দেশলাই – ১৩ পর্ব

0
203

দেশলাই – ১৩ পর্ব

বুকে মায়ের বিয়োগ ব্যথার ভার নিয়ে শুয়ে আছে রাফসান। জানালায় খয়েরী রঙের পর্দাটা মৃদু কাঁপছে। তাকে ঘুমোতে বলে চলে গেছে সবাই। কিন্তু ঘুম আসছে না তার। মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ছে। সে চলে যাবার পর কী হয়েছিল খুব জানতে ইচ্ছে হয়। মা কি খুব ভেঙে পড়েছিলেন? নববধূরই বা কি ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ভাবতে ভাবতে একপর্যায়ে তার চোখবুঁজে ঘুম এলো। সেই ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যা সাতটায়। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। পুরো শরীরে ব্যথা করছে। এতোদিনের অনিদ্রা আর অধিক হাঁটা তার কারণ। কিন্তু এখন সে কি করবে? হাত বাড়িয়ে আলনা থেকে একটা গেঞ্জি নেয়। এতোদিন অব্যবহৃত থাকায় কেমন একটা গন্ধ বেরুচ্ছে। তবে দেখে মনে হচ্ছে ধোয়া। মা হয়তো ধুয়েছিনেন। রাফসান গেঞ্জিটা পরে বাইরে যায়। পা ফেলা যাচ্ছে না। গোড়ালিতে পর্যন্ত ব্যথা করছে। চাচাতো ভাইবোনরা জোরে জোরে পড়ছে। উত্তর পাড়া থেকে হাততালির শব্দ ভেসে আসছে। কারও বিয়ে হয়তো। এখন সে কি করবে? অবশ্য একটা কাজ আছে। আইডি কার্ড নিয়ে তার সিম তুলতে হবে। মোবাইলে ইন্ডিয়ান সিম ঢোকানোর সময় ওইটা শফিকের ব্যাগে রেখেছিল। নিজের মানিব্যাগে অবশ্য রাখা যেতো, কিন্তু টাকা বের করার মুহূর্তে বাংলাদেশী সিম কেউ দেখে ফেললে ঝামেলা। এখন কি মধুশ্বরী বাজারে আইডি কার্ড নিয়ে চলে যাবে? আবার ঘরে ফিরে গেল। আলমারিতে একটা ফাইলে আছে কার্ড। চাবি কোথায় কে জানে। সমস্তকিছু খুঁজেও পেল না। ছোট চাচিকে গিয়ে বলতেই চাবিটা বাড়িয়ে দিলেন। আলমারি খুলে কার্ড নিয়ে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।
হাঁটতে হাঁটতে কবর গলির সামনে এলো। ইলিদের বাড়িতে কি উঠবে? চা-টা খেয়ে না হয় যাবে? গেইটটা খুলে ভেতরে গেল। দরজায় নক দিতেই মামা দরজা খুলে দিলেন। সে সালাম দেয়৷ কিন্তু কোনো জবাবই দিলেন না। গম্ভীরমুখে চলে গেলেন। রেগে আছেন হয়তো। ইলির রুমে গেল সে। ইলি টেবিলে বসে মোবাইল টিপছে৷ তাকে দেখে ওড়নাটা ঠিক করতে করতে বলল,
– ‘রাফসান ভাই করোনার সময় ইন্ডিয়া থেকে এসেছো। তোমার বাড়িতে থাকা উচিত। কেউ জানলে পুলিশকে খবর দিতে পারে।’

রাফসানের হঠাৎ মনে হলো তাইতো। সে আগেও এসে ডায়রেক্ট এখানে ঢুকে পড়েছে। তারা প্রথম সাক্ষাতের বিস্ময়ে হয়তো কিছু বলতে পারেনি।

– ‘হ্যাঁ রে আমার খেয়ালই ছিল না। তোদের বাড়িতেও আগে ডায়রেক্ট ঢুকে পড়েছি। আচ্ছা আমি এখন যাই।’

– ‘চলেই এসেছো যেহেতু বসো।’

– ‘আমি বের হয়েছিলাম বাজারে যাওয়ার জন্য। ভাবলাম উঠি।’

– ‘হ্যাঁ, উঠছো ভালো করছো৷ কিন্তু বাজারে যেও না। তুমি ইন্ডিয়া থেকে এসেছো লোকজন জানলে সমস্যা আছে।’

– ‘হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস।’

– ‘চা খাবে?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘তাইলে বসো, আমি মা’কে চা বসাতে বলি। আর গেঞ্জি উল্টো পরে আছো কেন? ওটা ঠিক করো।’

ইলি চেয়ার থেকে উঠে হেঁটে বাইরে গেল। পায়ে চটিজুতা। পরনে হলদে কামিজ। মাথায় জর্জেটের ওড়না। বারংবার মাথায় টেনে তুলে হাঁটছে। ডানপাশের চুল কানে গুঁজে অন্যপাশের একগোছা চুল কপাল বেয়ে বুকে পড়েছে। কি দারুণ দেখতে হয়েছে ইলি। খানিক পরে আবার ফিরে এসে টেবিলে বসে বলল,
– ‘বড়ো ফুপু অসুস্থ। বিকেলে ফোন দিয়েছিলেন।’

– ‘কি অসুখ?’

– ‘এই বয়সকালে যা হয়। কত রোগ উঁকি মারে। হাই প্রেসার মনে হয়।’

– ‘আম্মা মারা যাওয়ার পর খালা এসেছিলেন?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘খালাকে দেখতে যাবে তোমরা কেউ?’

– ‘করোনায় তো স্কুল-কলেজ সবকিছু বন্ধ। বাড়িতে ভালো লাগছে না। তাই এমনিতেই শ্রীমঙ্গল যেতে চাচ্ছিলাম। এখন ফুপুও অসুস্থ। আব্বাকে বলেছিলাম নিয়ে যেতে। আজ না কাল করছে।’

– ‘আমিই নিয়ে যাবো। কোনদিন যাবি?’

– ‘তুমি এতোদিনে বাড়িতে এসেছো৷ চেহারা-ছবির অবস্থাও খারাপ, কয়েকদিন রেস্ট নাও।’

– ‘না, বাড়িতে ভালো লাগছে না। শ্রীমঙ্গল গেলে ভালো লাগবে। খালাকেও কতদিন দেখি না।’

– ‘তুমি যেদিন বলবে সেদিনই যেতে পারবো। আমার তো ভার্সিটি বন্ধ।’

– ‘কালই যাই।’

ইলি চেয়ার থেকে উঠে গেল৷ চা আনার জন্য রহিমা বেগম ডাকছেন। খানিক পর ট্রে করে দুই কাপ চা আর বিস্কিট নিয়ে ফিরে এলো। ট্রে রাখার পর আবার ওড়নাটা ঠিক করে এক কাপ নিজেই নিল।

– ‘কিরে আমারে দেওয়ার আগে তুই চা নিয়ে নিলি?’

– ‘এহ তোমার কি হাত নেই? পাশেই তো ট্রে রাখা।’

রাফসান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,

– ‘তুই একটু তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে গেছিস।’

– ‘হুম, তুমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছ। আর আমি একটু বড়ো হব না?’

– ‘আমি বুড়ো হয়ে গেছি?’

– ‘হ্যাঁ অনেকটাই। তবে তোমার প্রেমিকার বিরহে যে দেবদাস হয়েছিলে তার থেকে ভালো।’

– ‘বুঝিনি। দেবদাস থেকে ভালো কীভাবে? আবার বলছিস বুড়ো হয়ে গেছি।’

– ‘মানে এখন মানসিকভাবে শুধু সুস্থ আছো। ইন্ডিয়া কোথায় ছিলে, কি করছো কে জানে। পুরাই গরু রাখাল হয়ে আসছো।’

কথাটি শুনে রাফসানের হাত থেকে বিস্কিট ভেঙে চায়ের কাপে পড়ে গেল। কেউ এভাবে মুখের উপর গরু রাখাল বলে?
সে আহত নয়নে তাকিয়ে বলল,
– ‘গরু রাখাল লাগছে? এভাবে বলতে পারলি?’

– ‘লাগছে তাই বললাম। তাছাড়া গরু রাখাল বললে অপমানিত হওয়ার কিচ্ছু নাই। ওরা কি মানুষ না?’

– ‘হ্যাঁ মানুষ, চাকরানীরাও মানুষ। তোকেও অন্যেরা বাসার চাকরানীদের মতো লাগে।’
কথাটি বলেই ভাবলো ঠিক হয়নি। কথার কথায় বাজেভাবে বলে ফেলেছে।
ইলির মুখ নিমিষেই ম্লান হয়ে গেল। তবুও সে চায়ে চুমুক দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার জন্য বলল, ‘ও তাই?’

রাফসানের অস্বস্তি লাগছে। ইলিকে এভাবে বলা মোটেও ঠিক হয়নি। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মুখ কেমন হয়ে গেছে ওর। এরকম কখন হয়? লজ্জায় না-কি অপমানে? চা শেষ করে কি বলবে, কি করবে সে ভেবে পেল না। ইলি বিব্রতকর ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে টেবিলের দিকে মুখ ফিরিয়ে চা খাচ্ছে।
রাফসান কিছু না বলে উঠে দাঁড়ায়। মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে এলো। মেয়েটি তাকে ইন্ডিয়া গিয়ে চেহারা খারাপ হয়েছে বুঝাতে মজা করে হয়তো বলেছে গরু রাখাল লাগছে। তাই বলে সে অন্যের বাসার চাকরানীর মতো লাগছে বলে ফেলবে? রাত ন’টায় তাকে খেতে ডাকলেনে ছোট চাচি। খেতে গেল সে। তাকে চাচি বললেন, ‘তোমার চাচারা তো ফোনে পাচ্ছেন না। একবার কল দিয়ে কথা বইল।’
– ‘আমার সিম তুলতে হবে চাচি। তারপর কল দেবো। না হয় তোমাদের সঙ্গে কথা হলে ডাক দিয়ো। আর হ্যাঁ, খালাকে দেখতে কাল শ্রীমঙ্গল চলে যাব।’

– ‘আচ্ছা।’

**
রাফসান বের হয়ে যেতেই ইলি দৌড়ে গেল মায়ের কাছে। রহিমা বেগম রান্নাবান্না করছেন। মা’কে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
– ‘আম্মা একটা ভুল করে ফেলেছি। রাফসান ভাই রাগ করে চলে গেছে।’

– ‘আমাকে ছাড়। কি করেছিস বল?’

– ‘আমি বলে ফেলেছি ইন্ডিয়া গিয়ে গরু রাখালের মতো হয়ে গেছে। বিশ্বাস করো আমি এমনিতেই মজার ছলে বলেছিলাম। সে রাগ করে ফেলেছে।’

– ‘হ, বড়ো তো বাতাসে হইছো৷ পড়ালেখা করে মানুষকে কি বলতে হয় না বলতে হয় তাও এখনও শেখনি।’

– ‘আমি জানতাম না-কি সামান্য এই কথায় রাগ করবে?’

– ‘আচ্ছা যা, সর এখন।’

– ‘রাফসান ভাই বলেছিল ফুপুকে কাল দেখতে যাবে।’

– ‘তাইলে তো ভালো৷ তুইও যা। ভার্সিটি বন্ধ আছে দেখে আয়। ছেলেটারও মা-বাবা কেউ নাই এখন। বেড়াতে গেলে মন ভালো হবে।’

– ‘কিন্তু রাগ করে যে চলে গেল?’

– ‘ধুরো যা সর। এতো রাগ করার কিছু হয়নি।’

– ‘রাগ করেছে মা। রাগ করে আমাকেও বলেছে অন্যের বাড়ির চাকরানী লাগে।’

– ‘কি?’

– ‘আমি বলছি রাখালের মতো লাগে৷ তাই সে রাগ করে কিছু না বলে চলে গেছে।’

– ‘বলিস কি৷ সামান্য এই কথায় এভাবে রেগে চলে গেল কেন? আজ দিনে তো কথাবার্তায় মনে হলো ঠিক আছে। মাথার সমস্যা আবার ফিরে এলো কি-না কে জানে।’

– ‘জানি না।’

ইলির ফোন বেজে উঠলো৷ মামাতো ভাই হৃদ কল দিয়েছে। রুমে চলে গেল। মাঝে মাঝেই কল দেয়। ইলি স্বাভাবিকভাবেই কথা বলে। আজ মিনিট বিশেক কথা বলার পর রাতের খাবার খেয়ে বেডে যায়। ফেইসবুক ইন্সটাগ্রামে খানিক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করে। আজ দিনটা আসলে শুভ। আচমকা রাফসান ভাই চলে এলো। মনটায় কেমন আনন্দ লেগে আছে। সঙ্গে একটু মন খচখচ করছে সন্ধ্যায় গরু রাখাল বলায়। মানুষটা এমনিতেই হঠাৎ এসে জানলো মা আর নেই। আর সে কি-না কি বলে দিলো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here