এলোকেশী কন্যা’- [২৬]

1
848

-‘এলোকেশী কন্যা’-
[২৬]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

আলোও দুপুরে খেয়ে না শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে গেল। রোদের কথায় খুব কষ্ট পেয়েছে। রোদ কেন একথা বলল? তার অপরাধ কী? নাকি এটা অজ্ঞাত কারণে রোদের রাগের বহিঃপ্রকাশ, কোনটা? আলো এত ভেবে কেনো উত্তর পেলো না। ওদিকে মেঘ পুরো অফিস দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আগেও সে সারাদিন রোদের সাথে অফিসেই থাকত। অফিসের মধ্য মণি সে। এ কয়েকদিনে আলোকে পেয়ে অফিসের কথা সে ভুলেই গিয়েছিল। আজ আবার আগের মেঘ হয়ে গেছে। অফিসের
স্টার্ফগুলোও যেন ওকে চোখ হারায়। দুষ্টু মেঘকে সবাই খুব
ভালোবাসে। এমনও দিন গেছে স্টার্ফদের হাতে মেঘ খাবার
খাবার খেয়েছে। কেউ কেউ ওর জন্য আলাদা করে খাবারও আনত। আনলে আবার খাইয়েও দিতে হতো। কোনোদিন না
আনলে মেঘবাবুর সে কি রাগ! মুখ ফুলিয়ে প্রায় সারাটাদিন আশেপাশে ঘুরঘুর করত, কিন্তু কথা বলত না। অনেকে এনে শুধু ওকে রাগানোর জন্য দুঃখী দুঃখী ভাব করে বলত, আজ আনে নি। তখন মেঘের কান্ড দেখে না হেসে থাকা যেতো না। রোদ এসব দেখে মেঘকে বকতোই সাথে স্টার্ফদেরও। সবাই চুপ করে শুনতো! তারপর রোদ চলে যাওয়ার পর মেঘ এবং স্টার্ফরা হেসে লুটোপুটি খেতো। এটা ছিল রোজকার রুটিন। আজ মেঘকে পেয়ে সবাই যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে। মেঘের তো গল্পই শেষ হচ্ছে না ওর বউমনিকে নিয়ে। কতশত গল্প শোনাল সবাইকে তার হিসাব নেই। হঠাৎ আলোর কথা মনে হতেই মেঘ দৌড়ে রোদের কেবিনে চলে গেল। রোদ একমণে তখন নিজের কাজ করছিল। রোদের ফোনটা নিয়ে মেঘ আলোকে ফোন দিতে গেলে রোদের কথা শুনে থেমে গেল।
মুখটা ভার করে রোদের কোলে উঠে বুকের সঙ্গে লেগে কাঁধে মাথা রাখল। মন খারাপ হলে সে একাজটাই করে। মেঘকে এভাবে বুকে নিয়ে রোদ মিটিং অবধিই করেছে। কতশত রাত এভাবে বসে অফিসের কাজ করেছে। আম্মুর জন্য কাঁদতে কাঁদতে মেঘ এভাবে রোদের বুকেই ঘুমিয়ে যেতো। ঘুম ভেঙে মেঘ কাঁদবে ভেবে রোদ বেশি নড়তোও না। একইভাবে ওকে বুকে আঁকড়ে ধরে রাখত। অফিসের চাপ, পড়াশোনা, মেঘের দেখাশোনা, সবদিক সামলাতে রোদের খুব কষ্ট হতো। মনে হতো, মেঘকে নিয়েই মরে যেতে। প্রথম সন্তান হিসেবে রোদ যথেষ্ট আদরের ছিল। মা ভক্ত রোদ ছিল ওর আম্মুর প্রাণ।
অথচ আম্মু দায়িত্বের সাগরে ডুবিয়ে ওকে একা রেখেই চলে গেছে। দিনগুলো হয়তো চলে গেছে, কিন্তু সেসব কথা স্মৃতির পাতায় আজও জলজল করছে। মেঘের মন খারাপ দেখে রোদ ওর পিঠে হাত বুলিয়ে আদুরে সুরে বলল,
“ছোট সাহেব কী পিৎজা খাবে?”
“হুম খাবে।”
মেঘের কথা শুনে রোদ মুচকি হেসে সাতটা পিৎজা অর্ডার করল। কারণ একটা করলে স্টার্ফদের দিয়ে মেঘের ভাগে কিছু থাকত না। আর দুষ্টুটা একাও খাবে না। মেঘ চুপ করে বসে থাকতে থাকতে ওভাবেই ঘুমিয়ে গেছে। দশ মিনিটের মধ্যে পিৎজা ডেলিভারী দিয়ে গেল। কিন্তু মেঘ ঘুমাচ্ছে দেখে রোদ আর ডাকল না। একটুপরে আকাশ রোদের কেবিনের এসে ইশারায় দেখিয়ে বোঝাল, ‘ওরা দুপুরে খাবে কখন?’ রোদ ‘একটুপরে’ বলে মেঘের দিকে তাকাল। হাতের কাজটা সেরে মেঘকে ডেকে খাইয়ে দিবে। আকাশ সম্মতি জানিয়ে নিঃশব্দে স্থান ত্যাগ করল। ওইদিকে আরেকজনও এখনো খায় নি। রাকা ফোন করে কেবল জানাল। সব জ্বালা-যন্ত্রণা এসে রোদের ঘাড়েই পড়ে। তবুও না আছে বিরক্ত না আছে কোনো অভিযোগ। তবে রোদও রাকাকে বলেছে, আলোকে ডেকে ওর কথা বলে জোর করে খাওয়াতে। নয়তো বাসায় ফিরে আজ ওর খবর আছে। রাকা ‘আচ্ছা’ বলে আলোকে রোদের ভয় দেখিয়ে জোর করে এনে খেতে বসিয়েছে। আর আলো নাক টানছে, ফুপাচ্ছে, আর খাচ্ছে। রোদকে সে কত রকমের গালি দিচ্ছে একমাত্র সেই জানে। এত অত্যাচার ওর সহ্য হচ্ছে না। হঠাৎ খাবার আটকে গেলে পানি খেয়ে শব্দ করে বলল,
“সব সময় এমন করে, সব সময়। উনি যা বলবে তাই’ই হবে, কেন রে? আমাকে মানুষ মনে হয় না? কী এমন ক্ষতি করেছি আমি? খারাপ মানুষ একটা! থাকব না আমি চলে যাব। এত এত অত্যাচার করলে থাকা যায় নাকি? সে নিজেকে কীভাবে হুম? চলে যাব তো, যেদিকে মন চাই চলে যাব।”
ফুঁপাতে ফুঁপাতে কথাগুলো বলে আলো ওড়নাতে নাক মুছে উঠে চলে গেল। সেও কথা বলবে না! কেন বলবে? ওর কী রাগ নেই? অন্যসময় মেঘ বউমনি! বউমনি! করে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। আর আজ কারোর খেয়াল নেই, বাসায় একটা মানুষ ওদের অপেক্ষায় আছে। তা থাকবে কেন? সে কী কেউ হয় নাকি? হয় না তো, সে কারো কেউ হয় না! এজন্য তো ওর কথা কারো মনেও পড়ে নি। এতসব অভিযোগ নিয়ে আলো বালিশে মুখ গুজেঁ শুয়ে পড়ল। আজ ওর অভিমানের পাল্লা বেশ ভারী। একরাশ অভিমান এসে জমা হয়েছে ওর মনের কোণে।
আচ্ছা আলো যদি জানত, যে ওর বলা প্রতিটা শব্দ কেউ স্পষ্টভাবে শুনেছে। অভিমানেপূর্ণ মুখশ্রীটা কেউ দু’চোখ ভরে দেখেছে। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওড়নায় নাক মুছতে দেখে কেউ নিঃশব্দে হেসেছে। ফুঁপানোর সময় ওর কম্পিত ঠোঁট জোড়া দেখে কারো হৃদস্পন্দন ক্ষণিকের জন্য থমকে গেছে৷ নিচের ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টায় ঠোঁটে যে দাঁতের দাগ বসে গেছে। সেটা স্পষ্ট হয়ে ভেসে ওঠাতে কারো বুকে তোলপাড় শুরু হয়েছে। ওর এলোকেশে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে উঠে যাওয়ার দৃশ্যটা কেউ পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখেছে। সেই সাথে কেউ ওর খোঁপাতে কাঠ গোলাপ গুঁজে দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছে। এসব খবর আদৌ কী সে জানে? নাকি মুখ ফুলিয়ে শুধু অভিমান করতেই জানে? যদিও এসব জানতে চাইলেও তাকে কেউ একজন জানতে দিবে না। এর উত্তরটা অজানা! আর এটাও বলবে না, সে কেউ’টা ওকে আড়াল থেকেই বড্ড বেশি ভালোবাসে!

ওদিকে মাহবরের চিকিৎসার জন্য হাকিমকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। উনি পাশের গ্রামে ওষধি গাছ তুলতে গেছেন। আর ফিরতে নাকি রাত হবে। কয়েকজন উনার খোঁজে বেরিয়েছে, খুঁজে পেলেই হয়। কোন আদাড়ে বাদাড়ে গাছ তুলতে গেছে, কে জানে! মাতবরের হাতের রক্ত ক্ষরণ কমছে না। ধারালো করাতের কোপে রগ কেটে শোচনীয় অবস্থা। আর যার হাতে করাত ছিল সে ব্যাক্তিও পলাতক। নাহলে তারও জান নিতো মতি। মাতবরের অবস্থা দেখে সবাই ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে।
না জানি কখন কী হয়! মতি তো পাগলের মতো সাবেদ আর পূর্ণিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ওদের পেলে সর্ব সম্মুখে সে টুকরো টুকরো করবে। পূর্ণি ঠিক কত্ত বড় কলিজা সে তাই’ই দেখবে। হাকিমকে না পেয়ে অন্য একজনকে ডেকে রক্ত বন্ধের ব্যবস্থা করা হলো।
রক্ত ক্ষরণের কারণে মাতবর অনেকটাই নেতিয়ে গেছে। পূর্ণি আর সাবেদ সেই বাসের ছাদেই আছে। বাস রাঙামাটিতে নয়, সরাসরি ঢাকায় যাবে। কারণ বাসের ছেলে- মেয়েরা ঢাকায় থেকে এসেছিল। পূর্ণি একদৃষ্টিতে সাবেদের দিকে তাকিয়ে আছে। কত্ত ভালোবাসে মানুষ তাকে। সেই মানুষটার হাত ধরেই আজ অজানা শহরের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। না আছে ওদের মাথা গোঁজার ঠাঁই আর না আছে টাকা-পয়সা। শুধু আছে একবুক ভালোবাসা আর অগাত বিশ্বাস। ওরা দু’জনে আহামরি সুন্দর, উচ্চ -শিক্ষিত, বিত্তবান, কোনটাই নয়! এক বেলা অনাহারে থাকা গরীব ঘরের দু’টো ছেলে মেয়ে। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোই অবস্থা! তবুও দু’জনে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে জানে। ভালোবাসার সঠিক মর্ম বুঝে। কঠিন পরিস্থিতিতেও প্রিয় মানুষটাকে আগলে নিতে জানে। এখন দেখার পালা, অচেনা শহরে তাদের কী উপহার দেয়! তাদের অস্বস্তি টিকে থাকবে। নাকি চিরতরের নিঃশেষ হয়ে বিলীন হয়ে যাবে।

বিকেল গড়িয়ে পৃথিবীর বুকে সন্ধ্যায় নেমে এলো। মাগরিবের আজান দিচ্ছে। তবুও মেঘের আসার নাম নাই। রাগে আলোর পুরো শরীর কিড়মিড় করছে। মনে হচ্ছে, ওই দু’টোকে কাঁচা কঞ্চি দিয়ে টানা একঘন্টা পিটাতে পারলে বেশ শান্তি পেতো। বিশেষ করে রোদ নামক খাটাশটাকে। নিজেকে কীভাবে সে? অত্যাচারী মানুষ একটা! আজ আসুক বাসায়। ওর একদিন কী আলোর এক বছর। এমন ব্যবহারে কৈফিয়ত তাকে দিতে হবে, মানে হবেই!যদিও রোদের সামনে কিছু বলার সাহস ওর নেই। তাই মনে মনে বলে রাগ কমানোর চেষ্টা আর কী! আর মনে মনে বলতে তো সমস্যা নেই! আলো নামাজটা পড়ে বই নিয়ে ওর রুমেই পড়তে বসল। আজ ওর অনেক পড়া বাকি আছে। যে ভাবেই হোক সম্পূর্ণ করতেই হবে। নাহলে কালকে কলেজে যেতে পারবে না। কারণ সে কারো হাসির পাত্রী হতে চায় না। আজকাল ওদের ক্লাসে পড়াশোনা নিয়ে পাল্লা-পাল্লি হচ্ছে। কেউ কারো থেকে পিছিয়ে পড়তে রাজি না। একজন না পারলে অন্যজনের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটছে। সেই হাসি দেখে অপরজনের জেদটা দ্বিগুন বেড়ে যাচ্ছে। পুরো কলেজে এখন এই নিয়ে বেশ সমালোচনাও হচ্ছে। শিক্ষকরা আগে তুলনায় অনেকটা এ্যার্লাট হয়ে গেছে। উনারা চাচ্ছেন
ছাত্র-ছাত্রীদের জেদটাকে কাজে লাগাতে চাচ্ছে। জেদটাই ওদের অনেকদূর নিয়ে যাবে। পড়াশোনায় জেদ স্টুডেন্টদের অনেক পরিশ্রমী করে তোলে। আর পরিশ্রম হচ্ছে সাফল্যের চাবিকাঠি। আলো পরপর ওর সব পড়াগুলো সম্পূর্ণ করল। এখন বাজে বারোটা বিশ। আলো মুখটা ভার করে উঠে নিচে গেল। কই রোদ মেঘ কেউই তো নেই। তারা কী এখনো আসে নি? রাকা আলোকে দেখে খেতে দিতে এগিয়ে আসল।আলো রাকার পিছু রান্নাঘরে গিয়ে বলল,
“আপু, ওরা আসে নি? কখন আসবে কিছু বলেছে?”
“স্যার তো অনেক আগে ফিরে, খেয়ে, শুয়ে পড়েছে।”
“ওহ আচ্ছা। আমি এখন খাবো না আপু, আপনি খেয়ে শুয়ে পড়ুন।”
কথাটা বলে আলো ঝাপসা চোখে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল। দু’একবার পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। সে মেঘের রুমে উঁকি মেরে দেখল, মেঘ নেই! তাহলে মেঘ আজ রোদের কাছে শুয়েছে। রোদ এসব ইচ্ছে করেই করছে, এটা আলোরও বুঝতে বাকি নেই। এসবের কোনো মানে হয়? উনি কেন এমন করছে? আর করে হবেটা কী? এসব ভেবে আলো গুটিগুটি পায়ে রোদের রুমের দিকে গেল। ওর রুমের দরজা ভেতর থেকে আটকানো। আর দরজায় বড় বড় করে রঙ্গিন কালি দিয়ে লিখা, ‘ডো’ন্ট ডিস্টার্ব।’
আলো মাথা নিচু করে ওর রুমে এসে শুয়ে পড়ল। পরেরদিন খুব সকালে উঠে নিজে রান্না করে ফ্রেশ হতে গেল। একেবারে রেডি হয়ে এসে রোদদের সঙ্গে নাস্তা করবে ভেবে। কিন্তু এসে ওর রান্না করা খাবারগুলো একটাও টেবিলে দেখল না। তাই রাকাকে ডেকে আলো জিজ্ঞাসা করল। রাকা উত্তর দিলো,
”আমি কেবল ডাস্টবিনে ফেলে আসলাম।”
“ক কে কেন?”
“স্যার বলেছে, এসব খাবার উনি খাবেন না। তাই এখুনি যেন ফেলি আসি। আর বাসায় নাস্তা করার মুডও উনার নেই। তাই মেঘকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।”
আলো আর কিছু বলল না কলেজ ব্যাগটা নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল। চোখ মুছতে মুছতে জেদ ধরেই একা হাঁটা ধরল। রবি এত ডাকলেও শুনল না। কিছুদূর যেতে আলোর সাফির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তারপর বাকিটা পথ সে গল্প করতে করতে সাফির সঙ্গেই গেল। অথচ সাফি ক্ষুণাক্ষরেও টের পেলো না, ওর পাশের মেয়েটা বুকের ভেতরের তোলপাড়। সে যে এখন চিৎকার করে কেঁদে বুক ভাসাতে চাচ্ছে। একথা কেউ বুঝল না। কান্নারা এসে গলায় জটলা পাঁকিয়ে দম আটকে দিচ্ছে। একথা না কেউ জানল আর না কেউ বুঝল। কেবল মেয়েটা একাই কষ্টটা উপলব্ধি করল।

বিঃদ্রঃ- আপনাদের রেসপন্স দেখে আমি সত্যিই হতাশ। আর একটা শব্দ লিখারও ইচ্ছে জাগছে না। শুধু মন চাচ্ছে, গল্পটা অসমাপ্ত রেখে হারিয়ে যায়।

To be continue…………..!!

1 COMMENT

  1. Khubi shundoor hoyese golpota, shamajik,pariparshik shorbo Pori Jiboner shokol bastobik prekkhapot niye lekha hoyese. Keep it up .

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here