দেশলাই – ১৯ পর্ব

0
166

দেশলাই – ১৯ পর্ব

আচমকা গাছের ডালে কিছু একটা লাফিয়ে পড়ার শব্দ হয়। ঝিরিপথে উড়ে এসে পড়ে বাঁশের পাতা আর ডুমুর গাছের কয়েকটি ফল। ইলি তখন নিজেকে ছাড়াতে ব্যস্ত। কিন্তু মাথার উপরে শব্দ শুনে আঁতকে উঠে সেও রাফসানের সঙ্গে তাকায়। বিস্মিত হয়ে দেখতে পায় ডুমুর গাছের শাখায় বসে তাদের দিকেই তাকিয়ে লেজ চুলকাতে চুলকাতে ফল খাচ্ছে দু’টি বানর। আরেকটি বানর নেতানো বাঁশে ধরে ঝুলে আছে। ইলি বিস্মিত হয়ে বলে উঠে, ‘ওমা বানরগুলোর চোখে চশমা কোত্থেকে এলো।’

রাফসান তখন আলগোছে ইলিকে পাঁজাকোলা করে কোলে নিয়ে বলে,
– ‘চোখে চশমা না৷ এগুলোকে চশমা বানর ডাকা হয়। চোখের চারপাশে সাদা রঙের লোমে আবৃত হয়ে চশমার আকার নিয়েছে। তাই দূর থেকে হঠাৎ দেখলে মনে হয় চশমা পরে বসে আছে।’

– ‘ছাড়ো আমাকে, ছাড়ো বলছি।’

রাফসান আরেকটু শক্ত করে ধরে পানিতে চপচপ শব্দ তুলে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
– ‘মোচড়ামুচড়ি করিস না ইলি পড়ে যাবো। পারলে আমার বাম হাতের লাঠিটা তোর কাছে নে।’

– ‘না, আমাকে ছাড়ো।’

– ‘ছাড়ছি, সামনের কিনার ঘেঁষে কয়েকটি বড়ো বড়ো পাথর দেখা যাচ্ছে সেখানে যাই।’

তবুও ইলির মোচড়ামুচড়ি থামে না, বারংবার বলেই চলছে, ‘আমাকে ছাড়ো তুমি, ছাড়ো বলছি।’

রাফসান শক্ত করে ধরে হাঁটতে থাকে। খানিক পর পাথরের সামনে নামিয়ে দিয়ে বলল,
– ‘এখানে বস। বাবা এতো ওজন হাঁপিয়ে গেছি।’

ইলি আবার চলে যাচ্ছিল। রাফসান হাত ধরে টেনে কাতর গলায় বলল, ‘বস না। এমনিতেই হাঁপিয়ে গেছি।’

– ‘আমি বলছি না-কি কোলে নাও আমাকে।’

রাফসান ওর কাঁধে ধরে ঠেলে পাথরের বসিয়ে বলল,
– ‘এতো কথা বলিস না তো। দেখি জোঁক ছাড়িয়ে দেই।

– ‘জোঁক থাকুক। রক্ত খাক।’ বলেই ইলি আবার হাঁটতে থাকে।
রাফসান তাড়াতাড়ি সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
– ‘কেন এমন করছিস ইলি?’

– ‘তোমার জানার দরকার নাই। পথ ছাড়ো আমার।’

– ‘ইলি রক্ত বেরুবে শেষে।’

– ‘বের হোক আমার রক্ত। তোমার কি আসে যায়।’

ইলি আবার হাঁটতে যেতেই রাফসান হাত ধরে টেনে কাছে এনে গালে হাত দিয়ে বলল,
– ‘কেন এমন করছিস বল? সিগারেট খেয়েছি বলে তাই তো? যা সিগারেট ছেড়ে দেবো আজ থেকে।’

রাফসানের চোখের দিকে তাকিয়ে ইলির ভেতর গুলিয়ে কান্না পায়। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,

– ‘ছাড়ো আমাকে। তুমি আমার জন্য সিগারেট ছাড়বে কেন? আমি তোমার কে হই? আমি আসলেই কেউ না সেটা তো সিএনজিতেই প্রমাণ করে দিয়েছো। ইন্তিশা যদি বলতো তুমি ঠিকই দেশলাই দিয়ে দিতে।’

ইলির মুখের দিকে তাকিয়ে রাফসানের বুকটা শিরশির করে উঠে, যুক্তিহীন হয়ে পড়ে নিমিষেই। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,

– ‘ইলি উল্টাপাল্টা কথা বলবি না তো৷ পৃথিবীতে এখন আমার সবচেয়ে আপন মানুষ কেউ থাকলে তুই আছিস। আমার প্রকৃত আপন মানুষ। এই একাকীত্বের দিনে তুই ছাড়া কে আমাকে এতো সঙ্গ দিচ্ছে বল?’

ইলি নিজেকে খানিকটা ছাড়িয়ে চোখ তুলে রাফসানের দিকে তাকিয়ে বলল,
– ‘তাহলে আগে দেশলাই আমার কাছে দিলে না কেন? আবার সিগারেটও খেলে। আমাকে তুমি ইচ্ছা করে অপমান করেছো। বুঝিয়ে দিয়েছো আমার সেরকম কোনো অধিকার নেই। আমি যে বাড়াবাড়ি করি তাই আমার লাগাম টেনে ধরার জন্য উল্টো সিগারেটও খেয়েছো।’

– ‘আচ্ছা সব বলছি আগে জোক ছাড়িয়ে নিই।’

– ‘না, আগে বলো তখন দেশলাই কেন আমার হাতে দিলে না। আর সিগারেটও খেলে কেন? ইন্তিশা হলে কি এমন আচরণ করতে পারতে?’

ইলির কোনো উত্তর না দিয়ে রাফসান হাঁটু গেড়ে বসে ওর বাম পা ধরে বলে, ‘টানাটানি করলে পড়ে যাবি। সোজা দাঁড়িয়ে থাক, জোঁক ছাড়িয়ে নিই তারপর যা ইচ্ছা বলিস।’

ইলি খানিকটা নিভে আসে। রাফসানের চুলে আঙুল ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সেকেন্ড কয়েক পরেই আবার রাফসান জোঁক হাতে দাঁড়িয়ে বলে,

– ‘দেখ রক্ত খেয়ে কত মোটা হইছে৷’

ইলি ভয়ে চোখবন্ধ করে বলে,

– ‘দূরে ছুড়ে ফেলো।’

রাফসান জোঁকটা ছুড়ে ফেলে পায়ের দিকে তাকায়।

– ‘ইশ, তোর পা থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। আগেই বলেছিলাম জোকটা ছাড়াই। তোর জেদের কারণে এমন হলো।’

ইলি জবাব না দিয়ে পাথরের ওপর গিয়ে দাঁড়ায়,
– ‘সামনে এসে দাঁড়াও, তোমার চুল এলেমেলো হয়ে গেছে ঠিকঠাক করে দিই।’

– ‘থাক লাগবে না, আমিই পারবো।’

– ‘তোমার হাতে ময়লা।’

– ‘হাত ধুয়ে ঠিক করবো।’

– ‘এতো কথা বলো কেন রাফসান ভাই? আমি এলোমেলো করছি আমি ঠিক করে দেবো আসো।’

রাফসান সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ইলি চুল ঠিকঠাক করে দিতে গিয়ে সেই সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে যায়। ওড়না দিয়ে এমন ভাবেই ঠোঁটের লিপস্টিক মুছে দিয়েছিল সে।

– ‘কিরে এতোক্ষণ লাগে চুল ঠিক করতে?’

– ‘শেষ।’

রাফসান জলে নেমে হাত ধুয়ে সামনে তাকায়। গাইড বহুদূরে একটা পাথরে বসে আছে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে।

রাফসান তার লাঠি হাতে নেয়,

– ‘তোর লাঠিও ভেসে গেছে। আয় আমার সাথে।’

– ‘না যাব না। এখনও তুমি জবাব দাওনি।’

– ‘কি জবাব দেবো। মেয়ে মানুষের মাথায় কত কিছু ঘুরে। আমি তো এমনিই সিগারেট খেয়েছি৷ তুই এতো কষ্ট পাবি কল্পনাও করিনি। তাছাড়া তোকে অপমান করতে বা লাগাম টেনে ধরতেও সিগারেট খাইনি৷ সবই তোর নিজের ধারণা।’

– ‘আচ্ছা পাশের পাথরে এসে বসো। একটু পর যাবো।’

ইলির দিকে এক পলক তাকিয়ে পাথরে গিয়ে বসতে বসতে বলল, ‘তোর মাথায় কখন যে কি চলে আল্লাই ভালো জানে।’

ইলি ফিক করে হেঁসে ফেলে। রাফসান ভ্রু কুঁচকে তাকায়,

– ‘এখন হাসি ঠেলে বের হচ্ছে তোর। পুরো রাস্তা গোমড়ামুখে থেকেছিস, আমি হাসাতে পারিনি৷’

– ‘তোমার ব্যাগেই সিগারেট আর দেশলাই তাই না?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘দেশলাই আগে দাওনি এখন দাও।’

– ‘কেন?’

– ‘দাও বলছি দেবে।’

রাফসান ব্যাগটা এনে হাঁটুতে রেখে বলল,

– ‘সামনের চাইনটা খুলে হাত ঢোকা।’

ইলি হাত ঢুকিয়ে দেশলাই নিয়ে বললো,

– ‘আজ থেকে তুমি আর সিগারেট খাবে না। তোমার সবচেয়ে আপন মানুষের নিষেধ। আমি কখনও নিজ থেকে দেশলাই না দিলে তুমি কোনো দোকান থেকেও কিনবে না।’ কথাটি বলে দেশলাই ছুড়ে ফেলতে যেয়েও ফেললো না।
আবার ব্যাগে রেখে বলল,
– ‘সিএনজিতে যাওয়ার পর এই দেশলাই আমার কাছে দেবে। এখন থাকুক।’

– ‘বুঝলাম না কি আবোল-তাবোল বকছিস।’

– ‘আবুল-তাবুলই। তুমি আর কখনও কোনো দোকান থেকে দেশলাই কিনবে না৷ এটা আমার নিষেধ। তুমি চাইলে পালন করবে না চাইলে নাই। তবে অনুরোধ করবো লুকিয়ে সিগারেট খাবে না। লুকিয়ে সিগারেটে আগুন ধরাতে যাওয়ার আগে আমার কাছে আসবে। আমি এই দেশলাইটাই তোমার কাছে দিয়ে দেবো। তারপর থেকে তুমি আবার নিজের মতো সিগারেট খেতে পারবে। তবে এই দেশলাই আমার কাছে যতদিন থাকবে ততদিন মনে করবো বর্তমানে পৃথিবীতে আমি তোমার সবচেয়ে আপন মানুষ।’

– ‘কীসব ছেলেমানুষী কথাবার্তা।’

– ‘থাকুক ছেলে-মানুষী কথা। তুমি প্লিজ বলো এই দেশলাই যতদিন আমার কাছে থাকবে সিগারেট খাবে না।’

– ‘তোর কথার কোনো যুক্তি আছে? কি বলছিস বুঝতেও পারিনি। সব মাথার উপর দিয়ে গেছে।’

– ‘সহজ কথা বোঝো না কেন তুমি? মনে করো তোমার সবচেয়ে আপন মানুষ এই দেশলাই কেড়ে নিয়ে বলেছে এটা ফিরিয়ে দেওয়ার আগপর্যন্ত আর সিগারেট কখনও খাবে না।’

– ‘হ্যাঁ, এখন যদি সে এই দেশলাই না নিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খায়?’

– ‘তুমি খাবে না প্লিজ। একটু আগেও না বলেছিলে আমি বললে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দেবে।’

– ‘ছাড়বো। কিন্তু আরও কি বলতে চাইছিস৷ কিছুই বুঝলাম না।’

– ‘কিছু না। এতো কিছু তোমাকে বলে লাভ নাই। এখন সহজ কথা তুমি খাবে না। আর সিএনজিতে উঠে দেশলাই আমার কাছে দেবে ঠিকাছে?’

– ‘আচ্ছা।’

– ‘তুমি লুকিয়ে খাবে না তো?’

– ‘না খেলে কী হবে?’

– ‘না খেলে তোমার উপকার হবে। আরও একটা কারণ আছে বলবো না।’

– ‘আচ্ছা বলতে হবে না৷ তোর মাথা গেছে আর বকবক করিস না।’

– ‘আমি বকবক করলে তোমার বিরক্ত লাগে তাই না?’

– ‘আমি বলেছি না-কি? হুদাই প্যাঁচাচ কেন?’

– ‘তুমি নিজেই প্যাঁচাও, যা বলি সেটার উত্তর দিলে কি হয়?’

– ‘চল যাই। আবুল-তাবুল কথা রাখ।’

– ‘আচ্ছা চলো।’

রাফসান লাঠি হাতে ঝিরিপথে নেমে বলে,
– ‘আয়।’

ইলি পা টিপে টিপে যায়। ঠান্ডা জল। রাফসান বাম হাত ইলির পিঠের দিকে নিয়ে পেঁচিয়ে ধরে। ইলি ডান হাত দিয়ে ধরে রাফসানকে। লাঠিতে ভারসাম্য রেখে তারা ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে। ইলির শ্বাস ভারী হয়ে আসছে। বুক ধুকধুক বেড়ে চলেছে৷
পা হঠাৎ পিছলে পড়ে যাচ্ছিল। রাফসান বাম হাতে টান দিয়ে বুকে আনে৷ ইলির নাক ঠোঁট ঘষা খায় ওর বুকে। ইলির এক অন্যরকম অনূভুতিতে পুরো শরীর কেঁপে উঠে।

– ‘ঠিক আছিস তো ইলি।’

– ‘হুম।’

রাফসান মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

– ‘এতো নীরব হয়ে গেলি কেন? ভয় পাচ্ছিস না-কি?’

– ‘না।’

– ‘ক্ষিধে লাগছে?’

– ‘না।’

– ‘তো এমন লাগছে কেন? আচ্ছা চল ধীরে ধীরে যাই।’

আবার তারা হাঁটতে থাকে। গাইডও যাচ্ছে বিড়ি টেনে টেনে। পাখির সুমধুর কলরব শোনা যাচ্ছে। আচমকা রাফসান খেয়াল করে ইলি বারংবার চোখের পানি মুছছে।

– ‘আরে কি হয়েছে? তুই কাঁদছিস না-কি?’

– ‘কিছু না।’

রাফসান সামনে গিয়ে মুখ আঁজলা করে ধরে বলে, ‘কিছু না মানে। তুই তো কাঁদছিস।’

ইলি আর নিজেকে সামলাতে পারে না। জড়িয়ে ধরে কেঁপে কেঁপে উঠে কান্নায়।
– ‘আরে কি হয়েছে বল না।’

– ‘আমার হৃদকে একদম পছন্দ না রাফসান ভাই৷ আমি কি করবো এখন ভেবে পাই না। তুমি কেন তখন ইন্তিশার সঙ্গে রিলেশন করেছিলে। তাহলে তো আমি হৃদের সাথে বিয়ে ঠিক হতে দিতাম না।’

রাফসান পেছনে তাকিয়ে দেখে আরও কিছু পর্যটক ঝিরিপথে নেমে গেছে।
সে ইলির চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
– ‘আচ্ছা পরে সব শুনবো। এখন কান্নাকাটি বন্ধ কর। আরও মানুষ আসছে।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here