এলোকেশী কন্যা’- [৪৫]

0
779

-‘এলোকেশী কন্যা’-
[৪৫]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)
(অন্তিম পার্ট)

দিন যায়! মাস যায়! দেখতে দেখতে বছর গড়িয়ে যুগও পেরিয়ে যায়। সময় বহমান! গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাওয়াই তার কর্ম। এই দায়িত্বে সময়ও নিশ্চল; যেন তার সৃষ্টি এই কর্মে সম্ভূত!
মানব জীবনে সুখ-দুঃখের গন্ডি স্থির নয়। এটা পালা বদলের অনবদ্য খেলা। সুখ আসলে মনে হয়; উফ, পৃথিবীটা এত সুন্দর কেন! সুখপূর্ণ রঙিন ভুবন! আর কষ্ট পেলে মনে হয়, এই বুঝি মরেই যাব। কষ্টের কড়াঘাত বড্ড নির্মম। এই কষ্ট প্রাণে সহে না।
অথচ প্রকৃতপক্ষে দিন পেরিয়ে সুখ-দুঃখের বদল ঘটে। পরিস্থিতি মোতাবেক জীবনও নিদির্ষ্ট পথে চলতে থাকে। শুধু স্মৃতির পাতায় এসে জমা হয়, অনাকাঙ্খিত মানুষদের আনাগোনা আর গুটি কয়েক অব্যক্ত গল্পকথা।
আর এই জীবনের সুখ -দুঃখের মধ্যস্থলে সৃষ্টি; পাপকর্ম। কেউ সুখে পাপে লিপ্ত, কেউ বা দুঃখে! তবে সময়, সুখ- দুঃখের কোনো ভেদাভেদ বুঝে না। চেনেও না, সুখ-দুঃখের মর্মজ্ঞ! শুধু জানে,
সঠিক সময়ের আগমনে সবার কর্মফল বুঝিয়ে দেওয়া।
যে জিনিস যত মূলবান তার চাহিদা তত বেশি।
কথাটা চরম সত্য! আর এই চাহিদা পূরণের পথ
কষ্টার্জিত! হাজারও বাঁধা বিঘ্ন! তবুও এটা সবার চাই-ই চাই! কেউ বুঝে; কেউ বা না বুঝে জড়িয়ে পড়ে, এই মায়াজালে। পূর্নতা অর্জনও কঠিন।
তবু! আর এই জিনিসটার যথার্থ উদাহরণ; প্রণয়!
____________________________

তিন বছর পর,

পাহাড়ের সেই ছোট্ট গ্রামে গত তিন বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। চিকিৎসালয়, স্কুল, মসজিদ, এবং বাজার তৈরী হয়েছে। চাকচিক্যময় সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ না হলেও, চলার উপযুক্ত! পূর্বের মতো,
গ্রামবাসী ভয়ে আড়ষ্ট থাকে না! মেয়ে জন্মালে বাবা-মায়ের আফসোস হয় না। সুন্দর মেয়েরা আর লুকিয়েও থাকে না! কারন গ্রামের কুৎসিত রীতি বদলে নতুন রীতি তৈরী হয়েছে। এই গ্রামে অনাবিল সুখ’রা এসে হানা দিয়েছে। গুমোটপূর্ণ পরিবেশ ছেড়ে আনন্দমুখর এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
গত তিন বছর পর, আলো আবার এসেছে ওর গ্রামে। সব পরিবর্তন দেখে খুশিতে কেঁদেছে। তবে ওর চেনা অনেক মানুষ নেই। কেউ মারা গেছেন, কেউ বা চলে গেছেন! এখানে জোর করে থাকার রীতিও আর নেই! আর ওই জঙ্গিদের সাথে চুক্তি হয়েছে। ওরা গ্রামেও ঢুকতে পারবে না, মেয়েদের তুলে নিয়ে যেতে পারবে না। নয়তো ওদের তথ্য ফাঁস করে দেওয়া হবে। জঙ্গিরা প্রথম প্রথম না মানলেও পরে রাজি হয়েছে। এখন সব সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা হচ্ছে।
বন্য পাখিরা যেমন দীর্ঘদিন খাঁচায় থেকে মুক্ত হলে, পাগলের মতো উড়ে আনন্দ প্রকাশ করে। ডানা ঝাপটে সুখচর সাজে! আলোরও তেমন অবস্থা। চেনা স্বচ্ছ আকাশ, কুয়াশায় ঢাকা পাহাড়, বন্য পাখিদের গুনগুন, শুভ্র মেঘেদের ভেলা, বুনো ফুলের সুগন্ধ। এসব পেয়ে আলোর খুশি আর ধরে না। খুশিতে ওর অশ্রুপূর্ণ আঁখি ছলছল করলেও মুখে তৃপ্তির হাসি। এখানে না আসলে রোদের জানাই হতো না, আলোর মন ও প্রাণ এখানে পড়ে থাকত। সে প্রত্যাশা করত; এখানে আসার। যদিও নিজের গ্রামের প্রতি টান থাকাটা স্বাভাবিক! তবুও মেয়েটা বুঝতে দিতো না।
ওদের সাথে এবার রোহানরা এসেছে। ব্যস্ততাকে ছুটি দিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্যে মোহিত হতে এসেছে।পূর্ণি আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা বিধায় আসে নি। সেও সময় বুঝে আসবে! শুভাননাগণ রোদদের গ্রামের থাকার সু-ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। রোদ প্রথমে রাজি না হলেও আলোর জোড়াজুড়িতে রাজি হয়েছে। যার খুশিতে এতকিছু, সে চায়লে আর কী করার! তবে আলোকে এতটা প্রানবন্ত দেখে ওরা খুব অবাকও হয়েছে। কারণ কর্মচঞ্চল শহরের এই আলোটা হারিয়ে বসেছিল। পুনরায় যেন মেয়েটা প্রাণপূর্ণ হয়ে উঠল! ওরা উঠানযুক্ত টিনের চালা বিশিষ্ট তিনরুমের কক্ষে থাকছে। পাশে রান্নাঘর আর সাদামাটা বাথরুম। এটা অতিথিশালা! প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিস দিয়ে সাজানো। বাড়িটা দেখতেও বেশ! রোদরা একরুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আলো আর মেঘ নেই। সেই সকালে বেরিয়েছে, এখনো ফেরার নাম নেই। ওদের কাজ’ই টইটই করে বেড়ানো। রোদ বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াতেই আলো আর মেঘ রুমে প্রবেশ করল। দু’জনের মুখভর্তি হাসি! যেন বিশ্বজয় করে ফিরল।আলো হাতে ফলের ডালা, সেখানে পাহাড়ি হরেক রকম ফল রয়েছে!
রোহানরা সেদিকে তাকাতেই, ওদের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। সকলের নির্বাক চাহনি! আলো তখন মিষ্টি হেসে ফলের ডালা রেখে বলল,
” টাটকা ফল! ঢাকাতে এমন পাবেন না।”
“বইন, কে গো তুমি?”
আকাশের কথায় আলো খিলখিল করে হেসে উঠল। প্রানবন্ত হাসি! সে বুঝেছে, আকাশের কথার মানে এজন্য অহেতুক কথা বাড়াল না।
তবে ওর হাসি দেখে সবাই মুগ্ধ হলো। রোদ খাটে হেলান দিয়ে বসে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। এই পরিবেশে মেয়েটার সৌন্দর্য যেন দ্বিগুন বেড়ে গেছে। তার উপরে, পোশাক বদলে গাঢ় লাল আর সবুজ রংয়ের সংমিশ্রণের থামিও পড়েছে। ফর্সা শরীরে রং দু’টো ফুটে উঠেছে। সাথে যুক্ত আছে; ভি স্টাইলে নেওয়া ওড়নাটা। চুল খোঁপা করে লাল রাবাব ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা। সুযোগটা সে কাজে লাগিয়েছে, ঢাকাতে তো থামি চলবে না।
তাই যে কয়েকদিন আছে, থামি পরলে মন্দ হয় না।
সময়ের সাথে সাথে ওর শরীরে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এজন্য এমন সাজে’ও ওকে অন্যরকম সুন্দর লাগছে। থামিতে দেখেই আকাশ কথাটা বলল। কারণ ওরা আলোকে এভাবে দেখি নি।
রোহান বার দু’য়ের তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। কারণ, নিষিদ্ধ সৌন্দর্য্যে আকৃষ্ট হতে নেই, মন পুড়ে! তখন মেঘ দাঁত বের করে হেসে রোদকে বলল,
“দাভাই বউমনি আগের মতো লাগছে তাই না?”
“হুম।”
রিমি রোদের কাঁধ চাপড়ে বিজ্ঞদের মতো মাথা নাড়িয়ে বলল,
“এজন্যই বলি, বন্ধুটা আমার শহরের ফুল ছেড়ে বুনে ফুলে আসক্ত কেন।”
আলো ততক্ষণে ফলগুলো ধুতে কলপাড়ে চলে গিয়েছে। সে রিমির কথা শুনতে পায় নি। রোদ আলোর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“শহরের ফুলে রং ঢং মেশানো, কৃত্রিম। আর আমার বুনো ফুলের সৌন্দর্য প্রকৃতিগত।”

রোদের জবাবে রিমি সম্মতি জানিয়ে নিঃশব্দে হাসল। আসলেই! আলো ফলগুলো ধুয়ে কেটে ওদের দিতে থাকল, ওরা খেতে থাকল। রোহান আনারস খেতে চাচ্ছিল না, মেঘের খাওয়া দেখে টেষ্ট করে লোভে পড়ে গেছে। তখন মেঘের সাথে ওর যুদ্ধ শুরু হলো। তারপর,আলো ওদের ফল খাইয়ে রোদকে নিয়ে একটু বের হলো। মেঘ ব্যস্ত থাকল, কুস্তিতে। বাইরের কড়া রোদ! সূর্য রেগে যেন রোদের তাপ বাড়াচ্ছে। বাতাস নেই! গাছের একটা পাতাও নড়ছে না! আলো মাথায় ওড়না টেনে মুখটা মুছে বলল,
“এখানে সবকিছুর ব্যবস্থা আছে। তাই আমি’ই ভাইয়াদের রান্না করে খাওয়াব। শুভাননাদেরও বুঝিয়ে বলে এসেছি।”
“হুম, তা এখন কোথায় যাচ্ছি।”
“বাজারে।”
হঠাৎ রোদ আশেপাশে চোখ বুলিয়ে কাউকে না দেখে, আলোর থুতনীর নিচে কামড় বসিয়ে সরে গেল। এমন ভাব যেন কিচ্ছু জানে না। ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটল, আলোর বুঝতে কয়েক সেকেন্ড লাগল। আলো আশেপাশে তাকিয়ে সেখানে হাত বুলিয়ে বলল,
“উফ, এমন করলে কেন?”
রোদ দুই পকেটে হাত গুঁজে আলোকে বাহু দিয়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল,
“খুশিতে ঠ্যালায়।”
আলো আর এই নিয়ে কথা বাড়াল না। অভ্যস্ত
সে! এই মানুষটা আর শুধরাবে না। ফাজিল না এটা; মহাফাজিল! আলো এখন রোদকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে। কারণ এই ব্যাপারেও রোদ ওকে চাপে ফেলেছিল। সেদিন আলোকে কাঁদিয়ে ‘তুমি’ বলিয়ে পরে মান ভাঙ্গাতে বলেছিল,
“ওরে আমার নাক, কান, গলা, কাঁদে না।”
আলো ওর কথা শুনে কান্না থামিয়ে জিজ্ঞাসাও করেছিল,
“আমি আপনার নাক, কান, গলা?”
রোদ তখন ফিচেল হেসে আলোর নাক’টা টেনে উত্তর দিয়েছিল,
“হুম! এখন কলিজা, জান, বাবু, হার্ট, কিডনী, এসব ডাক কমন হয়ে গেছে। আর আমি সর্বদা আনকমন জিনিস পছন্দ করি। তাই তোমাকে আদর করে ডাকলাম, আনকমন কিছু শব্দগুচ্ছ দিয়ে।”
এরপর আলো প্রত্যুত্তর করার শব্দ খুঁজে পায় নি। বোকার মতো তাকিয়ে সবটা মেনে নিয়েছে।
তাছাড়া সে জানে, রোদের দুষ্টুমিগুলো শুধু ওকে ঘিরে! আর এই ফাজিল মানুষটাও একান্ত ওর।যার পুরো হৃদয়জুড়ে সে বিরাজমান!

তারপর দু’জনে বাজার ঘুরে হাতভর্তি বাজার নিয়ে বাড়িতে ফিরল। রোদ আলোকে রান্নায় সাহায্য করতে, পাশে মোড়াতে বসল। একটুপরে, রোহানরা এসে যে যা পারে কাজে হাত লাগল। কেউ’ই আলোর বারণ শুনল না। বরং হাসির কথা বলে হাসাতে লাগল। গল্প হাসিঠাট্টায় মজে রান্না সম্পূর্ণ করল। তারপর একে একে গোসল সেরে, সবাই একসঙ্গে খেতে বসল। সবাই তৃপ্তি করে খেলেও, টাটকা জিনিসের স্বাদই আলাদা!
রান্নাটাও খুব মজার! দুপুরে রেস্ট নিয়ে বিকালে ওরা ঘুরতে বের হলো। কুয়াশায় ঢাকা পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। হঠাৎ আকাশ বুনে একটা ফুল নিয়ে রিমির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“আমার বউ হবি?”
রিমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে মুচকি হেসে ফুলটা নিলো। কারণ এরা দু’জন দু’জনকে বিগত সাত বছর ধরে ভালোবাসে। বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার ভয়ে কেউ কাউকে বলে নি। কারণ ওদের বন্ধুত্বে শর্ত ছিল, প্রেমজনিত কারণে কেউ বন্ধুত্ব নষ্ট করতে পারবে না। তবে রোদ আর রোহান সব জানত।
রোদ আকাশকে হুমকি না দিলে হয়তো আজও বলত না। রিমির লজ্জারাঙা মুখ দেখে সবার মুখে ফুটল। তবে কিছু বলে লজ্জায় ফেলল না। তখন মেঘ রোহানের দিকে তাকিয়ে আফসোসের সুরে বলল,
“আমার আর রোহান ভাইয়ার কেউ নেই।”
“হ্যারে ভাই।”
ওদের কথা শুনে বাকিরা উচ্চশব্দে হেসে উঠল।
তারপর পাশের পাহাড়িদের দোকানগুলো থেকে কেনাকাটা করল। আকাশ পছন্দ করে রিমিকে একটা নীল রংয়ের থামি, চুড়ি, দুল, আর হরেক রকমের আচার কিনে দিলো। মেঘ নাড়ু, বাদাম, আচারসহ শুকনো খাবার নিলো। রোহান আব্বু আম্মুর জন্য সুন্দর দেখে দু’টো শাল কিনল।
আলোকে কালো রেশমি চুড়ি নিতে দেখে রোদ হাসল। কারণ রোদের পছন্দ কালো! রোদ এসেই একটা সুন্দর চুলে কাঁটা আলোর খোঁপায় গুঁজে দিয়েছে। আলো না বুঝলেও, আকাশ’রা দেখে নিঃশব্দে হেসেছে। আশেপাশে কিছুক্ষণ ঘুরে ওরা
সন্ধ্যার পূর্বেই বাড়ি ফিরে গেল। এবার আর মেঘ বায়না করে নি।

হালকা শীতের রেশ পড়েছে। আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেছে। এই বুঝি বৃষ্টি নামবে। এখন বাজে রাত বারো’টা। রাতের খেয়ে মেঘ আলোর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে। রিমি একরুমে, রোহান আর আকাশ পাশের রুমে। রোদরা তার পাশের রুমে।
কিছুক্ষণ আগে, মেঘ দৌড়ে আলোর কাছে যেতে গিয়ে পড়ে পায়ে নখ উল্টে ফেলেছে। গলগল করে রক্ত বের হতে দেখে মেঘ কিছু না বললেও, আলোর কেঁদে একাকার অবস্থা। মেঘ একটু বড় হয়েছে। বউমনির সামনে কাঁদতেও লজ্জা পায়।
তাই বাক্‌শূন্য! কিছুক্ষণ পর, আলোকে কাঁদতে দেখে মেঘ ধরা গলায় বলল,
“বউমনি ব্যথা কমে গেছে।”
“বাচ্চারা আগে কার কাছে ধরা পড়ে মেঘবাবু?”
“মায়ের কাছে।”
“আমি কে?”
“আমার আরেকটা মা!
কথাটা বলে মেঘ ছলছল চোখেও মিষ্টি হাসল। আলো মেঘের চোখ মুছিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। দিন পেরিয়ে বছরে গড়ালেও ওদের সম্পর্কের ভিত নড়ে নি। বরং শক্তপোক্ত
হয়েছে! আলো সঠিক দায়িত্ব পালনে অটল। সে সত্যিই মেঘের বউমনিরুপি মা হয়েছে। সন্তানদের যেমন ব্যথা পেতে দেখলে মাযের কষ্ট হয়, বুকটা কেঁপে ওঠে! বার বার দোয়া করে যেন সন্তানের কষ্ট লাঘব হয়। তেমনি মেঘের সামান্য কিছুতেও আলো উতলা হয়ে পড়ে। একজন কাঙাল বুঝে, আরোকজন কাঙালের কষ্ট। এজন্যই বুঝি, ওদের সম্পর্কটা এতটা শক্তপোক্ত! তবে আলো সর্বদা চেষ্টা করে মেঘকে ভালো রাখার। আর মেঘেরও প্রাণ তার বউমনি! রোদ এতক্ষণ চুপ করে শুয়ে ওদের’ই দেখছে।
রোদ আর আলোর সম্পর্কটা এখন স্বাভাবিক! যতটা স্বাভাবিক হওয়ার কথা, ঠিক ততটাই! সংসার, মেঘের দায়িত্ব, পড়াশোনা, বুটিকশপ, সব আলো নিজে সামলায়। বাচ্চা নিয়ে এখন
চিন্তা নেই! হবে, নিবে, তবে নিজেকে আর একটু গুছিয়ে। কারণ স্বামীর সব থাকলেও ওর নিজের কিছু নেই। আজ স্বামী কোটিপতি, কাল ফকির হলে? আজ গাড়ি-বাড়ি সব আছে, কাল না থাকলে? আজ স্বামী সবটুকু দিয়ে ভালোবাসছে, কাল না বাসলে? আজ সে প্রিয়, কাল অপ্রিয় হলে? জীবন এত সহজ হলে, বিচ্ছেদ আর কষ্ট নামক শব্দ পৃথিবীতে থাকত না। কোটিপতিরাও পথে নামত না, কারো সোনার সংসার ভাঙ্গত না। বর সোহাগী মেয়েদেরও বিবাহবিচ্ছেদ হতো না। স্বামী সংসারের কথা ভেবে পড়াশোনা ছেড়ে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। তবে রোদও বাচ্চা নিয়ে না ভাবলেও পারিপার্শ্বিক অনেকে’ই উতলা হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ রোদকে এমনও বলেছে,
“রোদ বাচ্চা নিয়ে নাও। নয়তো তোমার সুন্দরী বউ উড়াল দিবে। বাচ্চা নিয়ে বাঁধনটা শক্ত করো।”
রোদ মুচকি হেসে খুব শান্তভাবে তাদের উত্তর’ও দিয়েছে,
“যে যাওয়ার তাকে সোনার শেকল দিয়ে বেঁধে রাখলেও সুযোগ বুঝে ঠিকই উড়াল দিবে। তাই বাঁধার প্রশ্নই আসে না।”
“পাখি উড়াল দিলে?”
“উড়াল দিলে বুঝব, পাখিটা কখনো আমার ছিল না।”

একথা শুনে কেউ আর কিছু বলতেও পারে না।
তাছাড়া রোদ আলোর কোনো কাজে বাঁধা দেয় নি। বরং যথাসাধ্য চেষ্টা করে সাহায্যের! তবে জ্বালাতন করে কান্না ঠিকই করাই! আলো কাঁদে আর সে দেখে মিটিমিটি হাসে! ইচ্ছাকৃতভাবে আলোকে কাঁদানোর সে সারাজীবনই করে যাবে।
এতে কী সুখ পায়? একমাত্র রোদই জানে! তবে
ওদের সম্পর্কে পূর্ণতা এনে আলো ওকে ওয়াদা করিয়েছিল।
১. যত কিছুই হোক; আমরা রেগে আলাদা ঘুমাব না।”
২. পরিস্থিতি যতই খারাপ হোক, ঝগড়া করে কেউ পাঁচ মিনিটের বেশি কথা না বলে থাকব না।”
রোদ সেদিন হাসি মুখেই ওয়াদাবদ্ধ হয়েছিলো।
কারণ শর্ত দু’টির গভীরতা সে বুঝেছিলো।তাই দ্বিমত পোষণ করে নি। আলো মেঘকে শুইয়ে আদর দিয়ে বাইরে গিয়ে বসল। রোদও নিঃশব্দে
আলোর পাশে বসে আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল রাখল। ঝড়ো বাতাস বইছে! মাঝে মাঝে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ অঝরে বৃষ্টিও শুরু হলো। গাছের পাতাগুলোও বৃষ্টির তালে তালে নৃত্য করতে লাগল। টিনের চালে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ হচ্ছে। ঢেউ খেলানো টিনের চালা বেয়ে বৃষ্টি গড়িয়ে যাচ্ছে। শুকনো মাটি ভিজে পোড়া পোড়া গন্ধ ভেসে আসছে। পঁচা ডোবা থেকে ব্যাঙ ডাকছে। তাদের ঘ্যাঙর ঘ্যাং ডাক’টা বৃষ্টির শব্দে মিলিয়ে যাচ্ছে। কয়েকটা কুকুর দৌড়াদৌড়ি করে আশ্রয় খুঁজতে ব্যস্ত। রাস্তায় ওরা শুয়ে ঘুমাচ্ছিল। হঠাৎ বৃষ্টির আগমনে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটল। তখন শো শো বাতাসের শব্দে বৃষ্টির ঝাপটা রোদদের শরীর ভিজিয়ে দিলো। তবুও উঠলও না, সরলোও না!
বরং দু’জনেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখল, শক্ত করে ধরে রাখা ওদের হাতের বাঁধনে। এটা অদৃশ্য শেকল!
আলো বামহাতে রোদের গালের বৃষ্টির পানিটুকু মুছে বলল,
“ভিজলে অসুস্থ হবে, চলো।”
একথা শুনে রোদ মুচকি হেসে আলোর হাতের উল্টো পিঠে আদর দিয়ে খুব’ই মোলায়েম কন্ঠে বলল,
“অসুস্থ তো সেই কবেই হয়েছি। ‘এলোকেশী’ নামক অসুখে আমি মারাত্মকভাবে মর্মঘাতী। আমার এই অসুস্থতা না কখনো সারবে; আর না সারতে দিবো।”
রোদের কথা শুনে আলো মৃদু হেসে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল,
“তা এই ব্যাধির প্রতিষেধক কী?”
” তুই নামক আমার সুখপাখি।”

#সমাপ্ত…!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here