#চলো_রোদ্দুরে,08,09
#ফাতেমা_তুজ
#part_8
দুপুরে কল করেছিলো রাদ। বাসা থেকে মেডিকেল ক্যাম্পেইন এর উদ্দেশ্যে বের হয়েছে। নানান কথার সাথে উপদেশ ও দিয়েছে ওকে। সাথে দিয়েছি এতো এতো পড়া। বই গুলো স্পষ্ট আর সহজ ভাষা তে লেখা। তবে দু বছর বই খাতার থেকে দূরে অবস্থান করায় কেমন যেন আড়ষ্টতা কাজ করছে। মুখে বেজে যাচ্ছে প্রায় প্রতি টি লাইন। আর লেখার গতি হয়েছে অনেক ধীর। যাঁর ফলে ভীষন কান্না পাচ্ছে। পুরো বেডে ছড়িয়ে আছে বই। হঠাৎ দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ হয়। কিছু টা হতচকিয়ে উঠে ওহ। কলিং বেল এর আওয়াজ এমন বাজে হয় জানা ছিলো না। ঠক ঠক আওয়াজ এর বেল , মনে হয় দরজায় লাথি ঘুষি মারছে কেউ।স্কাফ নিয়ে উঠে যায় ওহ। দরজা খুলতেই অপরিচিত এক মহিলা কে দেখতে পায়। ভদ্রতার খাতিরে সামান্য হেসে বলে
_আপনি?
_টিউটর।
_টিউটর!
_হ্যাঁ।রাদ স্যার আমাকে পাঠিয়েছেন।
_ওহহ ভেতরে আসুন।
মহিলা টি ভেতরে এসে রাদ কে ফোনে ম্যাসেজ করে দেয়। তৎক্ষনাৎ কল আসে ভোরের ফোনে। ‘ ডাক্তার সাহেব ‘ নাম টি দেখেই ধিম ধিম আওয়াজ হতে থাকে অন্তকর্নে।হাসনা সামান্য হেসে বলেন
_আপনি যেতে পারেন। আমি ততক্ষণে আপনার বই গুলো চেইক করি।
_ওকে।
ব্যলকনিতে চলে আসে ভোর। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন কন্ঠ
_তুমি ঠিক আছো?
_জি আমি ঠিক আছি।আপনার শ্বাসের গতি এমন কেন?
_ বলো না আর। বাস মিস করে ফেলেছিলাম। গর্দভ গুলো তে আমার প্রতি খেয়াল ই রাখে নি।
_এখন ঠিক আছে সব?
_হুম। মিসেস হাসনা তোমাকে পড়াবেন। তুমি যেহেতু বই এর জগত থেকে অনেক টা দূরে ছিলে তাছাড়া এখন অনেক নতুন শব্দ আছে যা আগে কখনো দেখোই নি তুমি। তাই ওনাকে টিউটর রেখে দিলাম। রোজ তোমাকে পড়াবে।
_আচ্ছা।
_আর শোনো
_ হ্যাঁ বলুন।
_ টেবিলে মেডিসিন আছে খেয়ে নিও। মাথার ক্ষত টা কিন্তু বেশ ধারালো।
_হুম।
দুজনের মাঝেই নিরবতা ছেয়ে যায়। কে কি বলবে বুঝতে পারে না। ছোট করে রাদ বলে
_ ইচ্ছে হলে ফেসবুকে যেও। তবে অধিক আসক্ত হইয়ো না। আর যখন যেটা প্রয়োজন হবে কাউন্টারে খবর দিবে আর না হয় সোজা আমায় কল করবে।
_ আচ্ছা।
_রাখছি নিজের খেয়াল রেখো।
_আপনি ওহ।
_হুম
ফোন রেখে দেয় রাদ। কেন যেন মন খারাপ হচ্ছে খুব। এবারের ক্যাম্পেইন টা একদম ই ভালো হবে না ওর।
রুমে ফিরতেই মিসেস হাসনা বলেন
_আপনার জন্য আমি কিছু পড়া রেডি করেছি। যেহেতু এডমিশন টেস্ট এর জন্য এখনো পনেরো দিন বাকি তাই এগুলো পড়ে নিতে পারবেন।
_কিন্তু ম্যাম আমি এগুলো কিছুই বুঝতে পারছি না।
_ডোন্ট ওরি। রাদ স্যার আমাকে সব বলেছেন। একদম ই ভেঙে পরবেন না। মনে রাখবেন চেষ্টাই সফলতা।
_জি।
খুব সুন্দর করে পড়া বুঝিয়ে দেন হাসনা। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে টুক টাক কিছু কথা ও হয়। প্রচন্ড মিশুক তিনি। পড়াশোনা শেষ করে একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি তে জব করছেন।সাতাশ বছরের এই রমনী এখন দুই মেয়ের জননী। হাসনার কথা গুলো ভোর কে ভীষন ভাবে আকর্ষন করছে। গ্রামের মেয়ে বলে ভোরের প্রতি কোনো রকম হেজিটেশন নেই। বরং কথা বার্তা খুব ই সুন্দর আর স্বচ্ছ। পড়া শেষ করিয়ে চলে যান তিনি। ডোর লাগিয়ে ছুটে আসে ভোর। টেবিল থেকে ফোন টা বাঘিনীর মতো থাবা দিয়ে তুলে নেয়। ওয়াই ফাই অন করে ফেসবুক লগ ইন করে। সঙ্গে সঙ্গে কতো গুলো নোটিফিকেশন আসে। সেখানে একটা নাম উজ্জ্বল হয়ে ভাসে
‘ ইফতিহার রাদ ‘। ফেসবুক সম্পর্কে কিছু টা অবগত হয়েছে ভোর। সেই অনুযায়ী রাদের রিকোয়েস্ট টা এক্সসেপ্ট করে নেয়। তবে ভাবনায় পরে আইডি টা রাদ ওপেন করে দিয়েছে। সেক্ষেত্রে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিয়ে এক ঘন্টা ঝুলে থাকার কি প্রয়োজন ছিলো?
নিজেই তো রিকোয়েস্ট টা এক্সসেপ্ট করে নিতে পারতো। ছোট্ট মস্তিষ্ক টা এতো শত বুঝে উঠে না। রাদের প্রোফাইল টা ওকে খুব টানছে। তবে শ্বাস প্রশ্বাস কেন ভারী লাগছে?
.
রাতের মধ্য ভাগে এসে বাস থামে। এবারের ক্যাম্পেইন টা পাহাড়ি এলাকায়। বন জঙ্গলের সাথে কিছু টা পরিচয় হবে সকলে, সাথে সামাজিক সেবা। রাদের একটা বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। কিছু নির্দিষ্ট পাহাড়ি লতা দিয়ে ঔষধের রিসার্চ। এই কোর্স টা করেছিলো সে। যাঁর জন্য ছয় মাস পড়াশোনায় প্রচন্ড ক্ষতি হয়। ইনফেক্ট প্রথম সেমিস্টারে একটুর জন্য ফেল থেকে বেঁচে যায়।
তাঁবু গেড়ে থাকবে ওরা। সেই ব্যবস্থাই হচ্ছে। এ দিকে রনিত এসেই অশ্লীল কাজে ব্যস্ত। চোখ সরিয়ে নেয় রাদ। এরা তো নিউইয়র্ক সিটি কে ও হার মানাবে। সবার সামনেই কিস করে যাচ্ছে। ফোন অন করে হলো আরেক ঝামেলা। একদম ই নেট নেই। কিছু টা উপরের দিকে যেতে থাকে রাদ। পেছন থেকে নাহিদ বলে
_এই রাদ কোথায় যাচ্ছিস?
_নেটওয়ার্ক পাচ্ছি না।
_সেটা তো আগের ই জানা। পাহাড়ি এলাকায় প্রচন্ড নেট প্রবলেম। রাত অনেক ঐ দিক টা যাস না।
মন খারাপ করে ফেলে ছেলেটা। সন্ধ্যা বেলায় ভোরের সাথে কথা হয়েছে। যদি ও এখন মধ্য রাত তবে মেয়েটা ফেসবুকে আছে কি না সেটা তো দেখা যেত।
সবাই জড়ো হয়ে বসে। কুয়াশার কারনে বেশি দূর চোখ যায় না। আগুন জ্বালিয়ে বেশ আয়েসে বসে আছে দ্বীপ আর রায়া। একে অপরের দৃষ্টি গুনতে ব্যস্ত দুই কপোত কপোতি। এখনো ইনায়া আর রনিত একে অপরের সাথে চিপকে আছে। এবার বেশি বেশি ই হয়ে যাচ্ছে। দুজনের সামনে যেতেই দুজন দু দিকে ফিরে যায়। রাদ বলে
_মারবো এক চড়। যদি উল্টো পাল্টা চিন্তা করেছিস তো সর্বনাশ করে দিবো রাসকেল।
_কামন রাদ এটা অস্বাভাবিক নয়।
_বেশি পাকনামি করবি না রনিত। রায়া ইয়ানা আর সুপ্তি এক তাঁবু তে থাকছে। আর তুই আমার সাথে।
_কিন্তু ভাই এটা তো কথা ছিলো না। আমি তো ইনায়ার সাথে থাকবো ভেবেছি।
_নো ওয়ে।
চোখের ইশারায় ইনায়া কে ফোর্স করতে থাকে রনিত। বেচারির অবস্থা শোচনীয়। বার বার হাত কচলাতে থাকে। দুজনের দৃষ্টি বুজে রাদ বলে
_দেখ ইনায়া আমি সব মেনে নিলে ও এক সাথে থাকা টা কখনোই মেনে নিবো না। তোরা যেভাবে আগাচ্ছিস এতে করে দুজন থেকে তিন হতে সময় নিবি না।
_তোরা কথা বল। আমি গেলাম।
সামান্য লজ্জা পেয়েই চলে যায় ইনায়া। রনিত কে টেনে নিয়ে যায় রাদ। রনিতের গোমড়া মুখ দেখে বিন্দু মাত্র মায়া হয় না ওর।বরং চাঁপা রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে
_দেখ আমি তুই কিংবা ইনায়া কেউ ই কোনো বাচ্চা নই। মেডিকেলের স্টুডেন্ট আমরা। কোন টা কতো টা উচিত খুব ভালো করেই বুঝি। শারীরিক আর মানসিক দুটো ক্ষেত্রেই মানুষ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে তখনি যখন অধিক কাছাকাছি হয়। তখন ঠিক ভুল বুঝতে পারে না। আমার মনে হয় না আরো ভেঙে বলতে হবে তোকে।
_ব্রো নট ফেয়ার। আমি তোর হেল্প করলাম আর তুই।
_তুই কি তিন নাম্বার সদস্য নিয়ে আসার প্ল্যান করেছিস?
_মোটে ও না। আমি জাস্ট
মাথা চুলকোতে থাকে রনিত। পর পর দুটো কিল বসিয়ে রাদ বলে
_শালা বিয়ে কর আগে। এই ক্যাম্পেইন শেষেই আঙ্কেল কে বলবো আমি।
_পাক্কা?
_ইয়েস পাক্কা। তোদের ভরসা করতে পারছি না আমি।
রাদ আর রনিত দুজনেই চাঁপা হাসি তে মত্ত হয়। একটু দূরে দাঁড়িয়ে বুকে হাত গুঁজে এদের হাসি দেখতে থাকে সুপ্তি। চোখ পিট পিট করে বলে
_দুটোর মধ্যে ই বিশাল ঘাপলা আছে।
সকাল সকাল দাঁত ব্রাশ করার সময় নেই রাদের। ফোন টা নিয়ে চলে এসেছে আরেক প্রান্তে। ভোর কে কল না করা অব্দি শান্তি নেই। যদি ও এতো টা বিচলিত হওয়া বেমানান ই বটে তবে মেয়েটা এখনো অপরিচিত স্থানের সাথে মানিয়ে নিতে পারে নি। সেই কারনে অধিক চিন্তা। রিং হচ্ছে তবে ফোন রিসিভ করছে না। এবার ভয় হচ্ছে খুব। তাই হোস্টেলের কাউন্টারে কল করে। সেখান থেকে জানতে পারে ভোর না কি খেলছে। বিষয় টা অদ্ভুত লাগে ওর কাছে। সকাল সকাল এই বয়সে কি খেলছে মেয়েটা? এখন তো এক্সারসাইজ এর সময়।
সারা দিনে ফোন করার সময় হয় নি ছেলেটার। এতো টাই ব্যস্ত যে লাঞ্চ ও করে নি। তবে এবার রেস্ট এর প্রয়োজন। তিন বার এসে ডেকে গেছে দ্বীপ। শুধু মাত্র ওর জন্য কেউ ই খাবার খায় নি। প্রচন্ড খিদে তে পেট জ্বলে যাচ্ছে রায়ার। রাগ মিশ্রিত মুখে এসে দাঁড়ায়। এক পলক তাকিয়ে রাদ বলে
_আর একটু সময় দেয়, হয়েই গেছে।
রাদের পিঠে কখন থাপ্পড় পরে বুঝতেই পারে না। মেয়েটার হাতে এতো জোড়?
পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে রাদ বলে
_কম খা ইয়ার। শরীর টা কি বানাচ্ছিস দেখেছিস?
_তোর না দেখলে ও চলবে হুম। আমার বউ আমি বুঝবো।
_ওরে কান ধরে টান দিয়েছি এ তো দেখি মাথা ও হাজির।
রায়া ভেঙ্চি কেঁটে দ্বীপের গাঁয়ে গা এলিয়ে দেয়। সামান্য কেশে রাদ বলে
_এহেম ভাই। তোরা কাপল রা যা শুরু করেছিস এতে করে অতি শীঘ্রই আঙ্কেল ডাক টা কানে আসবে।
_বললেই হলো আমরা ওদের মতো অশ্লীল নই। আমাদের মাঝে দুরুত্ব থাকে সব সময়।
_ কাদের অশ্লীল বলিস হুম?
ইনায়ার কন্ঠ কানে আসতেই পেছন ঘুরে তাকায় সবাই। চোখ দুটো ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে ইনায়া। ফিচেল হাসে রাদ। এদের ঝগড়া দারুন লাগে। টান টান উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছে ঝগড়া লাগবে ঠিক তখনি কোথা থেকে সুপ্তি এসে বলে
_গাইস স্যার সবাই কে ডাকছেন।
সবাই সেই দিকেই এগিয়ে যায়। এতোক্ষন পর ফোনের কথা মনে পরে ছেলেটার। কাজের মধ্যে গেলে দিন দুনিয়া ভুলে যায়। লক স্ক্রিনে আঠারো টা মিস কল দেখেই বুক কেঁপে উঠে। ভোর কল করেছিলো ওকে?
তৎক্ষনাৎ কল করতে যাবে তখনি সুপ্তি এসে ফোন টা কেড়ে নিয়ে যায়। রাদ বলে
_ফোন দে বলছি।
_দিবো না। আগে বল মেয়েটা কে?
_সুপ্তি ফোন টা দে।
_আগে বল মেয়েটা কে।
ভ্রু কুঁচকে আসে রাদের। রনিত কে মাথা থেকে পা অব্দি পেটাতে পারলে শান্তি মিলবে। ছেলেটা কেন যে একে জানিয়েছে। ধীর পায়ে এগিয়ে আসে ওহ। পেছন থেকে সুপ্তির হাত ঘুরিয়ে বলে
_এতো শক্তি তোর?
_ব্যাথা পাচ্ছি রাদ।
_হুহ ব্যাথা পাচ্ছি রাদ।
রাদ কে নিজের অনুকরন করতে দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উটে সুপ্তি। তখনি স্যারের ডাক কানে আসে। ফোন টা ছো মেরে নিয়ে যায় রাদ। রাগে গজগজ করতে করতে আসে সুপ্তি।
ক্যাম্পেইন প্রধান স্যার কিছু বিবৃতি দিয়ে চলে যান। সুপ্তি আবারো সুযোগ খুঁজে। তবে সুযোগ মিলে না। সবাই সন্ধ্যার খাবার খেতে ব্যস্ত হয়। আর রাদ ফোন কলে। বেশ কয়েক বার চেষ্টা করে কল ঢুকে ভোরের নাম্বারে। ওপাশ থেকে ভাঙা গলায় ভোর বলে
_কেমন আছেন ডাক্তার সাহেব?
_সর্দি লেগেছে তোমার?
_উহুহ।
_তাহলে গলা টা ভাঙা কেন?
একটু থামে রাদ আবারো বলে
_কেঁদেছো তুমি?
এই সামান্য কথা যে কারো অভিযোগের বিশাল লিস্ট হতে পারে তা কল্পনার অতীত। কান্না মিশ্রিত কন্ঠে গরগর করে ভোর বলে
_ এতো বার কল করেছি আপনি রিসিভ ই করেন নি। আমি তো ভেবেছিলাম রেগে আছেন আমার উপর। কতো রকম চিন্তা হচ্ছিলো জানেন? এ শহর টা অজানা। মানুষ গুলো অজানা। এক মাত্র আপনাকে ভরসা করেছি ডাক্তার সাহেব। পুরো পৃথিবী এক দিকে আছে আর আপনি আরেক দিকে। এতো টাই ভরসা জমেছে আপনার উপর। আর আপনি কি না কল টা রিসিভ করেন না।
_আরে পাগলী মেয়ে একটা। এই সামান্য বিষয়ে কাঁদে কেউ? মেয়েরা বুঝি এমনি হয়। সারাক্ষন চোখের পানি ফেলতে ব্যস্ত। একটু কিছু হলেই চোখ লাল করে ফেলে।
_ডাক্তার সাহেব।
আবারো কান্নায় ভেঙে পরে ভোর। এবার চিন্তা হয় রাদের। বার বার বলে
_তুমি কি ভয় পাচ্ছো ভোর? কোনো অসুবিধা হচ্ছে তোমার।
_না হয় নি।
_তাহলে কষ্ট পেয়েছো ফোন রিসিভ না করায়?
_না কষ্ট পাই নি।
কথাতে প্রচুর অভিমান। হেসে ফেলে রাদ। ফোন নিয়ে ঘাসের উপর বসে। কচি ঘাসের পাতা ছিড়ে বলে
_পাহাড়ের উপর আছি আমি। এখানে নেট নেই বললেই চলে। আর সারা দিন ব্যস্ত ছিলাম। এই যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে ডিনার এর সময় হয়ে গেল অথচ আমি লাঞ্চ ও করি নি।
_সেকি আপনি লাঞ্চ করেন নি?
মুহূর্তেই ভোরের কন্ঠের সুর পাল্টে যায়। মৃদু হাসে রাদ। ভোরের আচারন ওকে মুগ্ধ করে। এক বার নয় বরং বার বার মুগ্ধ করে ওকে। শুধু মাত্র একটা ভালো পরিবারের অভাবে দু বছর পিছিয়ে গেল মেয়েটা। তবে থেমে থাকবে না ওহ। ওকে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যাবে রাদ। প্রতি টা মানুষের জন্য মোক্ষম জবাব হয়ে ফিরবে ভোর।
চলবে
#চলো_রোদ্দুরে
#ফাতেমা_তুজ
#part_9
সাত টা দিন এতো টা যন্ত্রণার কেন হলো বুঝতে পারছে না রাদ। প্রতি টা সেকেন্ড মন একটাই ইচ্ছে পোষন করে চলেছে আর সেটা হলো ফিরে চলো। অথচ এর আগে ও অনেক গুলো মেডিকেল ক্যাম্পেইন করেছে ছেলেটা। তখন মনে হয়েছে ইস আরেক টু সময় থাকতে পারলে ভালো হতো। এবার যেন সব এলোমেলো তবে কাজ কর্মে কোনো প্রভাব পরতে দেয় নি।বেশ ভালোই ব্যালেন্স করে চলেছে। তবে মনের শান্তি নেই।একটা বিশেষ পাতার সন্ধান ও করেছে। যেটা দিয়ে অনিদ্রার রোগ সারানো যায়। তবে আশংকা করা হচ্ছে এই পাতা ব্যবহার করে অনেকেই নেশা গ্রস্ত হতে পারে। যদি ও এখনো এর মেডিকেল প্রুভ বের হয় নি। কাঁধে ব্যাগ টা ঝুলিয়ে এই পাহাড়ি এলাকা কে এক বার দেখে নেয় রাদ। উহুহ পিছু টান নেই। কিন্তু এর আগের বার, ফিরতেই ইচ্ছে করছিলো না। অদ্ভুত কেমন।
_ আমি আগের স্টপে নামবো।
পাশ থেকে ভ্রু কুটি করে নাহিদ বলে
_কেন?
_একটু দরকার ছিলো।
_আমাদের ডিনার পার্টির কি হবে?
_আরে তোরা কর না। আমি অন্য সময় জয়েন হবো। আজ খুব দরকার। আসছি রে।
ব্যাগ নিয়ে নেমে যায় রাদ। ইচ্ছে করে দুই স্টপ আগে নেমেছে ছেলে টা। যাতে করে ধরা না পরে। সাথে তো গাড়ি নেই তাই এক টা সি এন জি তে করে ভোরের হোস্টেল এর সামনে আসে। সময় দশ টা বাজার দশ মিনিট বাকি। অর্থাৎ অনুমতি নিয়ে বেশি ক্ষন কথা বলা যাবে না। তাই আবারো সেই পথ অবলম্বন করে ছেলেটা। আজ ও একি ভাবে জানালায় মাথা এলিয়ে আছে ভোর। অভ্যাস হয়ে গেছে মেয়ে টার। রোজ এভাবেই মাথা রাখতো। যদি রাদ আসে এই অপেক্ষায়।
_এই মেয়ে।
_ডাক্তার সাহেব!
_ব্যলকনির ডোর খুলো।
_আমি আসছি, সাবধানে।
ডোর খুলে দেয় ভোর।ব্যলকনিতে পা রেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে রাদ। হাসি হাসি মুখে বলে
_কেমন আছো?
_ভালো। আপনি এতো রাতে?
_এমনি আসলাম আর কি।
_ওহহ। মাত্র ফিরলেন বুঝি?
_হ্যাঁ কাল সকালে কিছু তেই ছাড় পাবো না। তাছাড়া বিকেলে একটা আর্টিকেল রেডি করতে হবে। ড্যাড আবার কখন কি ধরিয়ে দেয় তাই এখনি আসলাম দেখা করতে।
কাউচে বসে রাদ। দু বার হাই তুলে বলে
_এই কয়েক দিন এক দম ই ঘুম হয় নি।
_কেন?
_পাহাড়ি মশা একটু একটু করে খুব যত্নে আমাকে কামড় দিয়েছে। ভুল বসতো স্প্রে নিয়ে যাই নি আমরা। আর সেই এলাকায় কোনো প্রতিরোধক ব্যবস্থা ও নেই। ভেবেছিলাম ডেঙ্গু জ্বর বাঁধিয়ে ফেলবো।দ্যান কিছু পাহাড়ি পাতার সাহায্য মশার থেকে বেঁচেছি।
_আচ্ছা। আপনি কি ফ্রেস হবেন?
_হওয়া ই যায়। আজ অনেক টা সময় আড্ডা দিবো।
মাথা ঝাঁকায় ভোর। ওয়াসরুম থেকে ফ্রেস হয়ে আসে রাদ। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে গেলেই ভোর বলে
_এটা আমার ব্যবহার করা তোয়ালে।
এক পলক তাকিয়ে আবারো মুখ মুছে রাদ। অবাক হয় ভোর। বেডে উঠে বসে রাদ বলে
_তোমার টা সমস্যা নেই।
_তবু ও।
_বেশি কথা বলো তুমি। এখন বসো তোমার জন্য গিফ্ট এনেছি।
_গিফ্ট?
_হুমম। কাছে আসো।
পাশা পাশি বসে ভোর। ভোরের চোখে হালকা হাতে হাত বুলিয়ে বলে
_ক্লোজ ইউর আই।
চোখ বন্ধ করতেই ঝনঝন আওয়াজ এসে কানে বিঁধে। কেন যেন শব্দ টা বেশ ভালো লাগে ওর কাছে। ফট করেই চোখ খুলে ফেলে। রাদ তখন কিছু একটা বের করছিলো। ওকে দেখে বলে
_নট ফেয়ার। একদম ই ঠিক হলো না। সারপ্রাইজ বলে কিছুই রইলো না। তুমি চিটিং করলে।
_এটা কি ডাক্তার সাহেব?
_মুক্তোর মালা।
_ওহ আচ্ছা। ছোট সময়ে মেলা থেকে অনেক গুলো কিনেছিলাম আমি। খুব ভালো লাগে আমার।
_উহুহ ঐ গুলো নয় এটা। ঐ গুলো তো রিয়েল না। এটা একদম খাঁটি মুক্ত দিয়ে গড়া।
রাদের দৃষ্টি তে দৃষ্টি দেয় মেয়েটি। শুভ্র সুন্দর মুখে অবিশ্বাস্য কর চাহনি। ইশারায় কিছু একটা বলে রাদ। তবে সেটা বোধ গম্য হয় না। বেড থেকে নেমে গিয়ে ভোরের এলোমেলো চুল গুলো এক পাশ করে মুক্তোর মালা টা পরিয়ে দেয় ওকে। দারুন এক হাসি উপহার দেয় ভোর। সোজা মিররের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।নিজেকে পর্যবেক্ষন করতে ব্যস্ত হয়। সে দিকে তাকিয়ে থাকে রাদ। অল্প তে খুশি হওয়া মানুষ গুলো সত্যি খুব ভালো হয়।মিররের মাঝ দিয়ে রাদ কে দেখতে থাকে ভোর। সেই স্বচ্ছ হাসি টা যেন ওকে আঘাত করে চলেছে। চোখ নামিয়ে বলে
_জানেন ডাক্তার সাহেব আমার খুব ভালো লাগে এমন উপহার। অনেক ইচ্ছে হতো কেউ আমাকে উপহার দিক। কিন্তু সে ইচ্ছে টা কখনোই পূরন হয় নি। সবাই আমার ছোট ভাইয়ের জন্য খেলনা নিয়ে আসতো কিন্তু আমার জন্য কিছু নিয়ে আসতো না।
মেয়েটির কথায় হিংসে নয় বরং অভিমান ফুটে উঠেছে। অবেহেলা কতো টুকু ব্যথিত করে সেটাই ফুটে উঠেছে। রাদ অনুভব করে মেয়েটি বড্ড অভিমানী। অল্প তেই অভিমান জুড়ে বসে। আর এ তো বিশাল পরিমানের অবহেলা। শ্বাস বন্ধ হয়ে মরে যায় নি এটাই তো বেশি।
‘ মিসেস হাসনা বললেন তুমি নাকি পড়া শোনায় খুব চটপটে। স্কুলে রোল কতো ছিলো? ‘
_ লাস্ট ইয়ার যখন এস এস সি দিয়েছিলাম তখন 4 ছিলো। তবে এর আগে 2 অথবা 3 হতো সব সময়।
_ কখনো ফার্স্ট হও নি?
_উহুহ। ফার্স্ট বয় ছিলো চেয়ারম্যান এর ছেলের। কিন্তু একদম ই পড়াশোনা পারে না ওহ। প্রতি টা ক্লাস টেস্টে ফেল করতো। অথচ ফাইনালে টপ করতো।
_হুম বুঝলাম। বিশাল পরিমানে চোর যাকে বলে। হোয়াট এভার, কলেজে ফার্স্ট গার্ল হতে হবে কিন্তু। ইউ নো হোয়াট তোমার ডাক্তার সাহেব একটা পাগল ছিলো। কখনো কেউ হারাতে পারে নি। তবে ক্লাস টেনে আমি ফার্স্ট বয় থেকে সেকেন্ডে এসে গিয়েছিলাম। যে পরিমানে কান্না করেছিলাম আমি নিজে ও জানি না। ইনফেক্ট ফার্স্ট বয় যে ছিলো ওহ নিজেই স্যারের কাছে গিয়ে বলেছিলো স্যার রাদ কে ফার্স্ট দেওয়া যায় না।
ফিক করে হেসে উঠে ভোর। কেটলি থেকে গরম পানি ঢালতে ঢালতে রাদ বলে
_বিশ্বাস হচ্ছে না তোমার? এটা একদম সত্যি বলছি। বাট ভারসিটি তে গিয়ে কিছু টা পিছিয়ে গেছি। এতো এতো ট্যালেন্ট এর মাঝে টিকে থাকা কষ্ট ই বটে। তবে টপ থ্রি থেকে কখনোই সরাতে পারে নি। শুধু মাত্র সেমিস্টার এক্সামে ফেল হতে হতে বেঁচে ছিলাম।
_কেন? ফেল হতে বেঁচে ছিলেন কেন?
_আরে বলো না। যখন মাথায় যা আসে আর কি। ওর জন্য মম আমাকে বকে ছিলো। বি কজ মেডিসিন এর কোর্স টা করি কেউ ই চায় নি। বাট আমার খুব ভালো লেগেছিল। আর ফার্স্ট সেমিস্টার টা আমার কাল হয়ে গেল। 1’5 এর জন্য ফেল করি নি। ইসস কি লজ্জা।
প্রচন্ড হাসি পায় ভোরের। স শব্দে হেসে উঠে মেয়েটা। সাউন্ট প্রুভ রুম নয় এটা খেয়াল হতেই ভোরের মুখ চেপে ধরে রাদ। ফিস ফিস করে বলে
_ হুশশ সাউন্ড বাহিরে গেলে কেলিয়ে বের করবে আমায়। আসো একটা ড্রিঙ্কস পান করা যাক।
_কি সেটা?
_আই হেব সাম ক্যাডবেরি চকলেট বল। আর এখন চকলেট বল দিয়ে হট চকলেট বানিয়ে ফেলবো। আসো দেখাচ্ছি।
.
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই এক্সারসাইজ শুরু করেছে রাদ। ইফতিহার কিছু টা অলস ই বটে। রামিসা ডাকাডাকি না করলে ঘুম থেকে উঠতেই চান না। জগিং করতে করতে গার্ডেনে আসেন তিনি। রাদ তখন পুশ আপ করতে ব্যস্ত। টান টান উত্তেজনায় চল্লিশ খানা পুশ আপ নিমিষেই করে ফেলে রাদ। তবে এখন অনুভব করে শরীর ব্যাথা হতে শুরু করে। আরো দশ টা পুশ আপ দিয়ে উঠে যায়। ইফতিহার বলে
_আমি ভেবেছিলাম সেঞ্চুরি টা করবে তুমি। বাট কখনোই সেঞ্চুরি করো না। এটা ঠিক নয় বেটা।
_লিসেন ড্যাড। আমি কেন আমার বাপ দাদা ও সেঞ্চুরি করে নি। সেখানে আমি কেন করবো?
_হুম বুঝলাম। তুমি নাই করতে পারো বাট আমার দাদু ভাই সেঞ্চুরি করবেই। আর সেটা যদি না করাতে পারি তবে আমি ও ইফতিহার খান নই।
হট তোয়ালে গিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ইফতিহারের পাশে বসে রাদ। ওয়াটার বোতল থেকে কিছু টা পানি পান করে বলে
_যদি তোমার দাদু ভাই না আসে?
_হুমম চিন্তার বিষয় ই বটে। সমস্যা নেই আমি আমার নাতনি কে দিয়েই সেঞ্চুরি করাবো। আই উইস সে তোমার মতো গর্দভ না হয়।
_ড্যাড।
ইফতিহার বেঞ্চ থেকে উঠে আবারো জগিং এ নামে। রাদের মনে হলো এখন এক বার ভোর কে দেখা দরকার। এখন রোড ফ্রি আছে আর এই সময়ে একটু স্পিড দিয়ে ড্রাইভ করলে ত্রিশ মিনিটেই পৌছে যাবে। যেহেতু ছয় টা বাজে মাত্র। আর আকাশে এখনো কিছু টা অন্ধকার সেহেতু টাইম লি পৌছাতে পারবে। হোস্টেল এর এক্সারসাইজ শুরু হয় সাড়ে ছয় টার পর।
ঘুমু ঘুমু চোখে টলমলে পায়ে হোস্টেল থেকে গ্রাউন্ড এ বের হয় ভোর। কুয়াশার কারনে এখনো হোস্টেল এর এপাশ ওপাশ দেখা যাচ্ছে না। সবাই অলরেডি এক্সারসাইজ শুরু করে দিয়েছে। ভোরের মনে হলো আজ ও একটু বেশি ই লেট করে ফেলেছে। হবেই তো কাল রাতে একটার পর ঘুমিয়েছে। রাদের হট চকলেট এর পাল্লায় পরে এক ঘন্টা সময় লস হয়েছে। বহু কষ্টে সফল হয়েছে। বাট পড়া আদান প্রদান করতে করতে কখন যে বারো টা পেরিয়ে গেছে খেয়াল ই ছিলো না। সাড়ে বারো টার দিকে চলে গেছে রাদ। আর ওর ঘুমাতে ও দেরি হয়েছে। তাই তো আজ লেট। সাধারনত সবাই কিছু স্পেসিফিক এক্সারসাইজ করছে। যাঁর কোনো টা তেই ধারনা নেই মেয়েটার। তাই তো বাচ্চা দের মতো দড়ি লাফ খেলে। অবশ্য এতে ও বেনিফিট আছে।ভোর কে দেখেই এগিয়ে আসে তিন্নি। মুখে সামান্য হাসি ফুটিয়ে বলে
_গুড মর্নিং ম্যাম। আপনি আজ লেট করলেন যে?
_গুড মর্নিং। আসলে আপু কাল অনেক টা রাত করে ঘুমিয়েছি তো তাই।
_ওহহ। আজ কে ও স্কিপিং করবেন?
_হ্যাঁ ঐ টাই বেটার আমার জন্য।
_ওকে।
দড়ি নেওয়ার জন্য তিন্নি পা বাড়াতেই পিছু ডাকে ভোর। বলে
_তিন্নি আপু।
_ইয়েস ম্যাম।
_আমার সাথে দড়ি লাফে যোগ দান করবেন?
_দুজন এক সাথে স্কিপিং করবো?
_হ্যাঁ আপনি শুধু আমার পায়ের সাথে পা মেলাবেন।
_গ্রেট। ছোট সময়ে অনেক খেলেছি আমি। দড়ি নিয়ে আসছি আমি।
তিন্নি ছুট লাগায়। গেটের কাছ থেকে ভোর কে দেখে চলেছে রাদ। অনেক টা আড়ষ্টতা কাঁটিয়ে নিয়েছে। বেশ ভালো লাগে ওর কাছে। খেলার সাথে সাথে এক্সারসাইজ ও হয়ে যাচ্ছে। ঘড়ির কাঁটা টা টিট টিট করে বেজে উঠে। অর্থাৎ সাত টা বেজে গেছে। গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যায় রাদ।
বি : দ্র : ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।
চলবে