-‘এলোকেশী’-
[০৯]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)
আলোর কথা শুনে রোদ মুচকি হেসে বলল,”বেশ, উপহারের টাকা না’হয় নিও না। তবে ফলের টাকাটা নাও। এবার টাকা ফিরিয়ে দিলে সত্যিই আমরা আর আসব না, আগেই জানিয়ে দিচ্ছি”
“বউমনি লজ্জা পেও না, নাও।”
”ধরো।”
তবুও আলো মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। টাকাটা নিতে ওর কেন জানি খুব অস্বস্তি হচ্ছে। তাছাড়া ভালোবেসে কাউকে কিছু খাইয়ে দাম নেওয়াটা বড্ড বেমানান। আর এই মূহূর্তে আলো সেটা রোদকে বোঝাতে অক্ষম। আর রোদও নাছোড়বান্দা। এই পরিস্থিতিতে আলোকে একরাশ অস্বস্তি এসে ঘিরে ধরেছে। ওর মস্তিষ্ক বলছে, ‘টাকাটা অনায়াসে গ্রহন করতে।’ কিন্তু ওর অবুজ মনটা প্রতিবাদী সুরে বলছে, খবরদার না! টাকাটা নিলেই ভালোবেসে কিছু করাটা ফিকে হয়ে যাবে।’ আর সব জায়গায় টাকার খেলা চলে না। কিছু কিছু জায়গায় টাকাকে গো হারান হারতে দেওয়া উচিত। বিশেষ করে নিঃস্বার্থ ভালোবাসার কাছে। যদিও বাস্তবিক ক্ষেত্রে বেশির ভাগ বিপরীত কিছু ঘটে। পরিস্থিতি মোতাবেক টাকা হারিয়ে দেয় নিঃস্বার্থ ভালোবাসাকে। প্রাণপণে লড়াই করেও প্রাপ্তি মিলতে দেয় না। এভাবে টাকার জোর জিতে যায়। আর হেরে যায় নিগূঢ় ভালোবাসাটুকু।
এই কয়েক মিনিটের মধ্যে আলো একবার এসব কথা ভেবে নিলো। সে মস্তিষ্ক আর মনকে পাত্তা না দিয়ে বিবেকের কথা শুনল।
আলোকে চুপ থাকতে দেখে রোদ মেঘের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,”মেঘ চলো। আমাদের এখন রিসোর্টে ফিরতে হবে।”
“আর একটু থাকি দাভাই?”
“জেদ করবে না মেঘ। ভালো ছেলেরা অকারণে জেদ করে না।”
রোদের কথা শুনে আলো অন্য দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,”এ একশ টাকা দেন।”
আলোর কথা শুনে রোদ মেঘ দু’জনেই পাশ ফিরে ওর দিকে তাকাল। আলো মুখ কাঁচুমাচু করে অন্য দিকে তাকিয়ে হাতের আঙ্গুল মোচড়াচ্ছে। রোদের ওয়ালেটে সব এক হাজার টাকার নোট। তাছাড়া ওর প্যান্টের পকেটে খুচরা থাকলেও সে ইচ্ছে করেই বের করছে না। সে মূলত এই মেয়েটার জেদ দেখতে চাচ্ছে।
সকাল থেকে আলোর দোকানে এক টাকাও বিক্রি হয়নি। রোদ চাচ্ছে, আবডালে আলোকে একটু সাহায্য করতে। আর মেয়েটা ওর থেকে টাকা নিতে নারাজ। হয়তো একেই বলে আত্মসন্মানবোধ!
রোদ মুচকি হেসে এক হাজার টাকার নোট আলোর দিকে পুনরায় এগিয়ে দিলো। আলো উপায় না পেয়ে টাকাটা ধরে মেঘকে নিয়ে ফলের দোকানের দিকে হাঁটা ধরল। রোদ টুলের উপর চুপ করে বসে ওদের যাওয়া দেখছে। আলোর জায়গায় অন্য কেউ হলে টাকাটা হয়তো এভাবে ফিরিয়ে দিতো না। অথচ এই মেয়েটা! মেয়েটা সত্যিই সরল মনের।
ওইদিকে আলো মেঘকে বিভিন্ন ধরনের ফল, মোয়া, ভাজা বাদাম, এবং নানান ধরনের আচারসহ অনেক কিছু কিনে দিলো। ফলের দোকানে আগের দেড়’শ এবং এখনকার কেনা ফল মিলে সাড়ে তিন’শ টাকা দিলো। এতগুলো জিনিস পেয়ে মেঘের তো আর খুশি ধরছে না। সে খুশিতে তৃপ্তির হাসি হেসে আয়েশ করে পেয়ারাতে কামড় দিচ্ছে। আলো জিনিস গুলো কিনে ওর দোকানে ফিরে আসল। তারপর অবশিষ্ট টাকাটা
রোদের হাতে দিলো। আলোর এমন কাজে রোদের খুব রাগ হলেও বুঝতে দিলো না। তবে সুযোগ পেলে সেও অবশ্যই সৎ ব্যবহার করবে।
তখন বেশ কয়েকজন মেয়ে এসে দোকানের সামনে উপস্থিত হলো। রোদকে দেখে নিজেরা ফিসফিস করে কী যেন বলছে, আবার মুখ টিপে হাসছে। একটা মেয়ে আলোকে উপেক্ষা করে রোদকে জিনিসপত্রের দাম জিজ্ঞাসা করল। রোদ তো কোনোটারই সঠিক মূল্য জানে না। তাই সে আলোকে দাম বলতে ইশারা করল। তখন একজনের কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে আরেকটা মেয়ে বলল,
“তা আপনার নাম কি ভাইয়া? আর আপনি কোন রিসোর্টে উঠেছেন?”
মেয়ে গুলো আলোর দেখানো জিনিসপত্র না দেখে রোদকে এটা ওটা জিজ্ঞাসা করছে। এই দোকানে সুদর্শন একজন যুবককে দেখে ওরা বেশ অবাক হচ্ছে। তাই কৌতূহল বশত নানান প্রশ্ন করছে। মেঘ ওদের মাঝখানে বসে একবার রোদের দিকে তো একবার মেয়েগুলোর দিকে তাকাচ্ছে। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে আবার আলোকে দেখছে। মেয়ে গুলোর হাবভাব বুঝতে পেরে রোদ উঠে আলোর থেকে দাম জেনে অকপটে মেয়েগুলো বলল,
“আপনারা কী সত্যি কিছু নিবেন? নিলে বলুন, আমি নিজে আপনাদের সেগুলো দিচ্ছি। আর না নিলে ওই যে ওটা চলে যাওয়ার রাস্তা।”
রোদের মৃদু হাসি মিশ্রিত ঝাঁঝালো কন্ঠ শুনে মেয়েগুলো একে অপরের দিকে তাকাল। তারপর একটা করে জিনিস পছন্দ করে রোদকে দাম জিজ্ঞাসা করতে লাগল। রোদ মৃদু স্বরে আলোর থেকে দাম জেনে মেয়ে গুলোকে জানাল। মেয়ে গুলো তাদের পছন্দ মতো আরো জিনিস দেখতে লাগল।আর আলো রোদের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। সে যে দাম বলেছে, রোদ তার চেয়ে পঞ্চাশ টাকা বেশি বলেছে। এর মধ্যে একটা মেয়ে ওর হাতে নীল কাঁচের চুড়ি পরতে পরতে রোদের ফোন নাম্বার চাইল। রোদ কথাটা শুনে এর প্রত্যুত্তরে মুচকি হেসে বলল,
“এই থামি দু’টো দেখতে খুব সুন্দর। আপনি চাইলে নিতে পারেন।”
রোদের এমন উত্তর মেয়েটা মোটেও আশা করে নি। সে বুঝল রোদ খুব চতুর বটে। এজন্য কথা শুনেও এভাবে এড়িয়ে গেল। মেয়েগুলো প্রায় বারো থেকে চৌদ্দ জনের মতো ছিল। তন্মধ্যে কয়েকজন গায়ে পরা হলে বাকিরা যথেষ্ট ভদ্র ছিল। ওরা সবাই নিজেদের পছন্দসই কিছু না কিছু কিনল। তারপর দাম মিটিয়ে একে একে স্থান ত্যাগ করল। ওদের দেখে আরো কয়েকজন এসে দোকানে ভিড় করল। রোদ নিজে তাদেরও পছন্দসই জিনিস গুলো দিলো। এতটুকু সময়ের মধ্যে রোদ চার হাজার দুই’শ সাতাশ টাকার বিক্রি করল। বৃষ্টির কারণে কয়েকদিন ধরে আলোর দোকানে একদমই বিক্রি হয় নি।
পর্যটকরাও বৃষ্টির কারণে পাহাড়ে ঘুরতে আসে নি। আর ওদের দোকান গুলোই চলে পর্যটকদের কেন্দ্র করে। আজ এতগুলো টাকা বিক্রি হতে দেখে আলোর মুখটা খুশিতে চকচক করে উঠল। রোদ টাকা গুলো আলোর দিকে বাড়িয়ে দিলো। সে আলোকে তখন চাইলেও সাহায্য করতে পারে নি। তাই এখন এভাবে সাহায্য করল। আর কাস্টমারকে তেল না মারলে দোকানে বিক্রি হয় না। সে তেল না মারলেও, মেয়ে গুলোর কৌতুহল বশত ওর সঙ্গে কথা বলাটাকেই কাজে লাগাল। অন্য সময় হলে অনেক আগেই এখান থেকে উঠে চলে যেতো। শুধু আলোর জন্য এতটুকুন করল। তাছাড়া আলো এই অবধি ওদের অনেক সাহায্য করেছে। ওর জন্য কিছু করতে পারলে ওর নিজেরও ভালো লাগবে। তবে আলো বেশ বুঝেছে, রোদ যথেষ্ট বুদ্ধিমান এবং চালাক। নাহলে কথা দিয়ে মেয়েগুলো এত সহজে কাবু করে এত টাকা বিক্রি করতে পারত না। যদিও এখান থেকেও আলো রোদের নিরহংকারের পরিচয় পেয়েছে। তাছাড়া রোদদের বেশভূষা উচ্চমানের হলেও ওরা বেশ মিশুক।
আলোর মুখে মিষ্টি হাসি দেখে রোদ একবার তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। ওর ভাষ্যমতে, মেয়ে মানেই মায়াবিনী। কখন না জানি এই মেয়ে ওকেই কঠিন মায়াতে জড়িয়ে ফেলে।আর সে কারো মায়াতে জড়াতে ইচ্ছুক নয়। এভাবেই তো বেশ আছে! আচানক আলোকে জিনিসপত্র গুছিয়ে দোকান বন্ধ করতে দেখে রোদ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“এখনই দোকান বন্ধ করছ কেন? সারাদিনে তো আরো বিক্রি হতে পারে।”
রোদের কথা শুনে আলো ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
“উহুম, আপাতত আর লাগবে না। এই টাকাতে আমাদের অনেক দিন চলে যাবে। আল্লাহর রহমতের উছিলায় আজ আপনারা আমার সৌভাগ্য নিয়ে এসেছেন, তাই হয়তো এত টাকা বিক্রি হলো। আর এখন আমি অনেক অনেক খুশি। তাই দাদীমাকে এই কথাটা জানাতে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাচ্ছি।”
রোদ ওর এই কথার জবাবে আর কিছু বলল না। মাত্র চার হাজার টাকা বিক্রি হওয়াতে আলো কত্ত খুশি। ওর তৃপ্তির হাসিতে মুখে আলাদা এক সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। অথচ রোদের কোটি কোটি টাকা লাভ করেও হাসতে ইচ্ছে করে না। আলোর মতো খুশি রোদের মনে কখনোই জাগে নি। শুধু মনে হয়েছে, সে কষ্ট করেছে তাই প্রাপ্তি মিলেছে। তবে আলোকে হাসতে দেখে রোদ মুখেও মৃদু হাসি ফুটল। যেটা আলোর আর নজরে পড়ল না।
এদিকে আখ খেতে গিয়ে মেঘ মুখে গুঁতো খেয়ে বসে আছে। ওর দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত বের হচ্ছে। রোদ কিছু বলার আগে আলো পানি এনে মেঘকে কুলি করাল। অনেক টাকা বিক্রি হলো আর মেঘরা কালকে চলে যাবে। আর হয়তো চাইলেও আর দেখা হবে না। তাই আলো আজ দুপুরেই ওদের নিমন্ত্রণ করল।
রোদকে কিছু বলতে না দিয়ে মেঘ লাফিয়ে উঠে রাজি হয়ে গেল। এই ব্যাপারটা রোদের কাছে দৃষ্টিকটু লাগল। মেয়েটা এই পর্যন্ত ওদের জন্য অনেক করেছে। তাই সে আর আলোর কষ্ট বাড়াতে চাচ্ছে না। তাছাড়া রোদ সেদিন দেখেছে, ওদের খেতে দেওয়ার সময় আলোর মুখের সংকোচ ভাবটা। আলো সেদিন ওদের খেতে দিতে লজ্জা পাচ্ছিল, রোদ ব্যাপারটা অতি সহজে বুঝেছিলও। তাই সে আর মেয়েটাকে লজ্জায় ফেলতে চাচ্ছে না। আর এই ব্যাপারটা রোদ আলোকে বুঝতে না দিয়ে বলল,
“আজ না, পরবর্তীতে যখন আসব তখন তোমার নিমন্ত্রণ রক্ষা করব। আকাশের অবস্থাও ভালো না। এখন আমাদের ফিরতে হবে।”
কথাটা শুনে আলোর হাস্যোজ্জ্বল মুখটা নিমিষেই মলিন হয়ে গেল। সেদিনের খাবার রোদের পছন্দ হয়নি। তাই হয়তো রোদ আর যেতে চাচ্ছে না। একথা ভেবে আলো লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো। রোদের কথা শুনে সে জোর করার সাহসও পেলো না। আর জোর করার অধিকারও ওর নেই। আলো মেঘের দিকে একবার তাকিয়ে জোরপূর্বক হেসে সামনে পা বাড়াল। আলোর মলিন মুখ দেখে মেঘ রেগে রোদের দিকে আর তাকাল না। বরং রোদের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য মোড়ামুড়ি করতে লাগল। আলো আশা নিয়ে আর একবার পেছনে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল। রোদও কেন জানি ওর মলিন মুখ দেখে খুব খারাপ লাগছে। তাই মেঘের দিকে একবার তাকিয়ে আলোকে পিছু ডেকে বলল,
“না বলেছি বিধায় একাই চলে যাচ্ছ, আমাদেরকে কী আর সঙ্গে নেওয়া যায় না?”
এই কথা শুনে আলো থমকে দাঁড়িয়ে রোদের দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাসের সুরে বলল,”আপনারা যাবেন?”
“হুম চলো।”
মেঘ ততক্ষণে দৌড়ে গিয়ে আলোর আঙ্গুল ধরে সামনে হাঁটা ধরেছে। আর রোদ ফলের ঝুড়ি নিয়ে ওদের পেছনে হাঁটছে। আলোর মুখে পুনরায় হাসি ফুটেছে। এই মেয়েটার মায়াবী মুখটাতে মিষ্টি হাসি বেশ মানায়। মলিন মুখটা ওর জন্য বড্ড বেমানান। তাই রোদ চাইলেও পারল না, মেয়েটার মুখের হাসি কেড়ে নিতে।
আলো ওদের নিয়ে নিচে নামতে নামতে আঙ্গুল দিয়ে পাহাড় দেখাল। পাহাড় নিয়ে দু’একটা তথ্যও জানাল। মাথার উপরে
স্বচ্ছ নীল আকাশে ভেসে যাচ্ছে সারি সারি মেঘের ভেলা। কয়েকটা নাম না জানা পাখি উড়ে যাচ্ছে তাদের নিজ গন্তব্যে। পাহাড়ের মাটিতে জন্মেছে অসংখ্য গাছপালা। ওই অদূরে পাহাড়ের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে, পাহাড়ের মাথা দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। মেঘ পাহাড়ের মাথায় ধোঁয়া দেখে মুখ হাত দিয়ে ফিক করে হেসে দিলো। আলো ওর হাসির কারণ বুঝলেও রোদ ঠিকই বুঝল। দুষ্টুটার মাথায় সব সময় দুষ্টু বুদ্ধি ঘুরে। আশপাশের গাছ থেকে বুনো পাখির কিচিরমিচির ডাক শোনা যাচ্ছে।
গল্প করতে করতে আলো ওদের নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করল। দাদীমা এখন বাড়িতে নেই। হয়তো মুনের মায়ের কাছে গিয়ে বসে আছে।
আলো মেঘ আর রোদ কে মাদুর পেতে বসতে দিলো। রোদ বসে পুরো বাড়িটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। সেদিনও সে খেয়াল করেছে, আলোর বাড়িটা ছোট হলেও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। দাদীমার রুমের পাশেই একটা তাঁত রাখা। এটা দিয়েই আলো কাপড় বুনে। আলো ওর বাড়ির বিপরীত পাশে গিয়ে বেশ কয়েকটা কমলা ছিঁড়ে আনল। সেখানে সেই লাগিয়ে কমলার গাছগুলো। ছোট সাইজের কমলা হলেও খেতে খু্ব মিষ্টি! রোদ কমলার খোঁসা ছিঁড়ে দিচ্ছে আর মেঘ তৃপ্তি করে খাচ্ছে। রোদ আলোকে দাদীমার কথা জিজ্ঞাসা করল। আলো জানাল, একটু পরেই দাদীমা চলে আসবে। আলো দাদীমার হাতে বানানো বাটি ভর্তি মোয়া এনে ওদের খেতে দিলো। তারপর ওদের বসতে বলে, সে ঝটপট রান্নার কাজে লেগে গেল। একটু পরে, একজন শ্যামবর্ণ হ্যাংলা পাতলা যুবক এসে একটা হাঁস দিয়ে গেল। আলো হাঁসটা কেটে পরিষ্কার করে ঝাল করে ভুনা করলো পাকু মরিচ দিয়ে (মুম্বাই মরিচ)। এই এলাকার মানুষ এটাকে পাকু মরিচ বলে।
উঠানে একটা সাদা বাচ্চা ওয়ালা মুরগি দেখে মেঘ গুটি গুটি পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল। সে মুরগির থেকে কিছুটা দূরত্বে বসে বাচ্চা গুলো দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
“ওয়া, ওয়া কত্ত সুন্দর বাচ্চাগুলো।”
রোদ মেঘকে দেখে সুন্দর করে বলল,”মেঘ খুব কাছে যেও না। মুরগি রেগে যাবে।”
“আচ্ছা দাভাই।”
মেঘ ওখানেই বসেই শাহাদত আঙ্গুল দিয়ে একটা একটা করে বাচ্চা গুনতে লাগল। মুরগিটা বাইশটা বাচ্চা নিয়ে পুরো উঠান জুড়ে ঘুরছে। আশ্চর্য ব্যাপার বাইশটা বাচ্চাই কালো। মেঘ ঘাড় ঘুরিয়ে রোদের দিকে একবার তাকিয়ে আর একটু এগিয়ে গেল। এত সুন্দর বাচ্চা না ধরে সে শান্তি পাচ্ছে না। আর ধরতে গিয়েই বিপত্তি বাঁধিয়ে ফেলল। মুরগি রেগে কক কক শব্দ করে ওকে দৌড়ানি দিলো। আর মেঘ দাভাই! বউমনি! উু উু বাঁচাও! বলে চিৎকার করছে আর দৌড়াচ্ছে। সে যেদিকে যাচ্ছে মুরগিটাও সেদিকে যাচ্ছে। আর মুরগির পেছনে পিকপিক শব্দ করতে করতে বাচ্চা গুলো আসছে।
তখন দাদীমা এসে মেঘকে মুরগির থেকে উদ্ধার করল। মেঘ মনে মনে মুরগিকে অনেক বকা দিয়ে আলোর পাশে গিয়ে পিঁড়া নিয়ে বসল। দাদীমা রোদের সাথে টুকটাক কথা বলে উনার রুমে চলে গেলেন।
মেঘ আলোর পাশে বসে সমানে বকবক করছে, আর মোয়া খাচ্ছে। আলো খুদের ভাত, বুনো হাঁসের মাংস, মাছ ভাজা, শাক পাতা আর আমড়ার চাটনি রান্না করছে। মেঘের হঠাৎ চোখ গেল অদূরে বেঁধে রাখা একটা মানুষের দিকে। সে আবার উঠে ওইদিকে হাঁটা ধরল। রোদ একমনে ফোন স্কল করছিল। আর আলো রান্নার ব্যস্ততায় রোদের কাছে যাচ্ছে ভেবে আর খেয়াল করল না। মেঘ কৌতুহল বশত গুটি গুটি পায়ে ওই মানুষটার সামনে গিয়ে বলল,
” কী হয়েছে? তোমার মুখে এত রক্ত কেন? কে মেরেছে, খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার?”
হঠাৎ বাচ্চার কন্ঠে শুনে মকবুল ধীরে ধীরে ওর চোখ দু’টি খুলল। ফুটফুটে একটা বাচ্চা কোমরে হাত দিয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কী সুন্দর আদুরে ভাবে কথাগুলো বলছে! মকবুলকে তাকাতে দেখে মেঘ পুনরায় একই কথা বলল। মকবুল শুকনো একটা ঢোক গিলে খুব কষ্ট উচ্চারণ করল, “পা পানি খাব।”
“দাঁড়াও, আমি নিয়ে আসছি।”
কথাটা বলে মেঘ দৌড়ে চলে গেল পানি আনতে। মকবুলকে এখনো গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। তাকে একফোঁটা পানিও দেওয়া হয় নি। বিচারকের কড়া আদেশ তাকে কেউ পানি দিবে না। কেউ আদেশ অমান্য করলে অবশ্যই শাস্তি ভোগ করতে হবে। অবুজ মেঘ এসবের কিছু জানে না। সে শুধু জানে, কোনো তৃষ্ণার্ত ব্যাক্তি পানি চাইলে তাকে পানি দিতে হয়। এতে আল্লাহ খুব খুশি হয়। আর আল্লাহ খুশি হলে যা চাওয়া যায়, সব পাওয়া যায়!
To be continue…….!!