‘সাঁঝক বাতি-‘ নূরজাহান আক্তার (আলো) [০২]

0
486

-‘সাঁঝক বাতি-‘
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[০২]

প্রণয়ের অসংখ্য রুপ। ক্ষেত্রবিশেষ হাসি কান্নার কারণও বটে। তবুও এব্যাধিতে অাক্রান্ত শতশত মানব। দিনশেষে কেউ হাসে, কেউ পুড়ে। নতুবা
প্রাণনাশের পন্থা অবলম্বন করে। তবে হাস্যকর হলেও, অনেকে লোকসম্মুখে নিদারুন অভিনয় করে। এত ত্রুটিশূন্য অভিনয় বোঝাও মুশকিল। যদিও মানবজাতি অভিনয়ে পারদর্শী। এজন্যই
বুঝি; অভিনয়কে তারা স্বকীয়ভাবে কাজে লাগায়। শুধুমাত্র ধরণটাকে ভিন্নরুপে রুপান্তরিত করে।
_____________________________

সিগ্ধ সকাল! পাখিদের গুঞ্জরণ ভেসে আসছে।
অনেক মানুষ রাস্তায় হাঁটতে নেমে পড়েছে। কেউ শখে কেউ বা বাধ্য হয়ে। দিগন্ত হেঁটে মসজিদ থেকে বাসায় ফিরছে। সচারচর মসজিদে সালাত আদায় করে সে। এতে প্রশান্তি অনুভূত হয়। সুখ সুখ লাগে। এখন যেমন হচ্ছে। চেনা মানুষদের সঙ্গে কথা বলে ধীর পায়ে হাঁটছে। মনটাও ফ্রেশ। কিন্তু বাসার কাছে আসতেই সে ভ্রুজোড়া কুঁচকে নিলো। গেটের সামনে বাইকে একটা ছেলে বসে আছে। সাধারনত বাসায় সুন্দরী মেয়েরা থাকলে বখাটেরা উঁকিঝুঁকি মারে। আশেপাশেও ঘুরঘুর করে। ওরা দুই ভাই! প্রশান্ত আর দিগন্ত। বোন নেই। মেয়ে বলতে সর্বদা মা আর ভাবি থাকেন। গতকালকে শিফা এসেছে। শিফাকে তো চেনার কথার না। বখাটের এত সাহসও হবে না। কারণ ওরা স্থানীয় সবাই চেনে। তাহলে এই ছেলে কে? আর এখানে কেন? দরকারে এসেছে? নাকি বিপদে পড়েছে? বাইকের তেল শেষ হতেও পারে।বেশভূষা উচ্চমানের তবে দেখতে অগোছালো লাগছে। দিগন্ত মনমতো যুক্তি না কষে এগিয়ে গিয়ে বলল,
-‘কাউকে খুঁজছেন?’
-‘শিফাকে ডেকে দেওয়া যাবে?’
-‘তা রাস্তায় কেন? বাসায় চলুন।’
-‘না, অন্যদিন।’
দিগন্ত এত বলেও ছেলেটাকে নিয়ে যেতে পারল না। তাই বাসায় ডুকে শিফাকে খুঁজে, ডাকল। শিফা রান্নাঘরে শাশুড়ির সঙ্গে কাজ করছিল। খুব সকালেই উঠেছে। এটা ওর পুরনো অভ্যাস! শিফা দিগন্তের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। ওর দৃষ্টির মানে বুঝে দিগন্ত জানাল, বাইরে কেউ ওর অপেক্ষায় আছে। হয়তো চেনা কেউ। শিফা রান্নাঘরের দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
-‘আমি কী যাবো?’
-‘রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলা বেমানান। উনাকে বাসায় নিয়ে এসো।’
-‘আচ্ছা।’
শিফা ওড়নাটা মাথায় টেনে বেরিয়ে গেল। দিগন্ত ড্রয়িংরুমে বসল। ব্যাপারটা সে স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে। শিফা বাইরে গিয়ে দেখে, এটা স্বপ্নীল। ওকে এখানে মোটেও আশা করে নি সে। ছেলেটা এমন কেন? দিগন্তের বাড়ির লোক দেখলেই বা কী ভাববে? তার তো বোঝা উচিত, আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। বাস্তবতা গ্রহন করা বুদ্ধিমানের কাজ। সেটা যতই কষ্টসাধ্য হোক! না, সুযোগ দেওয়া যাবে না। নয়তো পাগলামি বেড়ে যাবে।
শিফা দ্রুতপায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল। রাগটাকে দমন করে কঠোর কন্ঠে বলল,
-‘বিরহ সহ্য করতে না পারলে, বিষ খান। তবুও ভুলেও আমার সামনে আসবেন না। কী, এক্ষুণি
বিদায় হোন।’

স্বপ্নীল ছলছল চোখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
বুকে অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে। সারারাত নিরবে অশ্রু
ঝরিয়েছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। অথচ এই মেয়েটা বুঝেও বুঝছে না। নিষ্ঠুরতা কেন শিফা? এমন তো ছিলে না? আমার কষ্টটা অনুভব করে তো দেখো, কতটা কষ্ট বুকে জমেছে। ভালোবাসি
কথাটা হয়তো বলা হয় নি। সিগ্ধ অনুভূতিগুলো কখনো প্রকাশও করি নি। তুমি তো সব জানতে, বুঝতেও। তাহলে সব জেনে কেন এত নিষ্ঠুরতা? এতবছরের যত্ন করে গড়া আমার ভালোবাসাকে,
এভাবে হেলা করো না। মানতে পারছি না। বুকে অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে। মুখে বলি নি বিধায় শাস্তি? শাস্তিটা আমার শান্তি কেড়ে নিচ্ছে, একটু সদয় হও। ব্যাপক কষ্টে দগ্ধ হচ্ছি। চোখের তৃষ্ণা আর মনের খোরাক মিটাতে বেহায়া হয়ে ছুটে এসেছি।
স্বপ্নীল মনে মনে এসব বললেও মুখে বাক্‌শূন্য।
শিফা আশেপাশে তাকিয়ে সতর্ক হয়ে নিলো।না, আর দাঁড়ানো ঠিক হবে না। ভুল বুঝতে পারে।
তাছাড়া রাস্তায় কথা বলা দৃষ্টিকটু। স্বপ্নীল কিছু বলার আগে শিফা বলল,
-‘সাফার ভাই বিধায় ভদ্রতা দেখাচ্ছি। নয়তো
বুঝিয়ে দিতাম। এখানে যেন আর না দেখি।’
-‘তোমার কেউ হই না?’
-‘না।’
-‘মেয়েরা তো নরম মনের হয়। তাহলে তুমি এত
নিষ্ঠুর কেন শিফা?’
-‘ফালতু কথা বন্ধ করুন। না আপনার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল, না হবু বউ ছিলাম। সম্পর্ক ছিল, সাফার ভাই হিসেবে। সাফ নেই, সম্পর্ক’ও শেষ। এখন খেঁজুরে আলাপের সময় নেই।এবার বিদায় হোন।’

শিফা একরাশ বিরক্ত নিয়ে তাকিয়ে স্থান ত্যাগ করল। অহেতুক কথা বাড়ানোর মানেই হয় না।
সে আর পিছু ফিরল না। সে সব জেনে, বুঝে,
স্বজ্ঞানে করেছে। তাই পিছু ফিরে মায়া বাড়ানো
অনর্থক। যা ইচ্ছে বলে চলে গেল। অপরজনকে কিছু বলার সুযোগও দিলো না। স্বপ্নীল দুইহাতে চোখ মুছে বাইকে উঠে বসল। ঝাপসা দু’চোখে রাস্তা দেখা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। কত চেষ্টা করেও অশ্রু থামাতে পারছে না। মনটা পুড়ছে বিধায় দু’চোখ ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। সেও কাঁদছে, কষ্ট পাচ্ছে। তাহলে ওর মানুষটা বুঝছে না কেন? সে কেঁদে বুকে মুখ লুকাচ্ছে না কেন? একবার ডেকে বলছে না কেন, স্বপ্নীল আমি তোমাকেই চাই।’
সে আর ভাবতে পারছে না। পুরো শরীরের শক্তি যেন কেউ শুষে নিয়েছে। মস্তিষ্কও ফাঁকা লাগছে।
স্বপ্নীল একবার গেটের দিকে তাকিয়ে, ছুঁটল এক অজানা পথের দিকে। মনটা বড্ড অশান্ত।শান্তি খুঁজতে হবে। এখন তার শান্তির প্রয়োজন। তা
নয়তো দম আটকে মারা যাবে। সিগ্ধ সকালটা আজ বিষাদপূর্ণ। চারিপাশটা যেন বিষাদে ছেঁয়ে
গেছে। শাস্তি আর সুখের আকাল। হয়তো তার মন পুড়ছে তাই সবকিছু এমন লাগছে। কথাতে আছে, ‘যার পুড়ে সে বুঝে। বাকিরা মজার পন্থা খুঁজে।’ ওর ক্ষেত্রেও তাই। স্বপ্নীল অনেক ভেবে বোনের কাছে যাচ্ছে। আদরের বোন চিরনিদ্রায় মগ্ন। শত ডাকলেও আর আসবেনা। কষ্ট পাচ্ছে দেখে বলবে না, ‘ভাইয়া কষ্ট পাস না। শিফুকে আমি বকে দিবো।’ একথাটা আর কখনো শোনা হবে না। কারণ বলার মানুষটা এখন অন্ধকার
কবরের বাসিন্দা।

শিফা বাসায় ঢুকে রান্নাঘরে গিয়ে পুনরায় কাজে হাত লাগাল। জা, শাশুড়ির সঙ্গে খাবারগুলো সাজিয়ে রুমে গেল। একটু ফ্রেশ হওয়া দরকার।
দিগন্ত অফিসে যাবে। গোসল সেরে কেবল বের হয়েছে। শিফাকে দেখে বলল,
-‘ছেলেটা এসেছে?’
-‘না, সে আসবে কেন?’
-‘পরিচিত কেউ, আসলে সমস্যা কোথায়?’
-‘সাফার ভাই। বিয়ের কথা শুনে দেখা করতে এসেছে।’
-‘সাফারা যখন ভাড়া থাকত, তখন ছেলেটাকে দেখিনি।’
-‘ওদের বাসায় কাজ চলছিল। তাই পাঁচ মাসের মতো এখানে থেকেছে। আর ভাইয়া কানাডাতে থাকত। সাফার মৃত্যুর খবর শুনে কিছুদিন হলো এসেছে।’
দিগন্ত আর কথা বাড়াল না। হঠাৎ বিয়ে হয়েছে, দেখা করতে আসা স্বাভাবিক।আর সাফার ভাই, শিফার পূর্ব পরিচিত। সাফা নেই! শিফাকে খুব
স্নেহ করে তাই হয়তো এসেছিল। দু’জনেই ফ্রেন্ড।
নেগেটিভ ভাবার কিছু নেই। দিগন্ত এই ব্যাপারে অযথা জলঘোলা করল না। নির্বিরোধী মানুষ, ঝামেলা থেকে দশহাত দূরে থাকে। এমনই সে।
শিফা ফ্রেশ হয়ে শাশুড়ির ডাকে বেরিয়ে গেল। একটুপরে, দিগন্তও রেডি হয়ে নাস্তার টেবিলে বসল। সবাই উপস্থিত রয়েছেন। শিফা আর নিহা (জা) মিলে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। টেবিলে হরেক রকমের নাস্তা সাজানো, যে যেটা খাবে। প্রশান্ত নিহাকে পানি দিতে ইশারা করে শিফাকে বলল,
-‘শিফা কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?’
-‘জি না ভাইয়া।’
তখন দিগন্তের বাবা কেশে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন,
-‘দিগন্ত, বিয়ের অনুষ্ঠানটা করে ফেলতে চাচ্ছি। বিয়ের কথা সবাইকে জানানো দরকার।’
-‘জি বাবা। যেটা ভালো হয় করুন।’

শিফা নির্বাক হয়ে শুনল। কিছু বলার প্রয়োজন মনে করছে না। উনারা পরশুদিন অনুষ্ঠান সেরে ফেলতে চাচ্ছে। দিগন্ত মতামত জানিয়ে একবার শিফার দিকে তাকিয়ে রুমে চলে গেল। শিফাও ‘আসছি’ বলে রুমে গেল। দিগন্ত তখন রুমের
যাওয়ার ইশারায় করেছে। হয়তো কিছু বলবে।
শিফা রুমে ঢুকতেই দিগন্ত বলল,
-‘অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তোমার মতামত কী?’
-‘মতামত নেই।’
-‘কি কি লাগবে নোট করে দাও। আসার সময় নিয়ে আসব।’
শিফা মৃদু হেসে কাগজে কিছু লিখে দিগন্তের হাতে ধরিয়ে চলে গেল। দিগন্ত ওর যাওয়ার দিকে একবার তাকিয়ে চিরকুট খুলে দেখে,

-‘আসার সময় হাসি কিনে আনবেন। আর হ্যাঁ,
হাসির মালিক যেন দিগন্ত’ই হয়। অন্যের হাসি আমার সুট করে না। মনগহীনে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
দেখা দেয়। এর ফলাফলও ভয়ংকর হয়। এজন্য দিগন্তের হাসিই লাগবে।’

চিরকুটটা পড়ে দিগন্ত মুচকি হাসল। এই হাসিতে কৃত্রিমত্তা নেই। মনে অন্তস্থল থেকে হাসির জন্ম,
এজন্য বুঝি এতটা প্রাণবন্ত। আর মেয়েটা সত্যি পাগলি। ওর কার্যকলাপে বেশ বুঝেছে। নয়তো বিয়ের জন্য এত পাগলামি কেউ করে। এজন্য প্রথমবার বিয়েতে না বলে, দ্বিতীয়বার ফেরাতে পারে নি। এত ভালোবাসা ফিরানোর সাধ্য ওর নেই। তবে মেয়েটা খুব শক্ত ধাঁচের। আর পাঁচটা মেয়ের মতো আবেগপ্রবণ নয়। বুদ্ধিমতীও বটে। ‘সুন্দরী মেয়েরা বোকা হয়।’ এই যুক্তিটা শিফার ক্ষেত্রে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বরং প্রমাণ করছে, ‘মেয়েদের মনও শক্ত হয়। এতটা শক্ত, না কারো অশ্রুতে ভিজে না আর্তনাদে গলে।’
ওদের পথচলা কেবল শুরু। শক্তমানবীকে সিক্ত প্রণয়ে কাঁবু রাখবে। এসব ভেবে দিগন্ত পুনরায় মুচকি হাসল। তখন শিফা পর্দার আড়াল থেকে মুখ বের করে বলল,
-‘হুম, হুম, এই কোম্পানিরই হাসি লাগবে।’
-‘পুরো কোম্পানিই তোমার। শোন..!’

দিগন্তকে কিছু বলতে না দিয়ে শিফা চলে গেল।
ক্ষুধা পেয়েছে। খাওয়া দরকার, নয়তো ওর মাথা কাজ করবে না। শাশুড়ির পাশে বসে খাওয়াতে মনোনিবেশ করল। আহা, পেট শান্তি তো দুনিয়া শান্তি। আর দুনিয়া শান্তি করতে বুদ্ধির দরকার।
আর খাবার বুদ্ধি বাড়তে সহায়তা করে। অর্থাৎ
প্রয়োজন খাবার ও বুদ্ধি। তবেই না বাজিমাত!
ততক্ষণে দিগন্ত ঠোঁট কামড়ে হেসে চিরকুট’টা বুকপকেটে রেখে বেরিয়ে গেছে। তার ভাষামতে, মেয়েটা অদ্ভুত! তবে চিরসঙ্গী হিসেবে মন্দ নয়।

শিফার ওর মামার সঙ্গে কথা বলে ফোন কাটল।
ওর ভ্রুজোড়া কুঁচকে আছে। কপালে দুই আঙ্গুল ঘষে ভাবনায় মগ্ন। তখন ওর শাশুড়ি রুমে এসে বললেন,
-‘শিফা, কি ভাবছো?’
-‘ভাবছি, আপনাদের ঘোল খাওয়াব।’
-‘মানে?’
-‘না মানে, মামার সঙ্গে কেবল কথা বললাম। উনি বললেন ঘোল স্বাস্থ্যের জন্য খুব উপকারী।
এতে নাকি ঘুম ভালো হয়। একাধিক মিনারেলস ও অ্যান্টিঅক্সিড্যান্সে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ায়। কোলেস্টেরলের মাত্রা এবং ব্লাড প্রেসার কমায়। এজন্য রোজ একগ্লাস করে ঘোল খাওয়া দরকার। আমার মামি একজন ডাক্তার। এজন্য কথায় কথায় ঘোলের কথা উঠল আর কি!’

কথাগুলো বলে শিফা মুচকি হাসল। ওর শাশুড়ি
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন। হুম, আসলেই ঘোল খাওয়া দরকার। একজন ডাক্তার অহেতুক কথা বলবে না। একগ্লাস ঘোলের উপকারিতা, উনি জানতেন না। এজন্য বংশে ডাক্তার থাকা ভালো। কত কিছু জানা যায়, শেখা যায়। শিফা
শাশুড়িকে বুঝাতে পেরে পুনরায় হাসল। তৃপ্তির হাসি। এমন মিষ্টি পুত্রবধূ পেয়ে শাশুড়িরও মনে মনে খুশি হলেন।

To be continue……..!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here