আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন . ১৭ পর্ব

0
133

আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন
.
১৭ পর্ব
.
ইজাজ মেম্বারের পরনে সাদা লুঙ্গি৷ গায়েও হাফহাতা সাদা সার্ট৷ চুলও সাদা হয়ে গেছে। তিনি মুখ জবজবে করে পান খাচ্ছেন৷ জানালা দিয়ে ‘ফুরুত’ করে পানের পিক ফেলে বললেন,
–‘আপনে এখানে যয়দিন ইচ্ছা থাকেন মাস্টার সাব৷ আপনে হইলেন আমাদের মেহমান। প্রয়োজনে আরও কয়দিন আমার বাড়িতেও গিয়া থাকবেন। এই গ্রাম চেয়ারম্যানের বাপের সম্পত্তি না। বুইচ্ছেন তো মাস্টার সাব? আচ্ছা এখন উঠি। আমার আবার ইউনিয়ন অফিসে যেতে হবে।’

ইজাজ মেম্বার জিসানের রুম ত্যাগ করলেন।
পুরো ইলাশপুর গ্রামে একটা অস্থিরতা বিরাজ করছে। ইতোমধ্যে দু’টো দল হয়ে গেছে। নানান কারণে যারা চেয়ারম্যানের প্রতি বিরক্ত তারা ময়নুল সাহেবের পক্ষে। ইজাজ মেম্বার এবং ময়নুল সাহেব চেয়ারম্যানের সঙ্গে ক্ষমতার এক অঘোষিত প্রতিযোগিতা শুরু করেছেন। জিসানকে ফোনে যোগাযোগ করে স্বয়ং ময়নুল সাহেব গিয়ে গ্রামে ফিরিয়ে এনেছেন।
চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে কয়েজন প্রবীণ ব্যক্তি পিয়াসের বিচার নিয়ে এসেছিল। ময়নুল সাহেব তাদেরকে উল্টো একগাদা অভিযোগ শুনিয়ে দিলেন, ‘তার ছেলেকে কেন হাওর থেকে দৌড়িয়ে ধরে নেওয়া হলো? সে তো চেয়ারম্যানের বাড়িতে যায়নি? সে বিলের পাড়ে ছিল। আর মাস্টার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল চেয়ারম্যান প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি যদিও রাতে দেখা করতে যেয়ে অপরাধ করেছেন। তবুও এখানে ভেতরের অনেক বিষয় খতিয়ে দেখে বিবেচনা করার ছিল। তিনি গেছেন মেয়ের মতামত জানতে। কারণ এই মেয়ের বাবা-মা নেই। মাস্টার এতোদিন সেখানে থাকায় জেনেছেন চাচা নামেমাত্র অবিভাবক। প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে ঘরে রেখে তিনি যোগ্য পাত্রও প্রত্যাখ্যান করে দিচ্ছেন। সুতরাং মাস্টারের মনে হইছে মতামত জানা দরকার। তবুও মানছি তিনি অপরাধ করেছেন। তাই বলে একজন মাস্টারকে রাতে এভাবে ফেলা আসা হবে কেন? মাদ্রাসা চাকরী নেই বললেই তো উনি একটা সময় চলে যেতেন।’ এভাবে পুরো বিচার প্রশ্নবিদ্ধ করলেন ময়নুল সাহেব। প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গেও বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হয়ে গেলেন।

জিসান পুরো ব্যাপারটা নিয়ে বিব্রতবোধ করছে। তাকে কেন্দ্র করে একটা গ্রামে ঝামেলা হোক সে চায় না। ঢাকায় চলে যাবার কথা ভাবে। পরক্ষণেই মনে হয় সে পারবে না৷ অন্তরাকে নিয়ে ইতোমধ্যে চেতন-অবচেতনে সুন্দর কিছু স্বপ্ন দেখে ফেলেছে সে। তাকে ছাড়া ঢাকায় গিয়ে থাকতে পারবে না। জীবনটা অস্থিরতার ছিল। অসংখ্য জিজ্ঞাসায় জর্জরিত মনটা অশান্ত ছিল। এখন সমস্ত কিছু বাদ দিয়ে অন্তরাকে নিয়ে একটা সুন্দর সুখের সংসার করতে চায়। বাবার ব্যবসায় মনযোগ দিতে চায়৷ কিন্তু কীভাবে আবার অন্তরার সঙ্গে যোগাযোগ হবে? কিছুই সে জানে না।

পিয়াস তার রোজকার রুটিন মতো দিন কাটাচ্ছে। ভোরে গরু নিয়ে মাঠে যায়। আসার সময় শালিকের জন্য ফড়িং নিয়ে আসে। সামনের বারান্দার সঙ্গে লাগোয়া ফটিকে ( আইতনায় ) ফার্মেসি। লোকজন এলে ঔষুধ দেয়। কারও বাড়িতে যাওয়ার ডাক এলে লুজ প্যান্টের সঙ্গে ফুলহাতা সাদা সার্ট আর মেডিক্যাল ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
সিক্তা পর্দার আড়াল থেকে তাকিয়ে অকারণেই ফিক করে হাসে। সে জানে স্বামী সহজ-সরল হাবাগোবা। তবুও পিয়াসের প্রতি ভালোবাসার কমতি নেই। সিক্তার বোধহয় কারও প্রতিই ভালোবাসার কমতি নেই। এখন সে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দূরের গাছের দিকে তাকিয়ে গ্রামের অতি পরিচিত একটি দৃশ্য দেখছে। কালো ফিঙের দল মিলে একটি কাককে বারংবার ঠুকরে উড়ে যাচ্ছে। সিক্তা বারংবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে। কাল রাতে তো ফ্যাসফ্যাস করে কেঁদে ফেলেছিল। কান্নার কারণ হচ্ছে তাদের বাড়ির জিসান মাস্টার। পিয়াসের কাছ থেকে সবকিছু জেনেছে সে। শহরের এই মাস্টার রাতে বিল সাঁতরে প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল? আহারে লোকটা কত ভালোবাসে মেয়েটিকে। তাকে এভাবে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হলো? কথাটি মনে হলেই সিক্তার জলে চোখ ভরে যাচ্ছে। জিসানকে তার কাছে মনে হচ্ছে কোনো উপন্যাসে আঁকা উঁচু দরের প্রেমিক। যে প্রেমিক তার ভালোবাসার মানুষটির জন্য সব করতে পারে। প্রেমিকা যদি বলে আচ্ছা এক্ষুনি ছাদের উপরে গিয়ে লাফ দিয়ে একটু মরে যাও তো। নায়ক বলবে আচ্ছা তুমি একটা মিষ্টি করে হাসি দাও। শেষবার তোমার হাসিটি দেখে মারতে চাই। তারপর ছাদে গিয়ে ভালো মানুষের মতো লাফ দিয়ে মরে যাবে৷ সিক্তা ঠিক করেছে একবার চুপিচুপি স্যারের রুমে গিয়ে দেখা করবে। যদিও গ্রামগঞ্জে স্যার-হুজুরদের সঙ্গে মহিলাদের দেখা করার নিয়ম নাই। আচমকা সামনে পড়ে গেলেও টান দিয়ে মাথায় কাপড় তুলে পেছন ফিরে রাস্তার কিনারায় চলে যেতে হবে৷ তবুও সিক্তা জিসান মাস্টারের সঙ্গে দেখা করে ধর্মের ভাই বানিয়ে ফেলবে। গ্রামগঞ্জে ধর্মের ভাই বানাতে পারলে লোকে আর বেশি ঘাটায় না। একটা মানুষ রাতের বেলা বিল সাঁতরে কবরস্থান ডিঙিয়ে প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ধরা পড়েছে৷ সেই অসাধারণ মানুষটি তার বাড়িতে থাকে সে দেখা করবে না তা করে হয়? সিক্তা চোখের পানি মুছে বিছানায় রাখা রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ উপন্যাসটি আবার পড়তে শুরু করলো। এখানে আসার পর থেকে একই উপন্যাস বারবার পড়ার অভ্যাস হয়ে গেছে৷ পিয়াস শহরে গেলে দু’একটা বই এনে দেয়। সেগুলোই কয়েক মাস বারবার পড়ে কাটায়। ঠিক করেছে টিউশনি পড়িয়ে টাকা জমাতে পারলে একগাদা বই কিনে আনবে। বই না পড়তে পারলে মানব জীবন বৃথা যাচ্ছে মনে হয়।

—-
মাস খানেক হয়ে গেল ময়নুল মাস্টারের পরিত্যক্ত বাড়ি থেকে পথচারীরা দুর্গন্ধ পায়। এদিকটা খানিক জঙ্গলের মতো হয়ে আছে। বাড়ির পাশ দিয়ে একটা খাল। এরপর রাস্তা। সেখানে মতিন মিয়ার বাড়ি। আখলাছুর এবং চেয়ারম্যানের খাস লোক মতিন মিয়া। পথচারীরা নাক চেপে যাওয়ার সময় তাকে জিজ্ঞেস করে কিসের গন্ধ, কোত্থেকে আসে?
মতিন মিয়া বেচারা হয়ে বলে, ‘কি জানি ভাই। বাড়িতে বসবাস করা দায়। ওই জঙ্গলের দিক থেকে গন্ধ আসে মনে হয়।’

প্রথমে মানুষজন ভেবেছে জঙ্গলের ভেতরে শিয়াল-কুকুর জাতীয় কিছু মরেছে হয়তো। ক’দিন পর দুর্গন্ধ এমনিতেই থাকবে না। কিন্তু এখনও থেকে থেকে গন্ধ আসছে। মতিন মিয়া আজ প্রতিবেশী কয়েকজনকে নিয়ে গন্ধ শুঁকে পরিত্যক্ত বাড়িতে ঢুকে। চারদিকে গাছগাছালি৷ এদিক-সেদিকে ঝোপঝাড়। তারা গন্ধ শুঁকে একটা টয়লেটের সামনে দাঁড়ায়৷ শ্যাওলা পড়া এই টয়লেটের উপরে টিন আছে। বাইর থেকে দরজা শক্ত করে বাঁধা। তারা ঠিক বুঝতে পারে গন্ধ ভেতর থেকেই আসছে। একজন দড়ি খুলে ভেতরে গিয়ে একটা বস্তা পেল। সেখান থেকে পেট গুলিয়ে আসার মতো গন্ধ আসছে। মাথা ব্যথা ধরে যাচ্ছিল। কোনোমতে বস্তা খুলে সবাই ভয়ের পাশাপাশি বিস্মিত হয়ে যায়। মাথার খুলি, হাড় আর কঙ্কালের সঙ্গে লুঙ্গি পাঞ্জাবি।

থানায় খবর দেওয়া হয়। পুলিশ আসে।
এলাকার মানুষকে নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণে পুলিশ নিশ্চিত হয় নারায়ণ মাস্টারকে খুন করে এখানে রাখা হয়েছিল। স্থানীয়রা জানায় এই পাঞ্জাবী লুঙ্গি নারায়ণ মাস্টার বেশি পরতেন। প্রথমে খোঁজা হয় পরিত্যক্ত বাড়ির মালিককে। ময়নুল মাস্টারকে জিজ্ঞেস করা হয় এবাড়িতে তিনি কতদিন থেকে আসেননি। এলে গন্ধ কি পাননি? এমন নানান প্রশ্ন। ময়নুল মাস্টার উত্তরে বলে এবাড়িতে আগে নিয়মিত আসা হলেও মাস কয়েক তাদের কারও আসা হয় না।
এপর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে নারায়ণ মাস্টারের বাড়ির কাজের মহিলা জানায় খুন হওয়ার দিন দুপুরে তাকে নারায়ণ মাস্টার বলেছিলেন রাতে রান্না করতে হবে না৷ কারণ ময়নুল সাহেবের বাড়িতে তার রাতে খাওয়ার দাওয়াত আছে। তিনি হিন্দু হলেও মুসলমানদের বাড়িতে যেতেন। দাওয়াত খেতেন। জাত-ধর্মে উদাসীন ছিলেন। মুসলমান অনেক পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তারা প্রায়ই দাওয়াত দিতো। তিনি যেতেন। আরও তদন্তের একপর্যায়ে মতিন মিয়া জানায় নানান সময় ময়নুল সাহেব তাদের কাছে নারায়ণ মাস্টারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করতেন। পুলিশও একটা সময় খুনের মোটামুটি কিছু কারণও খোঁজে বের করে। ময়নুল সাহেবের ফার্মেসি ব্যবসা আর টিউশনির মতো কিছু ছোটখাটো স্বার্থ জড়িত আছে। ময়নুল সাহেবকে ধরে থানায় নেওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদ চলতে থাকে। দেশে ফিরে আসে নারায়ণ মাস্টারের স্ত্রী-সন্তান। তারা বাবার খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান। ক’দিন পর রইসু নামের এক ভদ্রলোক তাদের সঙ্গে দেখা করতে যান। যিনি ময়নুল সাহেবের প্রতিবেশী। সে জানায় খুনের রাত ময়নুল সাহেবের বাড়িতে একটু হুলস্থুল শুনেছিল। রাতে নারায়ণ মাস্টারকে যেতেও দেখেছিলেন। অবিকল সেই পাঞ্জাবী এবং লুঙ্গি ছিল।
ময়নুল মাস্টারের পরিবার দিশেহারা হয়ে পড়ে। সদা শক্ত কর্মট মহিলা সেতারা বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েন। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারেন না। সহজ-সরল পিয়াস রাতদিন কোর্ট-কাঁসারিতে দৌড়াদৌড়ি করে কাটায়। সে গভীর জলে পড়ে গেছে৷ রাতে একফোঁটাও ঘুমাতে পারে না। সিক্তা কোলে মাথা নিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। পিয়াস উৎসাহ নিয়ে একেকদিন একেকটা আশার বাণী শোনায়, ‘সিক্তা এবার একজন ভালো উকিলের সন্ধান পাইছি৷ খুব গরম উঁকিল। ইজাজ চাচার পরিচিত।’

সিক্তা বুঝতে পারে। তার সহজ-সরল স্বামীটার মাথায় সারাক্ষণ এখন এইসব জটিল বিষয় ঘুরপাক খায়৷ বাবাকে গুছানো ফাঁদ থেকে বের করার চিন্তায় দিন রাত বুঁদ হয়ে থাকে।

— চলবে..
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here