সুদর্শন শঙ্খচিল’ [৪০] লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো) (অন্তিম পার্ট)

0
663

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[৪০]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)
(অন্তিম পার্ট)

দিশার কথাটা শুনে কেউ প্রত্যুত্তর করল না। কারন এই বিষয়ে কারো কিছু বলার নেই। এতোদিন যে ভুল করেও ইচ্ছের খোঁজটুকু নেয়নি। একবারও ভাবেনি, ছোট্ট বাচ্চাটা কেমন আছে? সে আজ স্বার্থের জন্য এখানে এসেছে। তাছাড়া দিশার মন-মানসিকতা সম্পর্কে ওদেরও ধারণা আছে। তাই ওর কথায় কেউ বিচলিত হলো না। বরং শান্ত ভাবে কথা চালিয়ে গেল। ইচ্ছে ওর রুমে বসে ড্রয়িং করছে। সে জানে না ড্রয়িংরুমে কি হচ্ছে। দিশা টিস্যু দিয়ে বার বার চোখ মুছে যাচ্ছে।

তুয়া কিছু বলার আগে প্রত্যয় একবার ইচ্ছের রুমের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,”আপনার কথা বুঝলাম। কিন্তু আপনার চাওয়াটা পূরণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যেহেতু আমি ইচ্ছেকে দত্তক নিয়েছি। সেই সূত্রে ইচ্ছে আমার মেয়ে। ওকে ছাড়া আমি বা থাকব কিভাবে? চাইলে ওর দায়িত্বটা আমি অফিসার সায়নকে দিতে পারতাম। তখন যেহেতু দেয়নি! তাহলে আজ কিভাবে দিব?” প্রত্যয়ের কথা শুনে দিশা একটু অসন্তুষ্ট হলো। সে প্রাণের দিকে একবার তাকিয়ে রাগটাকে আয়ত্তে এনে বলল,”আপনাদের বাচ্চা আছে। তবুও কেন আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন ভাই? আমার কষ্টটা একটু বোঝার চেষ্টা করুন।” প্রিয়ম এবার কড়াভাবে উত্তর দিল,” ইচ্ছে এই পরিবারের মেয়ে। এসব কথা ভুলেও আর দ্বিতীয় বার উচ্চারণ করবেন না। আমাদের মেয়েকে আমরা দিব না। আপনি বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমরাও আর চুপ থাকব না।”

একথা শুনে দিশা রেগে উঠে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল তুলে বলল,” আপনারা সবাই স্বার্থপর, লোভী! আপনাদের রুপ আমি চিনে ফেলেছি। ঠিক আছে, আমিও এর শেষ দেখেই ছাড়ব।” কথাটা বলে দিশা দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। দিশার ব্যবহারে সবাই হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এই মাত্রই তো বাচ্চার জন্য কেঁদে কাহিল হয়ে যাচ্ছিল। ইমোশন দিয়ে ওদের বশ করতে পারল দেখে হুমকি দিয়ে গেল। প্রত্যয় ইচ্ছের রুমের দিকে তাকিয়ে সবাইকে এই টপিকটা চেপে যেতে বলল। কারন ইচ্ছে যখন তখন রুম থেকে বের হতে পারে। কেউ কথা বাড়াল না চুপ হয়ে গেল। হঠাৎ প্রান কেঁদে উঠলে চাঁদ দাঁত বের করে হেসে বলল, “সোনা বাবাটা কাঁদে না। বাবাটার যত্নআত্তি কম হচ্ছে নাকি যে কাঁদছে, হুম?” কথাটা শুনে প্রাণ ড্যাব ড্যাব করে চাঁদের মুখ পাণে তাকাল। চাঁদ প্রাণের সঙ্গে আদুরে সুরে কথা বলতে লাগল। প্রত্যয় প্রিয়কে নিয়ে রুমে গেল। আর তুয়া গেল রান্নাঘরে। প্রিয়ম এবং আব্বু আম্মুও রুমে চলে গেল। এখন ড্রয়িংরুমে কেউ নেই। চাঁদ আশেপাশে চোখ বুলিয়ে প্রাণের কানে কানে বলল,”সোনা বাবা আমাকে শাশুড়ি বানাতে তোমার আপত্তি নেই তো?” প্রাণ কি বুঝল? কে জানে, একথাটা শুনে সে খিলখিল করে হেসে উঠল।

এদিকে, দিশা গালি দিতে দিতে রিকশা ডেকে উঠে বসল। ওর পরিকল্পনা ব্যর্থ হবে ভাবতেও পারে নি। সত্যিই সে বাচ্চা জন্মদানে অক্ষম। ওর বাচ্চা জন্মানোর থলি টাই নেই। যদিও তাতেও তার বিন্দুমাত্র আপসোসটুকুও নেই। বাচ্চা না হলে তো আর জান দিতে পারবে না। বাচ্চা ছাড়াও মানুষ বাঁচে। সেও বাঁচবে! শুধু শুধু অক্ষমতা নিয়ে আপসোস করার মানেই হয়না। তবে এটা নিয়ে ওদের স্বামী- স্ত্রীর রোজ ঝামেলা হচ্ছে। তাই সে ইচ্ছেকে দত্তক নিতে এসেছে। যাতে একটা বাচ্চাও পায় আর ওর সংসারটাও টিকে। এখন ইচ্ছেরও তেমন ঝামেলা নেই। তাছাড়া সে জেনেছে, প্রত্যয়ের আগের ফ্ল্যাটটা এখন ইচ্ছের নামে৷ ইচ্ছের সঙ্গে এসব পেলে তো মন্দ হয় না। তাই তার এতো ছলাকলা। কিন্তু আপসোস তার পরিকল্পনা ব্যর্থ হলো!

পরেরদিন বিকালে প্রত্যয় ইচ্ছেকে নিয়ে ইচ্ছের ফ্ল্যাটে এসেছে। প্রতি শুক্রবার ইচ্ছে এখানে আসে। ইচ্ছে ছলছল চোখে ওর আম্মুর আসবাবপত্রে হাত বুলালো। প্রত্যয় সোফায় বসে ইচ্ছেকে দেখছে। ইচ্ছে ওর আব্বু আম্মুর ছবিটাতে আদর দিয়ে বলল, “আব্বু! আম্মু! আমি খুব ভালো আছি! তোমরাও খুব ভালো থেকো।” কথাটা বলে ইচ্ছে শব্দ করে কেঁদে দিল। প্রত্যয় ইচ্ছেকে আঁটকাল না বরং মন খুলে কাঁদতে দিল। ওরা কখনও চায়নি ইচ্ছে ওর আব্বু আম্মুকে ভুলে যাক। বরং ইচ্ছেকে তাগাদা দেয় নামাজে আব্বু আম্মুর জন্য দোয়া করতে। তাছাড়া প্রত্যয় প্রিয়ম ইচ্ছেকে নিয়ে ওর আব্বু আম্মুর কবর জিয়ারত করতে যায়। ইচ্ছে প্রত্যয়ের আম্মুর সঙ্গে নামাজ পড়ে। আর মোনাজাতে আব্বু আম্মু দোয়াও করে। ইচ্ছেকে আজ ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে দেখে প্রত্যয় উঠে আলতো করে ইচ্ছের চোখ মুছে বলল,”সোনা আম্মুটা আর কাঁদেনা। সন্তানরা কাঁদলে বাবা মা খুব কষ্ট পায়। এখন তোমাকে কাঁদতে দেখে আমারও কষ্ট হচ্ছে মা।” ইচ্ছে দ্রুত চোখ মুছে মিষ্টি করে হাসল। যার মানে সে আর কাঁদবেনা! আর প্রত্যয়কেও কষ্ট পেতে দিবে না। প্রত্যয় হেসে ইচ্ছের কপালে আদর দিয়ে বাসার পথে রওনা দিল।

এদিকে বাসায় প্রাণ আর প্রিয়র কান্ড দেখে সবাই হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। একজন কাঁদলে আরেকজন খিলখিল করে হাসছে। যদিও প্রাণ খুব একটা কাঁদেনা। কিন্তু প্রিয় অকারণে কাঁদতে খুব ভালবাসে। প্রিয় যখন কাঁদে প্রাণ ড্যাব ড্যাব তাকিয়ে থাকে, প্রাণকে তাকাতে দেখে প্রিয় আরো জোরে চিৎকার করে কেঁদে উঠে। আর প্রত্যয়কে বাসায় ঢুকতে দেখলে প্রিয় আগে হাত বাড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ এখন তাকে কোলে নিতে হবে। প্রত্যয়কে ফ্রেশ হওয়ার সুযোগ টুকু দেয় না। চিৎকার করে কেঁদে চোখ, নাক, লাল করে ফেলে। এদিকে প্রাণ একদম ঠান্ডা স্বভাবের। ঠিক বাবার মতো হয়েছে। সে একা হাত পা নাড়িয়ে খেলতে পছন্দ করে। এজন্য চাঁদ তো রেগে বাচ্চা অদল বদল করতেও চেয়েছে। সত্যি সত্যি সেটা না করলেও, প্রিয় বেশির ভাগ থাকে প্রত্যয়ের রুমে আর প্রাণ থাকে চাঁদের কাছে। প্রিয়ম মাঝে দু’জনকে কোলে নিয়ে ঘুরতেও বের হয়। কখনও প্রত্যয় দু’জন একসঙ্গে নিয়ে খেলে আদুরে কথাবার্তা বলে। এভাবে দিন কেটে কয়েক মাস পেরিয়ে দু’জনের দাঁত উঠতে দেখা গেল। প্রাণের উঠেছে চারটে দাঁত আর প্রিয়র দু’টো। সেই দাঁতে দিয়ে যাকে তাকে কামড়ে দিয়ে দু’জনে আবার হাসে। কখনও কখনও দু’জন দু’জনকে কামড়ে দু’জনে একসঙ্গে কাঁদে। ওদের কান্ডে কারো কিছু বলার থাকে না, শুধু দম ফাটানো হাসি ছাড়া।

বাস্তব জীবনে হাসি, কান্না, মান, অভিমান আর ভালবাসার বন্ধনে থেকে কেটে গেল, বেশ কয়েকটা বছর। প্রিয় প্রাণ দু’জনই বড় হয়েছে। ওরা দু’জন একসঙ্গে একই কলেজে পড়াশোনা করে। ওরা দু’জনে সামনে বার এইচএসসি দিবে। সারাটাদিন ওদের ঝগড়া প্রায় লেগেই থাকে। প্রাণ খুব স্বল্পভাষী। কিন্তু প্রিয় বাঁচাল টাইপের। ইচ্ছেও ওর পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। পরাগ দেশের বাইরের পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরিও করছে। চাঁদ তুয়াসহ সবাই আগের মতোই আছে। রনিত বসের মন জয় করে তার আরেক মেয়েকে বিয়ে করেছে। পলকের নাম আজও তার মনের কোণে লুকিয়ে আছে। শুধু শেষ বয়সে একজন সঙ্গী দরকার ভেবে জীবনকে আরেকবার সুযোগ দিয়েছে। রনিতের একটা ছেলে হয়েছে। ওরা ওখানেই স্থায়ীভাবে থেকে গেছে। সায়ন একটা মেয়ে বাচ্চা দত্তক নিয়েছে। মাহিম আর রাশেদের যাবৎজীবন কারাদন্ড হয়েছে। সাত বছর পেরিয়ে গেছে রনিতের দাদী মারা গেছে। তুরাগ আর তিন্নির আরেকটা মেয়ে হয়েছে। সব মিলিয়ে সাজানো গুছানো গল্পের চরিত্র গুলো সবাই বেশ সুখে আছে।

আজ পাত্র পক্ষ এসে ইচ্ছেকে আংটি পড়িয়ে গেছে। সেই সময় ইচ্ছের সে কি কান্না! প্রিয়মের বুকে মুখে লুকিয়ে খুব কাঁদছিল। চাঁদ তুয়া প্রত্যয়ের আম্মুও কেঁদেছে। শুধু প্রত্যয় প্রত্যয় কাঁদতে পারেনি। শুধু ছলছল চোখে ইচ্ছেকে বুঝিয়ে কোনো মতে থামিয়েছে। ইচ্ছের বরের নাম স্পর্শ আহমেদ। পেশাতে মেডিকেলের প্রফেসর। দুইদিন আগে, প্রিয়ম কথায় কথায় ইচ্ছের বিশেষ মানুষটার কথা জানতে চেয়েছিল। বাসার সবার সম্পর্ট টা বন্ধুর মতো তাই ইচ্ছে লজ্জায় নতজানু হয়ে ওদের সম্পর্কের কথা জানিয়েছে। ছেলেও সবদিক থেকে পারফেক্ট। তাই সবাই ইচ্ছের পছন্দ মেনে নিয়েছে। অনুষ্ঠান শেষে সন্ধ্যার পরে সবাই আড্ডায় বসেছে। ইচ্ছে সোফায় বসে চুপ করে চানাচুর খাচ্ছে। প্রত্যয়ের বাবা ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, “ভাবলেও শান্তি লাগছে আমাদের ইচ্ছের বিয়ে। এখন বিয়েটা সম্পূর্ণ দেখলে পারলে হয়!” ইচ্ছে খাওয়া থামিয়ে ছলছল চোখে দাদুজানের দিকে তাকাল। এসব শুনলে ওর খুব কষ্ট হয়। মূলত সে দাদুজানের জন্য বিয়েতে রাজি হয়েছে। কারন উনি চাচ্ছিলেন ইচ্ছের বিয়ে দিয়ে দিতে। উনার হার্টে মেজর সমস্যা দেখা দিয়েছে। যদিও প্রত্যয় নিজে চিকিৎসা করছে। তবুও কারো আয়ুর কথা তো বলা যায় না। ইচ্ছেকে এভাবে তাকাতে দেখে উনি কথা বাড়ালেন না। প্রিয়কে ডেকে পাকা চুলে বেঁছে দিতে বললেন।

রাতে প্রান প্রিয় ছাড়া সবাই খেতে বসেছে। চাঁদের বকুনি শুনে প্রিয়ও এসে বসল। প্রত্যয় একবার প্রিয়র দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললে, “সোনা মা তোমার গাল লাল লাগছে কেন? গালে কি হয়েছে?” প্রিয় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,”বাবাই মশা মারতে গিয়ে থাপ্পড়টা বেশি জোরে দিয়ে ফেলেছি।” প্রাণ ততোক্ষণে চেয়ার টেনে বসে বাঁকা হাসছে। কারণ থাপ্পড়টা সে দিয়েছে। প্রায় সে সবার আড়ালে ডেকে প্রিয়কে মারে। প্রাণের ভয়ে একথা সে কাউকে বলতেও পারে না। প্রিয় বাঁচল হলেও বোকাসোকা টাইপের মেয়ে। সাথে প্রাণকে খুব ভয়ও পায়। চাঁদ এখন মাঝে মাঝে প্রাণকে জামাই ডাকে। প্রাণ আগে লজ্জা পেলেও এখন কিছু বলেনা। কিন্তু প্রিয় কেঁদে নাক টেনে টেনে বলে,”না আম্মু এটা হতে পারে না। কিছুতেই না।”

একথা শুনে সবাই মিটিমিটি হাসে। প্রত্যয়ের ছেলে প্রত্যয়ের মতো ব্যাক্তিসম্পূর্ণ। প্রত্যয় প্রিয়মের আদর্শে সে বড় হয়েছে।
চাঁদ প্রিয়ম ছোট থেকে প্রাণকে খুব ভালবাসে। আর প্রত্যয় তুয়া প্রিয়কে। বাসার তিনটা বাচ্চা সমান আদরে বড় হয়েছে। প্রাণ, প্রিয় আর ইচ্ছের সম্পর্কটাও দারুণ। কথার মাঝে
তুয়া ইচ্ছে আর প্রিয়কে মাছ বেছে শাশুড়ির প্লেটে ভাত তুলে দিল। উনাকে কিছু বলার সুযোগ টুকুও দিল না। প্রিয়ম ওর বাবার প্লেটে মাছ তুলে খেতে ইশারায় করল। প্রত্যয় সবার গ্লাসে পানি ঢেলে প্রাণের প্লেটে মাংস তুলে দিল। কারন প্রাণ শুকনো ভাত খাচ্ছিল। প্রাণ মাথা তুলে তাকালে প্রত্যয় হেসে খেতে ইশারা করল। প্রত্যয়ের আব্বু উনার জান্নাত নামক পরিবারের প্রতিটা ফুলের দিকে তাকালেন। প্রতিটা ফুল একটু একটু আদর ভালবাসা দিয়ে যত্ন করে বড় করা। উনি মনে মনে দোয়া করলেন, যেন উনার বাগানটা সব সময় সুখে পরিপূর্ণ থাকে। তারপর হাসি, ঠাট্টা, কথার ছলে খেয়ে যে যার রুমে চলে গেল। তুয়া প্রাণ, প্রিয়, ইচ্ছেকে একবার করে দেখে রুমে চলে আসল। মাঝরাতে প্রত্যয়ের বাবার বুকের ব্যাথা বেড়ে গেল। প্রত্যয় প্রাথমিক চিকিৎসা করে সকালে উনাকে হসপিটালে নিয়ে গেল। পরীক্ষা করে উনার হার্টে তিনটা ব্লক ধরা পড়ল। মূলত চর্বি জমে উনার হৃদযন্ত্রের রক্তনালী ব্লক হয়ে গেছে। প্রত্যয় রিপোর্ট দেখে ভাবল হৃদযন্ত্রে এনজিওপ্লাস্টি করবে। কিন্তু সেটা করা সম্ভব হলো না। তাই ওপেন হার্ট সার্জারি করার সিধান্ত নিল।

প্রত্যয় নার্সকে সব রেডি করে বলে ওটির ড্রেস পড়ে ওটির দিকে গেল। বাসার সবাই প্রত্যয়ের দিকে আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে। প্রত্যয়ের আম্মু চোখ মুছে প্রত্যয়ের মাথায় হাত রেখে বলল, “দোয়া রইল! তোমরা সফল হও।”

ঠিক তখন আরেকজন ওটির ড্রেস পরে প্রত্যয়ের পাশে এসে দাঁড়াল। উনি হলেন কার্ডিওলজিষ্ট ইনশিআরা। ডক্টর ইনশিআরা আর ওয়াসিক মিলে অপারেশনটা করবে। ওরা দু’জনে কথা না বাড়িয়ে ওটিতে ঢুকে গেল। ওটিতে কারো মুখে কোনো কথা নেই, শুধু টুংটাং যন্ত্রপাতি শব্দ। প্রত্যয় ওর বাবার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে কাজ শুরু করল।
একপর্যায়ে ডক্টর ইনশিআরা মুখ তুলে প্রত্যয়ের দিকে তাকাল। প্রত্যয়ের ইশারা পেয়ে, সে পেশেন্টের পা থেকে রগ কাটল। তারপর পুরো বুক কেটে দুই ভাগ করে সেই রগ হৃদযন্ত্রে বসিয়ে দিল। এই রগের মাধ্যমে নতুন ভাবে রক্ত সঞ্চালন হবে। ওদের ওটিতে ঢোকার চার ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। তবুও এখনও কেউ বের হচ্ছে না। অজানা ভয়ে সবার বুকে কাঁপছে। প্রায় পাঁচ ঘন্টা পর ওরা হাসি মুখে ওটি থেকে বের হলো।

ইনশিআরা রক্তমাখা ড্রেসে প্রিয়মকে জড়িয়ে ধরে কান্নারত কন্ঠে বলল,”বাবা! দাদু জানের অপারেশন সাকসেস হয়েছে।”

একথা শুনে সবার মুখে হাসি ফুটল। চাঁদ তুয়া ইনশিআরাকে জড়িয়ে ধরে আদর দিল। এই ডক্টরের পুরো নাম ‘ ইনশিআরা ইচ্ছে।’ সেই ছোট্ট চানাচুর পাগলি মেয়েটা ডক্টর’ ইনশিআরা।’ প্রত্যয়ের চাওয়া পূরণ করতে ইচ্ছে এতোদূর এসেছে। পড়ার চাপে কখনও কেঁদে একাকার করেছে। রাত জেগে চোখের নিচে কালি ফেলে, সেই চেহারা দেখেও কেঁদেছে। অনেক ত্যাগ আর কষ্ট করে সে ডক্টর হয়েছে। আজ ওর কষ্ট স্বার্থক হলো। যদিও শুরু থেকে প্রত্যয় ওকে হাতে ধরে সবটা শিখিয়েছে। আর সেই শিক্ষা সঠিক সময়ে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে।

এদিকে, প্রিয় এককোণে বসে এখনও কেঁদে যাচ্ছে। ওর কান্না সহজে থামেনা। চাঁদ প্রিয়র দিকে বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে তুয়ার সঙ্গে বাইরে গেল। আর প্রাণ প্রিয়কে নিয়ে করিডোরে গেল। প্রিয় হেঁচকি তুলে কাঁদছে আর ওড়নাতে নাকের সর্দি মুছছে। প্রাণ আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বিরক্ত হয়ে বলল,
” তুই কি কান্না থামাবি?”
“থামছেনা! আমার কান্নার ব্রেক ফেল হয়ে গেছে।”
“ওহ আচ্ছা!”

‘ওহ আচ্ছা!’ বলে প্রাণ স্বজোরে প্রিয়র গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। প্রিয় গাল ধরে শব্দ করে কাঁদার আগে প্রাণ বলল,” কান্নার ব্রেক ঠিক করে দিলাম। এবার কান্নার শব্দ কানে আসলে তোর খবর আছে।’ একথা বলে প্রাণ স্থান ত্যাগ করল। আর প্রিয় মুখে ওড়না ঢুকিয়ে কান্না থামাতে না পেরে পেরে বলল,”থামছে না তাও থামছে না।” একদূরে প্রাণ দাঁড়িয়ে কথাটা শুনে বলল,”আর লাগবে? আসব আমি?” প্রিয় চোখ মুছে নাক টেনে বলল,”না থাক হয়ে গেছে।”

দুই সপ্তাহ পর, এখন প্রত্যয়ের বাবা আগের তুলনায় ভালো আছেন। তুয়ার আব্বু আম্মু এসে উনাকে দেখে গেছে। বাসাটা আগের মতো আবার প্রাণোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। হসপিটালে প্রিয়কে মারার কাহিনী প্রত্যয় দেখে ফেলেছিল। পরে সে প্রাণকে ডেকে প্রিয়কে মারতে নিষেধ করেছে। প্রাণ ভেবেছে প্রিয় প্রত্যয়কে বলে দিয়ছে। তাই প্রাণ প্রিয়কে দুই ঘন্টা কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল।

দুপুরে চাঁদ গোসল সেরে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসল। প্রিয়ম শুয়ে শুয়ে টিভিতে খেলা দেখছিল। চাঁদ নিজের চুলে শ্যাম্পুর সুগন্ধ শুকে দাঁত বের করে হেসে বলল,”নিজের চুলের সুগন্ধে নিজেই মাতাল হয়ে যাচ্ছি। আল্লাহ না করুক আমার স্বামী কবে কোমায় চলে যায়।” প্রিয়ম শুনেও না শোনার ভাণ করে থাকল। এতো বছর পরেও চাঁদ ঠিক আগের মতোই আছে। এখনও আগের মতোই প্রিয়মকে জ্বালিয়ে মারে। এখন চাঁদকে প্রত্যুত্তরে কিছু বলা আর পাগলের খোঁচা মারা সমান। তাই প্রিয়ম বুদ্ধিমানের মতো চুপ থাকল।

ওদিকে, তুয়া রান্নাঘর থেকে বের হয়ে ওদের রুমে প্রবেশ করতেই হাতে টান অনুভব করল। প্রত্যয় তুয়াকে পেছন থেকে জড়িত ধরে আদুরে সুরে বলল,
“নিষ্ঠুর বউ আমাকে একটু সময় দিলে কি হয়, হুম?”
” সময় দিব কেন শুনি?”
“কেন দিবে না শুনি?”
” আহ্লাদ।”
“আহ্লাদ না রে পাগলি। এটা তোমার শঙ্খচিলের ভালবাসা।”

কথাটা শুনে তুয়া মুচকি হেসে প্রত্যয়ের বুকে মাথা রেখে বলল,”হুম তুমি আমার মনের আকাশের সুদর্শন শঙ্খচিল। যার পুরো হৃদয়ে শুধু আমার বিচরণ। আর এই শঙ্খচিল টাকে বড্ড বেশি ভালবাসি।” একথা শুনে প্রত্যয় তুয়াকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে বলল,” বুকের বাঁ পাশে আছো সারাজীবন থাকবেও।”

ইচ্ছে স্পর্শের সঙ্গে ক্যাফেতে দেখা করতে এসেছে। স্পর্শ বেশ সুদর্শন এবং চটপটেও বটে। স্পর্শ হঠাৎ খেয়াল করল, ইচ্ছে ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ব্যাপারটা বুঝে স্পর্শ হেসে হাতের প্যাকেটা ইচ্ছের দিকে এগিয়ে দিল। ইচ্ছে মুচকি হেসে স্পর্শের দুই গাল টেনে আদুরে কন্ঠে বলল,”ওলে লে আবার কিউট বাবুটা।” স্পর্শ হাসল কিন্তু প্রত্যুত্তর করল না। সে জানে ইচ্ছে চানাচুর পাগলি। আর পরীক্ষার সেন্টারে ইচ্ছেকে চানাচুর খেতে খেতে লিখতে দেখে সে প্রেমে পড়েছিল। ঝালে ঠোঁটে দু’টো লাল হয়ে গিয়েছিল। সে দৃশ্যটা স্পর্শের চোখে আজও ভাসে। স্পর্শ ইচ্ছের সঙ্গে দেখা দেখতে করতে আসলে চানাচুর নিয়ে আসে। আজও আসার সময় তার ব্যাতিক্রম হয়নি। স্পর্শ একবার আড়চোখে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বিয়ের আগে আমার সামনে আর চানাচুর খাবেনা।”
“কেন? খেলে কি হবে?”
“তাহলে আমিও খাব।”
“তো খাও।”
“উহুম চানাচুর নয় তোমার ঠোঁট।”
“ছিঃ! পঁচা কথা এখন আমি লজ্জা পাচ্ছি।”
“হা হা হা! দেখি দেখি আমার বউয়ের লজ্জামুখটা।”

এদিকে, প্রিয় পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে তুয়াদের রোমাঞ্চ দেখছে আর মিটিমিটি হাসছে। প্রাণ পানি খেতে এসে প্রিয়র কান্ড দেখে ফেলে। প্রাণ ওকে কড়াভাবে মানা করছিল কারো রুমে উঁকি না দিতে। কিন্তু প্রিয় পুনরায় একই কাজ করল। প্রাণ নিঃশব্দে এগিয়ে প্রিয়ও মুখ চেপে ধরে ওর রুমে নিয়ে নিয়ে। প্রিয় ভয়ার্ত চোখ প্রানের দিকে তাকিয়ে আছে। আর প্রাণ হাতে স্টিলের স্কেলটা নিয়ে স্বজোরে টেবিলে আঘাত করছে। যেন এভাবে প্রিয়কে আঘাত করে ক্ষান্ত হবে। হঠাৎ প্রাণ প্রিয়র বাহু ধরে টেনে বিছানায় বসিয়ে বলল,
“আমার নিষেধ অমান্য করলি কেন?”
“আর করব না দাঁত ছুঁয়ে বলছি।”
“আমার কথা অমান্য করার শাস্তি তোকে পেতেই হবে।”
-“আচ্ছা থাপ্পড় দাও, একটু আস্তে দিও।”

প্রাণের ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটল। প্রিয় ভয়ে মাথা নিচু করে কাঁদছে। প্রিয়ও ভয়ার্ত মুখটা প্রাণের কেন জানি খুব ভালো লাগে। তবে সে যে প্রিয়কে ভালবাসে না তা কিন্তু নয়। প্রানের প্রাণ হচ্ছে প্রিয়। যদিও একথা বাসার সবাই জেনেও না জানার ভাণ করে। প্রাণ প্রিয়কে সব সময় চোখে চোখে রাখে। কিন্তু বোকা প্রিয় প্রাণের শাষণটা দেখে কিন্তু ভালবাসাটা বুঝেনা। প্রিয় ওর দুই কান ধরে কেঁদে নাক টেনে টেনে বলল,
” বাবাই কত্ত ভালো আর..।”
“আর আমি খুব খারাপ তাই তো?”
” আমি তোমাকে আমার মনের আকাশের শঙ্খচিল বানাব না, হুম!”
“হতে আমার বয়ে গেছে।”

প্রিয় আর কথা খুঁজে পেল না। তাই সে কিছু একটা ভেবে আড়চোখে প্রাণের দিকে তাকিয়ে দৌড়ে রুম ত্যাগ করল। প্রাণ ধরতে গিয়েও পারল না। প্রিয়র ভাবনা,’ পরের কথা পরে ভাবা যাবে এখন তো পালিয়ে বাঁচি।’ প্রাণ ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল,

“হবু শশুড়ের মতো থাপ্পড়ে বউ সোজা করার দায়িত্বটা এবার আমাকেই নিতে হবে।”

সমাপ্ত!!

(সমাপ্ত থেকে নতুন গল্পের সূচনা করে দিলাম! ‘প্রাণপ্রিয়’ কে নিয়ে আচানক ভাবে আপনাদের মাঝে উপস্থিত হবো। আর হ্যাঁ, আজ আশা করি কেউ সাইলেন্ট থাকবেন না, ধন্যবাদ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here