দেশলাই – ১৭ পর্ব

0
182

দেশলাই – ১৭ পর্ব

রাতের খাবার শেষে সবাই পারভীন বেগমের (ইলির ফুপুর) রুমে বসে গল্পে মেতে উঠলেন। ভদ্রমহিলা ভীষণ মিশুক। কম বয়সী ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে মিশতে অত্যন্ত পছন্দ করেন। খানিক পর মিনহাজের বাবা গিয়ে শুয়ে পড়লেন। বাকীরা চেয়ার আর পালঙ্কে বসে পারভীন বেগমের গল্প শুনছে। সব গল্পই অতীতের দুঃখ-সুখের গল্প। এক সময় এই জগত-সংসারে দাপিয়ে বেড়ানো বিয়োগ হওয়া আপন মানুষগুলোর স্মৃতিচারণের গল্প।

ইলি হঠাৎ মিনহাজকে বলল,
– ‘মনে আছে আপনি আর ঈশী আপু বকুল পুর বেড়াতে গেলে রাফসান ভাই সহ আমরা সকলে চোর-পুলিশ খেলতাম?’

– ‘হ্যাঁ মনে আছে। কিন্তু এখন এগুলো কেউ খেলে না-কি? মাত্র সাত-আট বছর আগেও মানুষ বৃষ্টির দিনে বা মেহমান বাড়িতে এলে লুডু আর চোর-পুলিশ খেলে সময় কাটাতো। এখন মোবাইল, টিভি সবার হাতে হাতে, ঘরে ঘরে তাই কেউ খেলে না।’

রাফসান রসিকতা করে বলল, ‘সবার সবকিছুই মনে আছে খালি মনে নাই সব খেলায় কে রেগুলার জিততো।’

সকলেই ‘হু-হু’ করে হেঁসে উঠলেন।

ইলি মিনহাজের দিকে ফিরে বলল,
– ‘আচ্ছা মিনহাজ ভাই, এক দিনে শ্রীমঙ্গলের কতটা জায়গা ঘুরে দেখা যাবে?’

– ‘কেন তুই এর আগে শ্রীমঙ্গল ঘুরে দেখিসনি?’

– ‘ছোটবেলায় দেখেছি। মাধবপুর লেক আর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের কথা মনে আছে।’

– ‘আর কোথায় যাবি? একদিনে হামহাম জলপ্রভাত ছাড়া সবই ঘুরতে পারবি।’

– ‘তাহলে হামহাম জলপ্রভাতে কাল চলে যাই।’

– ‘শ্রীমঙ্গলে দর্শনীয় স্থানের কি অভাব? হামহাম জলপ্রপাতের রাস্তা ভালো না৷ জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ছোট ছোট খাল দিয়ে লাঠি হাতে নিয়ে হেঁটে যেতে হয়। পানিতে জোকও অনেক। লাঠি হাতে থাকলে অবশ্য পা পিছলেও পরবি না। আরেকটা রাস্তা আছে পাহাড়ের উপর দিয়ে। সেদিকে বেশি কষ্ট।

– ‘উফ কি এডভেঞ্চার হবে।’

– ‘যা গিয়ে মর।’

– ‘হুদাই ভয় দেখাইও না তো মিনহাজ ভাই। তুমি কি ভাবছো আমি এগুলোর খবর রাখি না? ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকেও পুরুষ-মহিলারা দেখতে যায়। তারা পারলে আমরা বাড়ির পাশে থেকেও পারবো না কেন?’

– ‘আচ্ছা যা ইচ্ছে হইলে। কিন্তু আমি যেতে পারবো না।’

– ‘তুমি যেতে হবে না। শুধু দোকানে গেলে পরিচিত একটা সিএনজি দশটার আগে পাঠিয়ে দিয়ো।’

– ‘আচ্ছা। তাইলে শোন৷ অন্যরা যদিও মোবাইল-ব্যাগ নিয়েও যায়। পরিচিত সিএনজি হওয়ায় তোমরা সবকিছু রেখে যেতে পারবে। ছবি তুলতে হলেও দু’জনের মধ্যে একজনের মোবাইল নিবি। রাফসান শর্ট প্যান্ট পরে নিস। একটা স্কুল ব্যাগ পেছনে ফেলে নিবি। সেটায় মোবাইল আর জোক ছাড়ানোর জন্য লবণ রাখতে পারবি।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে৷ কিন্তু লবণ লাগবে না। জোক এতো ভয় পাই না আমি।’

– ‘ইলি ভয় পাবে।’

– ‘সমস্যা নাই আমি তো আছিই।’

রাত বারোটার দিকে সবাই যার যার রুমে ঘুমোতে চলে গেল। রাফসানকে বারান্দার লাগোয়া রুমটিতে দেয়া হয়েছে। ইলি ঘুমিয়েছে পারভীন বেগমের সঙ্গে।
ভ্রমণের আমেজ আর উত্তেজনায় ইলির ভোর ছ’টায় ঘুম ভেঙে গেল। ইলি দাঁত ব্রাশ করতে করতে রান্নাঘরে গিয়ে পেল লিজার মা ঘরদোর ঝাড়ু দিচ্ছেন। সে পেছনের পুকুরে গিয়ে মুখ-হাত ধুয়ে এসে বলল,
– ‘ভাবী চলো তোমার দেবরের সঙ্গে দুষ্টামি করবে আমি আড়াল থেকে দেখবো।’

– ‘বুঝিনি, কার সাথে?’

– ‘রাফসান ভাইয়ের সঙ্গে। সে তো মিনহাজ ভাইয়ের ছোট।’

– ‘যাও তো আমি পারবো না। ওর সাথে সেরকম কথাবার্তাও হয়নি।’

– ‘তাইলে চলো আমি দুষ্টামি করবো তুমি দেখবে।’

– ‘না না। আমি যেতে পারবো না। তুমিই দুষ্টুমি করো গিয়ে।’

– ‘ধুরো, তুমি কচুর ভাবী। রাফসাইন্নার ভাবী আমি। দেখো কি করি।’

ইলি হনহন করে চলে গেল। পারভীন বেগমের এখান থেকে সামনের রুমের দরজায় শুধু পর্দা টানানো, বারান্দার দিকে দরজা। ইলি চুপিচুপি পর্দা সরিয়ে উঁকি দেয়। রাফসান শর্ট প্যান্টের সঙ্গে গেঞ্জি পরে ঘুমিয়েছে। পালঙ্ক একেবারে এই দরজার পাশেই। ইলি পর্দার ফাঁক দিয়ে আস্তে করে হাত বাড়িয়ে চুলে টান দিয়ে একচোখে দেখে।
রাফসান মাথা তুলে ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে কিছু বুঝতে না পেরে আবার ঘুমায়৷ ইলি আবার চুলে টান দিতে গিয়েও দিলো না। কাল চুল কেটে শ্যাম্পু করায় কেমন সিল্কি লাগছে। ইচ্ছে করছে চুলে আঙুল ডুবিয়ে নেড়ে দিতে। ইলির অকারণ আর জ্বালাতন করতে ইচ্ছে হলো না। গিয়ে দেখলো লিজা ঘুম থেকে উঠে গেছে। তাকে নিয়ে বাইরে হাঁটাহাঁটি করে সময় কাটাতে লাগলো। এ বাড়ির পশ্চিমেই বিরাট একটা পাহাড়। চারপাশে হেঁটে দেখে খানিক্ষণ পর ইলি আবার ফিরে এলো। রাফসান এখনও ঘুমোচ্ছে। ইলির কেন যেন ভালো লাগছে না। তবুও ফুপুর পালঙ্কে শুয়ে মোবাইল বের করে টিপাটিপি শুরু করলো। হঠাৎ তাকিয়ে দেখে আটটা হয়ে গেছে। আস্তে করে নেমে রাফসানের রুমের পর্দা সরায়। এখনও ঘুমোচ্ছে৷ ইলি ভেতরে গেল। চুল-দাড়ি কাটায় একদিনেই যেন অনেকখানি পাল্টে গেছে মানুষটা। ইলি বালিশে ধাক্কা দিয়ে আস্তে করে ডাকে, ‘রাফসান ভাই উঠো।’

রাফসান চোখ মেলে তাকায়।

– ‘উঠো আটটা বেজে গেছে।’

রাফসান হাই তুলে উঠে বসে বলল, ‘ভোরে তুই আমার চুল ধরে টান দিয়েছিলি কেন?’

ইলি চমকে উঠলো৷ ধরা পড়ে গেল কি-না কে জানে। আমতা-আমতা করে বলল,

– ‘কই না তো।’

– ‘মিথ্যা বলিস না।’

– ‘দিলে দিছি, এখন উঠো।’

নাস্তা করার পর সাড়ে ন’টায় সিএনজি এলো। বাড়িতে ভাত খেয়ে যেতে বললেও তারা খেলো না। পারভীন বেগম টিফিনে খাবার দিতে চাইলেও ইলি নিষেধ করলো। বাইরে খাওয়াও না-কি ভ্রমণের অংশ।
ব্যাগ-প্যাক নিয়ে তারা সিএনজিতে উঠে। কাঁচা-পাকনা দাড়ি-গোঁফ ওয়ালা মধ্যবয়স্ক ড্রাইভার। পাহাড়ি এলাকার আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে সিএনজি চলছে। বাড়ি থেকে শহর কাছেই। খানিক পরেই তারা শহরে চলে এলো।
ড্রাইভার পেছনে তাকিয়ে বলল, ‘পানসি রেস্টুরেন্টের দিকে নেব না-কি? এখানে কি নাস্তা-টাস্তা কিছু করবেন?’

ইলি রাফসানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কি করবে?’

রাফসান ড্রাইভারকে বলল, ‘মামা হামহাম যেতে কি খাওয়ার কিচ্ছু পাবো না?’

– ‘একেবারে কলাবন গিয়ে পাইবেন। সেখানে আগে বইলা গেলে আসার সময় খেতে পারবেন।

– ‘ইলি তাহলে আমরা এখান থেকে খিচুড়ি নিয়ে চলে যাই। কলাবন গিয়ে আগে খেয়ে নিতে হবে। হাঁটার রাস্তা তো। একেবারে না খেয়ে পারা যাবে না।’

– ‘তাহলে খেয়েই যাই। পার্সেল নিয়ে সেখানে গিয়ে খেলে শরীর ভারী লাগবে।’

– ‘তাহলে চল। মামা আপনিও আসুন খেয়ে নিই।’

– ‘না ভাই, আমি মাত্র খেয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছি।’

রাফসান আর ইলি পানসিতে খাওয়া শেষ করলে সিএনজি কলাবনের দিকে ছুটে। শহর থেকে বের হতেই সুরো রাস্তা। খানিক এগুতেই তারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে দেখে যতদূর চোখ যায় কেবল সবুজের হাতছানি। চা বাগানের সারি সারি টিলা, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ আর ঘন সবুজ অরণ্যের অপরূপ সৌন্দর্য। উঁচু-নীচু পাহাড়ের চা গাছের দিকে তাকালে ইলির কখনও মনে হচ্ছে সমুদ্রের জলের মতো সবুজের ঢেউ। কখনও মনে হচ্ছে উঁচু-নীচু পাহাড়ের গায়ে কেউ সবুজ চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। আবার কখনও মনে হচ্ছে ছোট ছোট চা গাছ কিলবিল করে যেন পাহাড় বেয়ে উপরে উঠা শুরু করেছে।
খানিক এগুতেই আর দূরে তাকাতে হলো না৷ রাস্তার দুই পাশ থেকেই চা বাগানের শুরু। চা বাগানের মাঝখান দিয়ে চলছে সিএনজি। বাগানের মাঝে মাঝে নাম না জানা আরও অসংখ্য গাছগাছালি৷
দিনের প্রথমভাগের সূর্যের নরম আলোকে গাছগাছালি ভেঙে ভেঙে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলেছে। সূর্যের সোনালি আলোয় চিকচিক করছে সবুজ চা পাতা। চা বাগানগুলো যেন বারংবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে তোমরা ঢুকে পড়েছো দুটি পাতার একটি কুঁড়ির দেশ সিলেটের চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গলে।
ইলি বুঁদ হয়ে তাকিয়ে আছে সেদিকেই। রাফসান পকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটে নিয়েছে সে টেরই পায়নি। কিন্তু যখনই সিগারেটে আগুন ধরাতে মাথা নুইয়ে হাত সিগারেটের কাছে তুলেছে। ইলি দেখে ফেলে ক্রোধান্বিত নয়নে দাঁত কটমট করে তাকায়। রাফসান সিগারেট হাতে নিয়ে মুচকি হেঁসে বলল, ‘জল্লাদের মতো তাকাচ্ছিস কেন?’

– ‘তুমি এটা কি করছো।’

– ‘কি আবার। সিগারেটে আগুন ধরাচ্ছিলাম।’

– ‘দেশলাই আমার কাছে দাও।’

– ‘কেন?’

ইলি চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি বলছি তাই।’

– ‘তুই বললেই দিয়ে দেবো কেন?’

ইলির মুখটি ম্লান হয়ে গেল। সিএনজির বাইরে চোখ রেখে অস্ফুটে বলল,

– ‘তাও ঠিক। আমি বললেই কেন দেবে।’

– ‘ইলি একটা খাই?’

এদিকে না তাকিয়েই বলল, ‘আমি না করলেও তুমি শুনবে না। সুতরাং জিজ্ঞেস করার মানে নেই।’

– ‘আচ্ছা এখন একটা ধরাচ্ছি। আজ আর খাব না।’

ইলি কোনো কোথা বললো না। রাফসান সিগারেট ধরিয়ে টানছে। ইলি বাইরের বিস্তৃত সবুজের সমুদ্রে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে আছে।
নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য ইলির কাছে এখন আর উপভোগ্য মনে হচ্ছে না।

রাফসান সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া সিএনজির বাইরে ছেড়ে ফুরফুরে মেজাজে বলল, ‘চা বাগানগুলো দারুণ দেখতে, তাই না ইলি।’

ইলি কোনো জবাব দিলো না। রাফসান বুঝতে পারে ইলি রেগে আছে। তবুও ড্রাইভারের জন্য এখন আর কথা বলতে গেল না।
খানিক পরেই তারা পৌঁছে গেল কলাবন পাড়ায়। ড্রাইভার একটা বাঁশের বেড়া দেওয়া বাড়ি দেখিয়ে বলল, ‘এখানে খাবার অর্ডার দিয়ে গেলে ওরা রান্না করে রাখবে। আসার পর খাওয়া গোসল করে কাপড় পাল্টে নিতে পারবেন।’

ইলি ভারী মুখে কাপড় আর ওড়না ঠিকঠাক করে হাঁটার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে।
– ‘ইলি কি করবো। খাবার অর্ডার দিয়ে যাই।’

ইলি মলিন মুখেই জবাব দিলো,
– ‘দাও।’

রাফসান খাবার অর্ডার দিয়ে এলো। এক ঝাঁক বাচ্চা-কাচ্চারা কাঁচা লাঠি নিয়ে তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বিক্রির জন্য। কারণ এখান থেকে দু’টা রাস্তা দিয়েই হামহাম যেতে হয়। একটা উঁচু-নীচু পাহাড় আর টিলা দিয়ে। সেদিকে যেতেও পিচ্ছিল পথে লাঠি প্রয়োজন। অন্যটি হচ্ছে ঝিরি পথ। সেদিকে যেতেও লাঠি লাগবে। তারা দশ টাকায় দু’টা লাঠি এবং তিনশো টাকা দিয়ে একজন গাইড নেয়। কারণ গহীন জঙ্গলের ভেতরে প্রায় আড়াই ঘন্টা হাঁটতে হবে, বনের প্রায় সাড়ে সাত কিলো ভেতরে হামহাম ঝর্ণা।
জঙ্গলের এতটাই ভেতরে যে দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে নিজের মহিমা লুকিয়ে রেখেছিল এই জলপ্রপাত। দূর্গম পথ আর লোকালয়ের বেশ বাইরে থাকার কারণে এতদিন এই জলপ্রপাতটি কারও চোখে পড়েনি। মাত্র দুই হাজার দশ সালে প্রথমে হামহাম জলপ্রপাত আবিষ্কার হয়।
ঝিরিপথে প্রায় হাঁটু অবধি পানি থাকায় অনেকেই জোকের ভয়ে লবণ বা গুল নিয়ে যায়।
গাইডের পিছু পিছু রাফসান আর ইলি লাঠি হাতে খালি পায়ে হাঁটতে থাকে। রাফসান উপরের প্যান্ট খুলে গাড়িতে রেখেছে৷ নিচেই শর্ট প্যান্ট ছিল। পেছনে স্কুল ব্যাগ। ইলি চুল খোঁপা করে ওড়না কাঁধ থেকে বুক দিয়ে আড়াআড়িভাবে পেঁচিয়ে বেঁধে নিয়েছে। হাঁটছে ম্লান মুখে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here