দেশলাই – ৫ম পর্ব
আমি টেবিলে রাখা বইয়ের পাতায় চোখ বোলাচ্ছি। আদতেই কিছু পড়ছি না। রাগে শরীর কাঁপছে। তার নষ্টা প্রেমিকাকে আমার হিংসা লাগবে কেন? আমারই দোষ, অন্যের ভাবে লাভ। আমি এতো কথা বলতে গেলাম কেন? কোনো জবাব না দিয়ে গুনগুন করে পড়তে শুরু করলাম। রাফসান ভাই দুষ্টামি করে চেয়ারে ঝাঁকুনি দিচ্ছিল। আমি মুখ স্বাভাবিক রেখে বললাম, ‘আমি পড়ব। এখন যাও তো ভাই।’
– ‘আচ্ছা চলে যাব। তার আগে বল তুই আমাকে এড়িয়ে চলছিস ক্যান?’
আমি ভেতরে ভেতরে চমকে উঠলাম। তবুও পাক্কা অভিনেত্রীর মতো মুচকি হেঁসে জবাব বললাম, ‘কি যে বলো না। তোমাকে আমি এড়িয়ে চলবো কেন? আচ্ছা শোনো। তোমারে হাত ঘড়িতে অনেক সুন্দর লাগছে।’
– ‘তাই না-কি? ঘড়িটি ইন্তিশা গিফট দিলো।’
– ‘ও আচ্ছা, দারুণ ঘড়ি।’
– ‘ঠিকাছে আমি যাচ্ছি৷ তুই পড়।’
রাফসান ভাই খুশি মনেই চলে গেল। আমি খানিক্ষণ বই বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইলাম। এভাবেই দিন কাটছে, রাত যাচ্ছে, মাস, বছর গেল। আমার এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়ে রেজাল্ট বের হয়। এ গ্রেড পাই। তখন আমার উঠতি বয়স। শরীরে, মননে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। রাফসান ভাইয়ের কাছেও আমি ধীরে ধীরে পুরোপুরি অচেনা হয়ে গেলাম। শৈশবের সম্পর্কের যে ধারাবাহিকতা ছিল সেটা বাধাপ্রাপ্ত হলো। এখন দেখা হলে কেবল ভদ্র বিধির বাক্যবিনিময় হয়। সাক্ষাতে কৃত্রিমতার ‘কেমন আছো’ ধরণের কথাবার্তা৷ রাফসান ভাইয়ের শহরে দিনকাল ভালো কাটছে। প্রেম করছে। উঠতি বয়সেই দেহ পাচ্ছে। মেসের নানান ধরনের বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডাবাজি চলছে। মনের আকাশে রঙিন ফানুস উড়ছে। আমি বকুল পুর কলেজেই ইন্টারে ভর্তি হলাম। বান্ধবীরা তখন বলতো আমি খানিকটা মোটা হয়েছি। দেখতে না-কি বেশ লাগে। অবশ্য আমি অসুন্দর কোনো কালেই ছিলাম না। তবে এখন অন্য রকম সুন্দর। আঁটসাঁট পোশাকে বাঁধ না মানা নিটোল দেহ। গায়ের রঙে হলদেটে আভা। পোশাক ঠেলে নিজের জানান দিতে সদা ব্যস্ত আমার অসভ্য দু’টি স্তন। ইতোমধ্যে পুরুষ মানুষকে মোমের মতন গলিয়ে নিঃশেষ করে দেওয়ার সব রকম আয়োজন এই অসভ্য, দুষ্ট নারী শরীরের পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি সেরে ফেলেছে। ঠিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণে আমার মামা-মামী এলেন ইংল্যান্ড থেকে। তাদের দু’জন ছেলে আছে। তারা দেশে আসতেই চায় না। বড় ছেলে ইংল্যান্ড বিয়ে করে আলাদা। পরিবারের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক নেই। ছোট ছেলের নাম হৃদ। তার এখনও বিয়ে হয়নি। আমার সমবয়সী। মামা-মামীকে দেখতে আমরা মৌলভীবাজার গেলাম। গ্রামের বাড়িতেই উঠেছেন। বহু বছর পর ভাই বোনের দেখা হওয়ায় আম্মু আর মামা গলা জড়িয়ে মরা কান্না দিলেন। মামার দাড়ি-চুল পেকে গেছে। মামী মোটা হয়ে বুড়িয়ে যাচ্ছেন। আমার গায়ে বোরকা, মুখে নেকাব। সেগুলো খুলে হাতমুখ ধুয়ে এলাম। তখনই মামী আমাকে বিশেষভাবে খেয়াল করলেন মনে হয়। উঠে এসে আমাকে টেনে বুকে নিয়ে আম্মুকে বললেন, ‘কত ছোট দেখে গিয়েছিলাম। তোর মেয়েটা মিষ্টি হয়েছে রে রহিমা।’
আমাকে পাশে বসিয়ে পড়ালেখার খবর নিলেন। উনার আগ্রহী চোখের সামনে আমার ভীষণ লজ্জা করছিল। নানান কথাবার্তা হলো। মামাও নামাজ পরে এলেন। মামী খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন, ‘দেখো আমাদের রহিমার মেয়ে কত সুন্দর হয়েছে। এবার ইন্টারে পড়ে।’
মামা টুপি মাথা থেকে রাখতে রাখতে দুষ্টামি করে বললেন, ‘ছেলের বউ করবে না-কি?’
আম্মুও সুযোগ পেয়ে বললেন, ‘তা করবা ক্যান। বাইরের মেয়েকে ছেলের বউ করে দাগ খাও। বড় ছেলের বউ তো শুনছি জামাই নিয়ে আলগা হয়ে গেছে।’
সবাই হু হু করে হেঁসে উঠলো। আর আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম। মামী আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মেয়েটা তো লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে।’
এই কথাটা আমার লজ্জার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। আচমকা আমি তাদের মাঝখান থেকে উঠে অন্য রুমে চলে গেলাম। আম্মু সকলের অগোচরে চোখ কঠিন করে আমাকে শাসাচ্ছিলেন। আমি উপেক্ষা করে চলে গেলাম। ধীরে ধীরে আমার কদর বাড়তে লাগল। মামী একের পর এক কল দিয়ে সবার সঙ্গে আমাকে কথা বলাচ্ছেন।
– ‘আমাদের রহিমার মেয়ে ইলির লগে কথা বলো। বাব্বাহ কি মিষ্টি হয়েছে না মেয়েটা। আর কত ভদ্র৷ বোরকা নেকাব পরে।’
বলেই মোবাইল বাড়িয়ে দেন। আমি কি কথা বলবো খোঁজে পাই না। লজ্জায় মরে যাই। সেটাও মামীর কাছে ভালো লাগে। মেয়েটির শরম-লজ্জা আছে। যার শরম বেশি সে নরম বেশি৷ নরম মেয়েরা বিনয়ী হয়।
দু’দিন পর শহর ঘুরে আমাকে নিয়ে শপিং করলেন। বাড়িতে এসে মামী নিজে আমাকে সাজগোজ করিয়ে বললেন, ‘মা তোমার হৃদ ভাইয়ের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলবে কল দিচ্ছি।’
আমি অস্ফুটে বলি, ‘আমি কথা বলতে পারবো না মামী।’
আম্মু-আব্বু তখন চোখ দিয়ে শাসান। পুরো ব্যাপারটায় খুশিতে তাদের চোখমুখ ঝলমল করছে।
ফোনে কথা হয়। হৃদকে দেখতে বয়স খুব কমই মনে হলো। অনেক হালকা-পাতলা। এর আগে আমাদের কথা হয়নি। শুধু মামা-মামীর সঙ্গে আব্বু-আম্মুর কথা হতো।
তারা আমাদের বাড়িতেও বেড়াতে এলেন। কয়েকদিন থাকার পর যাবার আগের রাত আমাকে আংটি পরিয়ে দিলেন। মানে হৃদের সঙ্গে আমার বিয়ে দুই পরিবারের সম্মতি হয়ে গেছে। তবে বিয়ে এখনই যে হয়ে যাচ্ছে তা না। কেবল কথা পাকাপাকি হলো। আমার পড়ালেখা চলবে। হৃদও যখন বিয়ের করতে চাইবে তখনই তাকে দেশে নিয়ে আসবেন। আমার আব্বু-আম্মু প্রচন্ড খুশি। বিলেতি বর পাওয়া তো আর মুখের কথা না। ক’দিন পর আমাকেও লন্ডন নিয়ে যাবে। আমিও কি খুশি? সেটা ঠিক জানি না। তবে বিয়ে তো একদিন বসতেই হবে। এদিকে আমার আলাদা কোনো পছন্দও নেই৷ সুতরাং হৃদের মতো ইউরোপী বর প্রত্যাখ্যানের প্রশ্নই আসে না৷ মামা-মামীরা সেবার আংটি পরিয়েই চলে গিয়েছিলেন। সত্যি কথা বলতে আমাদের পরিবার অনেকটা মামাদের উপর নির্ভরশীল। আমার পড়ালেখা সহ পরিবারগত সকল বিপদ-আপদে তারা আর্থিক সহযোগিতা করেন। মামা-মামী মাস দুয়েক দেশে থাকার পর চলে গেলেন। আমাদের সঙ্গে রোজ যোগাযোগ হয়। হৃদের সঙ্গে আমাকে মাঝে মাঝে কথা বলান। যতদূর বুঝতে পারি হৃদ বিয়ে-টিয়ে নিয়ে এখনও কিছু ভাবেনি। তার বিয়ের বয়সও হয়নি৷ আমাদের কথা পাকাপাকি হলেও বছর কয়েক পর বিয়ে হবে বুঝাই যাচ্ছে।
আমি ইন্টার সেকেন্ডে ইয়ারে উঠেছি। বেশ যাচ্ছে দিনকাল। সহপাঠীদের সঙ্গে অনেক মিশেছি। ওরা প্রায় সবাই জমিয়ে প্রেম করছে। রেল লাইন ধরে আমরা বিকেলে হাটি। এদিকটা ছবির মতোন সুন্দর। দু’পাশে সারি সারি শিরিষ গাছ। নিচে সবুজ ঘাস। রেল লাইন ধরে কলেজের উত্তর দিকে একটু হেঁটে গেলে একটি ব্রিজ। তার নিচে চানাচুর আর ফুসকার দোকান বসে। ছেলে সহপাঠীদের সঙ্গে আমার সুন্দর পরিষ্কার আচরণ। সবাই জানে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে৷ তবে বান্ধবীদের প্রেমের সাঁকো হিসেবে ইতোমধ্যে খ্যাতিও অর্জন করেছি।
অনেকের মধ্যকার মান-অভিমান ভাঙানোর দায়িত্বও আমার উপর এসে পড়ে। সবকিছু আমি বেশ আনন্দের সহিত পালন করি। মাতব্বরিতে একটা মজা আছে।
একেকজন একেকদিন ফিসফিস করে শিশুর মতো এসে বলবে, ‘ইলি সোনা, বেস্টু আমার, প্লিজ আজকে কলেজ ছুটি হলে থাকবি। ওর সঙ্গে ব্রিজের নিচে ফুসকা খেতে যাবো।’
আমি মুচকি হেঁসে বলি, ‘আচ্ছা।’
কিন্তু ভালো করে জানি কেউ সেখানে কেবল ফুচকা খেতে যায় না। ব্রিজের বাম পাশে একটা অর্ধ তোলা পুরাতন শ্যাওলা পড়া দালান। মাঝখান দিয়ে একটা পিলার পড়ে আছে। সেখানে বসে কলেজের পুচকে ছেলেরা লুকিয়ে সিগারেট খায়৷ প্রেমিক মহলের কাছেও স্থানটি ইতোমধ্যে খ্যাতি অর্জন করেছে। কারণ চারদিকে দেয়াল তোলা। দরজার সামনে থেকে একজন নজর রাখলেই তারা চুমু-টুমু খেতে পারে। সেদিন বান্ধবী লিজার সঙ্গে গিয়েছিলাম। ওর প্রেমিক আমাদের কলেজ থেকে ইন্টার দিয়ে এখন সিলেট এমসিতে অনার্স পড়ছে৷ তাদের বেশ কয়েক বছরের প্রেম৷ যেই-সেই প্রেম না, জটিল প্রেম। ছেলেটি পাগলের মতো ভালোবাসে লিজাকে। কিছুদিন পর পর বাড়িতে চলে আসে। দেখতে শ্যামলা। মুখ ভর্তি ব্রণ। এই জুটির বিশেষত্ব হলো এরা দেখা হলেই জড়িয়ে ধরে ফ্যাসফ্যাস করে কাঁদবে। তারপর একজন আরেকজনের চোখের পানি মুছে দিয়ে যাওয়ার সময় টুপ করে চুমু খেয়ে নেবে৷ আমার দায়িত্ব হলো প্রবেশ পথ থেকে খেয়াল রাখা কেউ আসছে কি-না। কেউ এদিকে এলে অতি মনযোগ দিয়ে ফুচকা খেতে হবে।
প্রেমের সাঁকো হিসেবে কাজ করতেও আনন্দ আছে।
এতোদিনে আমার সঙ্গে রাফসান ভাইয়ের কোনো যোগাযোগ নেই। তার পড়ালেখা, প্রেম কোনো কিছু জানি না। সে বাড়িতে এলেও যাই না। সেদিন রাতে আব্বু এসে বললেন রাফসান টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে এসেছে৷ কিন্তু ছেলেটার অবস্থা করুণ। শরীর-টরীর ভেঙে নাজেহাল অবস্থা। আমরা সবাই ভেবেছি হয়তো পড়ালেখায় এরকম হতে পারে। কিন্তু একদিন বিকেলে লিজাদের বাড়ি যাবার সময় তাকে খেলার মাঠে দেখে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। এই মানুষটি কি রাফসান ভাই? ঠোঁট কালো, চোখের নিচ কালো, শুকিয়ে কাঠ, ফ্যাকাসে চেহারা। কি চলছে ওর জীবনে? একবার মনে হলো পড়ালেখার চাপ হয়তো। আবার মনে হলো তাদের বাড়ি গিয়ে খোঁজখবর নেব। কিন্তু শেষ আবধি আর এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করলাম না।
এভাবেই দিন চলতে থাকে। আমারও পড়ার চাপ দিনকে দিন বাড়ছে। তাদের ব্যাচের ইন্টার পরীক্ষা শেষ হয়ে রেজাল্ট বের হয়। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে রাফসান ভাই একাধিক বিষয়ে ফেইল। এবং সে মেস থেকে যখন বাড়িতে এলো তখন বদ্ধ উন্মাদ। হাত কাটে। রাত-বিরেতে চিল্লাচিল্লি করে। মেয়ে মানুষ নিয়ে নোংরা গালিগালাজ করে। আমরা সবাই তাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে গেলাম। দীর্ঘ দিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় আমিও জানি না কি ঘটেছে যার জন্য তার এই অবনতি৷ এদিকে পরীক্ষায় একাধিক বিষয়ে ফেইলও করে ফেললো। দীর্ঘ কয়েক বছর তার এভাবেই কাটছিল। সিগারেট খাওয়া। রোদ,বৃষ্টিতে ঘুরে বেড়ানো, পাগলামো, আত্মহত্যার চেষ্টা করা। এসব থেকে বহু কষ্টে সবাই তাকে বের করে খানিকটা স্বাভাবিক হওয়ার পর বিয়ে দেয়। কিন্তু বাসর রাতে বের হয়ে গিয়েছিল আজও ফিরে আসেনি৷
চলবে….