বাঁক ( ১২ পর্ব )

0
133

বাঁক ( ১২ পর্ব )
____________

ইশি এখন তার মা’কে নিয়ে চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে আছে। সঙ্গে এসেছে আমজাদ। ট্রেনের টিকিটও কেটে দিয়েছে। সেদিন হোটেলে নিয়ে ইশির দেহ ভোগ করতে ব্যর্থ হলেও সে পুরোপুরি স্বাভাবিক আচরণ করে যাচ্ছে৷ আজ কলোনি থেকে বিদায় নিয়ে আসার পথে বললো,

– ‘ইশি দাঁড়াও আমি আইতাছি, তোমাদের স্টেশনে দিয়া আসি।’

ইশি কিছু বলেনি। কারণ আমজাদের দিকে তাকালেই তার লজ্জায় ঘৃণায় শরীর ‘রিরি’ করে। এই লোকটিই তো তার নগ্ন স্তন দু’টো জোর করে দেখেছে, নাক ডুবিয়েছে। সেলোয়ারও টেনে খুলে ফেলতো যদি কোনো এক দৈব ইশারায় ইরফান ভাইয়ের কল না আসতো।
আমজাদ তখন সেলোয়ারের গিঁট খুলতে ব্যস্ত। ইশি আশা ছেড়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে ঝরঝর করে চোখের পানি ফেলছে।
তখনই বিছানায় রাখা ইশির ভ্যানিটিব্যাগে মোবাইল বেজে উঠে। আমজাদ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে বিরক্তির স্বরে বললো,

– ‘এই সময় আবার কেটা কল দিলো।’

ইশি নিজেকে ছাড়িয়ে ভ্যানিটিব্যাগ থেকে মোবাইল বের করতেই আমজাদ টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে বললো,

– ‘এইটা কার নাম্বার?’

– ‘জানি না, সেভ নাই দেখছোই তো।’

আমজাদ কল কেটে দিয়ে বিছানায় ফেলে রাখে মোবাইল। ইশিকে পুনরায় পেছন থেকে টেনে নিয়ে বুকে এক হাত রেখে পিঠে নাক ঘষে। বিছানায় রাখা মোবাইলের স্ক্রিন আবার জ্বলে উঠে মেসেজ টিউনে।
আমজাদ ফোন হাতে নিয়ে চোখ বুলিয়ে ওর কাছে দেয়। ইশি মেসেজ ভিউ করে পড়ে ‘আমি সুন্দর পুরের ইরফান, কল রিসিভ করো।’
বিস্মিত হয়ে যায় ইশি। এতোদিন পর ইরফান ভাইয়ের কল দিল কেন? সে নাম্বারই বা পেল কোত্থেকে? ইরফান ভাই কী মৃদুল ভাইকেও এভাবে পেয়ে গেছে? সে তাড়াতাড়ি কল ব্যাক করে।

– ‘হ্যালো।’

– ‘ইশি বলছো?’

– ‘হ্যাঁ ভাই, তুমি কোত্থেকে? নাম্বার কীভাবে পেলে?’

– ‘আগে বলো আন্টির কী অবস্থা?’

– ‘এখন ভালো কিছুটা, তবে এখনও হসপিটাল আছে, কিন্তু তুমি এসব জানো কীভাবে।’

আমজাদ বিরক্ত হয়ে ফোন টান মেরে নিয়ে নিল। ইশি শুরু করলো টানাটানি ‘প্লিজ আমজাদ ভাই ফোনটা দেন জরুরি কল এটা।’
আমজাদ ছাড়ছে না। সে কেটে দিল কল। মোবাইল বিছানায় ছুড়ে ফেললো। ইশিকে টেনে নিল নিজের কাছে। শুরু হলো দু’জনের ধস্তাধস্তি। ইরফান আবার কল দেয়। ইশি আমজাদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে মোবাইল হাতে তুলে রিসিভ করে।

– ‘ইশি কে এমন করছে? তুমি কোথায় এখন? কোনো সমস্যা? বলো আমাকে।’

ইশি কাঁদতে কাঁদতে বললো,

– ‘আমি বিপদে আছি ভাই। তুমি কী আমাকে বারো হাজার টাকা দিতে পারবে? মায়ের চিকিৎসার জন্য ঋণ করেছিলাম। লোকটি এখন টাকার জন্য আমাকে হোটেলে নিয়ে এসেছে।’

আর কিছু বলতে হলো না ইশির। ইরফান বুঝে গেল সবকিছু।
সে শান্ত স্নিগ্ধ গলায় বললো ওর কাছে মোবাইলটা দাও।
আমজাদ চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছে।
ইশি ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

– ‘কথা বলো।’

আমজাদ দাঁত কটমট করে তাকিয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে বললো,

– ‘হ কন কি কইবেন।’

– ‘আপনি ওর কাছে কত টাকা পান?’

– ‘পনেরো হাজার।’

– ‘ও তো বললো বারো হাজার।’

– ‘ও খানকি তো বেইমান্নী মিয়া ভাই।’

– ‘একদম গালাগাল করবেন না। আপনাকে পনেরো হাজার না, বিশ হাজার দেয়া হবে। মেয়েটিকে নিরাপদভাবে বাসায় দিয়ে আসুন। আর যদি কোনো ক্ষতি হয় এর পরিণাম ভালো হবে না।’

– ‘না না ক্ষতি করমু কেন? আমার টাকা পাইলেই হইব। তাইলে কথা রইল বিশ হাজার টাকা দিয়া পাঠাইবেন। আমি বিকাশ নাম্বার দিতাছি মেসেজে।’

– ‘আচ্ছা, আর মোবাইল দিন ওর কাছে।’

ইশি মোবাইল হাতে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো। নিজেকে অনেক হালকা লাগছে।
ভাবতেই পারেনি আজ নিজেকে রক্ষা করতে পারবে।

– ‘ইশি কান্নাকাটি না করে এখন বাসায় যাও। আমি পরে আবার কল দিয়ে কথা বলবো, ঠিকাছে? আর আমার নাম্বারও সেভ দিয়ে রাখবে।’

– ‘আচ্ছা ভাই।’

আমজদ ইশিকে টেনে দাঁড় করিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,

– ‘এতো কাঁদতাছো কেন কও তো ইশি? আমারে ভয় পাওনের কিছু আছে? আমি জোর করে জীবনেই কিছু করতাম নাকি বেয়াক্কেল। তোমারে দেখলে ভালোবাসতে ইচ্ছা জাগে এইটুকুই। আইচ্ছা চলো, বাসায় চলো।’

ইশি চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়ায়। সেলোয়ার-কামিজ ঠিকঠাক করে পরে মাথায় ওড়না দেয়। তারপর ভ্যানিটিব্যাগ হাতে নিয়ে বললো,

– ‘চলো।’

আমজাদ দরজা খুলে দেয়, ইশি লজ্জায় ওড়না দিয়ে পুরো মুখ ঢেকে হোটেল থেকে বের হয়।

– ‘ইশি ভদ্রলোককে আমার বিকাশ নাম্বার দিয়া দেও, অপেক্ষা করতেছে মনে অয়।’

– ‘কিন্তু আমি তো তোমার থেকে বারো হাজার নিয়েছি, পনেরো বললে কেন?’

– ‘আরে ওইটা রাগের মাথায় বইলা দিছি।’

– ‘তাহলে এখন উনাকে বলি বারো হাজার দিতে।’

– ‘আরে বাদ দাও, উনিও দিবে বইলছে। তাছাড়া আমি যেইটার জন্য টাকা দিলাম তা পাইলাম না। একটু বেশি নিলে ক্ষতি কি কও।’

ইশি কোনো জবাব দিলো না। আমজাদ আবার তাড়া দিয়ে বললো,

– ‘আমার নাম্বারটা দিয়া দেও ইশি।’

– ‘লাগবে না, আমার নাম্বারে বিকাশ আছে। এটাতে ছাড়তে বলে দেবো। তারপর আমিই ক্যাশআউট করে তোমাকে দেবো।’

কথাটি বলে সেখান থেকে ইশি হসপিটাল চলে যায়। পরেরদিন মা’কে নিয়ে হসপিটাল থেকে কলোনিতে ফিরে। এরপর নিয়মিতই ইরফানের সঙ্গে যোগাযোগ হতো। নানান বিষয়ে কথা হতো। তার এখানকার বর্তমান অবস্থার কথা ভেবে একদিন ইরফান বললো, ‘আন্টি আরেকটু সুস্থ হলে তাকে নিয়ে তুমি সিলেটে চলে আসো, এখানে আমি কাজ দেখে দেবো তোমাকে।’

সেই থেকেই চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয় ইশি। সমস্যা হচ্ছিল তার মা’কে নিয়ে। পেটে সদ্য সেলাই নিয়ে ট্রেনে এতোদূর যাওয়া ঝুঁকি হয়ে যাবে। তাই আজ প্রায় পনেরো দিন পর ভোরে সে সিলেটের উদ্দ্যশ্যে বের হয়েছে। এখান থেকে ট্রেন ছাড়বে নয়টায়। আর বেশি সময় বাকি নেই। ট্রেন চলে এসেছে প্লাটফর্মে। মানুষ ধীরে ধীরে সিটে গিয়ে বসে পড়ছে। ইশি মা’কে ধরে ধরে ট্রেনে নিয়ে উঠে। সৌজন্যতাবোধ থেকে আমজাদকে মুচকি হেঁসে বিদায় জানিয়ে বলে,

– ‘যাচ্ছি ভাই দোয়া কইরো।’

আমজাদও মুচকি হেঁসে চলে যায়। ইশি মা’কে নিয়ে নিজের সিট খুঁজে বের করে বসে। সিট জানালার পাশেই। খানিক পর ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে ধীরে ধীরে ছুটতে শুরু করে। আমজাদ আবার কোত্থেকে এসে ইশির সামনে একটা প্যাকেট ধরলো।

– ‘কী এটা?’

– ‘গরম গরম শিঙারা নিয়া আইলাম।’

– ‘এখন এগুলো নিয়ে আসছো কেন? ট্রেনও ছেড়ে দিছে তো।’

– ‘হ ছাইড়া দিছে আমিও দেখছি।’

– ‘মানে? তুমি নামবে কীভাবে?’

আমজাদ ‘খ্যাক-খ্যাক’ করে বিশ্রী একটা হাসি দিয়ে বললো,

– ‘আরে আমারও সিলেটে কিছু কাজ আছে। যাইব যাইব করে যাওন হয় না৷ ভাবলাম তুমিও চাচিরে একা নিয়া যাইবা। তাই এক লগেই যাই টিকিটও তিনটা কাটছিলাম।’

ইশি কোনো জবাব না দিয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল। আমজাদের মতলব কী সে বুঝতে পারছে না। তাকে বারো হাজারের জায়গায় পনেরো হাজার সে নিজে তুলে দিয়েছে। যদিও বারবার বিশ হাজার দাবি করছিল। ইরফান না-কি বলেছে কোনো ক্ষতি না করলে তাকে বিশ হাজার টাকা দেবে। কিন্তু ইশি দিতে দেয়নি৷ কারণ এমনিতেই তিন হাজার বেশি দেয়া হয়েছে। আমজাদও মেনে নিয়েছে হাসিমুখে। এখন কী মতলব এঁটেছে বুঝতে পারছে না ইশি।
‘শিঙারা খাই না’ বলে প্যাকেট ঠেলে দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে চোখ রাখে সে।
যাত্রাটা বোধহয় খুব একটা সুখকর হবে না। তপ্ত রোদ উঠেছে। ট্রেনের গতি বাড়ছে। বাড়ি-ঘর, গাছগাছালি, বন্ধ দোকান, গরু-ছাগল, পথচারি সবকিছু কেমন উলটো দিকে দ্রুত ছুটে চলে যাচ্ছে।

– ‘ইশি খাইবে না তাইলে চাচি আপনে নেন একটা শিঙারা। গরম গরম আছে ভালা লাগবো।’

ইশি বাইরে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে আমজাদের হাত ঠেলে সরিয়ে দিয়ে মা’কে বললো,

– ‘এই লোক কিছু দিলে খাবেন না।’

আমজাদ অবাক হয়ে বললো,

– ‘এ কি কও ইশি? আমি দিলে খাইব না কেন? আমি অপরিচিতনি তোমাদের? আমরা এক লগেই তো যাচ্ছি।’

– ‘তুমি বাড়াবাড়ি করবে না। নিজের কাজে যাচ্ছ যাও, আমাদের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক প্ল্যাটফর্মেই শেষ।’

– ‘কি কও না কও ইশি। আইচ্ছা যাও, তোমার মনে অয় মন মেজাজ ভালা না। এখন কথা কইতেছি না।’

ইশি কোনো জবাব দিলো না। আবার বুকে হাত বেঁধে বাইরে তাকালো। এভাবে ঘণ্টা কয়েক চলে গেছে। ইশির মা বললেন বাথরুমে যাবেন। ট্রেনও একটু শ্লথ গতিতে যাচ্ছে। হয়তো সামনে কোনো স্টেশন আছে। ইশি এক হাতে ভ্যানিটিব্যাগ নিয়ে অন্যহাতে মা’কে ধরে ধরে টয়লেটে দিয়ে দরজা আঁটকে বাইরে দাঁড়ায়। তখনই তিনটা ছেলে তার দিকে এসে ফিসফিস করে বললো,

– ‘চিল্লাচিল্লি না করে ব্যাগ দে না হয় চাকু পেটে ঢুকিয়ে দেবো।’

ইশি তাকিয়ে দেখে সত্যি সত্যি একজন চাকু পেটের সামনে ধরে রেখেছে। সে চিৎকার দিতে যাবে তখনই একজন মুখটা চেপে ধরলো। আরেকজন ভ্যানিটিব্যাগ ধরে টান দেয়। কিন্তু ইশি শক্ত করে ধরে রাখে ব্যাগ। পলকেই তৃতীয়জন হাতে চাকু চালিয়ে দেয়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়। ঠোঁটের মতো ‘হা’ হয়ে যায় চামড়া। ইশি হাত চেপে ধরে আর্তনাদ করে বসে পড়ে। ট্রেনের গতি কম থাকায় ছেলেগুলো ব্যাগ নিয়ে নিমিষেই যেন উধাও হয়ে গেল। ভেতর থেকে মা কিছু একটা টের পেয়ে দরজা খুলে দেখলেন ইশির হাত থেকে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে।

___চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here