এলোকেশী কন্যা’- [৩৫]

0
772

-‘এলোকেশী কন্যা’-
[৩৫]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

রোদের এমন কাজে আলো হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওর রুমে চলে গেল। সুযোগ পেয়ে রোদ ওকে অপদস্থ করছে। লাজুক মেয়েটা যেঁচে বিয়ের কথা বলল, আর সে! আলো বেশ কয়েকবার পায়চারী করে কিছু ভেবে একটা চিরকুট লিখল। তারপর অনেকটা সাহস জুগিয়ে রোদের রুমের দরজা নক করল। রোদ তখন সোফায় বসে মিটিমিটি হাসছিল। সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিলে আলো এটা-ওটা বুঝিয়ে ফিরিয়ে দিতো। এজন্য সে মনে আঘাত করে মনে’ই ওর জায়গাটা পাকা পোক্ত ভাবে স্থাপন করে নিচ্ছে। ক্ষণিকের কষ্টে যদি সারাজীবনের সুখানুভব পাওয়া যায়; তাতে মন্দ কী! তাছাড়া এই টোপ না ফেললে এভাবেই ওদের দিন কাটতে থাকত। দরজা নক হতে দেখে রোদ নিজেকে সামলে নিলো। বোকামি করে এই
পরিকল্পনাটা ভেস্তে দেওয়া যাবে না।
আলো পুনরায় নক করার আগে রোদ দরজা খুলে ভ্রু কুঁচকে ঘড়ির দিকে তাকাল।এখনো প্রায় পঁচিশ মিনিট বাকি। আলো চিরকুট’টা রোদের দিকে এগিয়ে মাথা নিচু করে নিলো। রোদ সেটা
নিয়ে জোরেই পড়ল,’ আমি সব শর্তে রাজি।’
রোদ ঠোঁট কামড়ে কয়েকবার গলা পরিষ্কার করে আলোকে খোঁচা মেরে বলল,
“বিয়ের জন্য এত উতলা কেন, হুম? আজকাল
একটু বেশি’ই রোমান্টিক মুভি দেখো নাকি?”
একথা শুনে আলো চোখ মুখ খিঁচে নত মাথায় দাঁড়িয়ে রইল। এখন যদি রোদের পায়ে স্বজোরে
পাড়া দেয় অথবা রাম চিমটি দৌড় দেয়, তাহলে তো দোষ তো তার হবে। সবাই তো ওকেই বকবে।
নেহাৎ মেঘের জন্য এসব অত্যাচার সহ্য করছে। রোদ ওর থেকে উত্তর না পেয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“চিরকুট গ্রহনযোগ্য না, নিজের মুখে বলো।”
“আমি রাজি।”
“কিসে রাজি?”
আলো কটমট করে একবার তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিলো,
“সব শর্ত মেনে আপনাকে স্বামী হিসেবে গ্রহনে করে, কেবল আপনার দায়িত্ববান অর্ধাঙ্গীর সব দায়িত্ব পালন এবং আপনার বাচ্চার মা হতেও আমি ইচ্ছুক। আমাকে সাদরে গ্রহন করে এবার চিরকৃতজ্ঞ করুন।”
“আমি বাসর অবধি আটকে গিয়েছিলাম। আর তুমি তো দেখি বাচ্চাতে চলে গেছো, সাধু! সাধু! তবে ব্যাপারটা কিন্তু বেশ রোমাঞ্চকর।”
কথাটা বলে রোদ এক ভ্রু উঁচু করে হাসল। আর আলো রেগে হনহন করে স্থান ত্যাগ করল। এই লোক অসভ্য তাও চুড়ান্ত পর্যায়ের। রোদ ওকে রেগে যেতে দেখে শব্দ করে হাসতে লাগল। ইস! রেগে কিছু বলতে না পেরে ফোসফাস করে চলেই গেল। বেচারা হবু বউ!
বিকালের দিকে রোহান, আকাশ, শোভন, এবং রিমিসহ সবাই বাসায় উপস্থিত হয়েছে। আলো রেগে দরজা আটকে ঘুমিয়েছে আর নিচে নামে নি। রিমি আর মেঘের ডাকাডাকি আলো দরজা খুলে জোরপূর্বক হাসল। কান্না করে ঘুমানোর ফলে চোখ মুখ ফুলে লাল হয়ে আছে, দেখতে কিন্তু বেশ লাগছে! রিমি দ্রুম আলোকে গোসলে পাঠিয়ে মেঘকে নিয়ে রোদের রুমে গেল। রোদের সঙ্গে ওর কথা আছে। বাকিরা ড্রয়িংরুমে বসে হইহুল্লোড় শুরু করেছে। রিমি রোদের রুমে নক করে প্রবেশ করল, তারপর সরাসরি একটা প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“আলোর চোখ মুখ ফোলা কেন?”
রোদ ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে মেঘকে কোলে নিয়ে আদর দিলো। মেঘ অভিমান করে মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকাল। রিমি উত্তর না পেয়ে বিরক্ত হয়ে কিছু বলার আগে রোদ বলল,
“জানি না।”
“আলোর মত আছে?”
“হুম, ওকে রেডি করে নিচে আয়।”
কথাটা বলে রোদ মেঘকে নিয়ে নিচে চলে গেল।
রিমি আলোর রুমি গিয়ে দেখে আলো বসে মুখ গোমরা করে চুল মুছছে। ওর লম্বা চুলের পানি গড়িয়ে কামিজটা ভিজে একাকার। তবুও তার হেলদোল নেই। সে নিজের একান্ত ভাবনায় ডুবে আছে। রিমি গল্পের ছলে দরজা আটকে নিজের কাজ করতে লাগল। ওইদিকে সব বন্ধুরা মিলে ড্রয়িংরুমটা ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে। মেঘ রোদের কোলে থেকে চুপ করে সবার কাজ দেখছে। আজকে ওর না আছে দুষ্টমি আর না কথার বাহার। রোদ মেঘের চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে বলল,
“বউমনিকে শেকল দিয়ে বাঁধতেই সকালে কষ্ট দিলাম। আমি খুব সরি; ছোট সাহেব। এখনো আমার উপর রাগ করে থাকবে?”
“বউমনি আর কোথাও যেতে পারবে না? এখানে সারাজীবন থাকবে?
” হুম, সে আর কোথাও যাবে না।”
এবার মেঘের মুখে বিশ্বজয় করা হাসি ফুটল।সে তাড়াহুড়ো করে কোল থেকে নেমে বলল,
”আমার দাভাইয়ের বিয়ে, আমি কাজ না করলে হবে?”
মেঘের কথা শুনে রোদসহ সবাই হেসে ওকে টেনে নিলো। একথা তো করোর মনেই ছিল না। মেঘ কাজ না করলে রোদের বিয়ে তো অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। না এটা তো কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না। এসব বলে সবাই দুষ্টমিতে মেতে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। আকাশ আর রোহান গিয়ে কাজি ডেকে এনে রোদকে চোখের ইশারা করল। রোদ রিমিকে মেসেজ করে নিশ্চুপ হয়ে বসল। এখন সে জীবনের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ধাঁপে পদার্পণ করতে যাচ্ছে; অথচ বাবা-মাকে ছাড়া। এমনটা তো কখনো চায়নি, তাহলে? বড় ছেলে হিসেবে ওর বিয়ে নিয়ে আম্মুর অনেক ইচ্ছে ছিলো।বাবা কতশত রীতিনীতি পালনের গল্প শুনিয়ে মজাও করেছিলেন। ওর আম্মু রোদের চুলে হাত বুলিয়ে বলতেন,
“এই যে রাজকুমার রাজকুমারী এনে দিবো, শুধু পালিয়ে বিয়ে করো না।”
রোদ একথার প্রত্যুউত্তর না করলেও শুধু মুচকি হেসেছিল। ভবিষ্যৎের কথা আগ-বাড়িয়ে বলা বোকামি। ওর বাবাও একদিন কাঁধ চাপড়ে হাসি মুখে বলেছিলেন,
“মেকাবে আবৃত করা চাকচিক্যময় নয়, সাধারণ একজনকে আনবে। যে হবে ঠিক তোমার আম্মুর মতো বরপাগল ঘরনি।”
উনাদের সব কথা রোদের মনে আছে, শুধু মানুষ গুলোই আর নেই। উনারাদের ছাড়া আজ ওকে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে উপনীত হতে হচ্ছে। তেমন কিছু না, শুধু কষ্টে ওর বুকটা ভারী হয়ে উঠেছে। তবে অদ্ভুত ওদের সংযোগ। রোদ আর আলোর কারো’রই শক্ত ছায়া নেই।
এজন্য কেউ সাহসও জুগাচ্ছে না, মাথায় হাত রেখে বলছেও না, ‘ভয় কিসের আমরা আছি।’
যদিও এমন কিছু আশা করেও আর লাভ নেই।
উনারা কেউ আর ফিরবেন না। রোদ বিয়ে নিয়ে মজা করলেও আলোর প্রতি নেওয়া ওর দায়িত্বটা মোটেও মজা নয়।সে পরিপূর্ণভাবে শেষ নিঃশ্বাস অবধি এই দায়িত্বে অটল থাকবে। এটা রোদের নিজের কাছে, নিজের ওয়াদা।
রিমি তখন আলোকে এনে রোদের পাশে বসিয়ে হাসতে হাসতে বলল,
“আরে বোকা মেয়ে ভয় কীসের, হুম? কাঁপছো কেন তুমি?”
ড্রয়িংরুমের সবার দৃষ্টি তখন লাল সুতির শাড়ি পরিহিত ঘোপটা দেওয়া আলোর দিকে।সাজহীন ছলছল চোখের মেয়েটাকে দেখতে বেশ লাগছে। কেঁদে লালবর্ণ মুখটা লাল আঁচলে অদ্ভুত সুন্দর
দেখাচ্ছে। সে এখনো শব্দহীনভাবে অঝরে অশ্রু ঝরাচ্ছে। শোভন’রা এই প্রথম আলোকে দেখে একে অপরের দিকে তাকাল। মেয়েটা ভারী মিষ্টি দেখতে; রোদের সঙ্গে বেশ মানিয়েছে। যাকে বলে ‘মেইড ফর ইচ আদার।’ কাজি ততক্ষণে বিয়ের
কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছেন। মেঘ চুপটি করে আলোর হাতটা ধরে ওর মুখে দিকে তাকাল।সে ভাবছে এটা কেমন শেকল? ভালো শেকল হলে বউমনি কাঁদছে কেন? সে যে বউমনির কান্না সহ্য করতে পারে না। কষ্ট হয়, প্রচুর কষ্ট হয়। কাজি তখন আলোকে কবুল বলতে বললেন। আলো
কবুল না বলে উল্টে ফুঁপিয়ে হেঁচকি তুলে কাঁদতে লাগল। ওর অভিভাবক বলতে কেউ নেই। ওর দাদীমা থাকলেও মনে জোর পেতো। অথচ কেউ নেই;কেউ না। এই কষ্ট আদৌ কেউ বুঝবে? কেউ অনুভব করবে এই নিরব কষ্টের গভীরতা? না, কেউ করবে না। আলোকে এভাবে কাঁদতে দেখে
মেঘ বলল,
“বউমনি এই শেকলের দরকার নাই। চলো রুমে চলো।”
আলো মেঘের হাতটা ওর কপালে ঠেঁকিয়ে শব্দ করে কাঁদতে থাকল। মেঘও আলোকে জড়িয়ে ধরে মুখ লুকিয়ে কেঁদে দিলো। এই মেঘের জন্য
সে এই পদক্ষেপ’টা নিতে বাধ্য হয়েছে, সে বুঝে একজন মা ছাড়া সন্তানের দুর্গতি। অভিভাবক ছাড়া বেঁচে থাকাটাও কতটা দূর্বিষহ। জানবে না কেন? সেও যে একই পথিক। এই পথের যাত্রা সে অনেক আগে থেকেই শুরু করেছে। কঠিন যাত্রা এখনো চলমান! কাজি ভাষাহীনভাবে স্তব্ধ হয়ে শুধু দেখছেন। যদিও এমন অনেক অভিজ্ঞতায় উনার আছে।মেঘ আলোকে টেনে উঠাতে গেলে, আলো উঠল না। বরং নিজেরসহ মেঘের চোখ মুছে একবার রোদের দিকে তাকাল। রোদ লাল চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। এই চোখে না আছে রাগ আর না অভিযোগ! তাহলে উনার চোখ লাল কেন? কষ্ট পাচ্ছে নাকি, কষ্ট পেলে চোখ লাল হয়? রিমিসহ সবাই আলোকে কবুল বলতে তাগাদা দিলো। আলোর চুপ করে রোদের দিকে তাকিয়ে কিছু দেখছে। আজ রোদের চোখ
অনেক না বলা কথার জানান দিচ্ছে। আর সে
যেন এই ভাষা বোঝার’ই অপেক্ষায় ছিলো।রোদ তখন মৃদু স্বরে বলল,
“বলবে না?”
আলো রোদের চোখে চোখ রেখে তিনবার কবুল বলে দিলো। ‘বলবে না?’ এই কথাটার মধ্যে কী যেন একটা ছিল? কি ছিলো, সে জানে না! তবে কিছু একটা ছিল! বেশ অদ্ভুত শোনাল রোদের এই বাক্যটা। হয়তো একটু আবদার, অভিমান, আকাঙ্ক্ষা, আর অসীম ভালোবাসার সংমিশ্রণ ছিল। এজন্য আলো এই সাহসিকতার কাজটাও অনায়াসে করে ফেলল। কিন্তু পরক্ষনেই একরাশ লজ্জায় মাথা নিচু করে রাঙ্গা হয়ে উঠল। লাজে রাঙা রাঙাবউ যাকে বলে ! তারপর রোদও কবুল বলে, রেজিস্ট্রি পেপারের সাইন করে বিয়ে সম্পূর্ণ করল। আর বাঁধাও পড়ল অদৃশ্য এক শেকলে।
ওদের দু’জনের আসল অভিভাবক ‘আকাশ, রোহান, রিমি আর মেঘ।’ আলোর পক্ষে রোহান আর মেঘ, রোদের পক্ষে রিমি আর আকাশ।আর বাকিরা বিয়ের সাক্ষী।কাজিকে বিদায় দিয়ে
এবার সবাই মেতে উঠল হাসি-ঠাট্টায়।

সব ঠিকই ছিল। কিন্তু বিপত্তিটা ঘটল রাতে রোদ রুমে আসার পর। আলো খোলা চুলে বিছানার মাঝখানে বসে উশখুশ করছে। ওর ভেজা চুল
জবজব করছে। গোসল সেরে চুলে খোঁপা করাতে
চুল আর শুকায় নি। আর হেয়ার ড্রয়ারে সে চুল শুকায় না, চুল পেঁচিয়ে যাওয়ার ভয়ে। ওর চুলের পানিতে বেডশীটের অনেকটা ভিজে গেছে। রোদ ফ্রেশ হয় আলোর সামনে বসে বাঁকা হেসে বলল,
“রাঙাবউ!”
একথার প্রত্যুত্তরে আলো ফুঁপিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে দিলো। ভয় আর অস্বস্তিতে ওর প্রাণপাখি যায় যায়। তবে ওর কাজল কালো চোখে বড় বড় অশ্রুফোঁটা গড়িয়ে পড়ার দৃশ্যটা অমায়ায়িক।এ
দৃশ্যটা রোদ মনের কোণে চিরবন্দী করতে ভুলল না। এই দৃশ্যটা সে সারাজীবন অবলোকন করে যাবে, তাও সবার অগোচরে। আলো ওর কান্না আটকে কিছু বলার আগেই রোদ চট করে উঠে বিছানা ঝাড়া ঝাড়ু এনে বলল,
“বাসর রাতে বউ পিটানোর শখটা আমার বহুদিনের। তো বউ, মার খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হও।”
একথা শুনে আলো অসহায় হয়ে আবার কেঁদে দিলো। অবশেষে কি না ভাগ্যে ছিল, এই ঝাড়ুর বারি।”

To be continue…..!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here