#বুকের_বা_পাশে 🌿🌿
#written_by_Nurzahan_Akter_Allo
#Part_20
২দিন পর______
তুয়া হসপিটালের কেবিনের বাইরে বসে আছে। তুরাগ আর ওর আম্মু কেবিনে গেছে। ওরা কেউ তুয়াকে কেবিনের ভেতর যেতে দেয় না। তুয়ার বাবা তুয়ার সাথে এখনো একটা কথা বলেনি। তুয়া বাসাতেও যায় না, সারাটাক্ষণ হসপিটালেই থাকে।
প্রত্যয় জোর করে তুয়াকে প্রত্যয়ের পারসোনাল কেবিনে নিয়ে গেল। তুয়া কোন কথা বলেনি। তুয়াকে এখন যে যত যায় বলুক তুয়া টু শব্দটুকু করে না। সবার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। আগের তুয়া আর এই তুয়ার মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। এই তুয়া কথা বলতে জানে না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তুয়া কেমন জানি রোবটে পরিনত হয়েছে। প্রত্যয় তুয়াকে ওর কেবিনে নিয়ে এসে বসালো। আর তুয়ার সামনে এক লোকমা ভাত তুলে ধরলো। তুয়া মাথা নিচু করে বসে আছে। প্রত্যয় তুয়ার মাথায় হাত রেখে বললো,
— “খেয়ে নে ।আর কত নিজের অযত্ন করবি? আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।” (প্রত্যয়)
— (নিশ্চুপ)
— “হা কর। একটু খেয়ে নে, এভাবে না খেয়ে থাকলে তো তুইও অসুস্থ হয়ে পড়বি। তুই তো লক্ষী মেয়ে প্লিজ এবার হা কর।” (প্রত্যয়)
— (নিশ্চুপ)
তুয়া এবারও টু শব্দ করলো না। তবে তুয়া প্রত্যয়ের হাতে থাকা খাবারটা খেলো। তুয়া এখন পর্যন্ত কারো সাথে কথা বলেনি। মাঝে মাঝে একা একা কি যেনো বিরবির করছে। আবার মাঝে মাঝে ডুকরে কাঁদছে। তুয়া নিজেকে একেবারে গুটিয়ে নিয়েছে। এলোমেলো চুল, পড়নে প্রিয়মের দেওয়া সেই লাল শাড়িটা, মলিন মুখ, টানা টানা চোখ দুটো ফুলে আছে। এর সাথে চোখের নিচের কালিটাও এসে যুক্ত হয়েছে। তুয়ার হাসি খুশিতে থাকা জীবনটাতে যেন হুট করে ভয়ংকার কালো মেঘের ঘনঘটা। সেই মেঘ এসে যেন সব কিছু চূর্ন-বিচূর্ন করে দিলো। ওর সব ইচ্ছে আর স্বপ্নের সমাপ্তি ঘটলো। তুয়া প্রথমে নিজেকে শক্ত রাখলেও পরে একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে। আর এভাবে চলতে থাকলে তুয়ার মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। কারণ তুয়া মুখে কিছু বলছে না। তুয়া এমন চুপ করে থাকলেও কিন্তু ও ওর জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো বারবার স্মৃতিচরণ করেই যাচ্ছে। এর ফলে ওর ব্রেণেও অনেক চাপ পড়ছে।
প্রত্যয় তুয়াকে খাইয়ে দিলো। তারপর তুয়ার শরীরে একটা ইনজেকশন পুশ করে দিলো। যে তুয়া ইনজেকশনের সূচ দেখলে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করে। এখন সেই তুয়ার যে কোন খেয়ালই নেই। প্রত্যয়ের পারসোনাল কেবিনে সবকিছুর ব্যবস্থা আছে। এখানে বেড থেকে শুরু করে সবকিছু রয়েছে। প্রত্যয় তুয়াকে বেডে শুয়ে পড়তে বললো। তুয়া তাই করলো। প্রত্যয় তুয়াকে চোখ বন্ধ করতে বললো। তুয়া এবারও তাই করলো। প্রত্যয় ছলছল চোখে তুয়ার মুখ পানে চেয়ে আছে। কি বলবে? আর কি করেই বা এখন সে তুয়াকে স্বাভাবিক করবে? প্রত্যয় চোখের কোণেতে জমে থাকা পানিটা মুছে ফেললো। প্রত্যয়ের কথা শুনে তুয়া ওর চোখ বন্ধ করে থাকতে থাকতে ওর চোখে ঘুম নেমে এলো। প্রত্যয় তুয়ার দিকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তুয়ার এমন ভাবে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়াটা প্রত্যয় সহ্য করতে পারছে না। ওভাবেই কিছুক্ষন বসে থেকে প্রত্যয় নিঃশব্দে ওর কেবিন থেকে বের হয়ে গেল।
প্রত্যয় কেবিন থেকে বের হলো।আর তখনই ওর আম্মু ওকে ফোন দিলো। প্রত্যয় ওর ফোনটা রিসিভ করলো।প্রত্যয়ের আম্মু চিন্তিত গলায় জিজ্ঞাসা করলো,
— “এখন তুয়ার কি অবস্থা আব্বু?”
— “আমি এখন খাওয়ালাম আর ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছি। এখন ঘুমাচ্ছে।” (প্রত্যয়)
— “ইনজেকশন?”
— “হুম! ওর এখন রেস্টের বড্ড প্রয়োজন। এমন ভাবে চলতে থাকলে ও অসুস্থ হতে যেতে পারে। এজন্য ইনজেকশনটা দিলাম। আপাতত তিন ঘন্টা ঘুমাবে নিশ্চিত।” (প্রত্যয়)
— “হুম! আচ্ছা আমি তুয়ার দুইটা ড্রেস পাঠিয়ে দিচ্ছি।ওই শাড়িটাই দুইদিন ধরে পড়ে আছে।” (প্রত্যয়ের আম্মু)
— “আম্মু ড্রেস লাগবে না। আমি একজনকে ড্রেস আনতে দিয়েছি। তুমি টেনশন করো না।” (প্রত্যয়)
— “আব্বু সবার তো খেয়াল রাখছিস। নিজের দিকেও এবার একটু তাকা।” (প্রত্যয়ের আম্মু)
— “আম্মু আমি ঠিক আছি। তুমি চিন্তা করোনা।” (প্রত্যয় মুচকি হেসে)
— “হুম।”
প্রত্যয় কথা বলা শেষ করে ওটির দিকে গেল। প্রত্যয়ের সাথে তুয়ার আম্মু আর তুরাগের কথা হয়েছে। তুরাগ কেবিন থেকে বের হয়ে তুয়াকে দেখতে না পেয়ে আশেপাশে তাকালো। প্রত্যয়ের কাছে ফোন করার জন্য ফোন বের করতেই দেখে প্রত্যয় ওকে মেসেজ করে বলে দিয়েছে যে,
“ভাইয়া তুয়া আমার কেবিনে আছে। ওকে খাইয়ে ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছি। এখন তিন ঘন্টার মতো তুয়া ঘুমাবে। আপনি টেনশন করবেন না। আমি এখন ওটিতে গেলাম। আর তুয়াকে দেখতে চাইলে আমার কেবিনে গিয়ে দেখে আসতে পারেন।” (প্রত্যয়)
তুরাগ যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। তুরাগ যতই বোনের উপর রেগে থাকুক,কথা না বলুক, তাও সে তার বোন।প্রত্যয় আড়াই ঘন্টা পরে ওটি থেকে বের হলো। ওর এই অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে। প্রত্যয় ওর পারসোনাল কেবিনে আসলো। তুয়া এখনও ঘুমাচ্ছে। প্রত্যয় ওর সার্জারির ড্রেস বদলে নিলো। তারপর বাইরে গিয়ে তুরাগের সাথে কথা বললো,
— “ভাইয়া আমি তুয়াকে নিয়ে বাসায় যাচ্ছি। আর টেনশন করবেন না, আংকেল এখন ঠিক আছে।” (প্রত্যয়)
— “আচ্ছা তুমি যাও।”
— “হুম”
প্রত্যয় তুয়াকে কোলে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। বাসায় ফিরে প্রত্যয়ের রুমের বেডের উপরে তুয়াকে শুইয়ে দিলো। প্রত্যয়ের আম্মু প্রত্যয়ের রুমে আসলো।প্রত্যয় ইশারায় ওর আম্মুকে বললো কোন কথা না বলতে। প্রত্যয়ের আম্মু কোন কথা বললো না। শুধু ইশারায় বললো প্রত্যয়কে ফ্রেশ হয়ে নিতে। প্রত্যয় একবার তুয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। প্রত্যয় সাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ঠান্ডা পানি মাথা থেকে গড়িয়ে পুরো শরীর ভিজে যাচ্ছে। কিন্তু অশান্ত মনটা কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না।প্রত্যয়ের মনে হাজার প্রশ্নের ঝুলি এসে জমা হয়েছে।কিন্তু প্রত্যয়ের কাছে একটা প্রশ্নেরও উওর জানা নেই প্রত্যয় মনে মনে ভাবছে,
— “এত কিছু হয়ে গেল। সব কিছু উল্টে পাল্টে গেল।শুধু তোর পাগলামির জন্য তুয়া। কেন এমনটা করলি তুয়া? এমন একটা ঝড়ের অার্বিভাবে আমাদের সবার জীবনের মোড় ঘুরে গেল। এ কোন ভয়ংকর খেলায় মেতে উঠেছিস তুই? এই ভুল সিদ্ধান্তের জন্য এখন আমাদের সবাইকে চরম মূল্য দিতে হচ্ছে। তুই যদি আগে আমাকে একটা বার বলতি। তাহলে আজকে অন্তত আমাদের এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন
হতে হতো না।” (প্রত্যয়)
প্রত্যয় সাওয়ার নিয়ে টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুমে থেকে বের হলো। তুয়া ঘুম থেকে উঠে গেছে।বেডের মাঝামাঝি অবস্থায় হাটু ভাজ করে হাঁটুর ভেতরে মাথা গুঁজে বসে আছে। এলোমেলো অবাধ্য চুল গুলো সিলিং ফ্যানের বাতাসে উড়ছে। প্রত্যয় তুয়ার কাছে এসে বসলো। শান্ত কন্ঠ বললো,
— “তুয়া সাওয়ার নিয়ে আয়। তাহলে শরীর মন দুটোই ফ্রেশ লাগবে।” (প্রত্যয়)
— (নিশ্চুপ)
— “কি রে উঠ, তারাতাড়ি গিয়ে সাওয়ার নিয়ে আয়।”
— “আমাকে হসপিটাল থেকে কে আনলো?” (তুয়া মুখ তুলে)
— “আমি।” (প্রত্যয়)
— “কেন? আমি কি তোমাকে আনতে বলেছি?” (তুয়া)
— “তোর বলতে হবে কেন? হসপিটালে থেকে তুই কি করবি? এসব কথা আপাতত থাক। তুই সাওয়ার নিয়ে আয়।” (প্রত্যয়)
— “প্রিয়মের কোন খবর জানো? কেমন আছে ও?” (ধরা গলায়)
— “পরে সব বলবো। আগে তোকে যা বলছি তুই তাই কর।”
— “কেন এতো জোর দেখাচ্ছো?” (তুয়া)
— “জোর দেখানোর অধিকারটা এখন আমার আছে।তাই জোর দেখাচ্ছি বুঝলি? এবার যা তুই।” (প্রত্যয়)
— “সুযোগের সৎ ব্যবহারে করছো?” (জোর পূর্বক হাসি দিয়ে)
— “যদি তাই ভাবিস তো তাই। এবার তুই যাবি নাকি আমাকেই কিছু করতে হবে?” (প্রত্যয়)
— “এত জোর?” (কষ্টমাখা হাসি দিয়ে)
— “প্রতিটা ছেলের যেমন নিজের বউয়ের প্রতি তাদের জোর খাটানো অধিকার বেশি থাকে। তেমনি আমারও আমার বউয়ের উপর জোর খাটানোর অধিকার একটু বেশিই বলতে পারিস।” (প্রত্যয়)
— (নিশ্চুপ)
তুয়া আর কোনো কথা বললো না। কিন্তু চোখের অবাধ্য পানির গুলোর গড়িয়ে পড়লো ওর গাল বেয়ে। প্রত্যয় তুয়াকে হাত ধরে টেনে নামালো। তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে সাওয়ার অন করে তুয়াকে সাওয়ারের নিচে দাঁড় করিয়ে দিলো। তুয়া কিছু বলছে না; চুপ করে আছে।প্রত্যয় রুমে গিয়ে টাওয়াল আর তুয়ার ড্রেস এনে দিলো।আর তুয়াকে বললো,
— “সাওয়ার নিয়ে ভেজা ড্রেসটা বদলে নে। আমি রুমের বাইরে গেলাম।”
প্রত্যয় যাওয়ার পর তুয়া দরজা আটকে হাঁটু মুড়ে শব্দ করে কেঁদে দিলো। এই কোন দহনে দগ্ধ হচ্ছে সে! এই কষ্টের দহন যে পানির পরশেও কমছে না। এত কষ্ট হচ্ছে কেন? কেন মনে হচ্ছে, কেউ বুকের ভেতরে বার বার ছুড়ি দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে? কেন ত্যাগের ব্যাথটা এতটা কষ্টকর হয়? তুয়া ওভাবেই বসে ছিলো প্রায় ৩০ মিনিট। একটু পর প্রত্যয়ের ডাকাডাকিতে তুয়া বের হলো। তুয়া ড্রেস বদলেছে ঠিকই। কিন্তু যে কামিজ পড়েছে সে কামিজও ভিজে টইটুম্বুর। শরীর না মুছে ড্রেস পড়লে যা হয়। আর তুয়া মনে হয় ভুল করে চুলে টাওয়ালটাও ছুঁয়ে দেখেনি। কারণ ওর চুলের পানি গড়িয়ে ফ্লোর ভিজে যাচ্ছে।
প্রত্যয় উঠে গিয়ে টাওয়াল এনে তুয়ার চুল মুছে দিচ্ছে। তুয়া এই কামিজটাও বদলে না নিলে নির্ঘাত ওর ঠান্ডা লাগবে। প্রত্যয় তুয়ার দিকে আরেকটা ড্রেস ধরিয়ে দিয়ে বললো,
— “এই কামিজটাও ভিজে গেছে, দ্রুত বদলে নে। আমি আসছি একটু পর।” (প্রত্যয়)
— (নিশ্চুপ)
— “আর তুই এখন এমনভাবে চুপ করে আছিস কেন?আমাকে তো মাঝ সমুদ্রে বৈঠাবিহীন নৌকাতে তো ছেড়ে দিলি। একবারো ভাবলি না আমার কি অবস্থা হবে?তারপরেও তোক কাছে আমি কোন অভিযোগ করিনি। তুই যা চেয়েছিস, তাই হয়েছে। আমি কোনো কাজে বাঁধা দেয়নি। মাঝখান থেকে আমাকেই কেন ফেলে দিলি দোটানায়? এতকিছুর পরেও তো আমি কিছু বলিনি।শোন, না আছে তোর উপর আমার কোন অভিযোগ, আর না আছে অভিমান। আগে তোকে যেমন ভালবেসেছি এখন তার চেয়ে বেশি ভালবাসি। এই প্রত্যয় মৃত্যুর শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত শুধু তোরই থাকবে। তুই আগে ছিলি আমার ভালবাসার মানুষ, এখন হয়েছিস আমার অর্ধাঙ্গিনী। আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন। চিন্তা করিস, না সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি সব সময় তোর পাশে আছি, আর থাকবোও সবসময়। এখন ড্রেসটা বদলে নে, না হলে ঠান্ডা লাগবে। আমি আসছি একটু পর।” (শান্ত কন্ঠে)
প্রত্যয় চলে যাওয়ার পর তুয়া শুয়ে শুয়ে সিলিং ফ্যানের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আর চোখের কোণা বেয়ে ঝরে যাচ্ছে নোনাজলের স্রোত। তুয়ার সেই ভয়ংকর দিনের কথা স্মরণ হয়ে গেল। ওর চোখের সামনে ভাসছে ওদের সবার জীবনের মোড় ঘুরানোর ঘটনা। প্রত্যয়ও তো নির্দোষ। সত্যি তো এখন সে প্রত্যয়ের অর্ধাঙ্গিনী। এখন তো তুয়ার প্রতি প্রত্যয়ের অধিকার খাটানোর জোর আছেই। তুয়া যতই ওইসব কথা মনে করছে, যেন ততই অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে। তুয়া সেদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনা মনে মনে আওড়াতে থাকলো।
To be continue….
(বানান ভুল হয়ে থাকলে,নিজ দায়িত্বে ঠিক করে নিবেন)