সাঁঝক বাতি-‘ নূরজাহান আক্তার (আলো) [১৬]

0
322

-‘সাঁঝক বাতি-‘
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[১৬]

-‘প্রশান্ত, সাফাকে কেন মেরেছে?’
-‘জানি না। তবে আমি ওদের ইন্টিমেট হতে সাহায্য করেছি।’

শিফা সর্বশক্তি দিয়ে নিহার গালে থাপ্পড় দিলো।
ওর ধৈর্য্যের বাঁধ আর মানছে না। সবাই’ই পশু।
মানুষ হলে বিবেকবোধ বলে কিছু থাকত। পাপ ও পূর্ণ্যের পার্থক্য বুঝত। নিহার এই কথা শুনে,
হাসিবও এগিয়ে এসে চার থাপ্পড় বসিয়ে দিলো।
সাফা ও শিফাকে সে বোনের মতো ভালোবাসে।
অথচ এরা! মৃত সাফার ময়নাতদন্তের রিপোর্টে ছিল; প্রেগনেন্ট। তাও আড়াই মাসের। রিপোর্ট আগে শিফা দেখে হাসিবকে দিয়ে মিথ্যা রিপোর্ট বানিয়েছিল। যাতে ব্যাপারটা পাঁচকান না হয়। নয়তো সাফার আব্বু-আম্মু সহ্য করতে পারতেন না। স্বপ্নীলও ভেঙ্গে পড়ত। সবার ভালোর জন্য শিফা একাজ করতে বাধ্য হয়েছিল। এজন্য কেউ
একথা জানে না। নাহলে সন্মান নিয়ে টানাটানি হয়ে যেতো। সাফার বাবা-মাকেও সমাজের লোক বাঁচতে দিতো না। কথার খোঁচা মেরে। এতকিছু শিফা নিজ হাতে সামলেছে। ওর মধ্যেও কেমন ঝড় বইছিল, কেবল সেই জানে! আর সবকিছু হয়েছে এই নরপশুদের জন্য। সাফা মারা গেল, আর পাপীরা বেঁচে রইল। তবে, তাদেরও পতন
হবে, হতেই হবে! সময় কথা বলবে। তবে নিদির্ষ্ট এক পরিস্থিতিতে। পাপ এবং পাপীদের পতন না ঘটলে পৃথিবী আগেই রসাতলে চলে যেতো। না, এবারও পাপ ও পাপিষ্ঠের বরাবর হবে। তখন হাসিব নিহাকে বলল,

-‘এখনো সময় আছে সত্য প্রকাশ করো। নয়তো ফল ভালো হবে না।’

-‘আমি কিছু করি নি। আমাকে ছেড়ে দাও।’

হাসিব মারতে গেলে শিফা আঁটকে দিলো। ওকে
ভুলিয়ে ভালিয়ে কথা বের করার সময় নেই। যা করতে হবে ঝটপট। শিফা হাতের ছুরি রেখে উঠে দাঁড়িয়ে নিহাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করল,

-প্রশান্ত সাফাকে কেন মেরেছে? আর কে কে ওর সঙ্গে জাড়িত?’

-‘জানিনা।’

ওর এই মিথ্যা কথাটা সহ্য করার মতো না। তাই
শিফা পাশে থাকা ফুটন্ত গরম পানি ছুঁড়ে দিলো।
নিহা আতর্নাদ করে উঠল। পুনরায় গরম পানি
দিতে গেলে নিহা বলার জন্য উদ্ধত হলো। তবে
বলতে পারল না, কান্নার জন্য।শিফা ওকে একটু সময় দিলো। যাতে পুরো ঘটনা এখনই জানতে পারে। আর ওর জানাও খুব জুরুরি। নিহা বেশ কয়েকবার শুকনো ঢোক গিলল। পানি পেলে বেশ হতো। তবে ভয়ে পানির কথা বলতে পারল না। যদি টগটগে গরম পানি দেয়। গরম পানিতে পিপাসা মিটবে না। বরং ঝলসে যাবে। শরীরটা যেমন ঝলসে যাচ্ছে। কিন্তু গলাও শুকিয়ে গেছে। ভয়ে বুকটা দুরুদুরু কাঁপছে। পূর্বে কাউকে এতটা ভয় পায় নি সে। অথচ আজ পাচ্ছে! তাও ছোট্ট মেয়েটাকে। শিফার চোখে ধারালো চাহনি। যেন নিমিষেই ভষ্ম করে দিবে। ক্ষুধার্ত বাঘিনী যেন অবশেষে শিকারকে হাতে পেয়েছে। শিকার শেষ।
শিফা এত কঠোর নিহার জানা ছিল না।কীভাবে হলো? তাও হঠাৎ! নিহা এবার একটু সময় নিয়ে বলতে শুরু করল।

প্রথম থেকেই প্রশান্তর নজর ছিল, সাফার দিকে। মেয়েটার শারীরিক গঠন বেশ আকষর্ণীয়। ওর নাকি ছুঁইয়ে দেখার বাসনা জাগে। প্রশান্ত নারীর দেহের পাগল। দিগন্তের পছন্দ উচ্চমানের হলেও প্রশান্ত এমন নয়। একটা হলেই হয়। তবে চাই-ই চাই! আর ভালো সর্বদা ভালোকে আকষর্ণ করে আর খারাপ খারাপকে। ওদের পরিবারের সবাই এমন। কারো চক্ষুলজ্জাও নেই। প্রশান্ত বাবা-মা ও দিগন্তের সামনে মেয়ে নিয়ে রুমে ঢুকে। বাবাও তাই। বড়রা করলে ছোটটা বাদ যাবে কেন? তাই
দিগন্তও। সেও পুরুষ। তারও তো চাহিদা আছে।
আর নিহা বিয়ে ছাড়া বান্ধবীর পরিচয়ে বাসায় আসত, থাকত। কেউ কিছু বলতো না। বাঙালী কার ভেতরে কি আছে খোঁজ করে না। এরা মিষ্টি কথাতে মজে বেশি। সেও প্রশান্তদের ভাড়াটিয়ার
সাথে যেভাবেই মিশতো। বোকা এবং সহজসরল সেজে। এজন্য সবাই খুব সুনামও করতো। নিহা
বিয়ে ছাড়াই প্রশান্তের সঙ্গে অসংখ্যবার ইন্টিমেট হয়েছে। ব্যাপারটা ওদের কাছে খুবই স্বাভাবিক।
একদিন দু’জনে অর্ধনগ্ন হয়ে শুয়ে ছিল। তখন প্রশান্ত গদগদ হয়ে বলেছিল,

-‘নিহা ডালিং নিচের তলার মেয়েটাকে বিছানার আনার ব্যবস্থা করো, প্লিজ!’

তখন নিহা ভাব দেখিয়ে মুখ ভেঙিয়েছিল। এর কারণও আছে। সে প্রশান্তের নাক টেনে আহ্লাদী হয়ে বলেছিল,

-‘এর বিনিময়ে আমি কি পাবো, হুম?’
-‘আমার জানপাখিটার কী চায়, শুনি?’
-‘তোমার ভাইকে। ওর সঙ্গে আমার বিয়ে দাও।’
-‘একথা শুনলে তোমাকে গুম তো করবেই; সঙ্গে আমাকেও।’
-‘তাহলে তুমি আমাকে বিয়ে করো?’
-‘করবো জান। আগে ওই পাখিটাকে খাওয়ার
ব্যবস্থা করো।’

সেদিন থেকেই নিহা সাফার সঙ্গে বেশি মিশতো।দু’দিনে এত আপন হয়, যে সাফারও ওর পেটের কথা সব নিহাকে বলেও দেয়। সব বলতে সব’ই।
এমনকি দিগন্তকে পছন্দ করার কথাও। ওর দূর্বল পয়েন্ট জেনে নিহা আর প্রশান্ত পরিকল্পনা করে।
নিহা সাফাকে বোঝাতে থাকে সে নিজের সাফার কথা দিগন্তকে জানাবে। ওদের একজোড়া করেই ছাড়বে। তার দুইদিন পর, নিহা জানায় দিগন্তকে সে সাফার কথা জানিয়েছে। দিগন্ত নাকি রাজি।
সেও সাফাকে পছন্দ করে।সাফা খুশিতে গদগদ।
প্রশান্ত দিগন্তের নামে আইডিও খোলে ‘ওয়াসিম আহমাদ দিগন্ত।’ পরে ওই আইডি দিয়ে সাফাকে রিকুয়েস্ট পাঠায়। এসব এত দ্রুত হওয়াতে সাফা নিহাকে শুভাকাঙ্ক্ষী ভাবতে থাকে।শিফাকে কম সময় দিতে থাকে। ওদের তেমন কথাও হতো না। শিফা ফোনে দিলে কাজের ব্যস্ততা দেখাত।আর শিফা বাসায় আসলে; ওকে বসিয়ে রেখে সাফা
নিহার কাছে চলে যেতো। শিফা তখনো নিহাকে চিনত না। সে আবার আগ বাড়িয়ে কারো সঙ্গে মিশতে পারে না। সাফারও নিহার সম্পর্কে কিছু বলেছিল না। তারপর থেকেই প্রশান্তর সঙ্গে ওর কথা বলা আরম্ভ হয়েছিল। একদিন প্রশান্ত ওকে বলেছিল,

-‘সাফা, বাইরে আমাকে দেখলেও ঢং করবে না। কেউ যেন না বুঝে আমাদের সম্পর্ক আছে।মনে রোখো! আর তোমার ওই বান্ধবীকেও কিছু বলবা না। আমরা ওকে সারপ্রাইজ দিবো।’

-‘শিফাকে কিছু না বললে আমার শান্তি লাগে না। ওকে আমি প্রচন্ড ভালোবাসি। সে কলিজার বান্ধবী।’
-আর আমি? আমাকে বাসো না?’

সাফা লজ্জায় রাঙাবতী হয়ে রিপ্লাই করেছিল,
-‘খুব৷’
-‘তাহলে আমার কথা রাখতে হবে মানে, হবেই।’
তোমার ভালোবাসার কসম!’
-আচ্ছা।’

এভাবেই ওদের সম্পর্ক চলছিল। এরপর দিগন্তও অফিসের কাজে অন্য জেলাতে চলে গেল। এটা খুব ভালো হয়েছিল। এরপর সাফা রোজ ওদের বাসাতে আসত। নিহার সঙ্গে গল্প করে ওর সময় কাটত। নিহাও সাফাকে কিছু না কিছু রান্না করে খাওয়াত। আর খাবারের সাথে একটা মেডিসিন মিশিয়ে দিতো। প্রতিদিন। কারণ ওদের অজানা নয়, সাফার সর্বশেষ পরিণতি মৃত্যু। তাই তখন থেকে সেই পরিকল্পনা। নয়তো ফেঁসে যাবে। এটা হতে দেওয়া যাবে না। তারপরে, সাফা প্রশান্তদের বাসাতে কিছু খেলেই ঘুমিয়ে যেতো। কড়া ঘুমের ওষুধের প্রভাবে। আর প্রশান্তও ফায়দা উঠাতো।ওর কাজ হয়ে গেলে চলে যেতো। আর সাফাকে ঠিকঠাক করে নিহা ওর পাশে শুয়ে পড়ত। সাফা জেগে নিহাকে ঘুমাতে দেখে আস্তে করে উঠে চলে যেতো। আর নিহা হাসত। মেয়েটা খু্ব’ই বোকা!
এভাবে দিনগুলোও চলত লাগল। আর সাফার অবস্থাও খারাপ হতে লাগল। প্রশান্ত প্রথমদিকে প্রোট্রেকশন ব্যবহার করলেও, পরে করতো না।
সাফা নিজেও বুঝতো ওর সঙ্গে কিছু ঘটছে।তবে লজ্জায় জিজ্ঞাসা করতে পারত না। আবার কি ঘটছে মনে করতে পারত না। ততদিনে ওষুধে ওর অনুভূতিশক্তি অকেজো করতে সক্ষমও হয়েছে।
সাফা একদিন বলেছিল,

-‘নিহা আপু, আমি ঘুমালে কেউ আমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়?’

-‘তোমার উনি খুব আবেগী হয়ে লিপ্ত হয়েছিল।
পরে এখন আফসোস করছে।’

সেদিন দিগন্ত দুইদিনের জন্য বাসায় এসেছিল।
তাই নিহাও বুদ্ধি করে দিগন্তের নামটা বলেছিল।
পরে প্রশান্ত ইনবক্সে অভিনয় করে বারবার ক্ষমা চেয়েছিল। আর দিগন্ত পাতালঘরে কাজের জন্য একসপ্তাহ ছিলো। তখন দিগন্তের নামে প্রশান্ত’ই সঙ্গমে লিপ্ত হতো। বেচারা অবচেতন সাফা। সে
ক্ষুণাক্ষরে টেরও পায় নি। মৃত্যু আগ পর্যন্ত সাফা জেনেছিল, দিগন্ত ওর কাছে এসেছিল। একথাটা কাউকে বলতেও পারত না। ততদিনে নিহা ওকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেছিল। প্রশান্তও কার্যশেষে কম কথা বলতো। সাফারও বেগতিক অবস্থা।
কারো সাথে শেয়ার করবে এটাও মস্তিষ্কে আসত না। চোখে কম দেখা, বমি আসা, ভুলে যাওয়া, মস্তিস্ক কাজ করাও বন্ধ করে দিতো। সে খেতেও
পারত না। ওকে হসপিটালে ভর্তি করাও হলো। তখনো ওর সঙ্গে ফোনও ছিল। প্রশান্ত’ই ফোনটা সরিয়েছিল। যাতে প্রমাণ না থাকে। তবে প্রশান্ত এটা জানত না, সাফার আইডিটা শিফাই খুলে দিয়েছিল। পরে সাফাও নিজের প্রতি অকারণে বিরক্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছিল। আর শিফাকে শেষবার বলেছিল,

-‘প্রিয় আমার প্রাণ নিয়েছে। হ্যাঁ ওই, ওই প্রিয়’ই প্রাণ নিয়েছে।’

শিফা আর শুনতে পারল না। সে মাটিতে বসেই চিৎকার করে কেঁদে উঠল। সাফার মৃত্যুর পর;সে এই প্রথম চিৎকার করে কাঁদছে। শিফা সবাইকে সামলানোর দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে কাঁদতেও পারত না। কষ্টগুলো আর বুক ঠিঁকতে বেরিয়ে আসতে চাইতো। তবুও নিজেকে যথেষ্ট শক্ত রাখত। সে
কলিজার বান্ধবীকে হারানোর ব্যথা মানতে পারে না। কষ্ট হয়! দম আটকে আসে। অদূরে দাঁড়িয়ে হাসিবও কাঁদছে। একটুপরে, শিফা উঠে নিহাকে এসিডে ঝলসানোর ইশারা করল। ওর কঙ্কালটা
প্রশান্তের নামে পার্সেল করে পাঠাতে বলল। যেন সেও কিছুটা আঁচ করে। নিহার আঁকুতিতে কারো মন গলল না। দিনশেষ হাসিবও তাই’ই করল।

দুইদিন পর,

শিফা আর প্রশান্ত মুখোমুখি বসে আছে। কোনো এক নামীদামি রেস্টুরেন্টে। দু’জনের মুখে কুটিল
হাসি। চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি! অপ্রকাশিত কথা হচ্ছে; তাও চোখে চোখে। নিহার কঙ্কালটা পেয়ে প্রশান্ত খুব হেসেছে। ওর চাল ওকে’ই দেখাচ্ছে। মেয়েটা
সত্যিই বোকা। নয়তো এইরকম বোকামিটা কেউ করে? আর নিহাকে খুঁজছিল, একটা পাসওয়ার্ড জানতে। কারণ ওর মনে পড়ছিল না। তাছাড়া কিছু নয়। নিহা মরলেই কি আর বাঁচলে কী? সে কেবল খেলার ঘুঁটি ছিল। তখন প্রশান্ত শিফার শরীরে চোখ বুলিয়ে বলল,

-‘তোমার ওই ঠোঁটজোড়া আমাকে খেতে দাও। যতক্ষণ না আমার তৃপ্তি মিটবে। নয়তো….!’

পাশের টেবিলে থেকে দিগন্ত ফোনে গেম খেলতে খেলতে উত্তর দিলো,

-‘হজম করতে পারবে? ভেবে নিও। বেস্ট অফ লাক।’

To be continue………!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here