সুদর্শন শঙ্খচিল’
[১৬]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)
-“আমি করমুজ খাবই খাব, এনে দাও।”
কথাটা বলে ইচ্ছে হাতপা দাপিয়ে কাঁদতে লাগল। সে কাঁদতে কাঁদতে হাতে থাকা খরগোশটাকে ছিটকে
দূরে আছাড় মারল। খরগোশটা ব্যাথা পেয়ে সোফার নিচে লুকাল। কিছুক্ষণ আগে ইচ্ছে একটা বাচ্চাকে তরমুজ খেতে দেখেছে, এখন বাসায় এসে সেও তরমুজ খাওয়ার জন্য কাঁদছে। ওর আম্মু বলছে পরে এনে দিবে কিন্তু সে কিছুতেই শুনছে না। ওর এখনই তরমুজ চাই- ই চাই।
মেয়ের কান্না দেখে ইচ্ছের আম্মু রেগে ইচ্ছেকে বললেন, “মারলে খেতে না চাইলে চুপ কর, ইচ্ছে।” ইচ্ছে গলা জোর বাড়িয়ে বলল, ” না তুমি এনে দাও, আমি করমুজ খাব।”
এবার সে মেঝেতে শুয়ে উপুড় হয়ে কাঁদতে লাগল। আর ওর আম্মু রান্নাঘরে চলে গেল। প্রিয়ম বাইরে যাওয়ার জন্য নিচে নামছিল। ইচ্ছেদের দরজা খোলা আর ইচ্ছেকে মেঝেতে শুয়ে কাঁদতে দেখে প্রিয়ম শব্দ করে ডাকল। ইচ্ছে প্রিয়মের গলা শুনে উঠে বসে বলল, “প্রিউুম, আমি মেলা দুঃখু পেয়ে কাঁদছি।” প্রিয়ম হাসি আঁটকে রেখে সামান্য এগিয়ে এসে বলল, “তা কাঁদছ কেন শুনি?”
ইচ্ছের আম্মু রান্নাঘর থেকে এসে প্রিয়মকে ভেতরে আসতে বলল। প্রিয়ম ভেতরে ঢুকে ইচ্ছেকে কোলে তুলে নিল। ইচ্ছের আম্মু প্রিয়মকে জানাল সে তরমুজ খাওয়া জন্য কাঁদছে। ইচ্ছে প্রিয়মের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।
প্রিয়ম আর প্রত্যয় আগে থেকেই বাচ্চাদের খুব ভালবাসে। কোনো বাচ্চা ওদের কাছে কিছু আবদার করলে, তারা কখনই ফিরায় না। আর ইচ্ছের প্রতি ওদের আলাদা একটা টান কাজ করে। ইচ্ছের মত এমন মিষ্টি দেখতে একটা তোতাপাখিকে ভাল না বেসে থাকাও যাই না।
ইচ্ছের আম্মুর পারমিশন নিয়ে প্রিয়ম ইচ্ছেকে বাইক বসিয়ে বেরিয়ে পড়ল। একটুপরে ইচ্ছে মন মরা হয়ে বলল, “আমার মনে এখন মেলা দুঃখু। আমি এখন কুথাও যাব না, প্রিউুম।” প্রিয়ম হেসে বলল, ” তোমার কষ্ট কমাতেই তো যাচ্ছি, ইচ্ছেমণি।”
ততক্ষণে তরমুজের দোকানের সামনে ওদের বাইক থেমে গেছে। প্রিয়ম ইচ্ছেকে কোলে নিয়ে দোকানে ঢুকল। তরমুজ দেখে ইচ্ছে দাঁত বের করে হেসে বলল, “ইয়ে করমুজ খাব।”
প্রিয়ম ইচ্ছের পছন্দমত বড় একটা তরমুজ নিয়ে বাসায় ফিরল। ইচ্ছের খুশি যেন আর ধরেনা।
**!!
তুয়া ওর জামা কাপড় নিতে ওদের বাসায় এসেছে। তুরাগ চিৎকার করে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে, “আহা গো, বাড়িটা বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কেউ আসলে মন্দ হয় না।” এই নিয়ে চারবার সে একই কথা বলল।
তুয়া ওর ড্রেস নিয়ে তুরাগের সামনে গিয়ে বলল, “ভাইয়া, বিয়ে করবে সরাসরি বলো। এভাবে বাড়ির ফাঁকার হওয়ার অজুহাত দিচ্ছ কেন?”
তুরাগ দাঁত বের করে হেসে বলল, “আরে না সেরকম কিছু না।” তুয়া দুষ্টু হেসে “ওহ আচ্ছা” বলে যাচ্ছে। তুরাগ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে করুণ সুরে বলল, “বোন ওই রকম কিছুই। আব্বু আম্মুকে মনে করিয়ে দে না, প্লিজ।” তুয়া সুযোগে সৎ ব্যবহার করে বলল, “এতে আমার লাভ?”
তুরাগকে বিরক্ত চোখে তাকাতে দেখে তুয়া চলে আসতে যাবে তখন তুরাগ একপ্রকার চেচিয়ে বলল, “শপিং করিয়ে দিব।” তুয়া হেসে, “ডিল ডান” বলে চলে গেল। তুরাগ হেসে মাথা চুলকে রুমে চলে গেল।
**!!
রনিতদের বাসায় ঝগড়া লেগেছে। ঝগড়ার মূল কারণ রনিত বেতন পেয়ে পলককে একটা শাড়ি কিনে দিয়েছে। পলক দুপুরে গোসল সেরে শাড়িটা পড়েছেও। গোলাপি কালার শাড়িতে পলককে বেশ লাগছে লাগছে। কিন্তু রনিত দিশা আর ওর মায়ের জন্য শাড়ি আনেনি, এটাই এই ঝগড়ার মূখ্য কারণ। উনাদের দু’জনে কথা, “রনিত কেন একটা শাড়ি আনল? বউকে দিল তো আমাদের কেন দিল না?”
এসব বলে উনারা পলককে কথা শুনিয়ে যাচ্ছে। দিশাও ওর শাশুড়ির সঙ্গে তাল মিলিয়ে খোঁচা মারছিল। তবে দিশা যে ঘরে বসে লুকিয়ে কত কি খায়, স্বামীকে দিয়ে অসংখ্য শাড়ি এনে আলমারিতে তুলে রাখে, সোনার গয়না বানিয়ে বাবার বাড়ি রেখে আসে, এসব ওর শাশুড়ি জানেও না দেখেও না। তাই ভাবে বড় বউ তুলসীপাতা।
উনাদের ঝগড়ার একপর্যায়ে রনিতের মা পলকের বাবা মা নিয়ে গালাগাল দেওয়া করলেন। এতক্ষণ চুপ থাকলেও পলক আর সহ্য করতে পারল না। বাবা মা একটা মেয়ের সব’চেয়ে দূর্বল পয়েন্ট। সেই বাবাকে মাকে নিয়ে কিছু বললে সহ্য করাও যায় না।
পলক উনার কথা সহ্য করতে পারল না। তাই রেগে হাতের গ্লাসটা ছুঁড়ে ফেলে বলল, ” আমাকে যা ইচ্ছে বলুন। কিন্তু আমার বাবা মাকে কিছু বলবেন না। তাহলে আজকে আমিও আর চুপ থাকব না।”
রনিতের মা রেগে বললেন, ‘কালশাপিনী শরীর দিয়ে আমার ছেলেকে বশ করেছিস। ছেলে এখন মাকে ভুলে বউয়ের আঁচলের তলে থাকে। তুই আমার ছেলের কান ভাঙ্গাস আর আমাকে খারাপ করিস। কি ভেবেছিস আমি কিছু বুঝি না?”
পলক রেগে গর্জে উঠে বলল, “আপনার ছেলে কেন আমার শরীর পেয়ে বশ হল? কেন আপনার আঁচলে তলে থাকল না? ফিরলে ওকেই জিজ্ঞাসা করুন? আজ বিবেকহীন বলেই মা হয়ে একথা অনায়াসে বলতে পারলেন।”
রনিতের আম্মু আরও রাগান্বিত কন্ঠে বললেন, “আমার বিবেক নিয়ে কথা তুলিস? আমার ছেলে বশ করে গলা বাজি করছিস? আমাকে ছেলেকে পর করে তুইও ভাল থাকবি না। তোর উপরে আল্লাহর গজব পড়বে।”
পলক উনার কথা শুনে বলল, বানোয়াট কথা বলবেন না। আপনার ছেলে কি ফিডার খায় নাকি চোখে ছানি পড়া? যে তাকে হাতে ধরে শিখিয়ে বশ করব। আর আপনার বিবেক থাকলে তো বিবেকের কথা তুলব। বিবেকবান হলে এক চোখে তেল আর অন্য চোখে নুন বিলাতেন না। আপনি যত ইচ্ছে অভিশাপ দিতে থাকুন। কথাতেই আছে, শকুণের দোয়াতে গরু মরে না।”
দিশা এবার বলল, “তাই বলে তুমি আম্মাকে শকুণ বলবে?”
পলক দাঁত চেপে বলল, “উনাকে না আপনাকেও বলেছি। কারন আপনিও শকুণ চোখে চুরাচূন্নির মত অন্যের ঘরে উঁকি মারেন।”
এই কথা বলে পলক রুমে গিয়ে দরজা আঁটকে বসে রইল। দিশা রেগে রুমে চলে গেল আর রনিতের মা বিলাপ করে কাঁদতে লাগলেন।
রেগে গেলে মানুষের মুখে কনট্রোল থাকেনা। এখন যেমন রনিতের মায়ের বলা কথাটা বড্ড বেমানান। উনি মা হয়ে ছেলের দিকেই নোংরা ইঙ্গিত করলেন।
উনার কথা দিয়ে বোঝালেন উনার ছেলে বউয়ের শরীরের পাগল।
সংসারের যাবতীয় খরচ সহ এক মাসে সবার মন জয় করা সম্ভব নয়। এই মাসে বউকে কিছু দিল, পরের মাসে না হয় মাকে দিত। কিন্তু রনিতকে উনি সুযোগটাই দিলেন না, তার আগেই আঙ্গুল তুললেন। বাড়ির বউকে যখন শাশুড়ি প্রতিদ্বন্দী ভাবে, তখন এই সমস্যা গুলো সৃষ্টি হয়।
রনিত বাসায় এসে সবটা শুনে শান্তভাবে পলককে বলল, “সব গুছিয়ে নাও আমরা এক্ষনই চলে যাব। রোজকার এসব ঝামেলা থেকে আমি মুক্তি চাই।”
**!!
দুপুরে একটার দিকে প্রত্যয় বাসায় ফিরল। প্রিয়ম আর ইচ্ছে বসে তখন তরমুজ খাচ্ছিল। প্রত্যয়কে দেখে ইচ্ছে দাঁত বের করে হেসে বলল, “প্রত্তুয়, থাবা?”
প্রত্যয় হেসে ইচ্ছের গাল টেনে বলল,” তুমি খাও আমি ফ্রেশ হয়ে আসি” বলে প্রত্যয় ওর রুমে চলে গেল। প্রিয়মের মাথা নিচু করে বসে রইল। সেদিনের পর প্রত্যয় আর প্রিয়মের কোনো কথা হয় নি। আর প্রিয়মও ইচ্ছে করেই প্রত্যয়ের সামনে যায়নি। সে শুধু ভালবেসেছে কোনো পাপ করেনি। তবুও সে ভাইয়ের চোখে চোখ অপরাধী হয়ে গেছে।
প্রত্যয় রুমে ঢুকে তুয়াকে না পেয়ে ফ্রেশ হতে গেল। তুয়া চাঁদের রুম থেকে এসে কলিকে খাবার দিয়ে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল। কালকে সন্ধ্যায় প্রত্যয় চলে যাবে। একথা ভেবে তুয়ার মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল।
প্রত্যয় ফ্রেশ হয়ে এসে তুয়াকে শুয়ে থাকতে বলল, “কোনো সমস্যা?” তুয়া প্রত্যয়ের দিকে তাকিয়ে রইল কিন্তু প্রত্যত্তুর করল না। প্রত্যয় হাতের টাওয়াল রেখে তুয়ার কপালে হাত দিল। জ্বর নেই দেখে তুয়াকে বলল, “কিছু হয়েছে বলো আমাকে?”
তুয়া অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার অনেক বড় অসুখ হয়েছে, মনে হয় আমি আর বাঁচব না।”
তুয়ার কথা শুনে প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “প্রেমরোগে কেউ মরে না। ভালবাসা নামক মেডিসিনটা তিনবেলা ঠিকমত খাও অসুখ সেরে যাবে।”
তুয়া হেসে বলল,” এটা কোন ফার্মেসিতে পাওয়া যাবে, শুনি?”
প্রত্যয় মিটিমিটি হেসে বলল, “কার্ডিওলজিস্ট, ওয়াসিক রায়হান প্রত্যয়ের কাছেই পেয়ে যাবে।”
প্রত্যয়ের আম্মু তুয়া আর প্রত্যয়কে খেতে ডাকছেন। প্রত্যয় তুয়াকে,”খেতে চলো” বলে পা বাড়াতে যাবে তখন তুয়া বলল, “এই যে কার্ডিওলজিস্ট আমার মেডিসিনটা তো দিয়ে যান।”
তুয়ার কথা শুনে প্রত্যয় দাঁড়িয়ে গেল। মুচকি হেসে তুয়ার কপালে আলতো করে ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে বলল, “এই মেডিসিনের সাইড ইফেক্ট মারাত্মক ভয়ংকর, তাই এখন অল্প ডোজের দিলাম।”
প্রত্যয় হাসতে হাসতে উঠে চলে গেল। তুয়া লজ্জা পেয়ে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিল। এই বিল্ডিংয়ের সাততলার একটা মেয়ে তুয়ার সঙ্গে দেখা করতে এলো। চাঁদ উনাকে নিয়ে তুয়ার রুমে ঢুকে দেখে, তুয়া মুখ ঢেকে শুয়ে আছে। চাঁদ তুয়াকে ডাকলে তুয়া উঠে বসে বলল, “আরে মুমিনা আপু তুমি, এসো বসো।”
মুমিনা বসে বলল, “তোর কাছে একটা জিনিস চাইতে আসলাম, প্লিজ ফিরাস না বইন।” তুয়া জানতে চাইল,” কি জিনিস?”
মুমিনা তুয়া আর চাঁদের মুখে দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ” তোরা যে প্রোট্রেকশনই ইউজ করিস, ধার দে বইন। তুই তো সদ্য বিবাহিত তোর কাছে অবশ্যই কিছু আছে, প্লিজ দে। ”
তুয়া আর চাঁদ দু’জনেই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। মুমিনা দাঁত বের করে হাসল। তুয়া ঢোক গিলে চাঁদের দিকে তাকাল। চাঁদ ওর চোখ দু’টো রসগোল্লার মত বড় বড় তাকিয়ে আছে। মুমিনা যে এই কথা বলবে ওরা ভাবতেও পারেনি। এটা কেউ চাইতে আসতে পারে ওদের জানা ছিল না।
তুয়া ওর ঘরের খবর পরকে না জানিয়ে বুদ্ধি খাঁটিয়ে বলল, “আপু আমরা দ্রুত বাচ্চা নিতে চাই। এজন্য এসব রাখার প্রয়োজন মনে করিনি।”
তুয়ার কথা শুনে চাঁদ বুকের হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে
রইল। পর পর দু’টো অনাকাঙ্ক্ষিত কথা সে মানতে পারছেনা। ওর মনে হচ্ছে সে হার্ট এ্যার্টাক করবে।
তুয়ার কথা শুনে মুমিনা আপু হতাশ হয়ে চলে গেল। প্রত্যয়ের আম্মু মুমিনাকে খেয়ে যেতে বললেন, কিন্তু মুমিনা খেয়ে এসেছি বলে স্থান ত্যাগ করল।
মুমিনা চলে যাওয়ার পর চাঁদ আর তুয়া একে অপরের দিকে তাকিয়ে উচ্চশব্দে হাসতে লাগল। প্রত্যয় তখন ড্রয়িংরুমে বসে ফোনে কথা বলছিল। ওদের হাসি শব্দ ড্রয়িংরুম থেকে শুনতে পাচ্ছে।
প্রিয়ম এসে খেতে বসল। একটু পরে প্রত্যয় এসেও বসল। কিন্তু চাঁদ আর তুয়ার আসার নাম নেই। ওরা দু’জনে পেট ধরে এখনও হাসছে।
চাঁদ হাসতে হাসতে বলল, ” চাল, ডাল, চাইলেও তো সহ্য হয়। তাই বলে প্রোট্রেকশন!”
তুয়াও হেসে বলল, “এটাও দেখার বাকি ছিল। দারুণ একটা অভিজ্ঞতা হল আমাদের।”
To be continue….!!