‘এলোকেশী কন্যা’- [১৬]

0
580

-‘এলোকেশী কন্যা’-
[১৬]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

ওই ছেলেগুলোর একজন অবচেতন আলোর মুখটা দেখে দুই পা পিছিয়ে গেল। সে কিছুটা থতমত খেয়ে চিৎকার করে সবাইকে থামতে বলল। ওরা যাকে খুঁজছে সে এই মেয়ে না। ছেলেটার একথায় পুরো রুম জুড়ে নিরবতা ছেঁয়ে গেল। রোদ
নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মেঘকে বুকে আঁকড়ে ধরে হাঁটু গেড়ে বসল আলোর সামনে। আলোর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। মেঘ হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে আলোকে ডাকছে। রোদ এক হাতে আলোর গালে আস্তে আস্তে টোকা দিয়ে ডাকছে,
“আলো, আলো, এই মেয়ে চোখ খুলো।”
“বউমনি উঠো। ওহ্ বউমনি!”
রোদ হাত দিয়ে আলোর নিঃশ্বাসের গতি আর নাড়ি পরীক্ষা করল। নাড়ির গতি ধীরে ধীরে কমে আসছে। অতিরিক্ত ভয় আর টেনশনে ওর মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ না হয়ে জ্ঞান হারিয়েছে। দুই ভাইয়ের ব্যাকুলতা দেখে ছেলেগুলো একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। ব্যাপারটা এমন হবে ওরাও ভাবে নি। তখন কয়েকজন পুলিশ এসে ছেলেগুলোকে আগে একদফা মেরে পুরো ঘটনা শুনল। ছেলেগুলো বেধড়ক
মার খেয়ে চিৎকার করতে লাগল। পুলিশ ডেকেছে রিসোর্ট কতৃপক্ষ। তারা এটাও জানিয়েছে, গত দুইদিন ধরে এই ছেলেগুলো যখন তখন রিসোর্টে এসে ঝামেলা করছে। রুমে রুমে ঢুকে পর্যটকসহ সবাইকে খুব হেনোস্তা করে। অযথা গালাগালি করছে। অকারণে দুইজন ওয়েটারকে খুব মেরে আহত করেছে। এসব করার কারণ ছেলেগুলোর থেকে জানা গেল, ওরা একটা মেয়েকে খুঁজতে এসেছে। সেই মেয়ে তার স্বামীকে ফেলে অন্যজনের সঙ্গে পালিয়েছে। এবং এরা খবর পেয়েছে তারা এই রুমে তারা আছে। মেয়েটা ওদের বসের বউ! তাই সবাই তাকে হন্ন হয়ে খুঁজছে। আর মেয়েটাকে খুঁজে না পেলে ওদের কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে। তাই খবর পেয়ে না দেখেই এই রুমে আক্রমন করেছে। মার খেয়ে ছেলেগুলো কাতরাতে কাতরাতে এসব জানাল। মূখ্য কথা, এখানে একটু ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে। আর ভাগ্যক্রমে, রোদরা এমন ঝামেলা থেকে বাঁচতে এখানে এসেছে। তাই ওরাও ভয়ে পেয়েছে। এসব শুনে রোদের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। না জানি ওদের আর কত ঝামেলায় পড়তে হয়। তবে ভুলেও সে ওদের সমস্যার কথা কাউকে বুঝতে দিলো না। বিপদ এখনো কাটে নি।
রোদ বিরবির করে উঠে ওয়াশরুম গেল পানি আনতে। সে যে এই মেয়ের আর কতবার জ্ঞান ফেরাবে; আল্লাহ মালুম। রোদ
পানি ছিঁটিয়ে মৃদু স্বরে ডেকে আলোর জ্ঞান ফেরালো। আলো চোখ খুলে ছেলেগুলোকে দেখে রোদের হাত আঁকড়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে দিলো। রোদ ওকে আলতো করে বাহুডোরে জড়িয়ে কোনোমতে শান্ত করল।
যে ছেলেটা রোদের গায়ে হাত তুলেছে; সে মার খেয়ে তখনো মেঝেতে পড়েছিল। পুলিশ দেখে সাহস পেয়ে মেঘ স্ট্যাম্প তুলে সেই ছেলেকে পর পর দু’টো বসিয়ে দিলো। পুলিশ ওকে ধরতে ধরতে ঘুরে আরেকজনের মাথায় বারি দিলো। যে ওকে লাথি মেরেছিল। মারের উপর মার খেয়ে ছেলে দু’টো ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠল। একজন পুলিশ মেঘকে কোলে তুলে নিয়ে কোনোমতে আটকাল। মেঘ ওদের আরো মারার জন্য ওকে ছাড়তে বলে হাত পা ছুড়াছুড়ি করছে। পুলিশের থেকে
নিজেকে ছাড়াতে না পেরে সে হাতের স্ট্যাম্পটাই ছুঁড়ে মারল।
সেটা গিয়ে পড়ল একজনের হাঁটুর উপর। এইটুকুন বাচ্চার
রাগ দেখে দুইজন পুলিশ মুখ টিপে হাসল। রোদ উঠে মেঘকে কোলে নিয়ে বুঝিয়ে শান্ত করল। এবং এটাও জানাল, এরা জঙ্গিরা না। তবে একটু দুষ্টু লোক। এটা বলার কারণ মেঘের মন থেকে যেন জঙ্গিদের ভয়টা দূর হয়।
পরিবেশটা শান্ত হলে পুলিশ ওদের বুঝিয়ে ছেলেগুলোকে নিয়ে চলে গেল। এবং রোদকে আশ্বস্ত করল এদের উপযুক্ত শাস্তি দিবে। রোদ পুলিশের কথায় বিশ্বাসী না। সে জানে, পুলিশ টাকা খেয়ে এদের আজই ছেড়ে দিবে। আর ছেড়ে দিলেও পুলিশকে এর কৈফিয়ত অবশ্যই দিতে হবে। তাছাড়া
ছেলেগুলো মা তুলে রোদকে বিশ্রীসব গালি দিয়েছে। আর এটাতে রোদের খুব লেগেছে! এদের উচিত একটা শিক্ষা না দিলেই নয়। এজন্য সে থানার নাম্বার নিলো। আর জানাল ঢাকায় গিয়ে অবশ্যই যোগাযোগ করবে। এবং সেটা সঠিক মানুষকে দিয়ে।
এখন সন্ধ্যায় ঠিক পূর্ব মুহূর্ত। ওদের সময়গুলো এত বিশ্রী কাটছে বলার মতো না। রোদ এখনো কিছু খেতে পারে নি। খাবারগুলো ওভাবেই পড়েছিল, পরে ওয়েটারকে নিয়ে যেতে বলেছে। সে ছোট থেকেই ঠান্ডা খবার খেতে পারে না। কেন সেও জানে না! এদিকে মেঘ আর আলো শুয়ে গল্প করতে করতে দু’জনেই ঘুমিয়ে গেছে। ওদের একা রেখে রোদ ইচ্ছে করেই নিচে যাচ্ছিল না। ততক্ষণে ওর খাওয়ার ইচ্ছেটাও কেন জানি হারিয়ে গেছে। প্রচন্ড মাথাব্যথাতে চোখ দু’টো লাল দেখাচ্ছে। এখন কিছু খেয়ে ওষুধ নেওয়াটাও জরুরি। সে অসুস্থ হলে এই দু’জনকে কে দেখবে! রোদ এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে এসির পাওয়ার কমিয়ে চলে গেল। আজ সে একটা জিনিস খেয়াল করেছে। আলো ওকে কিছুটা ভয় পেলেও বিপদের সময় ভরসা করে আবার ওকেই আঁকড়ে ধরে। ওর এই ভয়টাকেই সে এবার কাজে লাগবে। রোদ নিচে গিয়ে খেয়ে আলোদের রুমের সোফাতে শুয়ে পড়ল। মেঘের ঘুম ভেঙ্গে ওকে না পেলে আবার কাঁদতে শুরু করবে। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে রোদের ক্লান্ত দু’চোখের পাতায় ঘুম নেমে এলো। তারপর রাতটা রিসোর্টে থেকে,পরেরদিন নতুন একটা সকালের আগমন ঘটল।
রোদ খুব সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে মেঘকে ঘুম থেকে উঠাল। আজ ওরা ঢাকায় ফিরে যাবে। ওদের যাওয়ার কথা শুনে আলোর মুখটা শুকিয়ে গেছে। নিঃশব্দে কয়েকফোঁটা পানিও গড়িয়ে গেল ওর ফর্সা গাল বেয়ে। সে চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে রুমের এককোণে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।তখন রোদ মেঘের চুল ঠিক করতে করতে বলল,
“তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
“তো কী করব?”
“রেডি হও, আমাদের সাথে যাবে। বাড়তি কথা বলে অযথা সময় নষ্ট করো না।”
একথা শুনে মেঘের খুশি যেন আর ধরে না। সে ওর পছন্দের গান ছেড়ে নাচতে শুরু করেছে। কিন্তু আলো ওদের আর কষ্ট বাড়াতে চাচ্ছে না। এই মানুষগুলো ওর জন্য অনেক করেছে।
ওদের আর কত বিপদে ফেলবে? অনেক তো হলো।ওরও তো বিবেক বলে কিছু আছে। তাছাড়া ছোট থেকেই সে পাহাড়ি অঞ্চলে বড় হয়েছে। শহরের গিয়ে হয়তো নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে না। তখন রোদরা বিপদে পড়বে, বিরক্তও হবে। ওর যুক্তিহীন কথা শুনে রোদের প্রচন্ড রাগ হলেও যথেষ্ট শান্ত গলায় বলল,
“কথা শেষ? শোনো তাহলে, ঢাকায় নাহয় মাতবর। তুমি একা থাকতে পারবে না। এক মিনিট সময় দিলাম, ভেবে আমাকে জানাও।”
রোদের দেওয়া দু’টো অপশনই আলোর জন্য বেশ কঠিন। সে উপায় না পেয়ে মাথা নিচু করে কাঁদতে লাগল। রোদ দেখেও কিছু বলল না। বরং ঘড়িতে সময় দেখে ওকে তাড়া দিতে লাগাল। আলো কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে রেডি হতে গেল। আর রোদের মুখ ফুটল বাঁকা হাসি। মেঘও কিছু বলছে না শুধু মিটিমিটি হাসছে। তারপর ওরা হালকা নাস্তা সেরে রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে গেল। ওরা এখান থেকে যাবে চট্টগ্রামে। তারপর সেখান থেকে ফ্লাইটে করে ঢাকায়। আলো গাড়িতে উঠে বসতেই মুখে হাত দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো। ওর যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে। নিষ্ঠুর পরিস্থিতি অজানা এক পথে পাড়ি দিতে ওকে বাধ্য করছে। এমনটা না হলেও পারত। এখানেই তো বেশ ভালো ছিলো সাধারণ একটা মেয়ে হয়ে।
মেঘ আলোকে কাঁদতে দেখে মুখ গোমড়া করে বসে আছে। ওর কান্নাকাটি মোটেও ভালো লাগছে না। আলোর কান্নার শব্দ শুনে রোদ একবার তাকিয়ে শান্ত ভাবে বলল,
“কাঁদছ কেন? আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে। এটাই হয়তো তোমার ভাগ্যে ছিল।”
কথাটা বলে রোদ মুখ ফিরিয়ে সামনে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আলো আর মেঘ পেছনের সিটে আর রোদ ড্রাইভারের পাশে। যাতে আলো রোদেরর জন্য অস্বস্তিবোধ না করে। মেঘ ওর ট্যাব বের করে আলোকে কত কী দেখাচ্ছে আর হাসছে। মেঘের কথা শুনে আলোও আর চুপ থাকতে পারল না। দুষ্টুটা ওকে হাসিয়েই ছেড়েছে। আর কান্নার সময় কেউ ঝুঁকে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে, হাসি তো পাবেই। মেঘ আলোর দিকে ঝুঁকে গালে হাত দিয়ে বসে ওর কান্না দেখছিল। ওর তাকানো দেখে আলো ফিক করে হেসে দিলো। ওকে হাসতে দেখে মেঘ মাথা চুলকে দাঁত বের করে হাসল। তারপর দু’জনেই একটা সময় ঘুমিয়ে গেল। ওদের ঘুমাতে দেখে রোদ যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। দু’টোতে কান মাথা ধরিয়ে দিয়েছে। অনেকটা পথে যাওয়ার পর রোদ একটা রেস্টুরেন্টের সামনে নামল। ফ্রেশ হয়ে ড্রাইভারকে সাথে করে খেয়ে মেঘদের জন্য খাবার প্যাক করে নিলো। ওদের ডাকলে কেউ আর ঘুমাবে না। এত লং জার্নিতে ঘুম নাহলে শরীর আরো বেশি খারাপ করবে। রোদ জানে ক্ষুদা লাগলেও আলো মুখ ফুটে কিছু বলবে না। কিন্তু মেঘ, ঘুম থেকে উঠেই আগে খাবার চাইবে। ওদের গাড়িটা আবার নিদির্ষ্ট পথ ধরে চলতে শুরু করল। এখনো কারো ঘুম ভাংগে নি। ওরা আরো দুই ঘন্টা ঘুমিয়ে সজাগ হলো। রোদ পানি এগিয়ে দিয়ে মুখ ধুয়ে দু’জনকে খেয়ে নিতে বলল। মেঘ তো বিরিয়ানী দেখে সিটেই লাফিয়ে উঠে বলল,
“উু উু বিরিয়ানীই! দাভাই এটা কিসের মাংসের বিরিয়ানী?”
“বিড়ালের।”
“এজন্যই খেতে মজা হবে মনে হচ্ছে। ইয়ে দাভাই, আমি হিসু করব, গাড়ি থামাও!”
“জুরুরি?”
মেঘ আড়চোখে একবার আলোর দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মুখ কাঁচুমাঁচু করে বলল,” হুম, হুম, মেলা জুরুরি বিভাগ!”

রোদ একটা রেস্তোরাঁয় গাড়ি থামিয়ে মেঘকে ওয়াশরুমে রেখে রাখল। তারপর আবার এসে আলোকে চোখ মুখে পানি দিয়ে আসতে বলল। আরো অনেকটা পথ ওদের যেতে হবে। এভাবে একনাগাড়ে বসে থাকলে শরীর খারাপ করবে। আর
এই মেয়ে যে মুখচোরা প্রয়োজন হলেও ওকে বলবে না। তাই লজ্জায় না ফেলে রোদ এভাবে বোঝাল। আলো রোদের কথা শুনে নেমে লেডিস ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। এই অবধি সব ঠিকই ছিল, কিন্তু বিপত্তি বাঁধল মেঘকে খুঁজে না পেয়ে।

To be continue………!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here