‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[০৭]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)
পরেরদিন সকালে প্রিয়ম বান্দরবান বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছাল। সেখানে নাস্তা সেরে মাহিন্দ্রাতে উঠে বসল। প্রিয়ম এখন যাত্রা শুরু করল নীলগিরির উদ্দেশ্যে। এক লেনের রাস্তা ধরে তীব্র গতিতে ছুটে যাচ্ছে মাহিন্দ্রা। প্রিয়মের নীলগিরিতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে পৌণে দশটা বেজে যায়। সেখানে একটা রিসোর্টে উঠে ফ্রেশ হয়ে সে আবার ঘুরার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। বেলা এগারোটার পরেও চোখের সামনে মেঘগুলো কুয়াশার মতো উড়তে দেখা যাচ্ছে। প্রিয়ম এমন মনোরম দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী করে মুচকি হেসে বলল, “পরেরবার আর একলা নয় বরং দোকলা আসব।”
খুব সকালবেলা তুয়ার আব্বু-আম্মু হসপিটালে ছুটে এসেছেন। রাতে উনারা বাসাতে গেলেও ওনাদের জানটা যেন এখানেই পড়েছিল। হসপিটালে এসে মেয়েকে ঘুমাতে দেখে তবেই উনারা শান্ত হয়ে বসেছেন।
গত রাতে কাঁদতে কাঁদতে তুয়া প্রত্যয়ের বুকেই সেন্স হারিয়ে ফেলে। প্রত্যয় দ্রুত তুয়াকে ধরে শুইয়ে দেয়। তুরাগ এসেছিল আইসিইউ’র বাইরে থেকে বোনকে একপলক দেখার জন্য। কিন্তু বাইরে থেকে প্রত্যয়কে তুয়ার মুখে পানি ছিটাতে দেখে সে নার্সকে উপেক্ষা করে ভেতরে ঢুকে যায়। মিনিট দু’য়েক পর তুয়ার সেন্স ফিরতে দেখে তুরাগ বোনকে জড়িয়ে ধরে। তুয়া কাঁদতে কাঁদতে তুরাগকে বলে, “ভাইয়া! ভাইয়া রে! আমি অপবিত্র হয়ে গেছি। আমি এখন ধর্ষিতা। ভাইয়া, এই কালিমা নিয়ে আমি বাঁচতে পারব না রে। তুই আমাকে মেরে ফেল, ভাইয়া। আমি আর বাঁচতে চাই না।”
“সোনা বোন আমার, এসব বলতে নেই। তুই তো আমার কলিজার টুকরা। তুই আমার কাছে আগের মতোই আছিস। আমি তোকে অনেক ভালবাসি, বোন।”
তুরাগ তুয়াকে অনেক বুঝিয়েছে। প্রত্যয় কেন জানি একটা শব্দও তখন গলা দিয়ে বের করতে পারেনি। সে শুধু তুয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। প্রত্যয় আর তুরাগ কেউই দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি সারারাত। তুয়া উচ্চশব্দে কেঁদেছে আর পাগলামি করেছে। তুয়াকে কিছুতেই সামলানো যাচ্ছিল না। তুরাগও একপর্যায়ে হাল ছেড়ে বোনের সঙ্গে কেঁদেছে। প্রত্যয় অনেক কষ্ট তুয়াকে শান্ত করলেও ওর কান্না থামাতে পারেনি। তুয়া সারাটা রাত শুয়ে শুয়ে আতনার্দ করে কেঁদেছে। ওর কষ্টটা হয়তো সে কেঁদে কমাতে চাইছে। কিন্ত আদৌও কি চোখের পানি দিয়ে কষ্ট কমানো সম্ভব? তুয়ার এই চেষ্টাও ব্যর্থ হলো। ভোরের দিকে কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে তবেই তুয়া ওর দু’চোখের পাতা এক করেছে।
প্রত্যয়ের কথামতো নার্স তুয়ার জন্য একটা কেবিন রেডি করল। তুয়া ঘুমানোর পর তুরাগ তুয়াকে কোলে করে কেবিনে এনেছে। তুরাগ বোনের হাত ধরে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে গেছে। তার উপর দিয়েও কম ধকল যাচ্ছে না। কালকের অফিসের শার্ট এখনও তুরাগের পরনে। প্রত্যয় ভাই-বোনকে ঘুমাতে দেখে নিঃশব্দে দরজা আঁটকে নামাজ পড়তে গেল। সে নামাজ পড়ে ওর চেম্বারে গিয়ে চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে বসল।
এখন ঘড়িতে সকাল সাড়ে সাতটা বাজে। প্রত্যয় চোখে মুখে পানি দিয়ে আবার তুয়ার কেবিনের সামনের আসলো। কেবিনের বাইরে তুয়ার আব্বু-আম্মুকে বসে থাকতে দেখে প্রত্যয় ধীর কন্ঠে উনাদের সালাম দিয়ে বলল, “আন্টি-আংকেল, তুয়া এখন ঠিক আছে। আপনারা নিজেরা শক্ত হোন।”
“মেয়েটার এমন অবস্থা আমরা যে আর সহ্য করতে পারছিনা, বাবা।”
“আপনারা ভেঙ্গে পড়লে তুয়া ওর বাঁচার ইচ্ছেটুকুও হারিয়ে ফেলবে। আপনাদের সাপোর্টাই এখন ওর খুব প্রয়োজন।”
তুয়ার বাবা উনার চোখের পানি মুছে বললেন, “আমার আম্মুটার হাত কি খুব গভীরভাবে কেটেছে, আব্বু?”
“না আংকেল! চিন্তা করবেন না, এক সপ্তাহের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে ও।”
“হুম! আব্বু তুমি বাসায় যাও। সারারাত তো হসপিটালেই ছিলে, তোমার শরীরেরও তো বিশ্রামের প্রয়োজন।”
“জ্বি আংকেল।”
প্রত্যয় তুয়ার কেবিনে ঢুকে আর একবার তুয়ার হাত চেক করে নিল। কালকে তুয়া হাতের ক্যানোলা টেনে ছুঁড়ে ফেলে জেদের বশে নিজের হাতের ব্যান্ডেজটাও টেনে খুলে ফেলেছে। তুয়া তখনও নিজেকে শেষ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল। তুরাগ আর প্রত্যয় কেউ ওকে থামাতে পারছিল না। ওর কাটা হাত দিয়ে তখনও ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। তুরাগ বোনের পাগলামি দেখে নিজেও উচ্চশব্দে কেঁদেছে। শুধু প্রত্যয় নিজেকে শক্ত রেখে তুয়াকে জোর করে বসিয়েছিল।
তুয়া ওর হাতে অবশের ইনজেকশন পুশ করতে দেয়নি। তাই অবশ ছাড়াই কাটা স্থানে নতুন করে সেলাই করতে হয়েছে। তুয়ার আর্তনাদে প্রত্যয়ের বুকটাও কেঁপে উঠেছিল। তবুও প্রত্যয় হাত থামায় নি। বরং সে কাঁপাকাঁপা হাতেই সেলাইটা করেছে। অন্য কারো বেলায় প্রত্যয়ের হাত দ্রুত চললেও তুয়ার আর্তনাদে ওর হাতটা ক্ষণিকের জন্য থেমে গিয়েছিল। তুয়ার চিৎকার করে বলছিল, “তোমরা আমাকে আর কষ্ট দিও না, আমি সহ্য করতে পারছি না। তোমরা আমাকে মেরে ফেলো তা-ও আমার আর কষ্টটা বাড়িও না।”
একথা যেন প্রত্যয়ের বুকে গিয়ে বিঁধেছে। তবুও সে কর্ণপাত না করে নিজের কাজ সম্পূর্ণ করেছে।
প্রত্যয় তুয়ার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিঃশব্দে কেবিন থেকে বের হলো। তুয়ার আব্বু-আম্মুকে বলে সে বাসায় ফিরে ফ্রেশ হতে গেল। একটু পরে প্রত্যয়ের আম্মু এসে প্রত্যয়কে জিজ্ঞেস করলেন, “আব্বু, তুয়া এখন কেমন আছে?”
প্রত্যয় বলল,”সারারাত কেঁদেছে।”
প্রত্যয়ের আম্মু ছেলের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললেন, “আব্বু! তোর চোখ এত লাল হয়ে আছে কেন? তুই কি কেঁদেছিস?”
প্রত্যয় ওর হাতের টাওয়ালটা বেলকণিতে মেলে দিয়ে মুচকি হেসে বলল, “আমি কাঁদব কেন? সারারাত জেগে ছিলাম, তাই হয়তো চোখ লাল লাগছে।”
প্রত্যয়ের আম্মু প্রত্যয়কে নাস্তা করতে ডেকে চলে গেলেন। প্রত্যয় জামিলকে ফোন দিয়ে বলে দিল আজকে সে সকাল এগারোটা থেকে পেশেন্ট দেখবে। প্রত্যয় হালকা নাস্তা সেরে প্রিয়মকে ফোন দিল। এত ব্যস্তার মধ্যে সে ছোট ভাইটার খোঁজ-খবর নিতে পারেনি। প্রিয়মের ফোন বন্ধ পেল, হয়তো নেটওয়ার্ক সমস্যা। প্রত্যয় ওর রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল। ওর চোখ দু’টো বড্ড জ্বালা করছে। চোখ খুলে রাখাটাও কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। এখন চোখের পাতা দু’টোও মনে হয় একটু বিশ্রাম চাচ্ছে।
বিল্ডিংয়ের কয়েকজন মহিলা ছাদে গিয়ে আলোচনায় বসেছেন। উনাদের আলোচনার বিষয় ধর্ষিতা তুয়াকে নিয়ে।
ইচ্ছের আম্মু কোনো কাজে ছাদে গিয়েছিলেন। হঠাৎ উনাদের মন্তব্য শুনে উনি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। একজন মহিলা ফিসফিস করে আরেকজনকে বলছেন, “মাইয়ার প্যাটে বাচ্চা না আইলেই হয়। কয়জন মিইল্লা ধর্ষণ করছে কিছু শুনছেন?”
“না! তা কইতে পারুম না। তয় ধর্ষিত মাইয়াগোরে হসপিটালে ভর্তি করাইলে প্যাট ওয়াশ কইরা দেয়। বাচ্চা প্যাটে না আসার ইনজেকশনও নাকি দেয়।”
“যাই কন, ভাবি! মাইয়াডার জীবনখান শ্যাষ। কোনো ব্যাডা মানুষই জাইনা শুইনা এমন মাইয়া ঘরে তুলল্যা নিবো না। হায়রে আল্লাহ! মাইয়াডার রুপ, গতর, জীবন ওই পোলাগোর হাতেই নষ্ট হইয়া গেল।”
“তুয়াদের সামনের ফ্ল্যাটের ওই ভাবির দুইখান জুয়ান পোলা আছে না? আমি তো ভাবছি ওই ভাবির ছোট পোলার লগে তুয়ার লটঘট আছে। একদিন আমি ওদের দু’জনরে রাস্তায় কথা কইতেও দেখছি।”
“লটঘট যতই থাকুক, বিয়া কেউ আর করবে না। না জানি কত পোলা ওর শরীর ছুঁইছে, ছিহ্! একথা ভাবতেও আমার শরীর ঘিনঘিন করতাছে।”
উনারা এমন ভাবে কথাগুলো বলছে যেন এটা দারুন মজার একটা টপিক। ইচ্ছের আম্মু চুপচাপ নিচে চলে গেলেন।
সকালবেলা পলক ঘর-উঠান ঝাড়ু দিয়ে রান্না ঘরে এলো। ওর শাশুড়ি পরোটা ভাজছে আর দিশা বেলে দিচ্ছে। পলক এসে বেসিনে রাখা থালা বাসন ধুয়ে নিলো। একটু পর রনিতের ডাকে পলক রুমের দিকে পা বাড়াতেই দিশা হাসতে হাসতে খোঁচা মেরে বলল, “কি গো পলক, রনিতকে কি দিয়ে বশ করেছ? তোমাকে ছাড়া যে সে রুমে একা থাকতেই চায় না।”
কথাটা বলে দিশা হাসতে থাকল। পলক ওর শাশুড়ির সামনে লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো। ওর শাশুড়ি কিছু বললেন না। সে দ্রুত পায়ে হেঁটে রুমে চলে গেল। রনিত ফ্রেশ হয়ে এসে দাঁড়াতেই পলক রুমে ঢুকে বলল, “আমি রুমের বাইরে থাকলে আমাকে ডাকবেন না। সব তো রেডি করে দিয়েছি। তাহলে এত ডাকাডাকি করছেন কেন?”
রনিত পলকের দিকে হাতের টাওয়ালটা ছুঁড়ে মারল। পলক টাওয়াল ক্যাচ ধরে চেয়ারের উপর মেলে দিল। রনিত হাসতে হাসতে বলল, “সকালবেলা আমার বউটা এত রেগে আছে কেন, শুনি?”
পলক কিছু বলতে যাবে, তখন দিশা রান্নাঘর থেকেই বলে উঠল, “পলক, তোমাদের আদর আহ্লাদ শেষ হলে নাস্তা করতে এসো।”
পলক দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে গেল। বাসায় শশুড়, ভাসুর আছে। তারা শুনলে কি ভাববে? সে রনিতকে কিছু বলার সুযোগটুকুও দিল না। রনিতও এবার ব্যাপারটা বুঝতে পারল। ওর মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে দিশাকে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিতে। শুধু ওর ভাইটা কষ্ট পাবে বলে সে কিছু বলে না। আর সে পলককে ডেকেছিল পলকের আম্মু ফোন দিয়েছিল, তাই কথা বলার জন্য।
হঠাৎ করে বুকের কাছে ছোট ছোট হাতের স্পর্শ পেয়ে প্রত্যয়ের ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। প্রত্যয় চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে ইচ্ছে ওর বুকে টোকা দিচ্ছে আর বলছে, “প্রত্তুয়! প্রত্তুয়! তুমি উতবে না?”
প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “হুম! ইচ্ছেমণি, এই তো আমার উঠে গেছি।”
ইচ্ছের মুখে আজকে কোনো হাসি নেই। প্রত্যয় ইচ্ছেকে ওর বুকের উপর বসিয়ে মুচকি হেসে বলল, “আমার ইচ্ছেমণির মন খারাপ কেন?”
ইচ্ছে ঠোঁট উল্টিয়ে ছলছল চোখে বলল, “আমি তোমাল সাতে দাবো।”
প্রত্যয় বলল, “আমার সাথে কোথায় যাবে? কাঁদে না সোনা, বলো আমাকে?”
ইচ্ছে বলল,”তুয়া আপুল কাছে।”
প্রত্যয় হেসে বলল, “আচ্ছা, নিয়ে যাব। তুমি রেডি হয়ে এসো।”
ইচ্ছে উঠে “আচ্ছা” বলে দৌড়ে চলে গেল। প্রত্যয় উঠে ফ্রেশ হয়ে হালকা কিছু খেয়ে রেডি হয়ে নিলো।
বিল্ডিংয়ের সবাই বলাবলি করছে তুয়া হসপিটালে। ইচ্ছে ছোট, সে জানে না ধর্ষিতা শব্দের মানে। তাই এই শব্দটা বার বার শুনেও বুঝতে পারেনি। সে শুধু বুঝেছে তুয়ার হাত কেটে গেছে। তাকে প্রত্যয়ের হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। এজন্য সে এসে প্রত্যয়ের কাছে এই আবদারটা করল। এদিকে ইচ্ছের আম্মু ইচ্ছেকে যেতে দিবে না। তাই ইচ্ছে কেঁদে একাকার অবস্থা। প্রত্যয় এসে ইচ্ছেদের দরজা নক করল। প্রত্যয়কে দেখে ইচ্ছে দৌড় এসে প্রত্যয়ের কোলে উঠে গেল। ইচ্ছের আম্মু বললেন, “প্রত্যয়, ইচ্ছে গেলে খুব জ্বালাবে। এখন ওখানকার যা অবস্থা, সবাই বিরক্ত হবে।”
প্রত্যয় বলল, “সমস্যা নেই, আমি সামলে নিব।”
ইচ্ছের আম্মু আর কথা বাড়ালেন না। প্রত্যয় ইচ্ছে কে নিয়ে চলে গেল। তুয়ার চোখের সামনে ছেলেগুলো বিশ্রীভাবে হাসছে। ওর শরীরে হাত দিচ্ছে, ওড়না কেড়ে নিজেরা হাসাহাসি করছে। ওর দিকে তাকিয়ে নোংরা নোংরা কথা বলছে। একটা ছেলে তুয়াকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। এতটুকু দেখে তুয়া চিৎকার করে বলল, “আম্মু! আম্মু! আমাকে বাঁচাও! আমাকে তোমরা ছেড়ে দাও। আব্বু! আব্বু কোথায় তুমি? আমি বাসায় যাব, আমাকে নিয়ে যাও। আম্মু! ভাইয়া! ভাইয়া! আমাকে তোমরা বাঁচাও।”
কথাটা বলে তুয়া চিৎকার করে কেঁদে উঠে বসল। ওর শরীর থরথর করে কাঁপছে। ভয়ে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। কালকে রাত থেকে সে চোখ বন্ধ করলেই এই স্বপ্নটাই দেখছে। তুয়ার আম্মু মেয়েকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো, উনিও কাঁদছেন। হয়তো সেই সময়ও সে ভাবেই উনাদের ডেকেছিল। তুয়া ওর আম্মুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মুখ লুকিয়ে আছে। তুয়ার আব্বু চোখের পানি মুছে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “মা! আমার সোনা মা! আমরা সবাই তোমার পাশে আছি। তুমি ভয় পেও না, মা। তোমার কিচ্ছু হবে না।”
তুরাগসহ ওর আব্বু-আম্মু তুয়াকে বুঝাচ্ছে। তুয়া চুপটি করে ওর মায়ের বুকে মাথা রেখে বসে আছে। সবাই অনেক জোড়াজোড়ি করেও ওকে কেউ কিচ্ছু খাওয়াতে পারেনি। একটুপরে প্রত্যয়ের হাত ধরে ইচ্ছে নাচতে নাচতে কেবিনে ডুকল। ইচ্ছে এক হাত দিয়ে প্রত্যয়ের এক আঙ্গুল ধরে আছে। আর ওর অন্য হাতে একটা পুতুলের পা ধরে আছে। যার ফলে পুতুলটা উল্টো করে ঝুলছে। এই পুতুলটা তুয়া ইচ্ছের জন্মদিনে ইচ্ছেকে উপহার দিয়েছিল। তুয়াকে দেখে ইচ্ছে দৌড়ে তুয়ার কাছে গিয়ে বললে, “তুয়া আপু, পুতুলেল বিয়ে দিবা না? বাসায় দাবে না?”
তুয়া একটা কথাও বলল না দেখে ইচ্ছে তুরাগের দিকে তাকাল। তুরাগও কোনো কথা বলল না। ইচ্ছে একে একে সবার দিকে তাকাল। কেউ কোনো কথা বলছে না দেখে ইচ্ছে ছলছল চোখে প্রত্যয়ের দিকে তাকাল। প্রত্যয় খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে ইচ্ছেকে ইশারায় বলল তুয়াকে খাইয়ে দিতে। ইচ্ছে পুতুলটাকে ছুঁড়ে ফেলে তুয়ার সামনে বলল, “নাও খাও! ছুটু বাবু! ছুটু বাবু নাও, খাও।”
তুয়া খাচ্ছে না দেখে ইচ্ছে মাথা নিচু করে বলল, “আমলা সবাই তোমাতে কুব ভালুপাশি, আপু। তুমি আল দুঃখু পেও না।”
তুয়া ইচ্ছেকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠল। এই তোতাপাখিকে তুয়া খুব ভালবাসে। ইচ্ছে তুয়ার চোখের মুছে দিচ্ছে। প্রত্যয় এই কারণেই ইচ্ছেকে এখানে এনেছে। কারণ ইচ্ছের সাথে তুয়ার সম্পর্কটা খুবই মধুর। এটা প্রত্যয় নিজে খেয়াল করেছে। তুয়াকে একটু নরমাল করতে এখন ইচ্ছেকেই দরকার।
প্রত্যয় ইশারায় তুয়ার আম্মুকে বলল খাইয়ে দিতে। তুয়ার আম্মু তুয়ার মুখের সামনে খাবার এগিয়ে দিলেন। তুয়া দুই বার ফিরিয়ে দিয়ে তিন বারের বেলায় লোকমাটুকু মুখে নিল। তুয়ার চোখের পানি অঝরে ঝরে যাচ্ছে। এদিকে ইচ্ছে ততক্ষণে হা করে বসে আছে। ইচ্ছের হা করা দেখে তুয়া বাদে সবাই হাসল। গুমোট থাকা পরিবেশটা একটু স্বাভাবিক হলো। প্রত্যয় মেডিসিন সাইডে রেখে কেবিন থেকে চলে গেল। জামিলকে বলে প্রত্যয় ওর পেশেন্ট দেখা শুরু করল।
কেবিনের মধ্যে সবাই চুপ করে ইচ্ছের গল্প শুনছে। ইচ্ছে গল্প বলে ওর পুতুলকে ঘুম পাড়াচ্ছে। ইচ্ছের গল্প শুনতে শুনতে তুয়া একটা সময় ঘুমিয়ে গেল। তুরাগ ইচ্ছেকে ইশারায় চুপ করতে বলল। সে তো চুপ থাকার বাচ্চা না। তাই ইচ্ছে প্রত্যয়ের কাছে যাওয়ার জন্য ছটফট করতে লাগল। তুরাগ ইচ্ছেকে নিয়ে বাইরে গেল। জামিল তুরাগকে দেখে বলল, “ইচ্ছেকে আমার কাছে দিয়ে স্যার আপনাকে বাসায় যেতে বলল।”
ইচ্ছে ফট করে বলল,”আমি প্রত্তুয় এর কাছে দাবো।”
তুরাগ জামিলকে বলল, “প্রত্যয় ফ্রি হওয়ার পর ইচ্ছেকে ওর কাছে দিবেন। নাহলে ওকে বিরক্ত করবে।”
তুরাগ ইচ্ছেকে দুষ্টুমি করতে বারণ করে চলে গেল। প্রত্যয় আসার সময় তুয়ার আব্বু-আম্মুর জন্য খাবার এনেছে৷ আর তুরাগকে বাসায় ওর আম্মুই খাওয়াবে।
তুরাগ যাওয়ার পর জামিল ইচ্ছেকে নিয়ে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াল। পেশেন্টের ভীড় কিছুটা কমেছে, তাই জামিল ইচ্ছেকে প্রত্যয়ের কাছে নিয়ে গেল। প্রত্যয় বলল, “ইচ্ছেমণি, তুমি খেলো। আমি পেশেন্ট দেখি কেমন? তারপর আমরা তোমার তুয়া আপুর কাছে যাব।”
“আতথা।”
খেলার জন্য প্রত্যয় ইচ্ছেকে অনেক গুলো কলম দিল। ইচ্ছেও আর কথা বাড়াল না। সে ভদ্র বাচ্চার মতো খেলতে লাগল। আর প্রত্যয় পেশেন্ট দেখতে লাগল।
প্রিয়ম আশেপাশে ঘুরে দেখতে দেখতে একটা মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো। মেয়েটা এখানে পর্যটকদের আশপাশটা ঘুরে দেখায়। প্রিয়ম কথায় কথায় জানতে পারল মেয়েটার নাম অপরাজিতা। অনেক বড় নাম তাই সবাই ওকে অপু বলে ডাকে। অপু প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যার, বিহা টো করেক লাই?”
“উহুম! আমার বড় ভাইয়ার বিয়ে দিয়ে তারপর আমি বিয়ে করব।”
“ভালবাসার মানুষ টো আনছে নাকি?”
“তা তো আছেই। আচ্ছা তুমি কোন জেলার ভাষায় কথা বলছ?
“আমি বিহারের মাইয়া। সবজেলা টোর মানুষের সঙ্গে কথা টো বুইলার লাইগ্যা মিশকুর টো কইরাই এখন কথা টো বুলি।”
“ওহ আচ্ছা।”
To be continue…..!