানরে ধইরা মাইর লাগাইছে।’
ধ্রুব বিরক্ত মুখে চাইল। মেয়েটার কথা শতভাগ সত্য নয়। আবির যতই চিল্লাপাল্লা করুক কল্পকে কখনো আঘাত করে না। বড়জোর ধ্রুবকে ফোন দিয়ে বিচার দেয়। ভয় দেখায়। কল্প আবিরের থেকে বিশ বছরের ছোট হওয়া সত্ত্বেও তাদের এই ঝগড়া কী করে চলে, এতো টপিক কোথায় পায়, বুঝে পায় না ধ্রুব।
‘ মা কোথায়?’
‘ খালাম্মা ঘুমায়। আমারে বলছে, বেশি চিক্কুর দিলে কল্প ভাইজানরে বাইরা ফেলাইয়া দরজা লাগায় দিতে। কল্প ভাইজান চিক্কুর না দিয়া মরার মতো পইড়া আছে বইলা বাইরে ফেলায় দিতে পারতাছি না। এখন কী করুম?’
ধ্রুব উত্তর দিলো না। সারাদিনের শারীরিক মানসিক পরিশ্রমের পর বিরক্তিতে কন্ঠে কথা জোগাচ্ছে না। ধ্রুব ধীর পায়ে কল্পর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। হাঁটু গেড়ে বসে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে নিজেকে সংযত করল। শান্ত কন্ঠে ডাকল,
‘ কল্প! ভাইয়া আসো।’
কল্প চোখ তুলে চাইল। অভিমানে ঠোঁট উল্টে চোখের পলকে ধ্রুবর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ভাইয়ের কাঁধে মুখ লুকিয়ে কেঁপে কেঁপে উঠল তার ছোট্ট দেহ। ধ্রুব সবল হাতে ভয়ার্ত ছোট্ট শরীরটি আগলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। চোয়াল শক্ত করে শীতল কন্ঠে শুধাল,
‘ মা মেরেছে?’
কাজের মেয়েটি মৃদু মাথা নাড়তেই হতাশ হলো ধ্রুব। মায়ের কিছু কিছু নিষ্ঠুরতা ধ্রুবর অসহ্য লাগে। ছেলেদের সাথে কঠিন হতে গিয়ে কাঠিন্যের সীমাও যেন ছাড়িয়ে যান মাঝেমাঝে। মায়েরা তো চির নমনীয়। মায়েদের কী এতোটা কঠিন হতে আছে?
‘ ভাইজান ভাত দিমু? খাইবেন এখন? কল্প ভাইজানও খায় নাই। রাইতের এগারোটা থাইকা এমনে পইড়া আছে। খাইতে কইলেও শুনে না।’
ধ্রুবর ক্ষুধা মরে গেল। অসহায় লাগল। কাজের মেয়েটিকে কঠিন একটা ধমক দিতে গিয়েও শীতল কন্ঠে বলল,
‘ খবরদার কখনো কল্পর গায়ে হাত দিবে না। যাও, ঘুমোতে যাও।’
মেয়েটিকে ফ্যাকাশে মুখে মাথা নেড়েই চোখের আড়াল হলো। আবিরের ঘরের আলো নেভানো। হয়তো ঘুমাচ্ছে। ধ্রুবর মেজাজ খারাপটা এবার সীমা ছাড়াল। কল্প তখনও শক্ত করে গলা ঝাপটে কাঁধে মুখ লুকিয়ে আছে। ধ্রুব নিজের ঘরে যেতে যেতে কল্পর পিঠে আলতো হাত বুলাল। মোলায়েম কন্ঠে ডাকল,
‘ কল্প? ভাইয়া?’
কল্প জবাবে আরও শক্ত করে গলা জড়িয়ে ধরে মুখ গুঁজে দিল ঘাড়ে। অর্থাৎ সে কোল থেকে নামবে না। ধ্রুব কিছুক্ষণ পায়চারি করে কল্পর ভয় কাটানোর চেষ্টা করল। কাজ হচ্ছে না। কল্পর পায়ে লাল হয়ে যাওয়া জখম দেখে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল ধ্রুবর। ছোট্ট, কোমল হাতেও তেমনই ছাপ। ইশ, এভাবেও কেউ মারে? নিজের অজান্তেই মোলায়েম হয়ে গেল ধ্রুবর কন্ঠস্বর,
‘ কল্প, ভাইয়া? উঠো। ক্ষুধা পায়নি? ভাইয়া চকলেট এনেছে।’
কল্প আগের মতোই শান্ত হয়ে পড়ে রইলো। ধ্রুব বলল,
‘ আমি ওদের সবাইকে বকে দেব। আর কেউ কল্পকে মারবে না। আচ্ছা?’
এবার কল্পর মান ভাঙলো। মুখ তুলে অভিমানে চোখে চাইল। কেঁদে কেটে ফুলিয়ে ফেলেছে বড় বড় দুটো চোখ। কল্পর মুখের দিকে চেয়ে থেকে নিজের মনেই হাসল ধ্রুব। একদম তার মতো দেখতে হয়েছে কল্প। নিশু কী একটা নাম বলেছিল? চিওমিও? ধ্রুব হেসে ফেলল। কল্পর নামটা চিওমিও-ই দেওয়া উচিত ছিলো। ফুলো ফুলো গালগুলোতে নামটা বেশ মানাতো। ধ্রুব আর নিশুর যদি কখনো বিয়ে হতো তবে নিশ্চয় তাদের ছেলে কল্পের মতোই দেখতে হতো? দাদি, বাবা, চাচা, ছেলে সবাই এক চেহারার মানুষ। নিশু নিশ্চয় মিনিটে মিনিটে বলতো? কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! নিশুর সদা বিভ্রান্ত ,আশ্চর্য চেহারাটা চোখে ভাসতেই শব্দ করে হেসে ফেলল ধ্রুব। পরমুহূর্তেই ঝুপ করে থেমে গেল সেই হাসি। খেয়াল হলো, এসব কী ভাবছে সে? আশ্চর্য!
রাতে আর ঘুম হলো না ধ্রুবর। ঘুমে নুইয়ে আসা চোখদুটোও হৃদয় পোড়ার যন্ত্রণায় খুব একটা স্বস্তি পেলো না। থেকে থেকে চাপা কষ্টে হাহাকার করে উঠল বুক। দীর্ঘশ্বাসের উপর দীর্ঘশ্বাস পড়তে পড়তেই পুবাকাশে লাল আভা ছড়াল। গলা ঝাপটে ধরে ঘুমিয়ে থাকা কল্পকে নিজের বুকের উপর থেকে নামিয়ে রাত ফুরিয়ে ভোরে এসে দু’চোখের পাতা এক করলো ধ্রুব। ঘুম ভেঙে তাড়াহুড়ো করে অফিসের জন্য তৈরি হতে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই দরজার সামনে এসে দাঁড়াল আবির। মন খারাপ করে বলল,
‘ ভাবী চলে গিয়েছে, জানো?’
ধ্রুবর বুকে চাপা অনুভূতির হুল্লোড় বয়ে গেল। আয়নার ভেতর দিয়েই আবিরের দিকে চাইল। আগে নিশুকে ভাবি ডাকা হলে খুব একটা গা করতো না ধ্রুব। কোনো অনুভূতি হতো না। কিন্তু সেই পূর্ণমিলন অনুষ্ঠানের পর থেকে কেমন বুক কাঁপে। আবিরের মুখে ভাবী ডাক শুনলেই মনে হয়, এই মোমের মতো সুন্দর রমণীটি কেবল তার। শুধু, শুধু এবং শুধুমাত্র তার। ধ্রুব নিজের মনোভাব গোপন রেখে শীতল কন্ঠে বলল,
‘ হ্যাঁ, জানি। রাতের নিউজে দেখাচ্ছিল, স্বামীর সাথে রাগ করে আবিরের ভাবীর বাপের বাড়ি প্রর্ত্যাবর্তন। সে দুঃখে আবিরের শয্যাশায়ী প্রাণ।’
আবিরের খুব মন খারাপ হলো। মর্মাহত হয়ে বলল,
‘ ভাবী চলে গিয়েছে আর তুমি মজা করছ ভাইয়া?’
‘ তোর ভাবী ভাবী শুনে মনে হচ্ছে, সে সত্যিই আমার বিয়ে করা বউ। রাগ করে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে বাপের বাড়ি হানা দিয়েছে! এসব রাবিশ, বাচ্চামো কথাবার্তা আমার সামনে আর বলবি না আবির। আরেকবার ভাবী ভাবী শুনলে, এক চড়ে দাঁত ফেলে দেব।’
ধ্রবর ধমকে খুব একটা হেলদোল দেখাল না আবির। কয়েক সেকেন্ড উশখুশ করে বলল,
‘ আমি ভাবীর সাথে দেখা করতে যাব৷ তুমি কী অফিসে যাওয়ার পথে আমায় ড্রপ করবে ভাইয়া?’
ধ্রুবর চোখদুটো ধক করে জ্বলে উঠল। চোয়াল শক্ত হলো। বিস্মিত হয়ে, জীবনের প্রথম সে উপলব্ধি করলো, নিজের ভাইকে সে প্রচন্ড ঈর্ষা করছে। নিশু আবিরের কাছাকাছি আসবে। কথা বলবে। ব্যাপারটা তার সহ্য হচ্ছে না। আবিরকে কষে একটা থাপ্পড় লাগাতে ইচ্ছে করছে। ধ্রুব তার ইচ্ছেকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রেখে চোয়াল শক্ত করে বলল,
‘ আজকে তোর বাইরে যাওয়া নিষেধ। ঘরে বসে পড়াশোনা কর। বাইরে বের হলে ডিরেক্ট লকাপে পুড়ব।’
#চলবে….