দেশলাই – ৩১ পর্ব

0
182

দেশলাই – ৩১ পর্ব

লতিফ মিয়া গেইটের দিকে এগোলেন। ইলির বুক ধুকপুক করছে। সেও জানালার কাছ থেকে সরে বাইরে আসে। তার অবচেতন মন সম্ভাব্য বিপদ আঁচ করতে পারায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।
লতিফ মিয়া একজনকে দাঁড় করিয়ে
এতো হৈ-হুল্লোড়ের কারণ জানতে চাইলেন। লোকটি দৌড়াতে দৌড়াতে বললো, ‘শুনছি বাজারে আগুন লাগছে।’

লতিফ মিয়া পেছনে তাকিয়ে রহিমা বেগমকে বললেন, ‘তোমরা থাকো, আমি একটু দেখে আসি তো।’

ততক্ষণে ইলি গেইট পেরিয়ে চলে গেছে। রহিমা বেগম পেছন থেকে ডাকছেন। ইলি থামছে না। লতিফ মিয়া স্ত্রীকে বললেন, ‘কোনো সমস্যা নাই তুমি বাসায় যাও, আমি ইলির সাথে আছি।’

দূর থেকে কালো ধোঁয়া আকাশে উড়তে দেখে যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে আগুনের ভয়ংকর শব্দ।
কলেজ গলি থেকে লাইন ধরে মানুষ যাচ্ছে। বাজারে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিসের টিম এসেছে। আগুন নেভানোর চেষ্টা চলছে। রেস্টুরেন্টের ওপর পাশে গ্যাস সিলেন্ডারের দোকানের সামনে ছিল একটি বাস। হরতালের দিনেও এখান থেকে কমবেশি সিএনজি, রিকশা, বাস প্রতিদিনের মতো চলছিল। হঠাৎ কোত্থেকে একদল ছেলেরা লাঠি হাতে চারদিকে তাণ্ডব চালায়। স্টেশনে দাঁড় করানো সিএনজিগুলো ভাংচুর করে। দোকানদাররা স্যাটার ফেলে তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে চলে যায়। হঠাৎ করে গ্যাস সিলেন্ডারের সামনের বাসটিতে কেউ একজন আগুন দেয়। দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠে। বাস থেকে প্রথমে গ্যাস সিলেন্ডারের দোকানের বারান্দার টিনের নিচে কাঠের বর্গায় আগুন লাগে। খানিক পরেই প্রচণ্ড শব্দে পুরো বাজার কাঁপিয়ে তুলে। আশপাশের এলাকাজুড়ে হৈচৈ পড়ে। ভাংচুরকারীরা যে যেদিকে পারে পালিয়ে যায়। উপজেলা থেকে প্রথমে পুলিশ আসে। ততক্ষণে গ্যাসের দোকানে বিস্ফোরণ থেকে আগুন রাফসানের দোকান সহ আরও নয়টি দোকানে ছড়িয়ে পড়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টায় ব্যস্ত।

ইলি মানুষের ভীড় ঠেলে চারদিকে তাকায়। রাফসানকে দেখা যাচ্ছে না। লতিফ মিয়া মেয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। ইলি বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
– ‘রাফসান ভাইকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?’

– ‘কোথাও আছে হয়তো, শান্ত হ মা।’

ইলি হাঁপাচ্ছে৷ পা যেন অবশ হয়ে আসছে। সে আবার বললো,

– ‘বাবা আমার সাথে মোবাইল নাই। কারও মোবাইল এনে রাফসান ভাইকে কল দাও।’

– ‘মা তুই বাড়িতে চল। বাড়ি গিয়ে কল দেওয়া যাবে।’

– ‘না বাবা আমি এখানেই থাকবো।’

– ‘তাহলে কলেজের দিকে চল সেখানে বসবি আমি দেখছি রাফসান কোথায়।’

ইলি উঠে দাঁড়ায়। লতিফ মিয়া তাকে কলেজের বারান্দায় নিয়ে বসালেন। খানিক্ষণ পর ফিরে এসে বললেন রাফসান না-কি শাহজালাল ফার্মেসিতে।
ইলি আঁতকে উঠে বললো, ‘কেন? কি হয়েছে ওর?’

– ‘লোকজন বললো মাথা ঘুরে না-কি পড়েছিল।’

– ‘চলো তো যাই আমরা।’

– ‘হ্যাঁ চল।’

তারা বাজারের ভেতর দিয়ে না গিয়ে ট্রেনের রাস্তা ধরে হেঁটে ব্রিজের পাশ দিয়ে শাহজালাল ফার্মেসিতে যায়। রাফসানের দোকানের কর্মচারী সহ আরও কয়েকজন মানুষ বাইরে বসে আছে। লতিফ মিয়া কি হয়েছে জানতে চাইলে তারা বললো, রাফসান না-কি বাইক থেকে নেমে ভীড় ঠেলে না গিয়ে প্রথমে একটা দোকানের সিঁড়ি থেকে উঁকি দিয়ে দেখছিল। তখনই মাথা ঘুরে সামনের পিলারে পড়ে ভুরুর নিচের চামড়া ফেটে রক্ত বেরোয়। তারা দেখতে পেয়ে তাকে ধরাধরি করে ফার্মেসিতে নিয়ে এসেছে। ইলি ততক্ষণে ভেতরে চলে গেছে। রাফসান সীটে চোখবুঁজে শুয়ে আছে। লতিফ মিয়া ডাক্তারকে বললেন,

– ‘সেলাই লেগেছে না-কি?’

ডাক্তার বললো, ‘না, শুধু ওয়াশ করে দিয়েছি। আর মাথা ঘুরেছে যেহেতু তাই একটু শুয়ে থেকে রেস্ট নেয়ার জন্য আঁটকে রেখেছি আরকি। বেশি কিছু হয়নি।’

ইলি স্বাভাবিকভাবে আস্তে করে ডাকলো, ‘রাফসান ভাই।’

সে লাল টকটকে চোখ মেলে তাকায়।

– ‘এখন ঠিক আছো তো?’

– ‘হ্যাঁ।’

লতিফ মিয়া ডাক্তারকে বললেন, ‘তাকে এখন নিয়ে যাওয়া যাবে তো?’

– ‘হ্যাঁ পারবেন।’

– ‘আপনার টাকা বাজারে এলে দিয়ে যাবো।’

– ‘আচ্ছা ঠিকাছে।’

লতিফ মিয়া রাফসানের হাত ধরে বললেন,
– ‘ধীরে ধীরে উঠ তো।’

রাফসান পুরোপুরি স্বাভাবিকভাবে উঠে কর্মচারীকে ডেকে চাবি দিয়ে বললো,
– ‘বাইক নিয়ে বাড়িতে চলে আসিস।’

রাফসানকে একটা রিকশায় তুলে দিয়ে ইলি আর লতিফ মিয়া আরেকটা রিকশা করে বাড়ি ফিরলেন। ইলির ইচ্ছে থাকলেও রাফসানের সঙ্গে কথা বলতে পারলো না। রাফসান চলে গেছে তাদের বাড়িতে। লতিফ মিয়া তাকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকে বললেন, ‘ইলি অতিরিক্ত কিচ্ছু ভালা না, তুমি যুবতী মাইয়া যখন-তখন বাজারে দৌড়ে চলে যেতে পারো না। একটু আগেও তোমাকে রাফসানদের বাড়ি থেকে এনেছি। সেখানে তুমি জড়াজড়ি কাণ্ড করেছো। এগুলো করলে তো এলাকায় মুখ দেখানো যাবে না।’

ইলি কিছুই বললো না। চুপচাপ নিজের রুমে গিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে রইল। মোবাইল এখনও রহিমা বেগমের কাছে।
রাফসানের জন্য খুব চিন্তা হচ্ছিল। এখন সে কি করছে? কি করবে? মা-বাবা কি আর রাজি হবেন রাফসানের কাছে বিয়ে দিতে? ইলির চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। রাফসান ভাইয়ের এই খারাপ সময়ে সে অন্য কারও কাছে বিয়ে বসতে পারে না। প্রয়োজনে পালিয়ে যাবে। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে ইলি ঘুমিয়ে পড়ে। সন্ধ্যায় লতিফ মিয়া চা নিয়ে এসে মেয়েকে ডেকে তুললেন। খানিক পরে রহিমা বেগমও এলেন। ইলির লাল টকটকে চোখ। থমথমে ভারী মুখ। লতিফ মিয়া মেয়ের দিকে চা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
– ‘নে মা, চা খেলে ভালো লাগবে।’

ইলি স্বাভাবিকভাবেই চা নেয়। লতিফ মিয়া চা’য়ে চুমুক দিয়ে বললেন,
– ‘দেখ মা, এখন আর পাগলামি করিস না। তুই পাগলামি করলে রাফসানও এখন আরও দুশ্চিন্তায় পড়বে। তার কি এখন আর বিয়ের অবস্থা আছে বল মা?’

ইলি শান্ত গলায় বললো,
– ‘হৃদের সঙ্গে বিয়ে ভেঙে দাও বাবা। রাফসান ভাইয়ের আবার অবস্থা ভালো হলে বিয়ে করবে।’

– ‘তুই বুঝতে পারছিস না মা। মানুষের সবকিছুর একটা শেষ আছে। রাফসান আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না। এখন তারও অস্তিত্ব থাকে কি-না দেখ। দোকানে কত লক্ষ টাকার মালামাল ছিল জানিস? সবই গেছে। চাচারা ঋণ করে দিয়েছিল দোকান। আর কোত্থেকে তাকে দেবে? এমনিতেই রাফসানের চাচীরা প্রথম থেকেই এগুলো ভালোভাবে নিচ্ছিল না। এখন রাফসানের বিয়ে-শাদি তো দূর, নিজে খেয়ে-দেয়ে বেঁচে থাকাটাই বড়ো।’

– ‘দোকান তো আর সে জ্বালায়নি বাবা।’

– ‘সে জ্বালায়নি ঠিকাছে, কিন্তু জ্বলেছে তো মা। এখন আর এসব পাগলামি করিস না। আমরাও তো তোর ভালো চাই। তোর সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ চাই। হৃদের সাথে বিয়ে হলে সব দিক থেকে ভালো হয়রে মা।’

ইলি বিছানা থেকে নেমে টেবিলে চায়ের কাপ রেখে বাথরুমে ঢোকার আগে বললো,
– ‘এতো বুঝাতে হবে না বাবা। তোমরা হৃদের সাথে বিয়ে ভেঙে দাও। রাফসান ভাইকে আমি অনেক আগেই মনে-প্রাণে গ্রহণ করে নিয়েছি। এখন তার সুখ-দুঃখ ভালো-মন্দ সবকিছুর সাথে আমি জড়িত। একবার ভাবো, যদি রাফসান ভাইয়ের সাথে আমার এক মাস আগে বিয়ে হতো আর আজ তার এই অবস্থা হতো আমি কি ডিভোর্স দিতাম?’

রহিমা বেগম দাঁত কটমট করে তাকাচ্ছেন।
লতিফ মিয়া কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। ইলি বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।
মুখ-হাত ধুয়ে আবার বাইরে এসে বললো,
– ‘আমার মোবাইলটা দাও। বাড়াবাড়ি বেশি করবা না। আর ভালো করে শোনে রাখো, জোর করে আমাকে তোমরা বিয়ে দিতে পারবে না৷ এগুলো মাথা থেকে বাদ দিতে পারো। এখন মোবাইল দিয়ে রুম থেকে বাইরে যাও।’

লতিফ মিয়া ‘হা’ করে চেয়ে রইলেন। তারপর রহিমা বেগমকে বললেন, ‘ওর মোবাইল নিয়েছো কেন? মোবাইল দাও এনে।’
রহিমা বেগম মোবাইল এনে দিলেন। লতিফ মিয়া শান্ত গলায় বললেন, ‘আচ্ছা মা তুমি ঠান্ডা মাথায় ভাবো, আমরা যাচ্ছি।’

ইলি মোবাইল হাতে নিয়ে রাফসানকে মেসেজ দিতে যেয়েও দিলো না। রাফসান এখন এমনিতেই মানসিক চাপে আছে। তার সঙ্গে কথা বলতে গেলেই দুপুরের প্রসঙ্গ আসবে। সুতরাং দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়ে লাভ নেই। এর থেকে কাল দেখা করবে গিয়ে। তখনও বিয়ের ব্যাপারে কিছুই বলবে না। অন্য প্রসঙ্গে কথা বলবে। সান্ত্বনা দেবে।

ভোর সাতটায় ইলি ঘুম থেকে উঠে। অন্যদিনের মতো ব্রাশ নিয়ে পুকুরে না গিয়ে বাথরুমে গেল। হাত-মুখ ধুয়ে ভ্যানিটিব্যাগ থেকে টাকা বের করে মোবাইলের কভারের নিচে নেয়। এই এক জ্বালা৷ মেয়েদের সেলোয়ার-কামিজ, শাড়ি কোনো কিছুতেই পকেট নাই। মেয়েদের যেন পকেটের দরকার পড়তেই পারে না। চুলগুলো খোঁপা করে ওড়না মাথায় দিয়ে দরজা খুলে বাইরে আসে। ঘর থেকে রহিমা বেগম ডেকে বললেন,
– ‘এই কোথায় যাচ্ছিস রে?’

– ‘বাইরে যাচ্ছি।’

– ‘কেন?’

– ‘রাফসান ভাইয়ের কাছে যাচ্ছি।’
কথাটি বলে ইলি গেইট খুলে হাঁটতে থাকে। রহিমা বেগম দাঁত কটমট করে তাকিয়ে আছেন। ইলি হেঁটে হেঁটে গেল বিল পাড়ের দোকানে। সেখানে বাড়িতে নাস্তা তৈরি করার মতো কিছুই পেল না।
নুডলস, তেল, ডিম আর অল্প পিঁয়াজ মরিচ নিয়ে রাফসানদের বাড়িতে এলো। উঠোনের উত্তরদিকে রাফসানের চাচি শীম পারছিলেন। ইলিকে দেখে তিনি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,
– ‘তোমার কি লজ্জা-শরম নাই ইলি? কাল তোমার কারণে জোয়ান-যুবক ব্যাটাকে তোমার মা চড় মেরে দিলেন। আজ আবার আসছো তুমি?’

ইলি কিছুই বললো না। তার কাছে মানুষের গুরুত্ব খুবই কম। গুরুত্ব দিতে হলে সে যুবতী মেয়ে হয়ে দোকান থেকে পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে আসতেও লজ্জা পেতো। মেয়েরা এমন কত ধরণের লজ্জা পায়। কে কি ভাববে। কে কি বলবে ইলি ভাবে না৷ এখন একটা চাকুরী হলে আরও কম ভাবতো। রাফসানের নক দেয়।
কোনো সাড়া না পেয়ে কল দিলো। একটা রিং হতেই রাফসান ফোন রিসিভ করে ঘুম ঘুম গলায় বললো,
– ‘হ্যালো।’

– ‘দরজা খুলো।’

– ‘বুঝিনি।’

– ‘তোমার দরজা খুলো।’

– ‘ও আচ্ছা।’

রাফসান দরজা খুলে অবাক নয়নে তাকিয়ে বললো,
– ‘তুই?’

– ‘পথ ছাড়ো ভেতরে যাবো।’

রাফসান সরে দাঁড়ায়। ইলি ভেতরে যেয়ে টেবিলে পলিথিনের ব্যাগ রেখে বললো,
– ‘ঘুমে ডিস্টার্ব দিলাম তাই না?’

– ‘ঘুম রাখ, তুই আজ আবার আসলি কেন?’

– ‘এমনিই আসলাম।’

– ‘ইলি পাগলামি করিস না। গ্রামের মানুষ ধীরে ধীরে সব জানবে। শেষে মুখ দেখাতে পারবি না।’

– ‘আমি এগুলো ভাবি না রাফসান ভাই। যাও মুখ ধুয়ে আসো। আমি নুডলস বানাতে রান্না ঘরে যাচ্ছি।’

– ‘এগুলো রেখে বাড়িতে চলে যা। আমি নিজেই খেয়ে নেবো।’

– ‘কেন? আমি রান্না করে এক সঙ্গে খাই?’

– ‘তুই বুঝতেই পারছিস না ইলি কি করছিস। মানুষ এখন সব খেয়াল করবে। মামা-মামীরা মুখ দেখাতে পারবেন না। এখানে রান্না করে খাওয়াইয়ে গেছিস সেটা নিয়ে নানান মানুষ নানান ধরনের গল্প ফাঁদবে।’

– ‘তুমি ছেলে মানুষ হয়ে অন্যদের কথা এতো ভাবছো কেন?’

– ‘ইলি চাচিরাও নিশ্চয় কান পেতে আছেন। তুই এখন চলে যা। এমনিতেই মন-মেজাজ ভালো নেই।’

ইলি আহত নয়নে খানিক্ষণ তাকিয়ে রইল। সে যেভাবে ভেবে এসেছিল সেরকম কিছুই হয়নি। উল্টো তাদের ব্যক্তিগত সমস্যা সামনে চলে এসেছে। ইলি চেয়ার থেকে উঠে বললো,
– ‘আচ্ছা যাচ্ছি।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here