দেশলাই – ৪র্থ পর্ব

0
395

দেশলাই – ৪র্থ পর্ব

সন্ধ্যায় রিকশা নিয়ে শাহী ঈদগাহ থেকে মেসে ফিরছিলাম।
তখনই মেসেঞ্জারে সুলতানার কল এলো। আমি ফোন রিসিভ করে বললাম।
– ‘কেমন আছো সুলতানা। তোমার বান্ধবীর বাসায় গিয়েছিলে না-কি?’

– ‘হ্যাঁ, সেখান থেকেই কথা বলছি। ও আমার পাশেই আছে।’

– ‘তাই না-কি?’

– ‘হ্যাঁ তাই। কিন্তু আমার বেস্টু কখনও প্রেম করেনি। তাকে তোমার কথা সব বলেছি। তোমার ছবিও দেখেছে। বললো ফেইসবুকে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট দেবে। নাম ইন্তিশা আক্তার।’

আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মানে এতো সহজে মেয়েটি রাজি হয়ে গেলে? নিজের উত্তেজনাকে প্রকাশ না করে বললাম, ‘আচ্ছা। থ্যাংক ইউ সুলতানা।’

একটু পরেই ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট এলো। আমি একসেপ্ট করে নক দিলাম,
– ‘হাই।’
সে সালাম দিলো,
– ‘আসসালামু আলাইকুম।’

– ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম।’

– ‘কেমন আছেন?’

– ‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো, আপনি কেমন আছেন?’

– ‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো৷ আপনার প্রফাইল ছবি দেখলাম। অনেক মিষ্টি আপনি। কিন্তু আমার থেকে অনেক বড় হবেন। তবুও বন্ধুত্ব করতে রাজি হলেন যে?’

সে জবাব দিলো৷ সেই জবাব থেকেই আমি সর্ববিষয়ে পুষ মেনে নিয়েছিলাম ওর কাছে। আমাদের সম্পর্ক পরিচালনার দায়িত্ব ওর ওপরেই চলে গিয়েছিল৷ আমাকে সে উল্টো প্রশ্ন করলো,
– ‘আমার বয়সে ছোট বলে কেন প্রত্যাখ্যান করবো? আপনি আমার বয়সে ছোট কিংবা আমি আপনার বয়সে বড় এখানে আমাদের দোষ কি? আমরা কি ইচ্ছা করে বড়-ছোট হয়ে দুনিয়ায় এসেছি?’

– ‘না, আমাদের কোনো দোষ নেই।’

– ‘আচ্ছা আপনার নাম্বার দেন। আমরা ফোনে কথা বলবো। আসলে কাল যখন সুলতানার সঙ্গে ফোনে কথা বললেন ভয়েজ ভীষণ ভালো লেগেছিল।’

আমি সঙ্গে সঙ্গে নাম্বার দিলাম। শরীর ঘেমে যাচ্ছিল। খানিক পরই ফোন বেজে উঠলো। আমি মেসের ছাদের চিলেকোঠায় গিয়ে রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে শান্ত, স্নিগ্ধ গলায় ইন্তিশা সালাম দিল।
আমি জবাব দিলাম, ‘ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছেন?’

– ‘নট আছেন। এখন থেকে আছো বলবে। ঠিকাছে?’

আমি ওর মিষ্টি ভয়েজে বিমোহিত হয়ে যাই৷ সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ‘হ্যাঁ তুমি কেমন আছো ইন্তিশা?’

– ‘ভালো, কারণ আমি অনার্স ফাস্ট ইয়ারে পড়লেও এখনও মনের মতো কোনো ছেলে বন্ধু পাইনি। তোমাকে পেয়ে জানি না কেন অনেক ভালো লাগছে।’

বিশ্বাস কর ইলি। আমার বুক কেঁপে উঠেছিল। ইন্তিশা আমাকে অল্প সময়ে এতো আপন করে নিয়েছে? আমি যেন তখনই ওর প্রেমের সাগরে হাবুডুবু খেতে শুরু করলাম৷
কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
-‘আমিও।’

সে ওপাশ থেকে ঝরনার কলকলে শব্দ তোলা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,
-‘বিব্রতবোধ করছো কেন? আমরা না বন্ধু, আমাদের মধ্যখানে লজ্জা-শরম কিচ্ছু থাকবে না, ঠিকাছে?’

আমি মহানন্দে বললাম,
– ‘আচ্ছা।’

– ‘সবকিছু আমার সঙ্গে শেয়ার করবে তো, বলো?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘আচ্ছা এখনই সেল্ফি তুলে তোমার একটি ছবি পাঠাও। ফোন রাখছি।’

আমার কাছে সব স্বপ্ন লাগছিল। এতো দ্রুত সব হয়ে যাচ্ছে। চিলেকোঠা থেকে বের হয়ে নিজেকে সেল্ফি ক্যামেরায় দেখে চুল ঠিকঠাক করে ছবি তুলে পাঠালাম।
সে অনেকগুলো লাভ স্টিকার দিল। আমি মেসেজে বললাম, ‘তোমার ছবি দাও।’

ইন্তিশা ছবি পাঠালো। আমি দেখে পাগল হয়ে গেছি। এতো মায়াবী একটা মেয়ে। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা। ঘন কালো ভ্রু। চুল একপাশ দিয়ে রাখায় এক গাল প্রায় ঢেকে থাকে। তুলতুলে মুখ। দেখলেই আদর করার মতো ইচ্ছে জাগানো ঠোঁট।

এভাবে দ্রুত আমাদের সম্পর্ক এগোচ্ছিল। মাস দুয়েকের ভেতরে আমরা এতো বেশি আপন হয়ে গেছি যে এমন কোনো রসালাপ নেই যা আমাদের হয়নি। আমি প্রথমদিকেই বুঝতে পেরেছিলাম ইন্তিশা অন্য মেয়েদের মতো রক্ষণশীল মনোভাবের না। অনেকটাই উদার। আমাদের ফোনে কথা বলতে বলতে প্রায় রাত দুই-তিনটা হয়ে যায়৷ সে কম্বলের নিচে ফোন নিয়ে আস্তে আস্তে ফিসফিস করে কথা বলে। আমার কাছে মনে হয় পাশের বালিশে ইন্তিশা শুয়ে আছে। একদিন সে নিজ থেকেই বলল দেখা করতে। আমি বললাম তোমার ভার্সিটির সামনে আসি একদিন। সে দ্বিমত করে বলল, ‘না, এভাবে দেখা করা রিস্ক। তুমি সন্ধ্যায় আমাদের নীলগঞ্জ বাজারের রাস্তার পাশের শিমুল গাছের নিচে এসে দাঁড়িয়ে থাকলেই হবে। কারণ আমি প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় টিউশনি করিয়ে এদিকে যাই। তারপর আছে আমাদের বাড়ির রাস্তা। দুইপাশে অনেক গাছগাছালি। সেদিকে কারও যাওয়া-আসা নেই। রাস্তা থেকে আমাদের বাড়িও অনেক দূর।’

যেরকম বলেছিল আমি একদিন বিকেলে সিলেট থেকে বাসে উঠে চলে যাই। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে আমাদের দেখা হয়। ভয়ে বুক ধুকপুক করছিল। কিন্তু এদিকটা অনেক নির্জন। মেইন রোড থেকে তাদের বাড়ির রাস্তার দুইপাশে গাছগাছালি। বাড়ি থেকে কেউ এলেও বুঝা যাবে। ইন্তিশার ওড়না আলগা করে মাথায় দেয়া। গলা দেখা যাচ্ছে। মাথার বাম পাশের চুল খানিক কানে গুঁজে সেখান থেকে উল্টো করে সকল চুল গালের দিকে এনে বুকের ডানপাশে ফেলে রেখেছে। তুমুল আগ্রহী দু’টা চোখ। ঠোঁট নড়ছে ওর। আমরা ফোনেই একজন আরেকজনকে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। ন্যাকামি চলবে না। যার যা ইচ্ছে তাই করবো। ইন্তিশা তাড়া দিয়ে বলল, ‘কেউ এসে যেতে পারে। আমি চলে যাবো।’
আমি চারদিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তাহলে একটা চুমু খাই।’
সে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে ঠোঁটে দীর্ঘ সময় নিয়ে চুমু খেতে লাগলো। আমার কাছে যেন স্বপ্ন মনে হচ্ছিল সব। এই পৃথিবী যেন স্বর্গ হয়ে গেছে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। ওর নরম গরম শরীরে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। সেও উম্মাদের মতো চুমু খাচ্ছে। তবুও সেদিন বিদায় নিয়ে আসতে হয়েছিল। কারণ রাস্তায় হঠাৎ কেউ দেখে ফেলতে পারে।

কিন্তু এই উষ্ণতা, ওম, সুখ আমরা ভুলতে পারছিলাম না৷ দু’জনই পাগল। রাতে ফোনালাপে আমরা সবই করতে লাগলাম।
সপ্তাহ দুয়েক পর সে বলল, ‘একদিন রাতে চলে আসো। সবাই যখন ঘুমোবে আমি তোমাকে আমার ঘরে নিয়ে নেব। আবার ভোর হওয়ার আগে নীলগঞ্জ বাজারে চলে যাবে৷ কথাটি শুনে আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। পুরো একটা রাত ইন্তিশাকে আমি কাছে পাবো? আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ আসবো।’

আচ্ছা যাক, তুই তো বুঝতেই পারছিস ইলি। অনেক কিছুই বলে ফেলেছি৷ আর না বলাই ভালো। এভাবেই আমাদের সম্পর্ক হয়েছে এবং চলছে।

রাফসান ভাইয়ের প্রেমের শুরুর দিকের এই গল্পটি অতি সাধারণ। পরিণতি যদিও ভয়াবহ ছিল। তবুও আমার বুক ধুকপুক করে। কোনো কথা বলতে পারছিলাম না।
‘আমি যাচ্ছি’ বলে ওর রুম থেকে ফুপুর ওখানে এসে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। সকলের ডাকাডাকি উপেক্ষা করে রাতে ভাতও খাইনি। নিজেকে অসুস্থ মনে হচ্ছিল। গায়ে কেমন জ্বর জ্বর ভাব। পুরো রাত আমি আজেবাজে স্বপ্ন দেখেছি৷ সত্যি বলতে রাফসান ভাইকে আমার কাছে বাজে লাগছিল। ইন্তিশা মেয়েটিকে নষ্টা ছাড়া কিছুই মনে হয়নি। বাস্তবে এমন গায়েপড়া মেয়ে স্বভাবের মেয়ে থাকতে পারে তখনও আমি জানতাম না। রাফসান ভাই আমাকে সব না বললেও বুঝতে পেরেছি তাদের সম্পর্ক গভীরতার শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছে৷ সেদিন ভোরেই আমি বাড়িতে চলে এলাম। রাফসান ভাইকে এড়িয়ে চলা শুরু করলাম। জানি না কেন যেন কাণ্ডজ্ঞানহীন, চরিত্রহীন জঘন্য মানুষ মনে হচ্ছিল তাকে৷ ইন্তিশার মতো নষ্টা মেয়ের প্রতি সে বুঁদ হয়ে আছে? যে মেয়ে জুনিয়র একটি ছেলের সঙ্গে প্রেম করে মজা নিচ্ছে। তাছাড়া পড়ালেখা রেখে রাফসান ভাই এমন নষ্ট প্রেমে মাতাল হয়ে গেল? এই তার শহরে মেসে গিয়ে পড়ালেখার নমুনা? আমি নিজেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নিলাম। অন্যকে নিয়ে ভেবে লাভ নেই৷ নিজের এসএসসি পরীক্ষা সামনে৷ পড়ালেখা, কোচিং এগুলোতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। বান্ধবীদের সঙ্গে বেশি করে মিশতে লাগলাম। আড্ডায়, আনন্দে আমার পরীক্ষার প্রস্তুতি এগোতে থাকে।
রাফসান ভাই মেসেজ দিলে ‘হুম, হ্যাঁ, ওকে।’ এরকম রিপ্লাই দিয়ে এড়িয়ে যাই। মেস থেকে বকুল পুর এলে আমাদের বাড়িতে আসে। আমি পড়ার টেবিলে ব্যস্ত হয়ে থাকি। সেদিন এসে মাথায় ঘাট্টা মেরে বলল, ‘কিরে পড়ালেখায় বড়ো মনযোগী হয়েছিস মনে হচ্ছে।’

আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকাই, গালে সুন্দর করে কাটছাঁট মেরে দাড়ি রেখেছে। চুল স্টেইট করা। বাম হাতে কালো ঘড়ি। পরনে পানপাতা রঙের গেঞ্জি। কালো ট্রাউজারের পকেটে বাম হাত গুঁজে রাখা। চোখ চিকচিক করছে। পেশি দেখে মনে হয় সদ্য জিম-টিম করাও ধরেছে। আগের থেকে আরও স্মার্ট, সুদর্শন লাগছে। আমার বুক শিরশির করে। আবার টেবিলের বইয়ে চোখ রেখে বললাম, ‘হ্যাঁ, আমার তো এসএসসি পরীক্ষা সামনে। পড়ালেখা তো করতেই হবে।’
কথাটি বলেই কোনো পাত্তা না দিয়ে স্বভাবসুলভ গুনগুন করে পড়া শুরু করলাম। এখন আর তাদের প্রেম কাহিনী শোনারও আগ্রহ দেখাই না৷ তবে মাঝে মাঝে খারাপ লাগে। ওর বাবা নেই। এসএসসিতে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। চাচারা টাকা খরচ করে মেসে দিয়ে পড়াচ্ছে। মেধাবী ছাত্র হিসেবে সবার আশা এইচএসসিতে ভালো রেজাল্ট করে ভালো ভার্সিটিতে চান্স পাবে। কিন্তু ইন্তিশার মতো নষ্টা মেয়ের সবকিছু উজাড় করে দেওয়া প্রেম তার পড়ালেখার ব্যাঘাত ঘটাবে আমি নিশ্চিত৷
তাই আবার মাথা ঘুরিয়ে বললাম,
– ‘রাফসান ভাই একটা কথা বলবো।’

সে রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। আবার পেছন ফিরে বলল, ‘কি বলবি বল।’

আমি বিব্রতবোধ করছিলাম। তবুও বললাম,
– ‘আসলে আমি নিজেই তোমার থেকে ছোট রাফসান ভাই৷ আবার মেয়ে মানুষ। তবুও তোমার ব্যাপারগুলো আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। তোমার বিশ্বাস ভেঙে বড় কাউকে বলে দিতেও পারছি না। আমার কাছে মনে হচ্ছে সরাসরি বলা দরকার। আসলে তুমি প্রেম করো ঠিকাছে, কিন্তু নিজের পড়ালেখা নিয়ে সিরিয়াস হও। আরেকটি কথা, প্রেম অনেকেই করে। কিন্তু তোমার প্রেমিকা আমার কাছে ভালো মনে হচ্ছে না। তোমরা খুব দ্রুত এগোচ্ছ। নিজেদের লাগাম রাখা উচিত। ছেলে হিসাবে তোমার বয়স কিন্তু এতটাও বেশি না৷ কিন্তু কাজ বড়দের হয়ে যাচ্ছে।’

কথাগুলো বলতে গিয়ে শেষ দিকে আমার কেন জানি না কান্না পাচ্ছিল। আমি মাথা ঘুরিয়ে বইয়ে চোখ রাখলাম।
রাফসান ভাই আমার মাথায় ঘাট্টা দিয়ে বলল, ‘বাবা, তুইতো মাস্টারনি হয়ে গেছিস রে ইলি। কত সুন্দর গুছিয়ে কথা বলিস৷ কিন্তু আমার প্রেমিকাকে তোর ভালো মনে হচ্ছে না কেন? হিংসা তাই না?’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here