দেশলাই – ৮ম পর্ব
রাফসানের এপাশ-ওপাশ করে রাত চারটা হয়ে গেল। সাদ ফ্যান ছেড়ে কম্বল গায়ে দিয়ে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। কনকনে শীতেও ফ্যান ছেড়ে ঘুমানো তার অভ্যাস।
কিন্তু রাফসানের চোখ থেকে যেন ঘুম ছুটি নিয়েছে। সারাক্ষণ মাথায় ঘুরছে কাল কি হবে? সবকিছু যেন তার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে। সত্যি কি ইন্তিশাকে কাছে পাবে সে? কাল রাত আস্ত একটা নারীর সঙ্গে যা ইচ্ছা করতে পারবে সে? প্রথমে কি করবে? তাছাড়া কারও কাছে ধরা পড়বে না তো? তার ভাবনায় ছেদ করে শহরের মসজিদগুলো থেকে ভেসে আসে মুয়াজ্জিনের আজান। নিজেকে খানিক্ষণ বকা দেয়। কীসব উল্টাপাল্টা ভেবে নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দিয়েছে। এমনিতেই কাল পুরো রাত জাগতে হবে। নিজেকে প্রেরণা দিয়ে চোখবুঁজে। ধীরে ধীরে ঘুম আসে। কিন্তু ভোর সাতটায় সাদের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। চা খেতে নিচে যাবে কি-না সে জিজ্ঞেস করে। রাফসান চোখ না খুলেই অসম্মতি জানায়। আবার ঘুম আসে। সেই ঘুম ভাঙে বেলা দশটায়। ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করে বাথরুমে যায়। আয়নায় নিজেকে দেখে। চুল কি লম্বা? কাটতে হবে। দাড়িও ছাঁট দিলে মন্দ হয় না।
মুখ-হাত ধুয়ে বাইরে বের হয়। মোড়ের চা’র দোকানে গিয়ে বলল, ‘মামা লিকার চা দেন।’
ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক দেয়। মনে পড়ে আজ তার বিশেষ একটা দিন। নারী সঙ্গ পাবে। তাও পছন্দের, ভালোবাসার মেয়েটিকে। শরীরে শিহরণ বয়ে যায়। বিল মিটিয়ে ফুরফুরে মেজাজে সেলুনের উদ্দ্যেশ্যে হাঁটতে থাকে। ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুল-কলেজে যাচ্ছে। রিকশার টুংটাং শব্দ। গাড়ির সাইরেন। মানুষে গিজগিজ। ব্যস্ত শহর। এক বৃদ্ধা সুরে সুরে দুরুদ পড়ে ভিক্ষা চাইছে। মায়া লাগে তার। আজ বড়ো মায়ার মন। মানিব্যাগ বের করে বিশ টাকা দেয়। সাদ কোত্থেকে এসে দেখে ফেলে।
– ‘আরে মামা, তুইতো বড়লোক। পুরো বিশ টাকা দিয়ে দিলি? চল চা খাওয়া।’
– ‘নারে সেলুনে যাবো।’
– ‘সেলুনে যাবি কেন? চুল-টুল সব তো ঠিকই আছে।’
– ‘তবু একটু কাটবো।’
– ‘আরে মামা, তোর লাইফ তো সুন্দর। টাকাপয়সা বাড়ি থেকে আসছে না-কি? আর তোকে এতো খুশিখুশি লাগছে কেন? বল বল, ঘটনাটা কি?’
– ‘আরে কিচ্ছু না।’
– ‘তাইলে চা খাইয়ে যা। ফকিরকে তো বিশ টাকা দিয়ে দিলি। আর বন্ধু-বান্ধবদের চা খাওয়াতে গেলে তুমি উল্টো ফকিরের ভাব লও। এগুলা তো ভালা না মামা।’
– ‘আমি তো এখনই চা খেয়েছি। নে তুই দশ টাকা নিয়ে একাই খা। আমি যাচ্ছি।’
টাকা দিয়ে রাফসান হাঁটা দিল। পেছন থেকে ডাকছে সাদ। সে কান না দিয়ে অন্য গলিতে ঢুকে পড়ে।
সেলুনে গিয়ে সুন্দর করে চুল কাটে। দাড়ি ছাঁট দেয়। মুখ ওয়াস করায়।
বাসায় ফিরতে সাড়ে বারোটা বেজে গেছে।
শ্যাম্পু ছিঁড়ে মাথায় দিয়ে গুনগুন করে নতুন লেজার নিয়ে বাথরুমে ঢুকে। বগল-টগলের লোম ফেলে গোসলটা সেরে নেয়। তারপর আর দিন যেন যাচ্ছেই না। সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে এক সময় তার যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসে। নতুন আন্ডারওয়্যারটি পরে। ব্লু জিন্সের সঙ্গে কালো গেঞ্জি তার উপরে ব্লেজার। বাম হাতে কালো বেল্টের ঘড়ি। পারফিউম মারে ভালো করে। বেরিয়ে পরে নীলগঞ্জের উদ্দ্যশ্যে। দুরুদুরু বুকে ফার্মেসিতে যায়। নাম বলতেই তার দিকে বাড়িয়ে দেয়। আলগোছে ব্যাগে ভরে বাসে উঠে।
নীলগঞ্জ বাজারে গিয়ে সে একটি হোটেলে বসে চা খায়। মোবাইল টিপে। কিন্তু কতক্ষণ আর বসবে? বিল মিটিয়ে বাইরে আসে। মানুষ কমতে শুরু করেছে। অলিগলিতে একা হাঁটাহাঁটি করে। রাত সাড়ে বারোটা হয়ে গেছে৷ বাজারে আর থাকা যায় না। পাঁচ মিনিট হেঁটে একটা নদীর পাড়ে যায়। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া এসে গা ভিজিয়ে দিচ্ছে। দূরে একটা লাইটের আলো দেখে পিলে চমকে উঠলো। তাকিয়ে দেখলো লোকটি অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। চ্যাটে টুকটাক কথা চলে ইন্তিশার সঙ্গে। রাত ঘনাতেই মেসেজ এলো, ‘চলে আসো।’
রাফসানের বুক ধুকপুক করে। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে। নীলগঞ্জে এখন রজনী নিঝুম। কেবল দূরে কোথাও শিয়ালের ডাক। বন্ধ দোকানের বারান্দায় কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। চারদিকে সতর্কভাবে তাকিয়ে হাঁটে সে। কথামতো আম গাছের সামনে গিয়ে মেসেজ দেয়, ‘এসেছি।’
খানিক বাদে আলগোছে দরজা খুলে যায়। অন্ধকারে কেবল মানুষের ছায়া দেখা যাচ্ছে। ছায়াটি তাকে হাত দিয়ে ইশারা করে। রাফসান ধীরপদে এগিয়ে যায়। ইন্তিশা তাকে রুমে নিয়ে দরজা বন্ধ করে ড্রিম লাইট জ্বেলে দেয়। রাফসান মৃদু আলোয় ইন্তিশার দিকে তাকায়।
ওর পরনে একটি কালো গেঞ্জি। মাথার চুল খোঁপা করা।
ইন্তিশা লজ্জায় আঁজলা করে নিজের মুখটা ঢেকে নেয়। রাফসান মুচকি হেঁসে কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ায়। ইন্তিশা হাত সরিয়ে চোখে চোখ রাখে। তারপর নিজ হাতে রাফসানের ব্যাগটি পড়ার টেবিলে রেখে ব্লেজার খুলে চেয়ারে রেখে জড়িয়ে ধরে কানে ফিসফিস করে বলে, ‘বোনকে বুদ্ধি করে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি।’
সেও ফিসফিস করে বলল, ‘ভালো করছো। না হয় ভয় ভয় করতো। কিন্তু তুমি লজ্জা পাচ্ছে কেন?’
– ‘বাতি বন্ধ করে দিলে আর লজ্জা করবে না। বন্ধ করি?’
– ‘আচ্ছা।’
বাতি বন্ধ করে ইন্তিশা সামনে এসে দাঁড়ায়। অন্ধকার সয়ে গেলে রাফসানের মাথার পেছনের চুল খামচে ধরে নিজের নাক ঠোঁট ওর সমস্ত মুখে ঘষতে থাকে। ঠোঁট ঢুকে পড়ে অপঠোঁটে। দু’জনের শরীরে শিহরন বয়ে যায়। ইন্তিশা তাকে আস্তে আস্তে ঠেলে বিছানায় ফেলে। রাফসান টেনে কোলে এনে ওর পেটে এক হাত রেখে ঘাড়ে নাক, ঠোঁট ঘষে। পেট থেকে হাত সাপের মতোন বেয়ে বুকে আসে আবার নিচের দিকে যায়৷ উত্তেজনায় ইন্তিশার শ্বাস-প্রশ্বাস বাড়তে থাকে। অসহ্য এক সুখের ব্যথা। ইন্তিশা নিজেকে ছাড়িয়ে রাফসানকে বেডে শুইয়ে গেঞ্জি টেনে খুলে ফেলে। বুকে নাক ঘষে, সমস্ত শরীরে চুমু খায়। রাফসান তাকে বুকে টেনে পাশ ফিরে নিচে ফেলে। ধীরে ধীরে তারা উত্তেজনার চরম পর্যায়ে পৌঁছে কামনা-বাসনায় একটি ঝড়ের দিকে ধাবিত হয়। এক সময় দু’টি দেহের ঝড় উঠে। পুরো রাত থেকে থেকে চলতে থাকে সেই ঝড়। কথামতো রাফসান চারটায় বাসা থেকে বের হয়ে হাঁটতে থাকে। চারধার কুয়াশায় ঘেরা। কনকনে শীত। ভোর পর্যন্ত সে হেঁটে নীলগঞ্জ ফেলে মহাসড়কে এসে বাসে করে সিলেট আসে। এরপর থেকে একজন আরেকজনের শরীরের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। ঢুকে পড়ে একটা চক্রে। পড়ালেখা, সমজা-সংসার সবকিছু ঐচ্ছিক হয়ে পড়ে। সমস্ত কিছু প্রেমকে কেন্দ্র করে চলতে থাকে। পুরো রাত ফোনালাপ। সকালে না পারতে ক্লাসে যাওয়া। আবার এসে চ্যাটিং, রাতে ফোনালাপ। সারাক্ষণ একজন আরেকজনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকে। কেবল বাথরুমে যেতে হলে, ‘আসছি একটু ওয়েট।’ বলে যাওয়া।
খেতে হলে, ‘খেয়ে আসছি ওয়েট।’
গোসল করতে হলে, ‘এখন গোসল করবো একটু পরে আসছি।’
দু’জন অতি প্রয়োজনীয় কাজ করছে এভাবে জিজ্ঞেস করে। সম্পর্ককে কেন্দ্র করে বাকী সব। ক’দিন পর পরই নীলগঞ্জ ছুটে যায় রাফসান। পুরো রাত তারা সুখের সমুদ্রে ভাসে।
কিন্তু বছর খানেক বাদেই আচমকা সম্পর্ক প্রাণহীন হয়ে যায়। ঘুড়ির সুতো কাটা পড়ে। ছন্দ পতন হয়।
চলবে…