দেশলাই – ( ২য় পর্ব )

0
301

দেশলাই – ( ২য় পর্ব )

আমি নববধূর পাশেই বসা৷ ফুপুর কথাবার্তা শুনে আমার কান দিয়ে যেন গরম ভাপ বেরুচ্ছে। কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না।
তবে মেয়েটির স্থানে নিজেকে ভাবলেই গা কাটা দিয়ে উঠছে। এমন পরিস্থিতি আসলেই কষ্টকর, অপমানজনক। তাছাড়া প্রকৃতি মেয়েটির সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে৷ এখানে তো ওর কোনো দোষ নেই। তাই না?
কিন্তু এই জগৎ-সংসার তো অন্যের কষ্ট দেখে চলে না। আমি আপাতত মেয়েটিকে রক্ষা করার জন্য ফুপুকে টেনে বারান্দায় এনেছি। তবুও হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধাচ্ছেন। মাটিতে পড়ে কপাল চাপড়ে সুর দিয়ে কান্নাকাটি করে বলছেন, ‘আল্লা গো, এতো টাকাপয়সা খরচ কইরা আমি ছেলের লাইগা বন্ধ্যা মাইয়া আনলাম। এখন কি হইব আল্লা। আমার ছেলের এখন কি হইব গো।’

কেউই মেয়েকে রাখতে চাচ্ছে না। ছেলের একটা ভবিষ্যৎ আছে। অন্য সবার মতো তাদেরও নাতি-নাতনির শখ হয়। এতো বড় ব্যাপার কনেপক্ষ গোপন রেখে বিয়ে দেবে কেন?
ফুপু এই পরিবারের সবার মুরব্বি বলা চলে। রাফসান ভাইয়ের বাবা ছাড়াও তিনজন চাচা। তাদেরকে ফুফা সৌদি আরব নিয়েছিলেন। চার ভাই এক সঙ্গে কাজ করতেন। কয়েক বছর আগে ফুফা কাজের সাইট থেকে নিচে পড়ে মারা যান। সে এক ভয়াবহ মৃত্যু। শরীর ছিন্নভিন্ন আর রক্তারক্তি কাণ্ড। নিচে খাঁড়া থাকা একটি রট পিঠের দিকে ঢুকে এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে গিয়েছিল। রাফসান ভাই তখন কেবল মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দিন-রাত মধুশ্বেরী পাব্লিক লাইব্রেরিতে নাক ডুবিয়ে উপন্যাস পড়ে। আমার বই পড়ার অভ্যাস হয়তো কোনোভাবে রাফসান ভাইয়ের কাছ থেকেই হয়েছে। কোনো ভালো বই বা সিনেমা দেখলে আমার সঙ্গে এসে গল্প করতো৷ কিছু ছেলেরা থাকে না, যারা আল্লাহর দুনিয়ার সর্ববিষয়ে সমান পারদর্শী? রাফসান ভাই সেরকম একটা ছেলে। পড়ালেখায় অত্যন্ত মেধাবী। পাড়ার ফুটবল ক্রিকেট খেলা তাকে ছাড়া ঠিক জমতো না। দেখতে তখন ভীষণ সুদর্শন ছিল। খানিকটা লম্বাটে মেদহীন মুখ। মাথায় কালো ঝাঁকড়া চুল। ভীষণ চঞ্চল স্বভাবের। রাফসান ভাইয়ের মধ্য আগের কোনো কিছুই এখন আর নেই। নারিকেল গাছের সতেজ কচি ডাব থেকে শুকিয়ে যাওয়া কিংবা গাছের সবুজ পাতা মাটিতে পড়ে মরে যাওয়ার মতোন একটা সময় ভেতর থেকে ক্রমশ রসকষ শুকিয়ে গিয়েছিল তার।
রাফসান ভাই কলেজে ভর্তি হয়ে মেসে যাওয়ার আগের একটা স্মৃতি আমার মনে আছে। অবশ্য কেউ শুনলে আমাকে খারাপ মেয়েও ভাবতে পারে। কিন্তু আমি যতটুকু জানি প্রেম ছাড়াও আমাদের কাজিনদের সঙ্গে এরকম মাঝে মাঝে হয়ে যায়। উপন্যাস আর সিনেমায় প্রেম ছাড়া নায়ক-নায়িকারা চুমু না খেতে পারে। কিন্তু বাস্তবে উঠতি বয়সে প্রেম ছাড়াও অনেক কিছু হয়। একবার আমাদের বকুল পুর হাই স্কুলে অনুষ্ঠান ছিল। আমি শাড়ি পরে গিয়েছি। ফিরতে রাত হচ্ছে দেখে বাবা রাফসান ভাইকে পাঠিয়েছিলেন। সে তখন ভীষণ দুষ্ট ছিল। আসার পথে বলল,
‘তোর জন্য আমার এতদূর হেঁটে আসতে হলো।’

‘তুমি আসো কেন, আমি বলছি না-কি আসতে?’

‘আচ্ছা এই কথা, কবর গলির দিকে অন্ধকার আছে। চল, দেখাবো মজা।’

‘একদম ভয় দেখাবে না রাফসান ভাই। আর রিকশা নাও তো৷ হেঁটে হেঁটে যাব কেন?’

‘রিকশা নিতে হবে না। গল্প করতে করতে চলে যাব।’

‘আচ্ছা তাইলে ভয় দেখাবে না।’

অনেক্ষণ দু’জন চুপচাপ হেঁটে এসেছি। এদিকটায় বাম পাশে কবরস্থান। ডান দিকে হলদে রঙের বাউন্ডারি ফেরানো বাড়ি। রাস্তায় আবছা আলো।

রাফসান ভাই তখন অস্ফুটে বলল,
‘শাড়ী পরায় মনে হচ্ছে তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস৷’

‘আমি তো বড়োই। আমার ক্লাসমেট দুইটার এইটে থাকতে বিয়ে হয়ে গেছে। জানো?’

‘বাব্বাহ বড়ো হয়ে গেছিস।’ বলেই রাফসান ভাই এক হাত আমার পেছনদিকে নিয়ে কোমরের ধরে টেনে কাছে আনে। আমার গালে এক হাত দিয়ে ঠোঁটে চুমু খায়। কি যে লজ্জা করেছিল। শুধু মুখে বললাম,
– ‘তুমি একটা বদমাইশ। রাতে আমারে একা পেয়ে এমন করলে কেন?’

– ‘গালাগালি করলে আরও দেবো।’

আমি আর কিছু না বলে ফিক করে হেঁসে ফেলি।
– ‘হাসবি না একদম। আমি মুভি দেখায় ছিলাম। মামা তখন ফোন দিয়ে বললেন তোকে আনতে যেতে হবে। রাগে তোকে কাঁচা খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছিল।’

– ‘নাম কি মুভির?’

– ‘বলবো না। তবে অনেক রোমান্টিক। তোকে যেরকম দিলাম। সেরকম সিনে আঁটকে রেখে এসেছি৷ তাই প্রতিশোধ নিলাম।’

– ‘তুমি একটা বদমাশ।’

– ‘আবার!’

– ‘আচ্ছা আচ্ছা আর বলবো না।’

দু’জন নানান গল্প করে হাটছি। কবর গলি পেরিয়ে প্রায় বাসার কাছাকাছি এসে আবছা আলোতে রাফসান ভাইয়ের মুখ দেখে আবার আমি হাসতে শুরু করলাম। ঠোঁটে লিপস্টিক লেগে আছে। আমার কেন জানি তাকাতে লজ্জা করছিল। অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তোমার ঠোঁট মুছো।’
সে হাত দিয়ে মুছতে গিয়ে আরও লেপ্টে গেল। আমার হাসি থামছে না। মুখ চেপে হাসছি।
– ‘এতো হাসিস না তো। একটু পেছনে এসে মুছে দে। এভাবে বাসায় যাব কীভাবে?’

আমরা একটু পেছনের অন্ধকারে গেলাম। শেওলা পড়া একটা দেয়ালের সামনে দাঁড়াল। আমি আঁচল দিয়ে আলগোছে মুছে দিলাম ওর ঠোঁট। সত্যি কথা বলতে চুমু থেকেও ঠোঁট মুছে দিতে আমার এতো ভালো লেগেছিল কেন জানি না। খানিক্ষণের জন্য রাফসান ভাইকে আমার ভীষণ আপন মনে হচ্ছিল। আমাদের মধ্যে প্রেম-টেম কিছু নেই। কখনও সে বলেনি ভালো-টালো বাসে। এজাতীয় কোনো প্রেমের স্লোগান আমাদের মধ্যে আদান-প্রদান হয়নি। তবুও ঠোঁট মুছে দেওয়ার ক্ষণে যদি আমার কোমর জড়িয়ে টেনে কাছে নিতো আমি ওর বুকে মাথা গুঁজে দিতাম। সামান্য এই ঠোঁট মুছে দেওয়ার মুহূর্ত আমি প্রায়ই জানালার পাশে বসে আকাশ দেখতে দেখতে ভাবি৷ বাড়ির এই জানালাটি উত্তরদিকে। বাউন্ডারির দেয়ালে রোজ একটি কালো ফিঙে এসে বসে থাকতে দেখা যায়। তার বোধহয় জায়গাটা ভীষণ পছন্দের। ওর কাছে কি আমি পরিচিত? অবশ্যই ফিঙেটি আমাকে চেনে। আমার সঙ্গে কি সে নীরবে বন্ধুত্ব করেছে? দেয়ালের ভেতরে কয়েকটি পেঁপে গাছ আছে। পেঁপে গাছে নানান ধরনের পাখির আনাগোনা। তবে দুপুর বেলা জানালায় চড়ুই পাখিরা বেশ হৈচৈ করে। বাড়িতে আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হচ্ছে উত্তরের এই জানালা।
— চলবে–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here