‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[৩০]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)
প্রত্যয় প্রিয়মের থেকে পলকের কথা শুনে দ্রুত পায়ে কেবিনের দিকে গেল। রনিত তখনও থম মেরে বসে ছিল।
প্রত্যয় কেবিনে ঢুকে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ডক্টরের দিকে তাকাল। ডক্টরের চোখের ভাষা বুঝে প্রত্যয় চুপ হয়ে গেল। রনিত ছলছল আকুতি ভরা চোখে প্রত্যয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। কারন ওর শেষ ভরসাটুকু প্রত্যয়ের একটা প্রত্যুত্তর। প্রত্যয় নিজ চেক করে ‘না’ বোধক মাথা নাড়াল। যার অর্থ আর নেই। রনিতের শেষ আশাটুকু একনিমিষেই নিভে গেল। সে মেঝেতে বসে দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিল।
তুয়া চাঁদ পলকের খবরটা শুনে হসপিটালে ছুটে এসেছে। কালকে রাতে পলকের সঙ্গে ওদের কথা হয়েছে। আর আজকে পলক আর নেই। তুয়া যেন এটা মানতেই পারছেনা।
একটুপরে, হসপিটাল থেকে পলককে রনিতের বাসায় আনা হলো। পলক লাল শাড়ি পরে এই বাসায় প্রবেশ করেছিল। আর আজ সাদা কাফনে চিরতরে গৃহত্যাগ করবে। এটাই যেন বাস্তবতার নিষ্ঠুর এক নিয়ম। প্রত্যয় হসপিটালের কাজ সেরে সবাই নিয়ে রনিতদের বাসায় আসল। পলকের মা বাবা উঠানে বসে শব্দ করে কাঁদছেন। এতদিন যারা পলককে কটু কথা শুনাত। আজ তারাও ওর চিরবিদায়ে অশ্রু ঝরাচ্ছে।
পলককে গোসল করিয়ে কাফন পড়ানো হয়েছে। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে ওর অন্ধকার কবরে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। পলককের নামটা বাতিল করে লাশ নামে নামকরণ হচ্ছে। শরীর থেকে প্রাণ যেতেই লাশ নামে সবাই ডাকা শুরু করেছে। লাশ দাফন হবে কখন? লাশকে গোসল করানো হয়েছে? লাশ কয়টার সময় মারা গেছে? আশে পাশের মানুষজন ফিসফিস করে এসব আলোচনা করছে। রনিত ধীর পায়ে হেঁটে পলকের কাছে গিয়ে বসল। একদৃষ্টিতে পলককের দিকে তাকিয়ে কান্না ভেজা কন্ঠে বলল,” তুমি যাও, আমিও খুব শীঘ্রই আসব। হাশরের ময়দানে আমাদের আবার দেখা হবে।”
রনিতের কথাটা শুনে উপস্থিত সবার শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গেল। রনিতের কথাটা বুঝিয়ে দিল, পলকের প্রতি তার ভালবাসা। কথাটা বলে রনিত মাথা নিচু করে কাঁদতে লাগল। ইশার নামাজের পূর্বে পলকের দাফন কার্য সম্পূর্ণ করা হলো। কবরস্থান থেকে সবাই ধীরে ধীরে স্থান ত্যাগ করল। শুধু রনিত পলকের কবরের থেকে একদূরে বসে রইল। ওদের আড়াই মাসের মৃত বাচ্চাটা দেখে রনিতের বুকটা ফেঁটে যাচ্ছিল। বাবুটা ধীরে ধীরে বড় হতো। ওকে আদুরে সুরে বাবা বলে ডাকত, নানান আবদার করত। কিন্তু সবটাই অপরিপূর্ণ স্বপ্ন হিসেবে রয়ে গেল। শুধু পলক নয় ওদের বাচ্চাটাও ওকে ফাঁকি দিল। রনিত মাথা নিচু করে বিরবির করে বলল,”আল্লাহ! আল্লাহ গো, আমি পাপী বলেই কি আমাকে বাঁচিয়ে রাখলে? আমার দুই টা প্রিয় মানুষের সঙ্গে আমাকে কেন নিলেনা?”
রনিতের থেকে বেশ কিছুটা দূরে প্রত্যয় আর তুয়া দাঁড়িয়ে আছে। তুয়া প্রত্যয়ের বাহুতে মাথা রেখে নিরবে কাঁদছে। আজকে রনিত পলকের জায়গায় ওরা দু’জন থাকতে পারত। তুয়ার জেদ মানলে হয়তো তুয়ার পরিণতিও এমন হতে পারত। মূলত একারনেই প্রত্যয় তুয়ার আবেগকে সাপোর্ট করেনি। তুয়ার কথাতে কষ্ট পেলেও ভুল পদক্ষেপ নিতে দেয়নি। অপরিপক্ব বয়সে বিয়ে আর গর্ভধারণ দু’টো এক নয়। বিয়েটা সামলে নিলেও অপরিপক্ব বয়সে গর্ভধারণ মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। তার সঠিক উদাহরণ পলক।
তুয়া মারা গেলে প্রত্যয় কি করত? তুয়াকে ছাড়া প্রত্যয় থাকতে পারত? প্রত্যয়কে ছাড়া সে বা কিভাবে থাকত? এসব ভাবনা তুয়াকে কষ্টে জর্জরিত করে দিচ্ছে। তুয়া আবারও ভাবছে, ‘ অপরিপক্ব বয়সে অহরহ মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে, বাচ্চা হচ্ছে। তারা তো দিব্যি সুস্থভাবে বেঁচে আছে। পলকের সঙ্গেও এমনটা না হলেও পারত। কিন্তু তা তো হলো না।’ এখানে আবার প্রমান হলো সবার ভাগ্য এক নয়। নিরাপদ পথের যাত্রাকালে সবাই বিনাবিঘ্নে চলে যায়। কিন্তু সহজ সরল মানুষটা সেখানে মুখ থুবকে পরে। আর নয়তো কোনো একটা বিপদের সম্মুখীন হয়। এজন্য কারো ভাগ্যের সঙ্গে কারো ভাগ্যের মিল খুঁজতে নেই। কারন কারো জীবনের পরিসীমা এক নয়। আর এটা তিতা হলেও আরেকটা বাস্তবিক সত্য।
প্রত্যয় আলতো করে তুয়ার চোখ মুছে শান্ত কন্ঠে বলল,” প্রিয় মানুষটাকে দাফন করার কষ্ট সেই বোঝে, সে করে। উহুম, কেঁদো না দোয়া করো। আল্লাহ যেন রনিতকে ধৈর্য্য ধারণের তৌফিক দান করে।” তুয়া হেঁচকি তুলে কেঁদে বলল,”ভাইয়ার কষ্টটা চোখে দেখা যাচ্ছে না। এমনটা তো না হলেও পারতো?” প্রত্যয় প্রত্যুত্তরে বলল,”এটা হচ্ছে বাস্তবতা নিষ্ঠুর কড়াঘাত। আর এটা আমর সবাই মানতে বাধ্য।”
একটুপরে, প্রত্যয় তুয়া রনিতকে বুঝিয়ে বাসায় নিয়ে গেল। বাসায় ফেরার সময় রনিত বার বার পেছন ফিরে তাকাচ্ছিল। ওর মনে হচ্ছিল পলক ওকে ডাকছে। কিন্তু পলকের ডাক শুনতে পেলো না। প্রত্যয় রনিতের বাসায় নিয়ে গিয়ে যতটুকু সম্ভব বুঝাল। রাত এগারোটার দিকে রনিতের খেয়াল রাখতে বলে, প্রত্যয় তুয়াকে নিয়ে বাসার পথে রওনা দিল। দাফনের কাজ শেষ করে প্রিয়মরা চলে গেছে। শুধু প্রত্যয় আর তুয়া ছিল। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রনিতের বাসাটাও আস্তে আস্তে ফাঁকা হয়ে গেল।
গাড়িতে, তুয়া প্রত্যয়ের বুকে মাথা রেখে চুপটি করে বসে আছে। প্রত্যয় এক হাতে তুয়াকে আঁকড়ে ধরে অন্যহাতে ড্রাইভ করছে। তুয়াকে নিশ্চুপ দেখে প্রত্যয় তুয়ার দিকে একবার তাকিয়ে বলল,”বাস্তবতা নিয়েই আমাদের জীবন। জন্ম নিলে মৃত্যুর স্বাদ সবাইকে নিতে হবে। জানো, একটা সময় আমি আমার পেশেন্টের মৃত্যু মানতে পারতাম না। খারাপ লাগত খুব কষ্টও হতো। মনে হতো জাদু করে সবাইকে বাঁচিয়ে দিতে। কিন্তু জন্ম, আর মৃত্যুর জাদুকাঠি তো সৃষ্টিকর্তার হাতে। তাই কষ্ট হলেও মেনে নিতে হতো। ইন্টার্নির সময় প্রথমবার হার্টের অপারেশন করা দেখে, আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ছিলাম। অথচ, আজকে এই হাত দিয়ে অসংখ্য পেশেন্টের হার্ট অপারেশন করি। এখন হসপিটালে রোজ মৃত্যুর রথ আর আপনজন হারানো আত্মনার্দ শুনি। এখন পেশেন্টের মৃত্যুর আগ মূহুর্তের ছটফটানি দেখেও অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আজকে সকালেও আমার একটা পেশেন্ট মারা গেল। মারা যাওয়ার সময় আমার হাতের মুঠোয় ওর হাত ছিল। ছেলেটা মারা যাচ্ছে দেখে আয়াতুল কুরসি পড়ে ওকে ফুঁ দিলাম। সে সঙ্গে সঙ্গে শান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। আম্মু একদিন বলেছিল, তুমি ডক্টর হওয়ার আগে একজন মানুষ। যখন কেউ তোমার সামনে মারা যাবে, তখন আয়াতুল কুরসি পড়ে ফুঁ দিবা। তাহলে তার মৃত্যুটা সহজ হবে।’ আম্মুর কথাটা শুনে আমি ঠিক তাই করি। আমার এই কাজ দেখে অনেকজন হেসেছে, তবুও কিন্তু আমি আমার কাজ থামায়নি। জানো তুয়া আমার মনে হয়, আজ আমি কারো শেষ সময়ে পাশে থাকলে, আমার মৃত্যুর সময় আমিও কাউকে আমার পাশে পাবো। আর আমরা ডক্টররা কল্পনায় ডুবে নয়। বরং মৃত্যুর মতো কঠিন সত্য দেখে আমাদের দিন কাটে। তবে এর মধ্যেও আরেকটা সত্যি লুকিয়ে আছে, জানো সেটা কি?”
তুয়া ছলছল চোখে তাকিয়ে ‘না’ বোধক মাথা নাড়াল। প্রত্যয় মুচকি হেসে একহাত দিয়ে তুয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,”ডক্টরদের মন অনেক শক্ত হয়। তারপরেও প্রিয় মানুষটার ক্ষেত্রে তারাও খুব দূর্বল। কথাটা শুনে তুয়া নিজেকে আর আঁটকাতে পারল না। প্রত্যয়ের শার্টের কলার আঁকড়ে ধরে শব্দ করে কাঁদতে লাগল। প্রত্যয় কিছু বলল না শুধু দেখে গেল। সে বুঝল, পলকের মৃত্যু আর রনিতের ভালবাসা দেখে তুয়ার মনে দাগ কেটেছে।
এদিকে, ইচ্ছের আম্মু এ খবর শুনে কান্নাকাটি করছে। ওরা সিলেট পৌঁছোনোর পরে তুয়া থেকে খবরটা শুনল। কিন্তু এতরাতে আর আসতে পারল না।
প্রায় তেরো দিনপর, রনিত ওর অফিসে গেল। কিছুদিন আগে রনিতকে বাইরের দেশে যাওয়ার অফার করা হয়েছিল। কিন্তু পলকের জন্য সে না করেছিল। এই গুমোট পরিবেশ থেকে বের হতে, রনিত বাইরের দেশের যাওয়ার কথাটা জানাল। যদিও অফিস কতৃপক্ষ রনিতের জায়গায় অন্য কারো নাম দিয়েছিল। কিন্তু রনিতের ব্যাপারটা বিশেষ বিবেচনায় ভেবে ওকে সুযোগ দেওয়া হলো। সে যদি এভাবে নিজেকে সামলে নিতে পারে। তাহলে ক্ষতি কি? রনিত অফিস থেকে বের হয়ে, পলকের কবর জিয়ারত করে ওখানে বসে রইল। সে বাড়ির কারো সঙ্গে খুব একটা কথা বলেনা। নিজের মতো চলে, কখন যায়? কখন আসে? কেউ বুঝতেও পারেনা। চারদিন পর রনিত চাকরিসূত্রে জার্মানিতে চলে গেল। আর যাওয়ার আগে ওর বাবাকে ওদের ফ্ল্যাটের জিনিস গুলো এনে, ফ্ল্যাট টা ছেড়ে দিতে বলল। সে চাইলে কাজটা নিজে করতে পারত। কিন্তু পলকছাড়া ওর ফ্ল্যাটে ঢোকার সাহস ওর হয়ে উঠল না।
ব্যস্ত জীবনে যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। চাঁদ আর তুয়া নিজেদের পড়াশোনায় মনে দিয়েছে। এখন ওরা সবাই বসুন্ধরার ফ্ল্যাটে থাকে। প্রিয়ম দু’টো প্রোগ্রামে সফল হয়েছে। এখন সে আগের তুলনায় গানের অনেক অফারও পাচ্ছে। চাঁদ আর প্রিয়মের সম্পর্কটা আগের তুলনায় একটু পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু প্রিয়মের থাপ্পড়ের কোনো পরিবর্তন আসেনি। চাঁদ উল্টা পাল্টা কিছু করলে বা বললে থাপ্পড় খায়। দুইদিন আগে, ইচ্ছের সাথে প্রত্যয়ের অনেক কথা হয়েছে। সিলেটে গিয়ে ইচ্ছে থাকতে চাচ্ছিল না খুব কান্নাকাটি করছিল। কিন্তু তিনদিনের বেলায় খেলার সাথী পেয়ে মানিয়ে নিয়েছে। তুয়ার আব্বু আম্মু প্রত্যয়দের বাসায় থেকে দুইবার বেড়াতে গিয়ে ছিলেন। উনারা এখন তুরাগের বিয়ের চিন্তা করছেন। তুরাগ আজকাল কেমন হয়ে গেছে। কিছু বললে রেগে যায় অযথা চেঁচামেচি করে। বিয়ের কথা তুললে এড়িয়ে যায়।
তার ঠিক দুইদিন পর, বিকেলের দিকে তুরাগ বাসায় ফিরল। ওর আব্বু আম্মু তখন চা খাচ্ছিলেন। তুরাগ ফোনে কথা বলে রেগে সোফার কুশনটা ছুঁড়ে মেরে বলল,”আম্মু আব্বু দুই দিনের মধ্যে আমি বিয়ে করব, তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করো।” তুরাগের বাবা বললেন,”তাহলে ইলার বাবার সঙ্গে কথা বলতে হবে।” তুরাগ রাগটা কনট্রোল করে বলল,”ইলা নয়, তোমরা অন্য মেয়ে দেখো। আর দুই দিনের মধ্যে বিয়ে দাও নাহলে আমি বাড়ি ছাড়া হবো। আর ভুলেও ওই মেয়ের নাম মুখে আনবে না।”
To be continue…!!