-‘সাঁঝক বাতি-‘
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[১৯]
-‘বাবা হওয়ার সুযোগ দাও। আমি খারাপ স্বামী হলেও ;একজন ভালো বাবা হবো।’
শিফা নিষ্পলকভাবে দিগন্তের দিকে চেয়ে রইল।
কত চমৎকার আবদার! প্রত্যেকটা স্বামী যেমন আবদার করে। ওরও ঠিক তেমন’ই আবদার।
অথচ পরিস্থিতি ভিন্ন। বেঠিক সময়। মানুষটাও ভুল। দিগন্ত ভালো হলে ওদের গল্পটা অন্যরকম হতো পারত। সুখ দিয়ে সংসার সাজাতে পারত। দু’জন একসঙ্গে পথ চলার প্রতিজ্ঞা করত।একে অন্যের বিশ্বাস হয়ে থাকত। অন্তস্থল থেকে গাঢ় প্রনয়ের রচনা তৈরি করত। এই রচনায় দু’জন
মানব- মানবীর উন্মাদিত প্রনয়ের কাহিনী লিখা থাকত। কতই না সুন্দর হতো ওদের দিনগুলো।
শিফার স্থানে সাফাও থাকতে পারত। যেই থাক, জীবনটা অন্তত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে পরিপূর্ণ থাকত।
এখন যেভাবে দিন কাটছে; এটাকে বেঁচে থাকা বলে না। বেঁচে থেকেও যেন জীবন্ত লাশ। এখন মুখে হাসি ফোঁটে না। প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতেও পারে না। প্রায় সময় দুঃচিন্তায় ডুবে থাকে। এই জীবনে সুখের ছিঁটেফোঁটাও নেই। সুখ নিখোঁজ।
ভালো নেই। একটুও ভালো নেই। খুব ক্লান্ত সে।
এসব ভেবে শিফা দিগন্তের দিকে তাকিয়েই চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে গেল। প্রত্যেকটা মেয়ের মনে ভালোবাসা, স্বামী, সংসার, সন্তান নিয়ে নানান ভাবনা থাকে। নিজস্ব কল্পনার জগৎ থাকে।ওর
ও ছিল। সেও স্বামীর ভালোবাসা আশা করত।
ফুটফুটে একটা বাচ্চার মা হওয়ার স্বপ্নও দেখত।
স্বামী সোহাগী হতে চেয়েছিল। অথচ! সে বাবার প্রাণ ভোমরা। তেমনি স্বামীরও প্রাণ ভোমরা হতে চাইত। আকাঙ্খা ছিল; স্বামী নামক মানুষটা ওর আসক্তিতে ডুবে থাকুক। ভালোবাসুক! আগলে ওকে রাখুক। ওর রন্ধে রন্ধে ছড়িয়ে দিক প্রণয়ের ব্যাধি।
তবে পরিস্থিতি আজ ভিন্ন। স্বপ্ন ধূলিসাৎ।জীবন
অনিশ্চিত! সুদর্শন স্বামী, সংসার, সেও, আছে। শুধু সুখ নেই। তবে ইচ্ছেগুলো রয়ে গেছে। মনে হানাও দেয়। একমুঠো সুখের বাসনা সেও করে। সুখপূর্ণ জীবনের স্বাদ পেতে শখও জাগে। তবে সেটা আর সম্ভব নয়! জীবনের মোড় বাজেভাবে
ঘুরে গেছে। পূর্বের মতো হওয়ার সম্ভবনাও নেই। হয়’ও না। দিগন্ত শিফাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হেসে ওর কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। সময় নিয়ে, গভীরভাবে। স্বযত্নে আদুরে স্পর্শ। শিফা দু’চোখ বন্ধ করে নিলো। টপটপ করে অশ্রু ঝরছে। ওর হাতজোড়া দিগন্তের আঙ্গুলের ভাঁজে বাঁধা। বেশ শক্তভাবে। সে নড়লে’ই দিগন্ত বেশি ভর দিচ্ছে।
তাই নড়তেও পারছে না। এটা দেখে; এই বেহায়া পুরুষটা হাসছে। দিগন্ত হঠাৎ শিফার অশ্রু শুষে নিয়ে বলল,
-‘আমার জীবনটা ঠিক শুকনো বকুলের মতো।
না আছে সৌন্দর্য ;না সুগন্ধ।’
শিফা নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে। সাফা বলত;
দিগন্তের চোখ কথা বলে। আসলেই কি তাই? সে কি এই চোখের ভাষা পড়তে পারবে? চোখ দু’টো
কি ওকে কিছু বোঝাতে চায়; বলতে চায়? বুঝছে না তো! তবে দিগন্ত অদ্ভুত এক চাহনিতে তাকিয়ে আছে। সত্যিই অদ্ভুত! দিগন্তের চোখের ভাষা সে পড়তে চায় না। আসক্ত হতেও চায় না। ডুবতেও চায় না; মোহপ্রাপ্ত চোখজোড়ায়। সেই চোখে ওর সর্বনাশ নিশ্চিত। তাই ছোট্ট করে উত্তর দিলো,
-‘ফুল পবিত্র। আর আপনি..!’
দিগন্ত হাসল। পুনরায় শিফার গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে
কানের কাছে মুখ নিয়ে আদুরে সুরে বলল,
-‘ভূমিকায় না থাকলেও উপসংহারে তোমাকেই থাকতে হবে। হোক, আমার জীবিত অথবা মৃত
অবস্থায়।’
শিফা দিগন্তকে সরাতে ধাক্কা দিতে থাকল। ব্যর্থ হলো। ওর কাব্যিক কথায়, শিফা বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে নিলো। প্রণয়বাক্য ওর মুখে শ্রীহীন। ওর জন্য খুন, রক্ত, বেইমানী, হিংস্রতা, কঠোরতরা,
এসবই পারফেক্ট। দিগন্ত ছড়ালোও না, নড়লোও না। বরং আদুরে স্পর্শে মগ্ন হলো। ওর পুরুষালি শক্তির কাছে শিফাকে হার মানতে হলো। আজও ব্যর্থ হলো। তবে খেয়াল করলে বুঝত; দিগন্তের
স্পর্শে হিংস্রতা নেই। খুবলে খাওয়ার তাড়া নেই।
শিফাকে কাঁদতে দেখে দিগন্ত ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
-‘ জানো, সাকা চৌধুরী বলেছিলেন; ধর্ষণ যখন নিশ্চিত, তখন তা উপভোগ করাই শ্রেয়। আমি ধর্ষক নই! আমি বৈধপ্রাপ্ত তোমার পতি।’
শিফা হারল। মেনেও নিলো। নিশ্চুপ হয়ে ছোঁয়া সহ্য করল। সময়ও গড়াতে থাকল। সূর্য আলো ছড়াচ্ছে। পাখিদের ডাক শোনা যাচ্ছে। ঘড়িতে এখন সাতটা ছাব্বিশ। শিফা উঠতেও পারছে না। দিগন্ত ওকে আষ্টে-পিষ্টে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে।
নিশ্চিন্তের ঘুম। শিফা ওকে সরাতে গেলে দিগন্ত বলল,
-‘ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিও না। নয়তো স্কিণে সমস্যা দেখা দিবে। ঘুমাও, ঘুমাতেও দাও।’
কথাটা বলে পুনরায় ঘুমে তলিয়ে গেল। শিফাকে আরো শক্ত করে ধরে। যেন বাহুডোরে ঢুকিয়েই ফেলবে। শিফা প্রচন্ড বিরক্ত হলো। ওর লাগছে।
এভাবে কেউ ঘুমায়? অসভ্য একটা! এটা কোনো কথা! শিফা বুদ্ধি খাঁটিয়ে দিগন্তের কানের কাছে চিৎকার করে বলল; ক্ষুধা পেয়েছে, কিছু খাব’ও।
শিফাকে থামাতে দিগন্ত স্বজোরে’ই ঠোঁট কামড় ধরল। শিফা ছটফট করলে ওকে ছেড়ে সে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। যেন কিচ্ছু করেই নি। শিফা ঠোঁটে হাত দিয়ে দেখে রক্ত। কেটে গেছে। শিফাও
দিগন্তের গলায় কামড়ে দৌড়ে চলে গেল। নয়তো শান্তি পেতো না। দিগন্ত শব্দটুকুও করল না।বরং
হাসল। শিফা দ্রুত উঠে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে গেল। খাওয়ার সময় নেই। দিগন্ত ঘুমাচ্ছে। শিফা কাল প্রশান্তের গোপন আস্তানার সন্ধান পেয়েছে। তাই
সেখানেই যাচ্ছে। খবর পেয়েছে; প্রশান্ত’ও নেই।
হাসিব যেতে চাইলে নিষেধ করে দিলো। শিফা
সতর্কতার সাথে সেখানে প্রবেশ করল। ভয়ংকর জায়গা। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কয়েকজন বসে তাশ খেলছে। শিফা বিপরীত দিকে শব্দ করে লুকিয়ে গেল। দু’জন লোক উঠে দেখতে গেল।হেলা করা যাবে না। প্রশান্ত জানলে জীবন্ত কবর দিবে। বড় এক থামের পিছনে শিফা লুকিয়ে আছে। বাইরে দিন। অথচ ভেতরটা রাতের মতো’ই অন্ধকার।
ভয়ে বুক কাঁপছে। হঠাৎ কাঁধে স্পর্শ পেয়ে শিফা চমকে উঠল। ধীরে ধীরে পেছনে তাকাল। কেউ নেই। ওর মনের ভুল। শিফা আর একটু সামনে এগোতেই কেউ বলল,
-‘হেই, হটি গার্ল লুক এট মি।’
শিফা পেছনে ঘুরে দেখে প্রশান্ত দাঁড়িয়ে আছে।
মুখে কুটিল হাসি। পরণে ফোর কোয়াটার প্যার্ট আর সবুজ র্টি-শার্ট। পোশাকও কুঁচকে আছে।
কেবল ঘুম থেকে উঠেছে, বেশভূষায় সেটা স্পষ্ট।
শিফাও ধরা পড়ে গেছে। তবুও বিচলিত না হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। ওর লকেটে থাকা ক্যামেরায় সব রেকর্ড হচ্ছে। এত কঙ্কাল দেখে সে হতভম্ব।
প্রশান্ত একটা সুইচ চেপে দরজা বন্ধ করে দিলো। এখানে আসতে শিফাকে আঠারোটা দরজা পার হতে হয়েছিল। আর আঠারো’টা দরজায় প্রশান্ত একেবারে বন্ধ করে দিলো। মাত্র একটা সুইচে।
প্রশান্ত আড়মোড়া ভেঙ্গে বলল,
-‘ আই ওয়াজ ওয়েটিং ফর ইউ।’
-‘কেন?’
-‘ জানতাম তুমি আসবে। এজন্য আসার পথে বাঁধাও রাখিনি। এখানে একটা বিশেষত্ব আছে। অচেনা কেউ প্রবেশ করলে টিউন বেজে উঠে। সেটা কেবল আমারই কাছে।’
শিফা নিশ্চুপ। পাশের রুম থেকে কেউ চিৎকার
করছে। ছেড়ে দেওয়ার আঁকুতিও ভেসে আসছে।
প্রশান্ত শিফাকে টেনে একটা রুমে নিয়ে গেল।
কারো বেডরুম। বিছানায় অর্ধনগ্ন একটা মেয়ে শুয়ে আছে। শিফা খেয়াল করল, মেয়েটার গলা কাটা। রক্তে বেডশীট ভিজে গেছে। প্রশান্ত হেসে জানাল, মেয়েটা সাংবাদিক ছিল। গোপনে তথ্য সংগ্রহ করতে এসেছিল। তাই ধর্ষণ করে মেরে ফেলছে। শিফা ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাল। অবাকও হচ্ছে প্রশান্তকে শান্ত থাকতে দেখে। এতক্ষণ ওর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা। নয়তো মারার পন্থা অবলম্বন করা। প্রশান্ত লোকদের ডেকে মেয়েটার লাশ সরিয়ে ফেলার হুকুম দিলো। লোকগুলোও তাই করল। তারপর প্রশান্ত সিগারেটে সুখটান দিয়ে বলল,
-‘তোমায় কেউ ভালোবাসে তাও পাগলের মতো।
জানো সে কে?’
-‘না।’
-‘আমার কথা বিশ্বাস করবে?’
-‘না।’
-‘স্বপ্নীলের খোঁজ জানো?’
-‘না।’
-‘দিগন্ত জানে। এই ঠিকানায় চলে যাও পেয়ে যাবে।’
শিফার সোজাসুজি উত্তরে প্রশান্ত হাসল। এরপর
একটা চিরকুট ওর দিকে এগিয়ে দিলো। কালো চিরকুটে সাদা কলম দিয়ে লিখা। শিফা নিজেকে সামলে নিলো। তনয়ের অপহরণকারী কে? সেও জানে। সাফাকে মারার পরিকল্পনা কার? তাও জেনেছে। প্রশান্ত তখন সুইচ চেপে ওকে যাওয়ার ইশারা করল। ওর ব্যবহারে শিফা হতবাক। সে
ভাবল কী? আর এসে ঘটল কি! শিফা চিরকুট নিয়ে সত্যিই বেরিয়ে গেল। ওর উদ্দেশ্যে এখন সুখুর বাসা। আর শিফা বেরিয়ে যেতেই ওখানে দিগন্ত উপস্থিত হলো।
To be continue……….!!