দেশলাই – ২৮ পর্ব

0
150

দেশলাই – ২৮ পর্ব

পরেরদিন বিদায় নিয়ে তারা এগারোটার দিকে বাড়ি ফেরার বাসে উঠে। ইলি রোজকার মতো জানালার পাশে বসা৷ কিন্তু আজ জায়গাটা সুখকর লাগছে না। গরমে ঘেমে যাচ্ছে তবুও সূর্য জানালার গ্লাসে আছড়ে পড়ায় খোলা যাচ্ছে না। রাফসান কোলে ব্যাগ নিয়ে চুপচাপ বসা। ইলি ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

– ‘গরমে অসহ্য লাগছে, বিকেলে বের হলেই ভালো ছিল।’

– ‘বাস ছেড়ে দিলে এতো গরম লাগবে না।’

– ‘কেমন সিগারেটের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে, তুমি আবার খেয়েছো না-কি?’

রাফসান অসহায় নয়নে তাকিয়ে বললো,
– ‘তুমি দেশলাই নেবার পর থেকে আমি এখনও একটাও সিগারেট খাইনি।’

– ‘তাইলে গন্ধ আসছে কেন? অসহ্য লাগছে।’

– ‘বাসে উঠার সময় অনেকেই খেয়ে উঠে, কিন্তু গন্ধ এতো বেশি না, তোমার এতো অসহ্য লাগছে কেন?’

– ‘জানি না। গরমে আমার সবকিছু অসহ্য লাগে।’

– ‘আর কারও এতো গরমও লাগছে না।’

– ‘আজব, তাহলে এখন আমি কি করবো? গরম কি আমি নিজে লাগাইছি?’

রাফসান হেঁসে ফেললো।

– ‘অযথাই রেগে আছো কেন? আচ্ছা গ্লাস একটু খুলে দাও। বাস ছেড়ে দিলে দেখবে ফুরফুরে বাতাস লাগছে।’

ইলি টেনে বললো,
– ‘বালটা খুলছেই না।’

রাফসান হাত বাড়িয়ে টেনে খুলতে গিয়ে কনুই লেগে গেল ইলির নাকে। ইলি দাঁত কটমট করে তাকিয়ে ওর উরুতে খামচে ধরে। রাফসান উল্টো খিলখিল করে হাসছে দেখে রেগে-মেগে এবার উরুতে কনুই দিয়ে গুতা দিলো। অস্ফুটে ‘উফ’ করে উঠে হাঁটুতে হাত বুলাতে থাকে রাফসান।

– ‘একটুতেই এতো লেগে গেল? হুদাই ভঙ্গি ধরবা না তো।’

– ‘উরু আর হাতের মাসলে ঘুষি লাগলে কেমন লাগে জানো?’

ইলি ফিক করে হেঁসে বললো,
– ‘জানি, স্কুলে থাকতে একবার বেঞ্চের কোণে হাঁটু লেগেছিল বাবা যা ব্যথা লাগে।’

– ‘আমার এখন সেরকমই লাগছে।’

– ‘তো এখন কি করবো? ভরা বাসে কি মালিশ করে দেবো?’

– ‘ছিঃ তুই হঠাৎ এরকম খাটাশ হয়ে গেলি কেন?’

– ‘তুই করে বললা কেন? বউকে কেউ তুই করে বলে?’

– ‘আগে তো বিয়ে হোক।’

– ‘বিয়ে তো হয়ে গেছে।’

– ‘অ্যাঁ, বিয়ে হলো কবে?’

ইলি ওর কাঁধে মাথা হেলে দিয়ে বললো,
– ‘হয়েছে।’

– ‘আমি তো টের পেলাম না।’

– ‘এতো বকবক করো না তো চুপচাপ বসে থাকো।’

– ‘তোমার কি হয়েছে বলো তো, এরকম করে কথা বলছো কেন?’

– ‘রাগ হচ্ছে। তোমার সঙ্গে এই কয়দিন কত ভালো কেটেছে, দুইজন ঘুরে বেরিয়েছি আবার রাতেও তুমি পাশের রুমে। আরও কিছুদিন এভাবে থাকা যেতো। কিন্তু মা ঝামেলাটা করলেন।’

– ‘বাড়িতে গেলেও আমাদের প্রতিদিন দেখা হবে। এতো মন খারাপ হওয়ার কি?’

– ‘পুরুষ মানুষরা এসব ছোটখাটো মন খারাপ বুঝার ক্ষমতা রাখে না।’

– ‘কেন?’

– ‘এইযে বললে বাড়িতে গেলে দেখা হবে। সেই দেখা আর এইযে কাঁধে মাথা রেখে গল্প করছি তা কি এক? আরও আছে এগুলো বুঝবে না।’

– ‘বাস ছেড়ে দেয়ায় এখন ভালো লাগছে তাই না?’

– ‘হু, আচ্ছা আমি শাড়ি পরলে তোমার অনেক আদর পায় তাই না?’

– ‘এই গিজগিজ বাসে বসে এগুলো কি বকবক করছিস? অন্যরা শুনছে কি-না কে জানে।’

– ‘তুমি কি জানো বুদ্ধিমান মানুষরা অপরিচিতদের লজ্জা পায় না?’

– ‘তোকে বলছে। তাহলে তো মানুষ প্রথম দেখায় লজ্জা পেতো না৷ কনে বরপক্ষের সামনে যাওয়ার আগে মাথা নুইয়ে থাকতো না।’

– ‘তখন লজ্জা পাওয়ার কারণ হচ্ছে তারা পরিচিত হওয়ার বন্ধনে আবদ্ধ হবার সম্ভবনা আছে তাই। কিন্তু এই বাসে সেরকম কিছু নাই৷ আমরা যথেষ্ট ফিসফিস করে কথা বলছি৷ তবুও কেউ শুনলে কিছু আসে যায় না।’

– ‘তুই এতো প্যাঁচাইয়া চিন্তা কীভাবে করিস বল তো?’

– ‘জানি না। বই পড়ি বলে হয়তো।’

– ‘বই পড়লে মানুষ আজাইরা চিন্তাভাবনা করে না।’

– ‘তোমার সাথে সিরিয়াস তর্ক করতে ভালো লাগে না।’

– ‘কেন?’

– ‘মেয়েরা প্রিয় মানুষদের সঙ্গে সিরিয়াস বিষয় নিয়ে তর্ক করে না। তবে ন্যাকামো করে অনেক ঝগড়াঝাটি করতে পারে।’

রাফসান হেঁসে বললো,
– ‘কেন?’

– ‘ধরো স্বামী আওয়ামিলীগ সমর্থন করে স্ত্রী বিয়ের আগে বিএনপি সমর্থন করতো। অথবা আমাদের মুসলিম সমাজে কিন্তু ইসলাম ধর্মের অনেক গ্রুপ আছে। তাদের মধ্যখানে সীমাহীন মতভেদ। মাঝে মাঝে কওমির মেয়ে আলিয়ায় অথবা আলিয়ার মেয়ে কওমিতে বিয়ে হয়। অথবা অন্য যেকোনো দলের কাছে বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের পর মেয়েরা স্বামীর সঙ্গে এগুলো নিয়ে তর্কবিতর্কে যায় না। পারলে নিজেকে ওদের মতো করে গড়ে নেয়। অথচ তুচ্ছ বিষয় নিয়েও মেয়েটা কত ঢং করবে, ঝগড়াঝাটি করবে, ন্যাকামো করবে, কারণ সে জানে এসবে সম্পর্ক গভীর হয়, ভেঙে যায় না।

– ‘বাব্বাহ। কিন্তু মেয়েরা কি এগুলো এরকম ভেবেচিন্তে করে?’

– ‘জীবনেও না। সচেতনভাবে করে না। কিন্তু মেয়েরা জন্মের পর থেকে অবচেতনভাবে এগুলো মাথায় ঢুকিয়ে নেয়।’

– ‘হু।’

– ‘বাসটা এতো স্পিডে চালাচ্ছে কেন?’

– ‘তো সমস্যা কি?’

– ‘তাড়াতাড়ি চলে যাবে।’

– ‘কি উল্টাপাল্টা বলিস।’

– ‘উল্টাপাল্টা না, চলে গেলেই তো তুমি বাড়িতে চলে যাবে। এভাবে আর কবে পাবো তার কি ঠিক আছে?’

– ‘তুই এতো আবেগী জীবনে ভাবিনি।’

ইলি কাঁধে মাথা রেখে গুনগুন করে গাইল,
– “এই পথ যদি না শেষ হয়
তবে কেমন হবে তুমি বলো তো?”

– ‘শেষই হয়ে গেছে। আর বেশি বাকি নেই।’

– ‘হু, জানি। আচ্ছা ইয়ারফোন বের করে গান শুনি।’

– ‘তোমার ভ্যানিটিব্যাগেই দেখো।’

– ‘ও হ্যাঁ।’

ইলি ইয়ারফোন দু’জনের কানে গুঁজে রাফসানের হাত পিঠের দিকে নিয়ে নিজেকে জড়িয়ে ওর বুকে মাথা রেখে গান ছেড়ে চোখবুঁজে। রবীন্দ্র সঙ্গীত চলছে,
“তুমি রবে নীরবে
হৃদয়ে মম
তুমি রবে নীরবে
নিবিড়, নিভৃত, পূর্ণিমা নিশীথিনী-সম
তুমি রবে নীরবে।”

বাস এসে শেরপুর থামে। ইলি তখনও চোখবুঁজে আছে। একেরপর এক গান বদলে যাচ্ছে। রাফসান ওর মাথায় হাত দিয়ে বললো,
– ‘উঠ ইলি।’

ইলি চোখ মেলে তাকায়।
– ‘এসে গেছি তাই না?’

– ‘হ্যাঁ।’

ইলি মোবাইল আর ইয়ারফোন ভ্যানিটিব্যাগে ভরে উঠে বললো,
– ‘চলো।’

বাস থেকে নেমে তারা মধুশ্বরী বাজারের সিএনজিতে উঠে। সেখানে এসে রিকশা নিয়ে চলে যায় বকুল পুর সবুজ রঙের টিনওয়ালা বাড়িটির গেইটের সামনে।
রিকশাওয়ালাকে বিদায় দিয়ে রাফসান বললো,
– ‘আমি এখন চলে যাই। পরে একবার আসবো।’

– ‘বাড়িতে কি আরেক বউ আছে?’

রাফসান কিছু বলার আগেই দেখলো রাহিমা বেগম গেইট খুলে বের হচ্ছেন।

– ‘কিরে চলে এসেছো তোমরা, আসো।’

– ‘আমি বাড়িতে চলে যাই, সন্ধ্যায় আসবো।’

রহিমা বেগম বাঁধা দিয়ে বললেন,
– ‘তোমার চাচীরা তো জানেই না মনে হয় আসছো যে, এখানে খাওয়া-দাওয়া করে যাবে ভেতরে চলো।’

রাফসান মাঝের রুমে গিয়ে বসে রইল। রহিমা বেগম আবার ফিরে এসে লুঙ্গি হাতে দিয়ে বললেন,
– ‘গোসল করে নাও, ইলি বাথরুমে গোসল করছে তুমি পুকুরে চলে যাও।’

রাফসান পুকুরে গোসল করতে চলে গেল। ইলি বের হলো খানিক পরই। টেবিলে খাবার দিলেন রহিমা বেগম। রাফসান খালি গায়ে ভেজা লুঙ্গি উঠোনের রশিতে দিয়ে আসার সময় ইলির মুখামুখি হয়ে গেল। ইলি আড়চোখে তাকায়, ফর্সা পুরুষালী দেহে বিন্দু বিন্দু জল। বুক থেকে সোজা লোম নেমে গেছে নিচের দিকে। রাফসান গেঞ্জিটা পরে খাবার টেবিলে যায়। ইলিও এসে বসে। রহিমা বেগম আবার রান্নাঘরে চলে গেলেন। ইলি টেবিলের নিচ পায়ের আঙুল দিয়ে রাফসানের লুঙ্গিতে টান দিয়ে বললো,
– ‘তোমার শ্বাশুড়ির কত মায়া দেখেছো?’

রাফসান চারদিকে তাকিয়ে চোখ রাঙিয়ে আস্তে করে বললো,
– ‘এসব রংঢং এখন আর করবি না। কেউ শুনলে কি হবে জানিস?’

– ‘ওমা আজ না হয় কাল সকলেই তো জানবে।’

– ‘চুপ করতো। তোর একটুও ভয় নেই।’

ইলি ফিক হেঁসে নিজের নগ্ন পা রাফসানের নগ্ন পায়ে রাখে। রাফসান নিজের পা সরিয়ে নিয়ে বললো,

– ‘এরকম করলে আর আসবোই না।’

– ‘ভীতু একটা।’

রাফসান কোনো জবাব না দিয়ে খাওয়ায় মনযোগ দেয়। ইলি আবার পা দিয়ে গুতা দিয়ে বললো,
– ‘রাতে আইসো।’

– ‘কেন?’

ইলি পরিষ্কার গলায় বললো,

– ‘বর-কনে এক সাথে ঘুমাবো।’

রাফসান আঁতকে উঠে চারদিকে তাকায়। পাছে কেউ শুনে ফেললো কি-না কে জানে৷ ইলি খিলখিল করে হাসছে। রহিমা বেগম রান্নাঘর থেকে ডেকে বললেন,
– ‘কিরে ইলি? খেতে বসে এতো হাসাহাসি করছিস কেন?’

ইলি কোনো জবাব না দিয়ে খেতে লাগলো। রাফসান তাড়াতাড়ি খেয়ে তার প্যান্ট পরে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে রহিমা বেগমকে ডেকে বললো,
– ‘মামী যাচ্ছি।’
ইলি কোনো কথা বললো না। রাফসান চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। প্লেটে পানি ঢেলে চলে গেল রুমে।
সন্ধ্যায় আর রাফসান এলো না। পরেরদিনও না। শুধু বিকেলে লিয়াকত মিয়ার কাছে রাফসানের বড়ো চাচা কল দিলেন। মধুশ্বরী বাজারে কি ব্যবসা দেয়া যায় এগুলো নিয়ে কথা বললেন। ইলি চুপচাপ শুনছিল। রাতে লিয়াকত মিয়া যান রাফসানদের বাড়িতে। এলাকার আরও দু’একজন মানুষের সঙ্গে রাফসানকে নিয়ে কথা হয়। ব্যবসার পরামর্শ নেয়া হয়। সবশেষে সীদ্ধান্ত হয় জামাকাপড়ের ব্যবসা করবে। মধুশ্বরী বাজারে এসব দোকান খুব একটা নেই। তাছাড়া এই ব্যবসা ততটা ঝুকিপূর্ণও না। বিক্রি না হলে পাইকারি দোকান থেকে জামাকাপড় পরিবর্তন করেও আনা যায়।
তারা সপ্তাহ খানেকের ভেতরেই মধুশ্বরী বাজারে দোকান ভাড়া পেয়ে গেল। বাজারের মাঝখান দিয়ে সিলেট টু ঢাকা মহাসড়ক গিয়েছে। ডান পাশেই উঁচুতে দোকানটি পেল। দোকানের বাঁ পাশের গলি গেছে বকুল পুর স্কুল এন্ড কলেজে। ডান পাশে গ্যাস সিলেন্ডার আর টিভি ম্যাকানিকদের দোকান। ঠিক সামনে একটা রেস্টুরেন্ট। সব মিলিয়ে ভাড়া নেবার জন্য তাদের সকলেরই বেশ পছন্দ হলো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here