সাঁঝক বাতি-‘ নূরজাহান আক্তার (আলো) [২৫]

0
269

-‘সাঁঝক বাতি-‘
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[২৫]

-‘তবুও! যন্ত্রণার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলছি, এই শূণ্য হৃদয় শুধু তোরই নামে খোদাই করা।’

কথাটা শুনে শিফা দিগন্তের বুকের উপর থেকে সরে গেল। পাশ ফিরে শুলো। কেন জানি অশ্রু ঝরছে। কষ্ট হচ্ছে! বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়েছে। দিগন্তের বলা কয়েকটা উক্তি শুনে নয়। আবেগের বর্শিভূতও নয়। কষ্টকে গুরুত্ব দেয় না,
ভালো মন্দের পরোয়াও করে না। সে বাস্তবাদী। নির্মম বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার ধৈর্য আছে। তা যতই কষ্ট হোক না কেন!তবুও দিগন্ত যদি সাফার মৃত্যুতে বাঁধা দিতো। মামাকে নিখোঁজ না করত। হসপিটাল নিজের নামে না করত। কিডনি বেচা চক্রের সঙ্গে জড়িত না হতো। খুনী না হতো। ওই
সরল মানুষগুলোকে কৌশলে ফেলে কিডনি না নিতো। পর-নারীতে আসক্ত না হতো। তাহলে ওদের গল্পটাও অন্য রকম হতো। সবাই তো সুখ চাই। ভালোবাসা চাই! সেও ব্যাতিক্রম নয়। সব স্বাভাবিক থাকলে ওরাও সুখী হতো। সুখ দিয়ে সংসার সাজাত। দিগন্তকে প্রণয়ের বাঁধনে আষ্টে পিষ্টে জড়িয়ে রাখত। কখনো ছাড়ত না। পাপী নয় বরং পারফেক্ট সঙ্গী হতো। দিগন্ত নামক ওই সুদর্শন পুরুষটা একান্ত তার হতো। প্রশস্ত বুকটা ওর দখলে থাকত। সূখপূর্ণ জীবন হতো। অথচ সেটা আর সম্ভব না। দিগন্ত কোন কাজটা ক্ষমার যোগ্য আর কোনটা অযোগ্য? যোগ্য কার্যক্রম আছে কি? চোখে তো পড়ে না। বরং পাপ হচ্ছে জেনেও সে নিশ্চুপ ছিলো। অথচ ওর অজানায় থেকে যাবে, দিগন্ত সাফা, মামা, আর তনয়ের ঘটে যাওয়ার ঘটনার কথা পরে জেনেছে। তখন জানলে, সে পদক্ষেপ নিতে পারত। বাঁধা দিতে পারত। যদিও, দিগন্ত তখন ডুবে থাকত নিজের জগতে। বাবা আর ভাইয়ের দিকে নজর দেওয়ার সময় কই!

এসব ঘটার পর, প্রশান্ত যখন শিফার দিকে হাত বাড়াচ্ছিল। তখন দিগন্ত সতর্ক হয়েছিল। ওদের নজরে রেখেছিল। বুঝেছিল, এবার ওদের থামাতে হবে। নয়তো শিফাকে হারাবে। যেটা ওর জন্য কষ্টসাধ্য। সে খারাপ। তবে তার প্রণয় নয়,
অনুভূতিও নয়! খুব ভালোবাসতেও জানে। আর ভালোবাসা রক্ষার্থে সে মরতেও পারবে ;মারতেও পারবে। এমন ধাঁচের মানুষ সে। দিগন্ত খারাপ হলো কেন? এর উত্তর জানা নেই। খারাপ হতে কারণ লাগে না। বরং ভালো থাকাই, কষ্টসাধ্য। হয়তো মর্জিমতো চলতে চলতে’ই পথভ্রষ্ট হয়েছে। সঙ্গদোষে ভালোকে অতিক্রম করে সে খারাপকে বেছে নিয়েছে। তাছাড়া, যখন কেউ টাকার প্রতি মত্ত হয়। তখন তার সবকিছুতে আপনা-আপনি পরিবর্তন চলে আসে। কাজে, ব্যবহারে, চাল- চলনে। দিগন্তেরও তাই! শিফার অজানায় থেকে যাবে এসব। থাকুক। মন্দ কী? সব জানতে হবে? কেন? দিগন্ত আগেও জানতে দেয় নি। এখনো জানাল না। সে খারাপ, খারাপই। নিজেকে সাধু প্রমাণ করার ইচ্ছে নেই। চেষ্টাও করবে না।করেও
লাভ নেই; তিক্ত অতীত।

শিফাকে কাঁদতে দেখে দিগন্ত বাঁধ সাধল না।চুপ
করে দেখছে। শিফার বলা কথাগুলো তাকে ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছে। নিজের প্রতি’ই ঘৃণা ধরিয়ে দিয়েছে। বুকে যন্ত্রনায় তীর ছুঁড়েছে। সেই তীরের আঘাতে বুকে অদৃশ্য রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কষ্টে দম আঁটকে আসছে। দিগন্ত ওর কনিষ্ঠ আঙুল দিয়ে অশ্রু মুছে বলতে বলতে বেরিয়ে গেল।

সুখ রাজ্যেও নই রে সুখী
দুঃখের রাজা আমি।
আমার আয়ুটুকু চাই যে দিতে।
যাকে, আমি ভালোবাসি।
(আলোমনি)

শিফা ঘাড় ঘুরিয়ে অবাক হয়ে তাকাল। কথাটা কি ওকে বলল? ওর আয়ু শিফাকে দিবে? দিগন্ত ততক্ষণে স্থান ত্যাগ করেছে। শিফা ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে মুখে বিষ্ময়! একোন দিগন্তকে দেখছে? তখন সুখু এসে বাইরে দাঁড়িয়ে কোথাও যাওয়ার তাগাদা দিলো। খুব’ই জুরুরি। যেতেই হবে। শিফা উঠে চোখে মুখে পানির ছিঁটা দিয়ে সুখুর সঙ্গে বেরিয়ে গেল। কোথায় যাচ্ছে?সুখুকে জিজ্ঞাসা করলেও বলছে না। ওর মুখটা থমথমে হয়ে আছে। ব্যবসাতে লস গেছে? নাকি
কাস্টমার টাকা মেরে দিয়েছে? হবে, কিছু একটা! নয়তো মুখ থমথমে কেন? তখন সুখু মাথা নিচু করে কান্নারত কন্ঠে বলল,

-‘আমার মৃত্যু না হওয়া অবধি আপনার সঙ্গে
থাকার হুকুম জারি কইরা দিছে।’
-‘মানে? কে করেছে?’
-‘ছ্যার! বিনিময়ে দশ কোটি ট্যাহা আর একখান বাড়ি দিছে।’

শিফা হাঁটা থামিয়ে দিলো। প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে ওর দিকে তাকাল। সুখু মাথা নিচু করে নিলো। ওর চোখে পানি। শিফা তা খেয়াল করল না। দেখার আগেই সুখু অন্য দিকে তাকিয়ে মুছে নিলো। সে নিরুপায়। দিগন্ত ভরসা করে ওকে একটা দায়িত্ব দিয়েছে। তাকে ওই দায়িত্বে অনড় থাকতেই হবে।
শিফা রেগে গেল সুখুকে মাথা নিচু করতে দেখে।
এটা কোনো কথা? সুখুর মৃত্যু না হওয়া অবধি মানে? দিগন্ত চাচ্ছে টা কি? এই লোকের ফালতু কাজকারবার! সুখুকে রাখবে কেন? তাও টাকার বিনিময়ে। এসবের মানে হয়? শিফা তখন গর্জে উঠে বলল,

-‘আমি কানা নাকি খোঁড়া যে তোমাকে আমার সঙ্গে থাকতে হবে?’
-‘আমার দায়িত্ব আপনাকে রক্ষা করা। রাগুন, মারুন, কাটুন, তবুও আমি যাবো না। আমার ছ্যারের হুকুম।’
-‘ দিগন্ত কোথায়?’
-‘বলা বারণ আছে।’

শিফা বিরক্ত নিয়ে হাঁটা শুরু করল। সুখুর হাতে থাকা ফোনে দিগন্ত এসব শুনছিলো। শিফা এই প্রথম ওর নাম উচ্চারণ করল। ডাকল।ওর কথা জিজ্ঞাসা করল। দিগন্তর মুখে হাসি ফুটল। প্রাণ জুড়িয়ে গেল। প্রিয় মানুষটা নাম ধরে ডেকেছে!
এটাও কম নয়! বেলাশেষে অনাকাঙ্খিত প্রাপ্তি।
দিগন্তর ঝাপসা চোখে শিফার মুখ ভেসে উঠছে।
চিরচেনা ওই রাগান্বিত মুখভঙ্গি। শিফা ওর সঙ্গে কখনো হাসি মুখে কথা বলে নি। মায়ার দৃষ্টিতে তাকায় নি। চোখে চোখে প্রণয়বাক্যে রচনা করে নি। মোহময় দৃষ্টিতে কাছে ডাকে নি। খুনশুটির
মুহূর্তও নেই।তবে দিগন্ত ওর চোখে ঘৃনা দেখেছে। তীব্র ঘৃণা। যেটা দিগন্ত জন্য প্রচন্ড কষ্টের। প্রিয় মানুষটার চোখে ঘৃণায় দৃষ্টি কতটা বেদনাদায়ক। সেটা এক ব্যর্থ প্রেমিকই অবগত। সেই বুঝবে এ দহনের জ্বালা। দিগন্তের হাতে চকচকে ছুরি। তবে সাধারণ ছুরির মতো নয়। প্যাঁচানো। ঠিক বাঁকা সিঁড়ির মতো। হাতলেও নিখুঁত কারুকাজ করা। অদ্ভুত সুন্দর ছুরিটা। ধারালোও বটে। সে বাইরে দেশ থেকে এনেছিলো। দুটো সুইচ আছে। একটা সুইচে প্যাঁচানো ছুরিটা বের হবে। অন্যটাতে খুব সাধারণ ছুরি। তবে সাধারণ ছুরিতে এক ধরনের তরল মিশানো থাকে। যেটাতে, মানুষের মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয়। তারপর শ্বাসনালীও। এবং ক্ষণিকের ব্যবধানে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে মৃত্যু। দিগন্ত কব্জিতে ছুরি রেখে চোখজোড়া বন্ধ করে বলল,

-‘প্রণয়হীন যন্ত্রনার তীর’টা এই বুকেই মারলি। আমিও শূন্যতাকে পূর্ণতাভেবেই গ্রহন করলাম।’

কথাটা বলে দিগন্ত ছুরি হাতে চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে রক্ত গড়িয়ে গেল। লাল রক্ত। দেখতে বেশ লাগছে। দিগন্ত হাসছে। হাসতে হাসতে দু’চোখে পানি এসে গেছে। হয়তো এটা জ্বালাময়ী হৃদয়ের
নিরব আর্তনাদ। গগনবিদারী আর্তনাদের থেকে নিরব আর্তনাদ ঘাতক বেশি। আর ওইদিকে, সুখু শিফাকে নিয়ে নিচ তলার এক রুমের প্রবেশ করল। অদ্ভুত জায়গা। ঘুটঘুটে অন্ধকার। শিফা
সুখুর পেছন পেছন হাঁটছে। ঘাড়-ঘুরিয়ে আশে পাশে তাকাচ্ছে। আরো কয়েক ধাপ হাঁটার পর, সুখু একটা দরজা খুলল। শিফাকে ঢুকতে দিয়ে নিজেও ঢুকল। রুমে কেউ নেই। বেশ পরিপাটি করে সাজানো। অভিজাত্যে ভরপুর। দেওয়ালে দিগন্তের ছবি টানানো। মুখে ফিচেল হাসি। সেই কথা বলা চোখ। ওয়াশরুমে পানির শব্দ ভেসে আসছে। দিগন্ত হয়তো। শিফা বসে সুখুর দিকে তাকাল। পাশেই নতমুখে দাঁড়িয়ে। শিফা পাশের সোফায় বসল। মুখে বিরক্তির ছাপ। একটুপরে, ওয়াশরুম থেকে স্বপ্নীল বেরিয়ে আসল। পরণে শুভ্র তোয়ালে জড়ানো। শিফা হতভম্ব। স্বপ্নীল
এখানে? তাহলে দিগন্ত কই? দিগন্ত ওকে এখানে
আসতে দিলো? কেন? স্বপ্নীল দ্রুত পোশাক পরে শিফার মুখোমুখি বসল। কতদিন পর দেখা। সে আলতো করে শিফার গাল ছুঁয়ে দিলো। শিফার অবাক চাহনি। স্বপ্নীল অক্ষত অবস্থায়! কিভাবে সম্ভব? স্বপ্নীল তখন মুখভর্তি হাসি নিয়ে বলল,

-‘অবশেষে পেলাম। আমরা নতুন করে সূচনা করব। তোকে প্রচন্ড ভালোবাসি, শিফা।’

শিফা নিশ্চুপ! স্বপ্নীলের মুখে তৃপ্তির হাসি। প্রিয় মানুষটা এখন তার। আর সুখু রুমের এককোণে দাঁড়িয়ে বাহুতে মুখ চেপে কাঁদছে। নিরবে। যেন কেউ বুঝতে না পারে। শিফা সত্যিই খুব পাষাণ। নয়তো দিগন্তকে বুঝতে চেষ্টা করতো। সে পাপী। কিন্তু অবুজ মন তো পাপ পূর্ণের হিসাব বুঝে নি। নিষিদ্ধ মানুষটাকেই চেয়ে বসেছে। তাকে পেতে রঙিন স্বপ্ন বুনেছে। সুখু ওদের দিকে তাকালেও না। শিফাকে অন্যের সঙ্গে মানতে পারছে না।
শিফা দিগন্তের। সেও তো রত্নাকে ভালোবাসে। কই রত্না তো ছেড়ে যায় নি। বরং মারলে উল্টো ওকেই জড়িয়ে ধরে। ভালোবাসার আবদার করে। রত্নার বাচ্চা হয় না। সে তো রত্নাকে ছুঁড়ে ফেলে নি। হৃদপিন্ড কে ছুঁড়ে ফেলা যায়? শিফা তো দিগন্তের হৃদপিন্ড। কেউ না জানুন সে তো জানে। নয়তো কাউকে এত ভালোবাসতে পারে?
তাহলে শিফা কেন পারছে না? শিফার প্রণয়ের পরশে দিগন্তকে কেন বদলাচ্ছে না? সুখু মনে মনে একটা কথা আওড়ালো।

-‘ স্যার পাপী বিধায় এত অভিযোগ। যারা ভালো তাদের ভালোবাসা স্বচ্ছ তো?

To be continue………!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here