বাঁক ( ১১ পর্ব )

0
209

বাঁক ( ১১ পর্ব )
_____________

সুইচ টিপে দিতেই ঘরজুড়ে অন্ধকার নেমে এলো। মানহা ফিরে আসছে বিছানার দিকে। মৃদুলের মাথায় চিন্তার ঝড় বইছে। মেয়েটিকে সর্বনাশের পথ থেকে সে কীভাবে ফেরাবে? কোন অযুহাতে ওর থেকে দূরে থাকা যায়? সেইই বা এমন রূপবতী থেকে নিজেকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখবে? এতটা কাছাকাছি থেকেও মোমের মতোন গলে যাওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করার মতোন আদৌও সাধুপুরুষ কি সে? তবুও মানহাকে বিয়ে এবং শারীরিক সম্পর্ক থেকে বিরত থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। আচ্ছা সবকিছু যদি খুলে বলে মানহাকে? যদি বলে আমি বিবাহিত? তাহলে কী এখানে কাজ, থাকা-খাওয়া, তার সমস্ত গোপনীয়তা রক্ষা করা সহ মা আর বোনের সন্ধানে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে মানহা? মৃদুলের তা মনে হয় না। মানহা ভেঙে পড়বে। তার প্রতি আগ্রহ হারাবে। আবার বলা যায় না উগ্রও হয়ে যেতে পারে। তাকে ভয় দেখাতে পারে। সত্য ঘটনা প্রকাশ করে দিতে পারে। কিন্তু এক সময় তো মানহা জানবে সে বিবাহিত। জানবে তার সঙ্গে প্রেমের নামে প্রতারণা করা হয়েছে। তখন কী হবে? মানহার পা ধরে মাফ চাইলে কী মাফ করবে? অবশ্য আরেকটা পথ খোলা আছে, পালিয়ে যাওয়া, নিরুদ্দেশ হওয়া। ইশি আর মা’কে নিয়ে বাটি অঞ্চলের কোনো একটা গ্রামে চলে যাবে। নতুন করে জীবন শুরু করবে। গরু কিনবে, চাষাবাদ করবে, মাছচাষ করবে। সময় করে ফাতিহাকেও রূপগঞ্জ থেকে রাতের আঁধারে তাদের কাছে নিয়ে যাবে।
মানহা বিছানায় এসে বসেছে টের পেল সে। খানিক পর পাশের বালিশ থেকে শ্যাম্পু করা চুলের ঘ্রাণ ভেসে এলো নাকে। বাহুতে এসে আছড়ে পড়লো উষ্ণ শ্বাস।
মানহা কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,

– ‘এভাবে শুয়ে আছো যে? বুকে একটু টেনে না নিলে মাথা রাখতে বুঝি আমার লজ্জা করবে না?’

– ‘অন্ধকার তো আছেই।’

– ‘তবুও।’

– ‘আমার খুব ঘুম পাচ্ছে মানহা। হাঁটুতে আঘাত পেয়েছি, তোমাকে কাঁধে করে নিলাম আনলাম। এখন ক্লান্ত লাগছে খুব।’

– ‘ওমা এতক্ষণ তো ভালোই দেখলাম।’

মৃদুল ঘুম ঘুম গলায় বললো,

– ‘হু, বাতি বন্ধ করায় রাজ্যের ঘুম চোখে নেমে এসেছে, শরীরেও প্রচণ্ড ব্যথা।’

মানহার বড়ো মায়া লাগলো। নারীত্ব মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠলো। ভাতের মাড়ের মতো বুদবুদ করে ভালোবাসা-মমতা উপচে পড়তে শুরু করলো।

– ‘তাহলে আজ পুরো রাত আমি তোমার শরীর টিপে দেবো।’

– ‘আরে না তুমিও ঘুমাও।’

‘উহু, এমন একটা রাত আমি ঘুমিয়ে কাটাবো না’ কথাটি বলে মানহা বিছানা থেকে উঠে মৃদুলের কাঁধ থেকে টিপে বাহুতে এলো। তারপর আলগোছে ঠেলে বললো,

– ‘আচ্ছা তুমি একটু উপুড় হয়ে ঘুমাও।’

মৃদুলে ধীরে ধীরে উপুড় হয়ে যায়। মানহা ঘাড়, পিঠ, পা পর্যন্ত টিপতে থাকে। মিনিট তিরিশেক পর খুব ইচ্ছা হলো বাতিটা জ্বেলে সে দেখে দেখে টিপে দেবে। অন্ধকার ভালো লাগছে না একদম। মানুষটাকে একটুও দেখা যাচ্ছে না। মনহা আলগোছে বিছানা থেকে উঠে যায়, সুইচটা টিপে দেয়। ঘর ভরে যায় আলোয়। বিছানায় দৃশ্যমান হয় মৃদুলের নগ্ন পিঠ। খানিক্ষণ বুঁদ হয়ে তাকিয়ে থাকে মানহা। তারপর নিজের কাছেই যেন লজ্জা পায়। দু’হাতে মুখটি ঢেকে নিজেকে বাঁধা দেয়। আবার নিজের সঙ্গেই প্রতারণা করে আঙুলের ফাঁক দিয়ে দেখে ভালোবাসার মানুষটিকে। আচমকা মৃদুল পাশ ফিরে চোখ মেলে তাকায়। মানহা আঁতকে উঠে লজ্জায় ঘুরে গেল। এটা কী হলো? এমন পাগলামি করতে কেন গেল সে? মৃদুলও আর সময় পেল না চোখ মেলতে? নিজের সঙ্গে লুকোচুরি খেলায় সেও নাক গলাতে হলো? কী লজ্জা, এখন সে ওর দিকে তাকাবে কী করে?

মৃদুলের চোখ আঁটকে আছে মানহার নগ্ন পিঠের দিকে। শাড়ির আঁচল খসে পড়ে আছে একপাশে। দেখা যাচ্ছে কোমরের উপরিভাগ। আতব চালের মতোন সাদা, মোমের মতোন মসৃণ। মধ্যখানের ছাই রঙের ব্লাউজের ওপরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কালো চুল। নারী দেহের সমস্ত সৌন্দর্য, রহস্য যেন লুকিয়ে আছে মানহাতে৷ ফাতিহা তো এমন নয়? পরক্ষণেই আবার নিজেকে একচোট শাসালো। ফাতিহা যেমন হোক তোর স্ত্রী। মানহা পরনারী। সে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,

– ‘কী হলো মানহা?’

– ‘তুমি হঠাৎ চোখ মেললে কেন?’

– ‘বাতি জ্বালালে কেন?’

– ‘ইচ্ছা হইছে তাই, আমি একশোবার জ্বালাবো।’

মৃদুল হেঁসে বললো,

– ‘আচ্ছা ঠিকাছে, কিন্তু ওইদিকে তাকিয়ে আছো কেন?’

– ‘তুমি চোখ বন্ধ করো আমি বিছানায় আসবো।’

– ‘কীসব পাগলামি করো তুমি বুঝি না।’

– ‘তোমার এতো বুঝার দরকার নেই চোখ বন্ধ করো।’

– ‘করেছি।’

– ‘আর একবারও খুলবে না এভাবে থাকো।’

– ‘আচ্ছা।’

মানহা বিছানায় এসে বসে পুনরায় বললো,

– ‘চোখ বন্ধ করে জবাব দেবে ঠিকাছে?’

মৃদুল স্মিত হেঁসে বললো,

– ‘আচ্ছা ম্যাডাম।’

– ‘তোমার ঘুম আসেনি?’

– ‘না।’

– ‘কেন?’

– ‘জানি না।’

– ‘তাহলে আমার কোলে মাথা দাও, আমি চুল টেনে দেবো, কপাল টিপে দেবো, দেখবে ঘুম আসবে।’

– ‘আচ্ছা।’

মানহা বালিশটা সরিয়ে নিজের কোলে ওর মাথা টেনে এনে এক হাতে চুলে আঙুলগুলো ডুবিয়ে আরেক হাত আলগোছে চোখের ওপর রেখে বললো,

– ‘চোখে আলো লাগবে না এবার ঘুমাও জনাব।’

মৃদুলকে বড়ো স্পর্শ করলো মানহার এমন ভালোবাসা, মমতা আর যত্ন। বুকের ভেতর শুরু হলো সংগ্রাম। নিজেকে বড্ড পাষাণ, নির্দয় মনে হচ্ছে৷
এভাবেও ভালোবাসতে পারে বুঝি মানুষ? এই মুহূর্তে ইচ্ছে করছে সবকিছু ভুলে মানহাকে বুকে টেনে নিতে। সেও বুকে মাথা রেখে ঘুমোতে চেয়েছিল। কিন্তু ফাতিহার সঙ্গে এমন অবিচার সে করবে কীভাবে?
সেই যে সতেরো বছর আগে রূপগঞ্জ পালিয়ে গিয়ে দাদাভাইয়ের কাছে আশ্রয় নিয়েছিল। তারপর থেকে তো পরম বন্ধু ফাতিহাই তার। মনে আছে একবার দাদাভাই হাওড়ে ফুল, শসা, মরিচ, টমেটোর চাষ করেছিলেন। সেখানে পাহারা দেয়ার জন্য নাড়া দিয়ে ছোট্ট ঘর বানানো হয়। থাকবে একা মৃদুল। রাত-দিনের বেশিরভাগ সময়ই তার ওখানে থাকতে হতো। প্রথম কিছুদিন ভালোই লেগেছে। এরপরই বিরক্ত লাগা শুরু হয়। দিনে শুধু দাদাভাই আর কাজের লোক বাগানের এটা-সেটা কাজ কর‍তে আসতো। রাতে আবার হারিকেনের আলোয় মশারির ভেতরে সে একা।
দিন রাতের অদল-বদল বড়ো চোখে পড়তো তখন। কখনও রোদ, কখনও বৃষ্টি আরও কত রঙ বদল। ফাতিহা স্কুল শেষে ভাত নিয়ে যায়। ওর জন্যই সারাদিন চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় থাকে সে। ফাতিহা গেলে দু’জন লুডু খেলা, দৌড়াদৌড়ি, মারামারি আর খুনসুটিতে মেতে উঠে কেটে যেত বেলা। ফুল গাছগুলো এক সময় বড়ো হয়। বাগানে নানান ধরনের নানান রঙের ফুলগুলো ফুটতে শুরু করে। একেকটা ফুল যেন মানুষকে দেখলেই মিটমিট করে হাসে। চারদিক এক অদ্ভুত দীপ্তময় হয়ে উঠে, স্বর্গীয় দ্যুতি বিরাজ করে। বাতাসে মিশে যায় পুষ্পের অপার্থিব ঘ্রাণ। ফাতিহা তখন স্কুল ফাঁকি দিয়ে ছুটে আসে ফুলের টানে। ফুরফুরে বাতাসে বাগান ভরা ফুল নৃত্য করতে থাকে। সে আর ফাতিহা তখন শুরু করতো লুকোচুরি খেলা। লুকানোর জায়গা বিশাল বিস্তৃত বাগানের কোনো এক সরু আলে শুয়ে পড়া।
ওয়াজের সময় তার সঙ্গে মেলায় গিয়ে দুই হাত ভরে রঙিন চুড়ি কিনে আনা৷ বাড়ির সবার কড়া নিষেধ থাকার পরও লুকিয়ে পূজায় গিয়ে দেরি করে বাড়ি ফিরে বকা খাওয়া। এরকম কত সহস্র স্মৃতি এই ফাতিহার সঙ্গে। তারপর কী হলো? এক দূর্ঘটনার পর অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফাতিহার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে পুরো জীবনের জন্য সঙ্গী করে নিল সে। অথচ আদৌও তারা এর আগে একে ওপরকে স্বামী-স্ত্রী রূপে ভাবেনি। দু’জনই আট-দশটা সমলিঙ্গের বন্ধুর মতোই ছিল। তবুও বিয়ের পর দু’জন দু’জনকে সর্বোচ্চ সুখী করার চেষ্টা করেছে। মৃদুলও ফাতিহার দূর্বলতায় ঘুণাক্ষরেও আঘাত করেনি। শুধু দাদাভাই আশ্রয় দিয়ে বিশ্বাস করে আঘাত পেয়েছিলেন৷ তবুও মৃদুলের দয়া-মায়ার শরীর। ফাতিহার জন্য সকল অপবাদ মেনে নিয়েছিল৷ সকলের তির্যক কথাবার্তা হজম করেছিল। ফাতিহার সঙ্গে বেঁধেছিল ঘর। এখন কী মানহার মতো রূপবতীর, মায়াবতীর আমন্ত্রণে সেই সম্পর্কের বাঁধনে চির ধরতে শুরু করেছে?
কিন্তু মানহার সঙ্গেই বা সে এখন কী করছে? প্রেমের অভিনয়? প্রতারণা? হয়তো অবিবাহিত হলে মানহাকে সে ফিরিয়ে দিত না৷ কিন্তু এখন যে সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নেই তার স্বপ্ন দেখানো কী ঠিক হচ্ছে মানহাকে? সে তো এমন মানুষ নয়। অন্যের দোষ ঘাড়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর লোক। কিন্তু এবার সে একটু প্রতারণা করবে। বড়ো ক্লান্ত লাগছে। এবার কেউ তার দ্বারা একটু প্রতারিত হও। একটু নির্দয়, পাষাণ হতে ইচ্ছা করছে।

‘ঘুমিয়ে গেছো না-কি?’ আস্তে আস্তে ডেকে মানহা পরীক্ষা করে মৃদুল ঘুমিয়ে পড়েছে কি-না। সেও বুঝতে পেরে জবাব না দিয়ে ভান ধরে রইল। মানহা তার চোখের পাতায় বুড়ো আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে পুরো মুখে হাত বুলিয়ে এনে আবার ঠোঁটে বুড়ো আঙুল রাখে।

____চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here