-‘সাঁঝক বাতি-‘
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[২৩]
পরেরদিন সকাল ছয়টা। সূর্য রোজকার নিয়মেই
ধরণীর বুকে আলো ছড়িয়েছে। রৌদ্রজ্জ্বল দিন।
শিফার ঘুম ভেঙে গেছে। বিরক্তিকর দৃষ্টিতে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। দিগন্ত ওকে জাপটে ধরে পেটের উপর পা তুলে ঘুমাচ্ছে। সরাতে ব্যর্থ সে।
ডাকলেও সাড়া দিচ্ছে না। বরং খুব শক্ত বাঁধনে
বুকে আরো জড়িয়ে নিচ্ছে। যেন ছাড়লেই শিফা পালিয়ে যাচ্ছে। যাবেও! এতে সন্দেহ নেই। শিফা পালানোর সুযোগ খুঁজছে।একথা বলার অপেক্ষা
রাখে না। দিগন্তের গাঢ় নিঃশ্বাস শিফার গলাতে বারি খাচ্ছে। বেশ অস্বস্তিও হচ্ছে। সে কয়েকবার ধাক্কা দিয়ে বিরক্ত হয়ে বলল,
-‘সরুন। এভাবে কেউ ঘুমায়? লাগছে আমার।’
-‘শত কষ্টকে উপেক্ষা করে আমার তোকেই চাই। শুধু তোকে, হ্যাঁ তুই, তুই’ই।’
দিগন্ত বিরবির করে কথাটা বলে পুনরায় ঘুমিয়ে গেল। দিবারাত্র এসব কথায় ভাবে৷ তাই এসবের স্বপ্নই দেখে। আর ঘুমের ঘোরে ওর কথায় বলে। শিফা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। এই মানুষটা বোধহয় পাগল হয়ে যাচ্ছে? নয়তো এসব কেন করছে? এমন কাব্যিক কথাবার্তা ওর মুখে বড্ড বেমানান। এমন রুপ মানাও যাচ্ছে না। অচেনা লাগছে। বড্ড বেশি’ই অচেনা। দিগন্ত হঠাৎ পা সরিয়ে নিলো। হাতটা সরিয়ে পাশ ফিরে শুলো। শিফা দ্রুত উঠে ফ্রেশ হতে গেল। যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। ওয়াশরুমের পানির সুইচ চেপে শিফা দাঁড়িয়ে রইল। পুরো শরীর ভিজে গেল। পানির গতি খুব বেশি।শিফা গভীর ভাবনায় মগ্ন। ওর
হিসাব মিলছে না। হঠাৎ দিগন্তের এত পরিবর্তন কেন? এটাই বা কোন নাটকের সূচনা? সে কারণ
ছাড়া কাজ করে না। স্বার্থ অবশ্যই আছে।দিগন্ত ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ। যা করবে ভেবে’ই করবে।
এখন মূখ্য কথা ওর উদ্দেশ্যে কি? নাকি সত্যিই ওর মনে প্রণয়ের কলি ফুটেছে। ভালোবাসার মর্ম বুঝেছে। সম্পর্ক কি? সেটা অনুভব করছে। পাপ থেকে কি বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে? নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছে? যদি এমন হয়! তাহলে কি ওকে সুযোগ দেওয়া উচিত? সে কি নিজেকে বদলাতে পারবে?
ক্ষণিকেই নিজের চিন্তাধারা দেখে শিফা নিজেই চমকে উঠল। কি ভাবছে এসব? সেও পাগল হয়ে হলো নাকি? শিফা থপ করে বসে পড়ল। এখন নিজের প্রতি নিজের ঘৃণা হচ্ছে। ওই অমানুষকে নিয়ে ভাবতেও চায় না। সে ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না। সে পাপী, খুনী, নিষ্ঠুর,মানুষ। আচ্ছা
একজন খুনিকে কী ভালোবাসা যায়? তার পাপ মাফ করা যায়? সারাটাজীবন তার সঙ্গে থাকা যায়? অন্তঃকরণে তার নামটা খোদাই করা যায়?
ওর উত্তর হয়তো হ্যাঁ অথবা না। সে সঠিক উত্তর খুঁজল না। মনও সায় দিচ্ছে না। আচ্ছা মন কি
সর্বদা সঠিক কথা বলে? নাকি বিবেক? সে কার কথা শুনবে? এসব ভেবে শিফা সংশয়ে ভুগছে।
এখানেও মন আর বিবেকের লড়াই চলছে। সে টানা আধাঘন্টা ধরে ভেজা শরীরে বসে আছে।
ওয়াশরুমের দেওয়ালে হেলান দিয়ে।কিছু ভাবতে পারছে না। সবকিছু এলোমেলো লাগছে।দিগন্তর
হঠাৎ পরিবর্তনের কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। হয়তো ধ্বংসলীলা শুরু করবে। এটাই আগাম সংকেত।
দিগন্ত বিছানা হাতড়ে শিফাকে না পেয়ে ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়াল। ব্যাতিব্যস্ত হয়ে শিফাকে উচ্চ শব্দে ডাকতে লাগল। সাড়াশব্দ নেই।দরজা বন্ধ
দেখে দিগন্ত হাফ ছেড়ে বাঁচল। তারমানে রুমেই আছে। দিগন্ত হেসে ওয়াশরুমের দরজা নক করে বলল,
-‘হার্টবিট, জলদি আপনার দর্শন দিন। আমার প্রাণ, আপনার দর্শনের আশায় বড্ড ব্যাকুল।’
শিফা নিজেকে সামলে ভেজা ড্রেস বদলে বেরিয়ে আসল। চুল মুছছে। দিগন্ত ওর কপালে আদুরে স্পর্শ করল। স্বযতনে! শিফা নিশ্চুপ। সে হাতের তোয়ালেটা শক্ত করে চেপে ধরে আছে। মস্তিষ্কে চলছে প্রশ্নের সমাহার। শিফা এক পা বাড়াতেই দিগন্তে ওকে জাপটে ধরল। মুখে ফিচেল হাসি।
সে শিফার কাঁধে ঠোঁট বুলাতে ব্যস্ত। শিফা ওকে সরিয়ে বেশ বিরক্ত হয়ে বলল,
-‘জাপটা-জাপটি ছাড়া আপনার কাজ নাই?’
-‘যেতে ইচ্ছে করছে না।’
-‘ঢং বন্ধ করুন। আমি প্রচন্ড বিরক্ত হচ্ছি।’
-‘তোকে ছেড়ে থাকার সাহস পাচ্ছি না। হারিয়ে যাস যদি।’
শিফা এবার দিগন্তের চোখে চোখ রাখল। চোখ মনের আয়না। মনের কথা নাকি চোখ’ই বলে।
দিগন্তের ঠোঁটর কোণে হাসি লেগে আছে। চোখ অন্য কথা বলছে। অদ্ভুত চাহনি। শিফা এবার সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ল।
-‘আমি এখন নন-ভার্জিন।তাহলে এই নাটকের মানে কি?’
-‘ নাটক নয় পাগলি। আমার সুখুটুকু তোমাতেই সীমাবদ্ধ।’
-‘ভালোবাসা উদয় হলো কবে?’
-‘কবুল বলার পর থেকে।’
-‘এজন্যই বুঝি আবাসিক হোটেলে রাত কাটাতে যেতেন?’
-‘যেতাম। তবে রাত কাটাতে নয় খুন করতে।’
-‘বুঝলাম, আপনি সাধু পুরুষ!’
-‘মোটেও না। আমি হচ্ছি, অমানুষ। যার হৃদয়ে মায়া বলতে কিচ্ছু নেই। হোটেলে রাত কাটানো,
খুন, কিডনি পাচার, সব’ই করেছি। কত মেয়েকে নিজের হাতে খুনও করেছি। শর্ত ছিলো রেসপন্স করতে পারবে না। অথচ শর্ত ভঙ্গ করত।এজন্য
মরতে হতো। তবে তোমার ব্যাপারটা ভিন্ন।তুমিও একই ভুল করেছো। তোমাকে মাফ করে দিয়েছি।
আমার প্রাণপ্রিয় বউ বলে কথা।’
শিফা ঘৃনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। একথা মুখে বলছেও। লজ্জাবোধ বলতে কিচ্ছু নেই। অসভ্য একটা। দিগন্তকে বিশ্বাস করে না। কবুল বলার পর থেকে নাকি ভালোবাসে। এজন্যই এত কষ্ট দিয়েছে। অকারণে অপমান করেছে। পাপকর্ম চালিয়ে গেছে। এর পরিণতির কথাও ভাবে নি।
শিফাকে এভাবে তাকাতে দেখে দিগন্ত মৃদু হেসে বলল,
-‘তোমার ঘৃণার দৃষ্টিতে দগ্ধ হয়ে এই তো বেশ আছি।’
শিফা মুখ ফিরিয়ে নিলো। মানুষটাকে ঘৃণা হয়।
অসহ্য লাগে। ওর প্রতিটা কথা শরীরে ফুটে।সে
বিরক্ত হয়। প্রচন্ড বিরক্ত। দিগন্ত নিঃশব্দে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মুখে হাসি। রুমের দরজাটা খোলা। শিফাও উঠে বের হলো। কাউকে দেখছে না। দোতলায় এসে দেখে দিগন্ত সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। দু’হাত প্রসারিত করা। শিফাকে দেখেও কিছু বলল না। শিফাও
গুরুত্ব দিলো না। সময় নিয়ে পুরো বাড়ির খুঁজে দিগন্তের কাছে ফিরে আসল। মুখ’টা থমথমে।
দিগন্ত সেভাবেই বসে আছে। শিফার উপস্থিতি
বুঝতে পেরে চোখ বন্ধ করে বলল,
-‘স্বপ্নীল নেই। ওকে পাবে না।’
-‘কোথায় সে?’
-‘যাবে তার কাছে? ভালোবাসো খুব?’
-‘হুম।’
-‘আমাকে বাসো না? কখনো কি বাসবে?’
-‘ না।’
-‘তোমাকে কতটা চাই! এজন্মে হয়তো বোঝাতে পারব না শিফা।’
দিগন্ত নিশ্চুপ হয়ে গেল। চোখজোড়া বন্ধ।শিফা এতক্ষণ স্বপ্নীলকেই খুঁজছিলো। দিগন্তও জানত, এমনটা হবে। এজন্য গতরাতে স্বপ্নীলকে সরিয়ে ফেলেছে। শিফা পুনরায় জিজ্ঞেস করল। দিগন্ত উত্তর দিলো না। সুখুও নেই। কোথায় গেছে কে জানে। শিফা রেগে রুমে চলে গেল। দিগন্ত মৃদু হাসল। প্রাণহীন হাসি। শিফার বাড়ির লোকরা
দিগন্তের নামে কেস করেছে। পুলিশ এখন ওকে
হন্য হয়ে খুঁজছে। হসপিটাল’ও বন্ধ করে দেওয়া
হয়েছে। ইচ্ছে করে’ই ওর পাপকর্ম সবার সামনে এনেছে। প্রশান্ত এবং তার আস্তানার খবর ফাঁস করেছে। প্রশান্তর বাবার কঙ্কালটা নাম ঠিকানা দেখে শনাক্তও করা হয়েছে। শিফার পরিবারটা আরেকদফা হতভম্ব হয়েছে। যখন প্রশান্তর ওই অাস্তানা থেকে মামার কঙ্কাল উদ্ধার করেছিল।
উনাদের কাছে সব স্পষ্ট। উনারাও বুঝে গেছেন শিফা কেন বিয়েটা করেছিল। কেন ওর জীবনটা বাজি রেখেছিল। সাফার মৃত্যুর আসল কাহিনী কি? মামা হঠাৎ নিখোঁজ কেন? তড়িঘড়ি বিয়ের কারণ কি? শিফার স্বপ্ন জার্নালিস্ট হওয়া। শিফা আর সাফা দু’জনে জার্নালিজমের ছাত্রী। ওদের
স্বপ্ন পূরণের আশায় ছুটছিলও। হঠাৎ করে সবটা পাল্টে গেল। ওরা লক্ষচ্যূত হলো। পরিস্থিতি সব উলট-পালট করে দিলো। সম্পর্কগুলোর ভিত নড়ে গেল। গতদুইদিন পেরিয়ে যাওয়াতে, তমাও উনাদের সবটা জানিয়েছে। সব বলতে সবকিছু।
স্বপ্নীল এখনো নিখোঁজ। শিফারও খোঁজ নেই।
কেমন আছে, কোথায় আছে? জীবিত নাকি মৃত
সে? এসব নিয়ে উনারা খুব চিন্তিত। মেয়েটাকে ফিরে পাবেন তো! এই আশাতেই অধির আগ্রহে দিন কাটাচ্ছেন
দিগন্ত এখনো বসে গভীর ভাবনায় মগ্ন। বড়ভাই
প্রশান্ত, বাবা-মা, নিহা, কয়েকটা পাপীর বিনাশ সম্পূর্ণ। এখনো একজনের বাকি আছে। এসব
পাপীদের সংস্পর্শে সেও পাপকর্মে জড়িয়ে গেছে। বিবেকের কথা কর্ণপাত করে নি। যেটাই ভেবেছে সেটাই করেছে। জীবনের মানে খুঁজে নি। পাপ ও পূর্ণের তফাতে দৃষ্টিপাত করে নি। টাকাকে লক্ষ্য করেছে! ভেবেছে, বেচেঁ থাকার একমাত্র উপাদান টাকা। টাকায় সব! তবে যা হয়ে গেছে। তা নিয়ে আফসোস করে লাভ নেই। কারণ সেসব এখন অতীত। বিষেভরা অতীত। যে অতীতকে মৃত্যু অবধি বয়ে বেড়াতে হবে। দিগন্ত অনেক ভেবে
সুখুকে কল দিলো,
-‘শিফাকে ওখানে যা।’
-‘ছ্যার দোহাই লাগে এমনটা করবে না।’
-‘যা বলছি কর।’
-‘ম্যাডাম সহ্য করতে পারবে না।’
-‘যেখানে বিচ্ছেদ নিশ্চিত। সেখানে সম্পর্কের আশা করা নেহাৎ বোকামি।’
সুখু আঁকুতি মিনতি করে দিগন্তকে বোঝাতে ব্যর্থ হলো। দিগন্ত ওর সিদ্ধান্তে’ই অনড়। সুখু এবার বলেই ফেললো,
-‘ম্যাডামকে এত কষ্ট দিয়েন না স্যার। আপনি তো উনাকে প্রচন্ড ভালোবাসেন।’
দিগন্ত বার দু’য়ের ঢোক গিলল। বুকের বাঁ পাশে
হাত বুলাতে থাকল।প্রচন্ড যন্ত্রনা হচ্ছে সেখানে।
দম আঁটকে আসছে। মৃত্যু হলেও মন্দ হতো না।
বরং জোর বাঁচা বেঁচে যেতো। এমন নির্মম কাজ করতে হতো না। সুখুর কথায় জবাবে দিগন্ত বেশ সময় নিয়ে বলল,
-‘আমার এই পরিত্যক্ত হৃদয়ে আমার প্রেমটুকু একান্ত আমার হয়েই বেঁচে থাকুক।’
-‘আপনার পায়ে পা স্যার। এমনকিছু কইরেন না।’
কথাটা বলে সুখু হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। সে
জানে, দিগন্ত ভয়ংকর একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এর পরিসমাপ্তিটা আরো ভয়ংকর। ওকে কাঁদতে দেখে দিগন্ত হাসছে। খুব হাসি পাচ্ছে। সিরিয়াস
মুহূর্তে হাসা ওর কিশোর বয়সের রোগ। চাইলেও হাসি থামাতে পারে না। অথচ চোখ দুটো বড্ড জ্বলছে। হয়তো ময়লা পড়েছে। সে সুখুকে ধমকে কান্না থামাল। সমস্ত আবেগকে ছুঁড়ে ফেললো।
তারপর কন্ঠস্বরকে কঠিন করে বলল,
-‘আমাদের সম্পর্কের সমারম্ভ’টা অনুউজ্জল। তাই সমাপ্তিটা ভীতিপ্রদ।’
To be continue………..!!