দেশলাই – ১৫ পর্ব

0
182

দেশলাই – ১৫ পর্ব

ঢালু পথ দিয়ে মাঠে নেমে খানিকটা হেঁটে যেতেই ইলির চটিজুতো ছিঁড়ে গেল। দাঁত কটমট করে জুতো ছুড়ে ফেলে আবার হাঁটা ধরবে তখনই পেছন থেকে হাঁক এলো,
– ‘এই ইলি হয়েছে কি, চলে যাচ্ছিস যে।’
পেছন ফিরে তাকায় ইলি। রাফসান ভাই বাড়ি থেকে নেমে এদিকে আসছে। ইলি কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইল। রাফসান কাছাকাছি এসে আবার বলল,
– ‘কি রে, কিছু না বলেই চলে যাচ্ছিস যে, টিফিনও নিলি না।’

– ‘টিফিন তো তুমিও নিতে পারবে।’

– ‘বল তো কি হয়েছে? কেউ কিছু বলছে?’

– ‘না৷’

– ‘আর তুই রাস্তা দিয়ে না গিয়ে বন দিয়ে যাচ্ছিস কেন?’

– ‘এদিকে ক্ষেত দেখে যাব। আখের ক্ষেত, সূর্যমুখী ফুলের বাগানও আছে।’

– ‘কিন্তু এখন তো মুখ বাঁকা করে ফুলের সঙ্গে সেল্ফিও তুলতে পারবি না।’

ইলি ফিক করে হেঁসে বলল,
– ‘কেন?’

– ‘তোর মন মেজাজ তো খারাপ মনে হচ্ছে। এই অবস্থায় মুখ বাঁকা করা যায় না।’

– ‘আমার মন অযথা খারাপ হয় না।’

– ‘তাইলে বল যথার্থ কারণটা কি?’

– ‘কিছু না। এখন যাই।’

– ‘এই দাঁড়া, জুতা তো ছিঁড়ে ফেললি। আইলে-টাইলে ভাঙা শামুক থাকলে পা কাটবে আমার চটিজুতা পরে নে।’

– ‘এই আলিশান জুতা আমি পরবো?’

– ‘হ্যাঁ পরবি, এখানে তো কেউ দেখবে না। রোদ উঠেছে, নে তাড়াতাড়ি ফিরে যা। আমি একটু পরেই রেডি হয়ে আসছি।’

– ‘আচ্ছা।’

ইলি আখ ক্ষেত পেরিয়ে সূর্যমুখী বাগানের সামনে গেল। আকাশে ঝকঝকে রোদ। সূর্য কপালে এসে পিছলে পড়েছে। সেল্ফি তুলতে গিয়ে হচ্ছে বিরাট ঝামেলা। সূর্যকে পেছনে রেখে তুলতে গেলে অন্ধকার আসছে সব। আবার সূর্যের দিকে তাকিয়ে বাগানকে পেছনে রেখে তুলতে গিয়ে ওর কপাল কুঁচকে যাচ্ছে রোদে। তবুও ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে কয়েকটি ছবি তুলে দেখলো একটাও ভালো হয়নি, নিজেকে পেত্নী লাগছে।
হাঁটতে লাগলো। জুতো বড়ো হলেও খুব বেশি অসুবিধা হচ্ছে না। সোজা এসে তাল গাছের নিচ দিয়ে কবর গলিতে উঠে গেল। বাড়ির গেইট খুলে দেখলো মা উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছেন।
তাকে দেখে বললেন, ‘কি রে, পেঁচা মুখ করে ফিরলি যে।’

– ‘আজ মেহমান বাড়ি যাব তো মা, তাই মুখটা আরও কত রূপ ধরবে।’

– ‘তোর আরও কত কি থাকবে।’

– ‘কত কি না মা। আমি প্রায়ই খেয়াল করে দেখেছি৷ কোথাও যাওয়ার আগে আমার মুখ পেত্নী, পেঁচা কত কি হয়। কিন্তু বাড়িতে থাকলে বিশ্ব সুন্দরী।’

– ‘যা যা সর। আর টিফিন কোথায়?’

– ‘রাফসান ভাই আনবে। কিন্তু তুমি পায়ের দিকে তাকালে না যে মা?’

– ‘এ কি রে? তোর পায়ে কার জুতা?’

– ‘আমার জুতা ছিঁড়ে গেছে।’ কথাটি বলেই ইলি হনহন করে নিজের রুমে চলে গেল।

ফ্যান ছেড়ে উত্তরের জানালা খুলে খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল ইলি। মন কিছুতেই ভালো হচ্ছে না। একটা মানুষ পদে পদে শুধু ভুল করে গেল। ভুল সিদ্ধান্ত নিল। এখন তার জীবনটা বিলের ভাসমান পানার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেদিকে বাতাস দেবে সেদিকেই পানা যাবে। নিজের হাতে কিছুই নেই। কোনো লক্ষ্য উদ্দেশ্য নেই। অথচ সমস্তকিছু নিজেরই ভুলে হলো। ইলির চোখ জলে ভরে এলো। স্পষ্ট মনে আছে। প্রাইমারি স্কুলে থাকতে হেড স্যার রাফসান ভাইকে নিয়ে খুব গর্ব করতেন। ছোট ক্লাসে পাঠাতেন ক্লাস নিতে। শুধু কি ছোট ক্লাসে? একবার তারা কয়েকজন অযথাই প্রস্রাব করার নামে বাইরে ঘুরাঘুরি করছে। হঠাৎ দেখলো হেডস্যার রাফসান ভাইকে ডেকে ফাইভের ক্লাসে নিচ্ছেন। ইলিরা উঁকিঝুঁকি মারে।
স্যার ব্লাকবোর্ডে ইংলিশে “international”
লিখে ফাইভের কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন উচ্চারণ কি?
প্রায় সকলে বলল, “ইন্টারনেটিওনাল”
স্যার সব শেষে বললেন, ‘রাফসান, বলো এখানে কি লেখা।’
রাফসান ভাই বলল, ‘ইন্টারন্যাশনাল।’
স্যার সবাইকে অনেক্ষণ ঝাড়ি দিলেন, ‘ক্লাস থ্রি পড়ুয়া একটা ছেলে পারে তোরা পারিস না। দু’দিন পর তোরা গিয়ে বোর্ড পরিক্ষা দিবি। অথচ তোদের ক্লাস থ্রিতে পড়ারও যোগ্যতা নেই।’
জানালার পাশে তাদেরকে দেখেও একটা ধমক দিলেন। দৌড়ে তারা ক্লাসে চলে গেল। এসএসসিতেও জিপিএ ফাইভ পেল মানুষটা। তারপর? বিলের ভাসমান পানা। লোকজন এখন পাগল বলে। ইলির খারাপ লাগে। ওর শৈশবের হিরো যে রাফসান ভাই।

– ‘ইলি গোসল করবি না?’

পেছন ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ মা করবো।’

– ‘তুই এতো ভাবিস কি বল তো? কপালে যা আছে তাই হবে, বুঝলি? আল্লাহ কাউকে না খাওয়াইয়ে মারবে না। তাছাড়া রাফসানের এখন মা-বাবা না থাকলেও চাচারা আছে।’

– ‘থাকলেও মা। আজ বুঝলাম ওরা বিরক্ত হয়ে উঠেছে৷ তাদেরও বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে অভাবের সংসার। তবুও পড়ালেখা বিয়ে-শাদি করালো। আর কি করবে? ভাত না হয় খাওয়ালো। আর তো কিছু করবে না।’

– ‘বিদেশ-টিদেশ পাঠাবে।’

– ‘তোমারে বলছে। কয়েক লাখ টাকা খরচ করে তাকে এখন বিদেশ পাঠাবে? তাদের সংসারই টানাটানিতে চলে।’

– ‘কাজকর্ম করে খাবে। পুরুষ হয়ে জন্মাইছে হাত থাকলে ভাত আছে। যা গোসল কর।’

– ‘হ্যাঁ করবো।’

– ‘আর কি দেখলি। এখন মাথায় সমস্যা-টমস্যা তো মনে হয় নাই।’

– ‘না এখন ঠিকই আছে।’

– ‘মাথা ঠিক থাকলেই হলো।’

ইলি কাপড় সাবান নিয়ে গোসল করতে ঘাটে চলে গেল।

***
ইলিকে বিদায় করে মাঠ থেকে ফেরার পর রাফসান রুমে এসে বসে আছে। তখন বড়ো চাচি নাহেরা বেগম এসে বললেন, ‘রাফসান বাবা, করোনার কারণে স্কুল তো বন্ধ। বাচ্চারা পড়ালেখা বাদ দিয়া খালি টই টই করে ঘুরে বেড়ায়। ওদেরকে একটু পড়া দেখিয়ে দিয়ো তো। এই যাও, ভাইয়ের কাছে পড়তে যাও।’

তারপর দুই চাচার পাঁচজন ছেলে-মেয়ে পড়তে এলো। আরেকজন চাচি একটা মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি থাকেন। নাহেরা বেগম নিচে মাদুর বিছিয়ে দিয়ে গেছেন। সবাই গোল হয়ে পড়তে বসেছে।

রাফসান বারংবার মোবাইলে সময় দেখছে। এখন বাজে সাড়ে বারোটা। ইলি নিশ্চয় গোসল করে নিয়েছে।
– ‘তোমরা চলে যাও এখন।’

সবাই এক সঙ্গে হুড়াহুড়ি করে চলে গেল। ছোট চাচি এলেন তখনই একটা কাগজ নিয়ে।
– ‘এই বাজারগুলো একটু আনো তো। মুদির দোকানটাতেই সব পাবে।’

আচ্ছা দাও নিয়ে আসছি। রাফসান টাকা আর কাগজ নিয়ে তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলো। বিল পাড়ের দোকানটা বন্ধ। খাটো রাস্তা ধরে তাড়াতাড়ি হেঁটে গেল রেললাইনের পাশের দোকানটিতে। বাজার নিয়ে ফিরেছে একটা দশে। কাপড় নিয়ে দ্রুত চলে গেল পুকুর ঘাটে। গোসল সেরে খেতে গিয়ে দেখলো রান্না চলছে। খেতে না বলে বলল, ‘ছোট চাচি এক হাজার টাকা হবে?’
– ‘না, এতো টাকা তো হবে না। দেখো তোমার বড়ো চাচিকে জিজ্ঞেস করে।’

বড়ো চাচিকে গিয়ে বলতে হলো না। ঘর থেকেই জবাব দিলেন, ‘টাকা কই পাব? বিদেশ বাড়ি ওরা করোনার লাগি রুজিরোজগার করতেই পারছে না আর টাকা।’

– ‘আচ্ছা ঠিকাছে৷ আমি শ্রীমঙ্গল যাচ্ছি চাচি। কয়েকদিন পর ফিরবো।’

– ‘খেয়ে যাও। মারিয়া রান্না হয়ে গেলে ভাত দাও তাকে।’

– ‘হয়ে যাচ্ছে৷ রাফসান একটু অপেক্ষা করো নামিয়ে ডাকছি তোমাকে।’

– ‘না চাচি। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। সমস্যা নাই ইলিদের বাড়ি খেয়ে নেবো।’

– ‘এরকম করো না তো রাফসান। ওদের বাড়ি গিয়ে খেলে আমাদের কি বলবে? চাচিরা খেতে দেয়নি তাই সেখানে গিয়ে খাচ্ছ। একটু দেরি হলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।’

– ‘আচ্ছা। আমি অপেক্ষা করছি।’

খানিক পরেই খানার ডাক এলো। গরম গরম ভাত তরকারি। ফ্যান ছেড়ে দিলেন ছোট চাচি। দ্রুত খেয়ে নিল সে। তারপর ব্যাগটা পেছনে ফেলে বেরিয়ে গেল সে।

ইলি খাওয়া-গোসল শেষ করে রেডি হয়ে বসে আছে। জোহরের আজান হয়ে ঘড়ি দু’টা ছুঁইছুঁই করছে এখনও রাফসান আসার নামগন্ধ নেই। আরেকটু দেরি হলে মা-বাবা আজ যেতেই দিবেন না৷ ইলি রাস্তা থেকে একটু পর পর উঁকি দিচ্ছে। লিয়াকত মিয়া ক্ষেত থেকে দুই হালি শসা নিয়ে এসে বললেন, ‘কি রে রাফসান আসেনি এখনও?’
– ‘না বাবা।’
– ‘গর্দভের লগ ধরেছিস। ওর কি কোনো ঠিক আছে। আচ্ছা দেখিস তো দুইজনের ব্যাগে ভরে শসাগুলো তোর ফুপুদের জন্য নেয়া যায় কি-না।’
– ‘তুমিও না বাবা। শসা কি ফুপুর বাড়ির ওদিকে কিনতে পাওয়া যায় না?’
– ‘আরে পাওয়া যায়। তারপরও ক্ষেতের জিনিস বইন-ভাগ্নীকে দিতে হয়। আগে তো মানুষ প্রথম আম, প্রথম ধানের পিঠাও বইন-ভাগ্নী রেখে খেতো না।’
– ‘আচ্ছা রাখো ঘরে নিয়ে৷ ব্যাগে ভরা যায় কি-না দেখবো।’
– ‘ওই তো রাফসান আসছে।’
– ‘হ্যাঁ, ওই দেখা যাচ্ছে।’

‘চল ঘরে সে আসুক।’ ইলি আর তার বাবা ঘরে গেলেন। রাফসান খানিক পর ইলির ঘরে এসে বলল, ‘ফ্যানটা ছাড় গরম লাগছে।’

ইলি ফ্যান ছেড়ে দিয়ে তাকিয়ে দেখলো খানিকটা ঘেমে গেছে রাফসান। এলোমেলো চুল। কালি পড়া চোখ। পোড়া ঠোঁট। দাড়ি-গোঁফে জঙ্গল মুখ। গায়ে একটা ফুলহাতা পুরোনো শার্ট৷ গ্যাবার্ডিন প্যান্ট। পায়ে কবেকার কেডস। কি বিচ্ছিরি লাগছে দেখতে।

– ‘এতো দেরি হলো কেন?’

– ‘পিচ্চিরা পড়তে এলো তাই দেরি হয়ে গেছে।’

– ‘ও, খাওয়া-দাওয়া করে এসেছো?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘তোমার ব্যাগে কি দুই হালি শসা ভরা যাবে। ফুপুকে দিতে চাচ্ছেন বাবা।’

– ‘হ্যাঁ ভরা যাবে নিয়ে আয়। পলিথিনের কোনো ব্যাগে করে আন।’

ইলি শসা এনে দিলো।
রাফসান শসা ভরতে ভরতে ফিসফিস করে বললো, ‘আমার কাছে তো টাকা-পয়সা তেমন নাই ইলি। তুই মামার কাছ থেকে টাকা বাড়িয়ে নিতে পারবি?’

– ‘তোমার টেনশন করতে হবে না।’

খানিক পরেই তারা রেডি হয়ে বেরিয়ে গেল। রিকশায় উঠার সময় লতিফ মিয়া রাফসানকে এক হাজার টাকা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই টাকা নে। দেখেশুনে যাবি। আর শ্রীমঙ্গল গিয়ে বেড়াতে গেলে বাড়িতে সন্ধ্যার আগে আবার ফিরে আসবি ওরে নিয়ে।’

– ‘টাকা লাগবে না মামা। আমার কাছে আছে।’

– ‘টাকা নিতে বলছি নে।’

রাফসান টাকা নিল। রিকশা চলছে মধুশ্বরী বাজারের দিকে। মধুশ্বরী থেকে তারা শেরপুর গেল একটা সিএনজি করে। সেখান থেকে বাসে উঠলো ঠিক আড়াইটায়।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here